মাত্র ১১ বছরে (২০১১-১২ থেকে ২০২২-২৩ সাল) ভারতের প্রায় ২৭ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়েছেন। বিশ্বব্যাঙ্কের এই রিপোর্টের পর দেশের প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকার গর্ব করে বলছে, গত দশ বছরে দেশে ৮০% দারিদ্র্য কমেছে, ২৫ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার উপরে তোলা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট জানিয়েছে, ২০১১-১২ থেকে ২০২২-২৩ সাল সময়ে ভারতের চরম দারিদ্র্যের হার ২৭.১% থেকে কমে ৫.৩% হয়েছে। অর্থাৎ দেশে চরম দারিদ্র্যে থাকা মানুষের সংখ্যা এই সময়ে ৩৪.৪৭ কোটি থেকে নেমে ৭.৫২ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে দেশের খাদ্য ও স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রায় সমস্ত রিপোর্ট জানাচ্ছে সাধারণভাবে দারিদ্র্যতার পরিসংখ্যান হিসাব হয় দেশের কত মানুষ দিনে দুবেলা পেট ভরে খেতে পায়, কতটা পুষ্টি পায় সেই হিসাব ছাড়াই। অর্থাৎ খাদ্য সংকট এবং পুষ্টিহীনতাকে উপেক্ষা করেই দারিদ্র্যসীমা নিরুপণ হয়ে থাকে। অথচ গবেষকরা বলেন, সঠিক দারিদ্র্য পরিমাপ কেবলমাত্র আয় নয়, পুষ্টিও বিবেচনা করা উচিত।
দুনিয়ার প্রতিটি মানুষই তার নিজের ও সন্তানদের দুবেলা পেট ভরে খাওয়ানোর জন্য লড়াই করে। দেশে প্রতিটি মানুষের জন্য পর্যাপ্ত না হলেও যথেষ্ট খাদ্য থাকা সত্ত্বেও অন্তত ১৯ কোটি ভারতবাসী পেটে খিদে নিয়েই রাতে ঘুমিয়ে পড়ে। অন্যদিকে দেশে মোট রোগের ৫৬.৪ শতাংশের জন্য দায়ী অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস। এখানে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বলতে লবণ, চিনি এবং চর্বিযুক্ত প্রক্রিয়াজাত খাদ্য বেশি খাওয়া, অতিরিক্ত ফাস্ট ফুডের জন্য স্থূলতা, ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য অসংক্রামক রোগ (NCD) বৃদ্ধি পেয়েছে।এর পাশাপাশি আরও একটি ছবি হল; ভারতে ১.৩৯ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ বাস করার পরও দুনিয়ার একেবারে উপরের সারির খাদ্য উৎপাদনকারী দেশগুলির অন্যতম বিশেষ করে চাল, গম, ডাল এবং তুলা উৎপাদনে। কেবল তাই নয় দুধ উৎপাদনে ভারত প্রথম এবং ফল ও সবজি উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। দেশটি কৃষিক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ, জিডিপি এবং মাথাপিছু ভোগ বৃদ্ধি সত্ত্বেও, কেন এই দেশটিকে গুরুতরভাবে খিদের সংকটে নিমজ্জিত থাকতে হয়?
একথা ঠিক যে ভারতের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি হয়েছে, কিন্তু তা স্বত্বেও কেন লক্ষ লক্ষ শিশু এবং মহিলা ‘ক্ষুধা’তে (hiddeb hunger) ভোগেন। কেন দেশে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি বছর ১.২ মিলিয়ন? কেন এদেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের সব থেকে মৃত্যু ঘটে। এদেশে ক্ষুধা বা (hidden hunger) বৃদ্ধির প্রধান কারণ দারিদ্র্য। যদিও পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, দারিদ্র্য ২০১১ সালে ছিল ২১.৯ শতাংশ, ২০১৭-১৮ সালে নেমে দাঁড়িয়েছে ১০.৪ শতাংশে, তবুও ১৫ কোটিরও বেশি মানুষ পিপিপি (ক্রয় ক্ষমতা সমতা)-এর উপর প্রতিদিন ১.৯০ আমেরিকান ডলারের নীচে জীবনযাপন করে। জাতীয় পরিসংখ্যান দফতর (এনএসও)-এর সমীক্ষা রিপোর্ট জানাচ্ছে, গ্রামাঞ্চলে ভোক্তা ব্যয় প্রতি বছর ১০ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যেহেতু এ দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে এবং তার মধ্যে ৫৪.৬ শতাংশ কৃষি ও সংশ্লিষ্ট কাজে যুক্ত।দেখা যাচ্ছে দারিদ্র্য আর ক্ষুধা কৃষির উপর নির্ভরশীল। এর কারণ বা সমস্যা হল, জমির মালিকানা হ্রাস, বর্ষার উপর নির্ভরতা, সীমিত সেচ পরিকাঠামো, কৃষিতে অল্প অর্থ বিনিয়োগ এবং অত্যন্ত কম সরকারি উদ্যোগ। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এস্থার ডুফলো তাদের বই ” পুওর ইকোনমিক্স: আ র্যাডিক্যাল রিথিংকিং অফ দ্য ওয়ে টু ফাইট গ্লোবাল পোভার্টি “-তে ভারতের ক্ষুধার কারণ হিসাবে বাজার-বহির্ভূত খাদ্য উৎসের পতন এবং বিলাসবহুল ব্যয়কে দায়ী করেছেন।
দারিদ্রতা এবং খাদ্য সংকটের কারণ কিন্তু খাদ্য উৎপাদনের ঘাটতি নয়, আসল কারণ কার্যকরী নয় এমন একটি খাদ্য সরবরাহ ও বিতরণ ব্যবস্থা যা দেশের সকলের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহের সুযোগ থাকা স্বত্বেও লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনাহারের দিকে ঠেলে দেয়। সরকারি হিসাবে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয় ২৭২ মিলিয়ন কিন্তু অপচয় হয় প্রায় ৪০ শতাংশ খাদ্য। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ শাকসবজি এবং ফলমূল সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয় এবং কয়েকশো টন খাদ্যশস্য অত্যন্ত নিম্ন মানের গুদামে পচে। কেবল তাই নয় ফসল কাটার পর অপর্যাপ্ত কৃষি সরবরাহের কারণে দেশে প্রতি বছর ৯২,৬৫১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। কারণ নেই যথেষ্ট সংরক্ষণাগার এবং পরিবহন ব্যবস্থার সুবিধা।
দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশের গ্রামে থাকা ৪০% মানুষ দিনে দুবার পেট ভরা সুষম খাবার কিনতে পারে না। শহরে এই হার ১০%। এদেশে মাথাপিছু একজনের ভরপেট নিরামিষ ও আমিষ খাবারের যা খরচ তা গ্রামাঞ্চলের ৮০% এবং শহরের ৫০% মানুষের নাগালের বাইরে। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার এক রিপোর্ট (২০২৩-২৪ সাল) জানায়, গ্রামে মাসিক ১,৬৩২ টাকা ও শহরে ১,৯৪৪ টাকা আয়কে দারিদ্র্যসীমা ধরা হয়েছে। কিন্তু খাদ্যের খরচ হিসাব করলেও এই আয়ে ৪০% গ্রামীণ ও ২০-৩০% শহুরে মানুষ দিনে দু’বেলা খাবার জোগাড় করতে পারবে না। যেহেতু দারিদ্রতা কেবল আয় নয়, খাদ্য ও পুষ্টির প্রেক্ষিতে বিবেচনা করা উচিত তাই সরকারি তথ্যে দারিদ্র্য পরিমাপের পদ্ধতি পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে।