প্রতিটি বছরেই একাধিক ভাল ও মন্দ ঘটনা থাকে। ২০২৪ সালটিতেও তার অন্যথা হয়নি। তবে এই বছরটিতে দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছে যা অন্যান্য বছরের তুলনায় কেবল বেশি নয় যথেষ্ট তাৎপর্যময়। স্বভাবতই সেই পরিবর্তন নতুন বছর এবং তার পরবর্তী সময়ে যে সমাজ-জীবনে ও ভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে সেকথা বলাই বাহুল্য।
বছর শেষে এসে দেখা যাচ্ছে যে ২০২৪-এর বড় পরিবর্তন হল কেন্দ্রে ও একাধিক রাজ্যে জোট রাজনীতির নতুন করে প্রত্যাবর্তন। তার আগে অবশ্য উল্লেখ করতে হয় সাত দফায় হওয়া ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন প্রায় ৬৪.২ কোটি ভোটার। গোটা দুনিয়ার নির্বাচনের ইতিহাসে এত মানুষের ভোটে যোগদান আগে কোথায় কখনও ঘটেনি। কেবল তাই নয়, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলেও ভারতের রাজনীতিতে একটি পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়। ২০১৪ ও ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়া সত্ত্বেও ২৪-এ পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ২৪০টি আসন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার থেকে ৩২ কম। শরিক দলগুলি (এনডিএ) ৫৩টি আসন পাওয়ায় আসনসংখ্যা দাঁড়ায় ২৯৩। ফলে ২০১৪-র পর এই প্রথম মোদীকে শরিক দলগুলির উপর নির্ভরশীল থেকে সরকার চালাতে হচ্ছে। চন্দ্রবাবু নাইডু কিংবা নীতিশ কুমারের উপর নির্ভরশীলতা কী বড় পরিবর্তন নয়।
পাশাপাশি গত এক দশক পর ২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের তুলনামূলক ভালো ফল আরও একটি পরিবর্তন। কারণ তার আগের দুটি লোকসভায় (২০১৪ ও ২০১৯) কংগ্রেস এমন ফল করেছিল যে, লোকসভায় বিরোধী দলনেতার আসন পর্যন্ত পায়নি। কিন্তু ২৪-এ কংগ্রেস ৯৯টি আসনে জিতেছে, রাহুল গান্ধী বিরোধী নেতা হয়েছেন, কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া ২৩৪টি আসন পাওয়ায় বিরোধী দলগুলির শক্তি যেমন বেড়েছে, জাতীয় স্তরে কংগ্রেস এবং রাহুল গান্ধীর গুরুত্বও বেড়েছে। মোদী প্রচুর ধুমধাম করে রামমমন্দিরের উদ্বোধন করেও যোগী রাজ্যে বিজেপি বড়সড় ধাক্কা খায়। বারাণসীতে মোদী জিতলেও ভোটের ব্যবধান কমে যায়। রাহুল গান্ধী লোকসভায় দুটি আসনে (উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলি এবং কেরালার ওয়েনাডে) লড়ে দুটি কেন্দ্রেই জেতেন। পরে রায়বেরিলি রেখে, ওয়েনাড ছেড়ে দেন। সেখান থেকে উপনির্বাচনে লড়ে জিতে এসেছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। অর্থাৎ কংগ্রেসের নেহরু-গান্ধী পরিবারের আরও এক সদস্য সাংসদে প্রবেশ করলেন। যদিও লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ভাল ফল করলেও বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে তারা একেবারেই প্রত্যাশামতো ফল করতে পারেনি। একমাত্র ঝাড়খণ্ড ছাড়া হরিয়ানায় সুবিধাজনক অবস্থায় থেকেও কংগ্রেস হেরেছে, তার থেকেও বড় ধাক্কাটা খেয়েছে মহারাষ্ট্রে যেখানে বিজেপি-জোট গোহারান হেরেছিল, সেখানে তারা হইহই করে জিতে ফিরেছে। অন্ধ্রপ্রদেশে ফের ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন চন্দ্রবাবু নাইডু। ওড়িশায় ২৪ বছর ধরে মুখ্যমন্ত্রী থাকার পর নবীন পট্টনায়েক হেরে গিয়েছেন। মহারাষ্ট্রে ফের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন দেবেন্দ্র ফড়নবিস। এগুলি ২০২৪ সালে দেশের রাজনীতির পরিবর্তন।
ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ২০২৪ সালে আরেকটি বড় পরিবর্তন যাকে পরিবর্তণ না বলে বরং তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বলা উচিত, সেটি অবশ্যই জম্মু ও কাশ্মীরে বিধানসভার ভোট। জম্মু-কাশ্মীরে বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার এক দশক পরে সেখানে প্রথম নির্বাচন হয়। প্রসঙ্গত, লোকসভা নির্বাচনের সময়ই দেখা গিয়েছিল, জম্মু ও কাশ্মীরে মানুষ লাইনে দাঁড়িয়েছেন ভোট দেবেন বলে। এর আগে যেখানে ভোট বয়কটের ডাক দেওয়াটাই ছিল রীতি। কিন্তু গত লোকসভায় নিজেদের প্রতিনিধি বেছে নেয়ার ব্যাপারে আগের তুলনায় তারা অনেক বেশি উৎসাহ দেখিয়েছেন সেখানকার মানুষ। বিধানসভা ভোটের সময়েও দেখা গেল, সেই ধারা বজায় আছে তো বটেই তার সঙ্গে ভোটের ব্যাপারে মানুষ অনেক বেশি উৎসাহী। বিশেষাধিকার বাতিল করার পরও প্রথম ভোট হল। বলাই বাহুল্য যে জম্মু ও কাশ্মীর এখন আর পূর্ণ রাজ্য নয়। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মাত্র। সেখানে বিধানসভা নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৬৩ শতাংশের বেশি। সেখানে ওমর আবদুল্লার নেতৃত্বে এনসি, কংগ্রেস ও বামেদের জোট ৪৯টি আসন পেয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন ওমর আবদুল্লা। এখানেও ইন্ডিয়া শিবিরের ফল ভালো হয়েছে। ওমর আবদুল্লার দল ন্যাশনাল কনফারেন্স ৪২টি আসন পায়। বিজেপি পায় ২৯টি আসন। কংগ্রেস ৬টি আসন। দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে জম্মু ও কাশ্মীরে বিজেপি এর থেকে বেশি আসন কখনও পায়নি। জম্মুতে নিজেদের সবকটি আসন জিতলেও কাশ্মীরে কিন্তু গেরুয়া শিবির ব্যর্থ হয়েছে।
চলতি বছর আর একটি ঘটনার উল্লেখ করতেই হয়। ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্য মণিপুর যেখানে এখনও আগুন জ্বলছে। জ্বলতে শুরু করেছিল ২০২৩ সালের ৩ মে থেকে মেইতেই আর কুকিদের সংঘাত ঘিরে। এক বছর পর ২০২৪ সালের ২৪ মে মাসের সরকারি হিসাব হল সেখানে ২২১ জন মারা গিয়েছেন, আহত হয়েছেন এক হাজার জন, খোঁজ নেই ৩২ জনের, ঘরছাড়া প্রায় ৬০ হাজার মানুষ আর চার হাজার ৭৬৮টি বাড়ি জ্বলে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাতেও সংঘর্ষ থামেনি, রাজ্যটিতে যে কবে শান্তি আসবে কারও জানা নেই। বছর শেষে এসেও বোঝা যাচ্ছে না, কবে এই হিংসার আগুন নিভবে। শুরু করেছিলাম ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের উল্লেখ করে কিন্তু দেখা যাচ্ছে মণিপুরের পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। যে আগুন ২০২৩-এ লেগেছিল তা মাঝেমধ্যে নিভুনিভু হলেও ফের জ্বলে ওঠে। ২০২৫ কি মণিপুরে পরিবর্তন আনতে পারবে, শান্তি ফেরাতে পারবে, বন্দুকের আওয়াজ থামিয়ে শান্তি ও কল্যাণের বাতাবরণ সৃষ্টি করতে পারবে?