“মনে পড়ে যায় কবিতা লেখার শুরুর দিনগুলি। সেই বন্ধুদল, সেই সব গাছ, বাড়ি, আশ্রম, বন্ধুগৃহ, ভাড়াঘর, বছর বছর বন্যা, সীমান্ত, আমাদের একুশে যোগ্যতার অভাবে আমার কবিতারচনার প্রচেষ্টা সার্থকতা পায়নি হয়তো। কিন্তু ভালোবাসাটা বড় তীব্র। আর এইসব কবিতা অবলম্বনেই তো পার করে গেছি সর্বনাশ-আক্রান্ত শ্রেষ্ঠ আয়ুষ্কাল, এখন আর কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। ব্যর্থতাবোধ জীবনকে সহজ করেছে। ভালোবাসার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। টের পাই অনন্তকে।”
যাঁর কবিতা পড়তে পড়তে জীবনকে চিনেছি, যাঁর কবিতা পড়তে পড়তে আমিও টের পেয়েছি অনন্তকে, যাঁর কবিতার পাতায় চোখ রাখলে সর্বনাশ থেকে অনেক দূরে পালিয়ে যেতে পারি, যাঁর কবিতার পঙক্তি আমাকে দিয়েছে সাহস,জেনেছি কীভাবে ভালবাসতে হয়, ‘চেঁচিয়ে ভালোবাসার কথা বলি না, চুপচাপ পাশাপাশি থাকি সারাজীবন’, যাঁর ভাষা শিখিয়েছে ঈশ্বরই প্রকৃতি, যাঁর নির্মিত কবিতার আশ্রম হয়ে উঠেছে আমার শুশ্রূষা, আমার ছায়া সেই বিভাস রায়চৌধুরীর শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় উল্লিখিত কথাগুলি দিয়েই শুরু করলাম এই লেখা।
কোনো এক শীতের রাত। হাওড়া স্টেশন থেকে ছেড়ে যাবে চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার। আমরা যাব বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া পাহাড়ের কোলে… বাঁকুড়া কবিতা উৎসবে। প্লাটফর্মেই পরস্পর আড্ডায় মশগুল অনেকেই। আমার সঙ্গেও আলাপ হলো কয়েকজনের,তাদের লেখার সঙ্গে পরিচয় ছিল আগেই, সাক্ষাৎ হয় নি, আমি তো আপ্লুত। কথাকার, কবি, সাংবাদিক, শিল্পী, গায়ক — চাঁদের হাট ট্রেনের কামরা জুড়ে। আমি পাশে পেলাম কবি মৃদুল দাশগুপ্ত এবং কবি বিভাস রায়চৌধুরীকে। স্বপ্নের ট্রেনযাত্রা যেন। কলেজে পড়ার সময় প্রায়ই যেতাম কবি মৃদুল দাশগুপ্তের কাছে তাঁর পত্রিকাদপ্তরে বিধানসরণিতে। উঠে এলো কথোপকথনে সেসব কথা। কিন্তু বিভাসদার সাথে সেই প্রথম আলাপ। আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। রাতের অন্ধকার ভেদ করে ছুটে চলেছে ট্রেন, মায়াবী আলোয় ট্রেনের কামরা জুড়ে কত না শব্দের কোলাজ,এগিয়ে দেওয়া নিজের বই- পত্রিকা।তারপর থেকে তাঁর কবিতাকে ভালোবেসে পৌঁছে যাই কবির কাব্যসংসারে। কোনো একদিন কবি আসেন কথার ঘরে। মনে হয় — আমাদের পুতুলগ্রামে পা রাখেন মাটির ঈশ্বর/গাছ-পাখির পৃথিবী বানাতে শেখান/কবিতার অক্ষর ভাত হয়ে ফুটে ওঠে কাঁসার থালায়…। তাঁর উপন্যাস ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘অশ্রুডানা’, ‘প্রিয় ইছামতী’ জীবনকে ছুঁয়ে-থাকা শব্দের নদী যেন। নিজের মুখোমুখি বসে থাকতে ইচ্ছে করে বহু ক্ষণ। ইতিহাস,সময়, ভালোবাসা,বেঁচেথাকা,ছিন্নমূল জীবন, নাটক, কবিতা বেঁধে বেঁধে রাখে।হাঁটতে থাকি আবার থামি, ছুটি। পালাতে চাই। ফিরে আসি জীবনের কাছে।তাঁর কবিতার বইগুলি আমাকে আশ্রয় দিয়েছে। আমার ব্যথা, আমার যন্ত্রণায়,আমার একাকীত্বে, আমার ভালোবাসায়, আমার দুঃখে-সুখে-কষ্টে-যন্ত্রণায় আমার সঙ্গী বিভাসদার প্রতিটি পঙক্তি। আমি আগলে রাখি ‘চণ্ডালিকা গাছ’, আগলে রাখি ‘জীবনানন্দের মেয়ে’। সেই রাতের ট্রেন, হঠাৎ আলাপের মায়াময় মুহূর্ত আমাকে দিয়েছে কবিতার ক্ষেত…শব্দের বীজ… নিয়ে চলেছে মহাজীবনের পথে। ভোররাতে পাগল হয়ে যায়, ঈশ্বর ভেবে নদীকে ভালোবেসে ফেলি, নদীর বালুচর দেখে ভাষাবোধ জেগে ওঠে আর দিগন্তের বাইরে পালাবার পথ খুঁজতে খুঁজতে আমারও খিদে পায়। তাঁর মতো আমারও যে বলতে ইচ্ছে করে —
“আমি যে শুধু একটু বেঁচে থাকতে চাইছি, / আর কিচ্ছু না, /শুধু নিজস্ব দু-চোখ নিয়ে একটু বেঁচে-থাকা, / ও শহর, /ও ফমসসল সীমান্ত শহর, তুমি আমাকে এই স্বীকৃতিটুকু দাও। “আমিও আত্মহত্যা করতে পারিনা, মনে হয় আমারও প্রেমিকা আছে। একটা অস্পষ্ট পথে হারিয়ে যেতে যেতে ভাবি শিগগিরই একটা নতুন ঋতু আসছে, আমরা একটা নৌকো কিনে ফেলব এবার। আমরা ধ্বংস হবো না কিছুতেই।
তিনি চেয়েছেন একটা দলিল হয়ে থাকুক তাঁর জীবন। কবিতা-সর্বস্ব হয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। কবিতা তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছে — একটা কঠিন সময় পার করে দিয়েছে কবিতা তাকে অনেক কিছু দিয়েছে। “কবিতার প্রতি আমার সেই মোহ আমাকে ঠিক বাঁচিয়ে রেখেছে।” কবিতার প্রতি তাঁর কোন অভিযোগ নেই, নিজের প্রতি তাঁর অভিযোগ, “আমি কবিতাকে কিছু দিতে পারিনি। সূর্যের আলো একটা বিরাট জগতকে আলোকিত করে রেখেছে, তার মধ্যে আমি সামান্য কণামাত্র, এই ভেবে আমি এগোইনি এবং একটা অন্ধকার ঝোপের মধ্যে একটা হ্যালোজেন জ্বলছে…সেইখানে শ্যামাপোকা হয়ে আমি ঘুরঘুর করেছি।”
কবিতা লেখা দিয়ে শুরু করেননি। গদ্যলেখা দিয়ে শুরু করেছিলেন। ছোটো গ্রামীণ পাঠাগার থেকে বই নিয়ে গিয়ে পড়তেন। একটা কলোনীতে ছোটো পরিসরের মধ্যে জন্মেছিলেন। যখন বড় হতে থাকলেন তখন আক্ষরিক অর্থেই ঘরে আর কোন জায়গা হলো না। আত্মীয়র বাড়িতে, একটা পড়শী দাদুর বাড়িতে বড়ো হয়ে উঠলেন। কলোনিপাড়ায় থাকতেন ধীরেন্দ্রকুমার নাথ,খুব জ্ঞানী মানুষ। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী।ভালো বাংলা, সংস্কৃত,ইংরেজি ভাষা জানতেন। সিলেবাসের বাইরের বইয়ের সাধ পেতে শুরু করেছিলেন অনেক রকম বই উনি পড়তে দিতেন পড়তে পড়তে পাঠক সত্তাটা ভালোভাবে গড়ে ওঠে।বিভাস বলছেন, “দরিদ্র পরিবারে জন্মালে মনের মধ্যে যে অভিমান তৈরি হয় ছেলেবেলায়, ওরা আমাদের বুঝতে পারে না, ভালবাসে না, শুধু মারে… খিদে পেলে খাওয়ার কথা বললে রাগারাগি করে… তখন তো আর ব্যাখ্যা করতে পারতাম না এসব… শুধু মনের মধ্যে বৈরিতা তৈরি হত। ফলে বাড়ির বাইরেটা আমাদের টানত। সব পরিবারের ঘটনা এটা। আমরা কলোনির ছেলেরা বাড়ির বাইরে এপাড়া-সেপাড়া ঘুরছি… বন-জঙ্গল ঘুরছি… ফলপাকুড় পাড়ছি,কুড়োচ্ছি… খেলতে যাচ্ছি… এভাবে তখন থেকেই যেন ওটা ঘরছাড়া ব্যাপার তৈরি হয়ে গেছিল। যেন বাড়িতে থাকতে পারলেই আনন্দ।তার মধ্যে এমন একটা লোকের সংস্পর্শে এলাম যিনি জ্ঞানের জগতের একটা বড় পথ খুলে দিলেন, মনে হল ওই পথ দিয়ে উদ্ধার হওয়া যাবে।”
তাঁর নিজের কথা অনুযায়ী ‘দৈনিক বসুমতী’তে বাচ্চাদের পাতায় এটা গল্প বেরিয়েছিল, ওটাই সম্ভবত তাঁর প্রথম মুদ্রিত লেখা। বনগাঁয় ভালো একটা সাহিত্য সমাজ আছে, সেখানকার পত্রপত্রিকায় লেখা বেরোতে শুরু করলো। বড়ো হবার সাথে সাথে বিষণ্ণতা, মনখারাপ — এসব যেন একটা আত্মঘাতী প্রবণতার দিকে নিয়ে যেতে থাকলো। ধানক্ষেত, যার পাশ দিয়ে তিনি ঘুরে বেড়ান,দিগন্তে সূর্যাস্ত দেখেন — ছবিগুলো আস্তে আস্তে পাল্টে যায়। তারপর দেখেন দিগন্তের সঙ্গে মিশে যাওয়ার সূর্যের শেষ আলোটা যেন একটা সাপ। “আমি লিখতে শুরু করলাম আমার নিজের মতো করে।পরে যখন সেগুলো পড়ি দেখতে পাই আমি এমন একটা জায়গা থেকে লেখাটা শুরু করেছিলাম… লিখতে গিয়েছিলাম… লেখাটা শেষ হয়ে যাবার পর ওটা একটা অন্যরকম লেখায় পরিণত হয়ে গেছে। ঠিক ডায়েরি নয়,একদম অন্য কথা হয়ে গেছে।তার মধ্যে আমি আছি, একটা লোকের কষ্ট আছে,প্রকৃতি আছে, নিসর্গ আছে,অন্য জীবনের ইশারা আছে। এইসব কিছুর মধ্যে দিয়ে এমন একটা জীবন আমি দেখেছি, যে জীবনে আমি যা হতে চাই,যা আমি ভুলের অভিজ্ঞতা থেকে পেয়েছি, ছোটোবেলা থেকে যা দেখেছি, সেসব মিলেমিশে একটা নতুন রসায়ন তৈরি হয়ে যায়। এভাবেই কিন্তু আমার প্রথম দিকের কবিতাগুলো।”তারপর ‘নষ্ট প্রজন্মের ভাষা’ নামে একটা দীর্ঘ কবিতা ‘দেশ’ পত্রিকায় বের হল, তা বৃহত্তর পাঠকের দৃষ্টিআকর্ষণ করল। এই নামেই ‘প্রতিভাস’ থেকে প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরল তাঁর, ১৯৯৬ সালে। ‘নষ্ট প্রজন্মের ভাসান’ জীবনের মহাকাব্য — সময়ের উদাত্ত স্বর। অস্তিত্বের মধ্যে আরেক অস্তিত্বের নড়াচড়া টের পাই। বুঝতে পারি পাল্টে যাবে মফস্ সল সীমান্ত শহর, অগ্নুৎপাতে, নিজস্ব মোচড়ে।
“আমরা খুশিতে খেলতে খেলতে দেখি
পাড়ে জেগে আছে পরজন্মের ভূমি,
আমাদের নির্জন জানে, আমরা বিলুপ্তির সীমায় এসে গেছি, ভাঙনের শব্দে আমাদের কান্না পায়
তৃতীয় নয়ন কী সাংঘাতিক! বলে,’অশ্রুই প্রথম ঝরনা,
তাকে ভালোবাসো —’
ও শহর, ও মফস্ সল সীমান্ত শহর, ভয় পেয়ো না,
তোমার প্রতিটি ভাঙনেও একদিন এক-একটি ঝরনা জন্ম নেবেই —”
১৯৯৬ সাল থেকে ২০২২। এই দীর্ঘ সময় তাঁর কাছ থেকে আমরা পেয়েছি অসংখ্য কবিতা। ২০২১-এ বিভাস রায়চৌধুরীর ‘লাজুক ভাতের দানা’ পড়তে পড়তে মনে হলো, ‘মন খারাপ করতে নেই…
দিগন্তে কখনও শেষ হয় না কবিতা… জীবন অপার…’
প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করছে খুব… বুঝতে পারি পথ আছে বলেই ছুটতে ছুটতে ঘাম মুছে আমি নিরাময়ের দিকে চলে যাই… ডুবে যাওয়া মানুষ শেষমেষ যেমনভাবে আঁকড়ে ধরে এক ফুলগাছ আমিও তেমনভাবে আঁকড়ে ধরি কবির শব্দকে…”একজীবন অপেক্ষার পর/এইমাত্র বুঝি,/লেখার আগে না লেখাকেই/ধারণ করতে হয়…” কবিজীবন চাষির মতন… জীবন বাঁচে সম্ভাবনায়…ভালবাসছি বলেই শূন্যতাকে আকাশ মনে হয়, গাছকে মনে হয় বিভূতিভূষণ… কবির মতো আমারও বিশ্বাস — “ভালবাসা একটা নেশা/ ভালবাসলে চোখের জলকে মনে হবে সুজাতার পায়েস… ভালোবাসি বলেই তো তুমি ফিরে আসো আর না-আসো আমি মাটির প্রদীপ ঠোঁটে পরজন্মের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি রোজ সন্ধেবেলা…”
ভালোবাসছি বলেই তো শূন্যতাকে আকাশ মনে হয় গাছকে মনে হয় বিভূতিভূষণ। তাঁর কবিতা আসলে আমার কাছে শ্লোক-ভালোবাসার ফসল, বেঁচে থাকার মন্ত্র। তিনি আমাদের জন্য বিছিয়ে দিয়েছেন আলপথ, দিয়েছেন জীবন্ত বীজতলা। তিনিই শিখিয়েছেন আমাদের কবিজীবন আসলে চাষির জীবন। লেখাই স্বয়ংক্রিয়। মাটির দাবি যে দৃঢ়।
বিধ্বস্ত অসুখের সময়কে কত কোমল ভেবে দেখেন তিনি। করোনার দিনগুলিকে কীভাবে দেখেন তিনি? সব ফেরত পাচ্ছি যেন — পুরনো দুঃখ, পুরনো আকাশ, পুরনো নদী। মানুষের পাপ মুছে পৃথিবীর সুস্থ হচ্ছে রোজ, আর তাইতো শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন রঙের রবীন্দ্রনাথ। অনেক ফুলের গন্ধে চিনে নেন কাকে? আমাদের সেই চেনা বন্যা লোহারকে। পাথর এবং অ্যাসিডকে নিয়ে অত সহজ কবিতা লেখেন তিনি, কিন্তু কত গভীর। তার সঙ্গে মিশে যায় মন্দির, মসজিদ, ভারত, পাকিস্তান, শরণার্থী, অনুপ্রবেশকারী। পাথর হয়ে ওঠে অযত্নে শুকিয়ে যাওয়া হৃদয়, চোখের জলই সাধনার অভাবে হয়ে যায় অ্যাসিড —
“চোখের জল আর হৃদয় সব ধর্মের ভগবান!
কেউ কারও চেয়ে বড় নয়…”
কবিতা জীবনমাত্র… যে বাঁচে, সে জানে কবিতা আসলে কিন্তু বেঁচে থাকার মতো ক্রমশ সহজ…
‘লাজুক ভাতের দানা’ সব ফেরত দিচ্ছে আমাকে… পুরনো দুঃখ, পুরনো আকাশ, পুরনো নদী… দেখতে পাচ্ছি মানুষের পাপ মুছে পৃথিবী সুস্থ হচ্ছে রোজ… সন্ধ্যাকে সাজাচ্ছে হাজার হাজার জোনাকি… পাশের জনকে ডাকি, তার কাঁধে হাত রেখে দিগন্ত যে অনেকদূর সেই কথাটা ভুলে যাই আমি… লাজুক ভাতের দানা শুশ্রূষা হয়ে ওঠে। কবিতা লেখার সময় আমিও বুঝতে পারি আমার মধ্যে একটা মেয়ে থাকে, যাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা আমার রোজকার কাজ। বিভাসদাই পারে এমন পঙক্তি লিখতে, এমন করে ভাবতে। আমার মেয়েও একটু একটু করে বড় হচ্ছে রোজ। আমার মনখারাপে সেও এক ভোর। দেশভাগ,উদ্বাস্তু কলোনি, সীমান্ত বিভাসদাকে আচ্ছন্ন করেছে বারবার।
“তাকিয়ে থাকে অনেক আকাশ জুড়ে
বোবার মতো… পুরনো অভ্যেস…
তুমি কি কিছু বলতে চেয়েছিলে?
দ্বিধার মতো দু’জন দুটি দেশ!”
ভাঙন শুধু ভাঙন ডেকে আনে। কবিতায় যন্ত্রণা প্রচ্ছন্ন থেকেছে, ছায়ার মত ঘিরে থেকেছে। কিন্তু তার সমস্ত জখম পৃথিবীর অতিরিক্ত গাছে ফুল হয়ে ফুটবেই। বুঝেছেন প্রয়োজন নেই কোনো ফুরিয়ে যাবার। মানুষই তো অন্যায়কারী। পথে পথে খুঁজে চলেন কী? কার সাথে দেখা হবে তার? আসলে আচমকা পথে পথে দেখা হয়ে যাবে — এই সম্ভাবনা চাই। তাঁর কবিতায় পয়লা মে হয়ে যায় এক বিশ্বাসের নাম। দেশহারা কলোনির মজদুর কমরেড বাবাকে আমারও বড্ড আপন মনে হয়। আগুনের আলোয় তাঁর চোখ চকচক করছে, স্বপ্ন খুঁজছে। আমিও বিড়বিড় করছি ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও! ‘উই শ্যাল ওভারকাম… বাংলা ভাষার দুঃখকে ছুঁয়ে বিভাসদা বেঁচে আছেন,তাই তো শ্রদ্ধা জানাতে ভোলেন না বাংলাভাষার কবি প্রবুদ্ধসুন্দর করকে। লেখেন —
“ব্যর্থ কবিতাও বাংলাভাষা
আঁকড়ে ধরে থাকে অধিকারে
আমাকেও সঙ্গে নাও, প্রবুদ্ধসুন্দর
কবি-নীল জম্পুই পাহাড়ে…”
তাঁর কবিতার ভাস্কর্য মুগ্ধ করে আমায়। পরম মমতায় তিনি সাজিয়ে তোলেন একের পর এক পঙক্তি। কত সাবলীল তার গতি। কিছুটা অংশ পড়ার পর তিনি যেন একটু থামতে বলেন… বর্ণমালাকে ধারণ করি মননে… তারপর আবার চলি… কবিতার অনন্ত আশ্রমে।
তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ব্লার্বে লেখা আছে —
“বিভাস রায়চৌধুরী লিখতে শুরু করেছেন আটের দশকের একেবারে শেষ লগ্নে। নয়ের দশকের এই বিশিষ্ট কবি বর্তমানে বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র স্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নষ্ট প্রজন্মের ভাসান’ থেকে সপ্তম কাব্যগ্রন্থ ‘পরজন্মের জন্য স্বীকারোক্তি’ পর্যন্ত বিভাসের ব্যতিক্রমী কবিতামাত্রার চিহ্ন ধারণ করে আছে এই ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’। নদীর সাঁতরে ভূমিতে উঠে এসে যে-কবি সেই দিনে অনুভব করেছিলেন জলে ভেসে আছে বিগত শরীর, তাঁর গভীর অবলোকন কবিতাকে তো বারংবার অন্য জন্মের আলো দেবেই। সমস্ত তুচ্ছ করে কবিতা আঁকড়ে বেঁচেছেন, তাঁর কবিতায় তাই বড়ো তীব্র সর্বনাশ আর বাংলাভাষাপ্রেম।…. রহস্যময় কুয়াশা সরিয়ে বিভাস ক্রমশ পৌঁছেছেন নির্জন মায়াবী প্রদেশে… স্বর যেখানে স্পষ্ট, কিন্তু রহস্য অটুট, প্রকৃতপক্ষে কবিতায় তিনি সততার সঙ্গে রচনা করে চলেছেন ক্ষুধার্ত, সংকেত, প্রান্তিক, বিষণ্ণ এক আত্মজীবনকেই। নয়ের দশকের ঝলমলে সপ্রতিভ কবিতার বিপরীতে তাঁর কবিতা অশ্রু, বন্ধু আর আত্মহত্যাকাতর। দুঃখী আপনজন। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র পাতায় পাতায় নিজের জীবন বাজিয়ে চলেছেন উদ্বাস্তু শিবিরের এই সন্তান।”
তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থের কবিতা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। বাংলা ভাষার প্রতি এত গভীর প্রেম কোনো কবির হতে পারে! “বুকের ভেতর আমি আগলে আগলে রাখি ভাঙাবুক/ ভাঙা বাংলা জোড়া লাগলে সেরে যাবে আমার অসুখ…”
বুকের ভিতর গান আছে, বুকের ভিতরে আছে রাগ, বুকের ভেতরে আছে তির, এই বুকের ভিতরেই তো আছে চোখ। তাই তো সব কাঁটাতার তুলে দিতে পারেন কবি, বর্ণমালা জুড়ে চোখে পড়ে শহীদশিবির, মাথা ভর্তি থাকে স্বপ্নে, শোনা যায় কুলুকুলু বাঙালির স্বর। স্নিগ্ধ মুজিবর তাঁর জীবনে এসে পথ হয় — সেই পথ কোনোদিন শেষ হয় না জীবনে। বাংলা ভাষা হেরে গেলে কত প্রেম হেরে যাবে বলো তো! আমরা হয়ে উঠি বাংলাছন্দ-জানা-তির —
“বাংলা ভাষা আমি তোর নুন খাই, নুন…/ গলা ছেড়ে গান গায় প্রতি রাতে ভোরে-ভোরে/ ভেতরে-ভেতরে/আমিও আগুন…/ দুঃখের শিখাটি জ্বালি,দুঃখ থেকে প্রেম নেমে আসে…/ আমাকে কাঁদায়, আর আজন্ম প্রেমিক থাকি খিদেপেটে…/ দেখি, সোনা বর্ণমালা ধিকি ধিকি জ্বলে-নেবে/বাংলার ধানখেতে… শিশুদের স্লেটে…”
এরকম কবিতা পড়তে পড়তে আমরা সবাই, আমরা সবাই বাংলা ভাষা হয়ে উঠি। লড়তে লড়তে আমরা চিনে নিই ফাঁদ, ‘আমাদের প্রেরণা জীবনানন্দের বাংলাচাঁদ’। আর তাইতো বাবার ঘুসঘুসে জ্বর, মার চোখে আলো নিভে আসলেও রিফিউজির ছেলে হেলেঞ্চার ঝোপ ভালোবাসে।
তাঁর কবিতা আমাদের অসুখ সারিয়ে দেয় — অজস্র রাত্রির শেষে আমাদের মৃতদেহ আলো লাগা মাত্রই এখনও যে প্রেমিক। অনন্ত শব্দের পাশে চোখের পতঙ্গ স্তব্ধ হয়ে আছে। তাঁর কবিতা একটা পাখির মতোই আমাকে প্রথম রোদ্দুর এনে দেয়, আমাকে জীবনে ফেরায়। তাঁর কবিতা পড়তে পড়তেই বুঝেছি জীবনে ফেরার জন্য আমাদের চুম্বন জরুরী।প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক তৈমুর খান লিখেছেন — “বাংলা কবিতার পরিবর্তনে যে নতুন ধারায় কবি উঠে এসেছেন তা একান্তই নিজস্ব। ভাষা বদলে, রহস্যে, আত্মোন্মচনে, সময় ও ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে এবং মূর্ত ও বিমূর্তযাপনে বিভাস চূড়ান্ত স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর কবিতার বিষয় আছে, কিন্তু বিষয়াতীত এক উপলব্ধির বিস্ময় আছে, যেখানে আমরা প্রবেশ করলেও চূড়ান্ত সমাধানে পৌঁছাতে পারিনি। কোথাও সিদ্ধান্ত নেই, আবেগের নিষ্ঠাহীন প্রাচুর্য নেই, বরং দার্শনিকের প্রত্যয় আছে, প্রত্ন-প্রেম আছে।”
এই ধ্বস্ত সময়ে এইতো আমার কাজ পড়তে পড়তে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে আগুন।শব্দ অস্ত্র হয়। ভাষাঢেউ আমাকে জাগায়।
কবির বন্ধুর নাম কেলো, মিন্টু, শিবু, অরুণ, নিতাই। এরা সব খিদের দেশের বন্ধু, এরা সবাই থাকে খিদের ভেতরে। ‘খিদেকে ভোলার খেলা খেলে খেলে খেলে কাদামাখা/ সব গেঁয়ো ভূত/ পুকুরের জলে গিয়ে ঝপাং ঝাঁপাই! ‘কবির কাছে কেলো, মিন্টু, শিবু বৃষ্টির নাম। অরুণ নিতাই ভাতের নাম।তাঁর কবিতা পড়লে খুব খুব কান্না পেলেও একাকী ঝরনার মতো মাথা উঁচুতে রাখতে ইচ্ছে করে। মনে হয় যতদিন পৃথিবী অটুট, মুখ লুকোবো না — মাথা নিচু করে কাঁদবো না। নদীকে বাঁচাতে পথে নেমেছেন যিনি, পাহাড় বাঁচাতে পথে নেমেছেন যিনি, বলেন ‘আমার দেশ লুট করে নিল উন্নয়নে’ সেই ভারভারা রাওকে নিয়ে কবিতা লেখেন বিভাস। সেই ভারভারা রাও যিনি, ‘এক কথায় কবির অধিক!’ দেখতে ভুলি না কিছু, দেখাই তো আমার কাজ, জলের উপর নিখিলের ঝরে-যাওয়া, ভেসে-যাওয়া দেখি, দেখি নিঃস্ব গাছ একা বসে আছে। কবি আমাকে দেখতে শেখান। কবি আমাকে বলে দেন, ‘ভালবাসা কেউ না/বরং তুমি অপমানের কথা বলো!’ সবাই ছেড়ে গেলেও ‘একটা তুচ্ছ অপমান/, দু’পয়সার তুচ্ছ অপমান/তোমাকে একলা ফেলে পালায়নি কখনো কোনো/ দুর্যোগের সন্ধ্যায়। মহাজগতের আলো অস্থির করে তোলে, বৃষ্টি নামে, দৌড়তে দৌড়তে নতুন গ্রাম পার হয়ে ইছামতী পেরিয়ে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে নীলকন্ঠ পাখিদের দেশে, আকাশে আকাশে ঠিকানা সময়ে ঘুড়ির পিঠে লিখে দিই — ‘সীমান্ত মানি না…/ সকল গ্রামের নাম বাংলাদেশ…’। সুতো ছিঁড়ে সে ঘুড়ি উড়তে থাকে, উড়তে থাকে। বুঝতে পারি পৃথিবীর সীমান্তে সীমান্তে ব্যথা জাগিয়ে রাখার জন্য কলোনিপাড়ায় কবি প্রয়োজন, যে বলবে ‘আমরা ভাঙিনি দেশ কোনোদিন।’
‘এই তো আমার কাজ’ কবিতাটি পড়তে পড়তে আমারও কান্না পায়, ব্যথায় মোচড় দেয় মন, ক্ষতবিক্ষত হই। হাতে তুলে নিয়ে তাঁর উপন্যাস ‘বাইশে শ্রাবণ’।যখন বিভাস রায়চৌধুরী এই উপন্যাস পড়ি তখন বিস্মিত হয়ে ভাবি, শান্তিনিকেতন, বসন্ত উৎসব, বাইশে শ্রাবণ, কবিগুরুর মৃত্যুর শেষদিনগুলির ছবি এইভাবে শব্দবন্ধে বাঁধতে পারেন কেউ? কবি বিভাসের আত্মজীবনী কি এই উপন্যাস? নাকি বিদিশা নামের সেই মেয়েটির গল্প? নাকি রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের আখ্যান? এরকম একটি অভিনব উপন্যাস পড়তে পড়তে আমি যেন শুনতে পাই বেদনার ভাষা, উপলব্ধি করি চরাচরকে, অনুভব করি রবীন্দ্রনাথকে। এরকম অভিনব আঙ্গিকে একটি উপন্যাস রচনা করা যায় তা আমি অন্তত ভাবতে পারিনা। যাঁর কবিতায় সবসময় বুঁদ হয়ে থাকি, যাঁর কাব্যভাষাকে মনে হয় ঈশ্বরের শ্লোক, তাঁর এই উপন্যাস আমার কাছে জীবনের মহাকাব্য। এই উপন্যাস আসলে একটি দীর্ঘ কবিতা।সবসময় মনে হচ্ছে বেদনা শব্দটির পাশে হৃদয় শব্দটি কীভাবে চুপ করে বসে থাকতে পারে? অদ্ভুত সব মায়াময় শিরোনাম। রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ অংশগুলো লিখতে গিয়ে শিরোনাম দিলেন ছিন্নপত্র। বিদিশার জীবনের বর্ণনা করতে গিয়ে শিরোনাম দিলেন ভাঙন, চাঁদের আলো, কবির মেয়ে, সর্বনাশ। একটা পুরো অংশের নাম হল একটি চিত্রনাট্যের খসড়া, রক্তকরবীর এক নবনির্মিত রূপ দেখতে পেলাম।শেষ অংশের নাম দিলেন শেষের কবিতা, যার মধ্যে মিশে থাকলেন রবীন্দ্রনাথ মিশে থাকল বিদিশা, কবির বাবার চিতাভস্ম এবং কবি। তিনটি পরস্পরকে জড়িয়ে জড়িয়ে থেকেছে। কান্নায় ভেঙে পড়েছি, বিদিশার জন্য উৎকণ্ঠা হয়েছে বারবার, প্রিয় কবির আত্মজীবনী পড়তে পড়তে কষ্ট হয়েছে। স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামে, অপমানিত হতে হতে মরে যাচ্ছে এক কবির মেয়ে বিদিশা, অন্যদিকে এক মুষ্টি কালো, ভেজা, ছাইমাখা মাটি রুমালে জড়িয়ে রাখে কেউ। আর কলসিতে রবীন্দ্রনাথের চিতাভস্ম সংগ্রহ করে সুরেন্দ্রনাথ ফেরেন শান্তিনিকেতন। “বোলপুর-শান্তিনিকেতনের আকাশে তখন অমলিন অজস্র তারকা। ঘনীভূত অন্ধকারে ব্যঞ্জনাময় জোনাকির দল।”
সকাল হয়। আমার পুতুলনগরীতে আমি খুঁজে চলি রবীন্দ্রনাথকে, বিদিশাকে আর আমার ঈশ্বর উদ্বাস্তু শিবিরের কবিকে…।
বিভাস রায়চৌধুরীকে যত পড়ি তত বিস্মিত হই, ভাবি, ‘জীবন অবাক হয়ে বেঁচে আছে ঘেঁটুফুলে আর গুঁয়ে-বাবলার বনে। বিভূতিভূষণকে খুঁজে পাই, প্রতিটি খিদের গায়ে যিনি রেখে গেছেন বুনো লতাপাতা, প্রতিটি ক্ষতের গায়ে মহাসময়ের উপশম। তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে আমারও বলতে ইচ্ছে করে ‘সমস্ত গাছের কাছে মানুষের ক্ষমা প্রয়োজন!’
গৌতম হাজরা সম্পাদিত প্রতীতি পত্রিকায় প্রকাশিত