তিথি হল এক দিনে চন্দ্র সূর্যের মধ্যে যে কৌণিক পার্থক্য হয় তাঁর মান — ১২ ডিগ্রি। ৩০টা তিথিতে এক মাস। অর্থাৎ ৩৬০ ডিগ্রি। মেকলে পদ্ধতিতে শিক্ষিতরা একে অঙ্ক বা জ্যোতির্বদ্যা না বলে কুসংস্কার বলেন — সেটা আসলে তাঁর শিক্ষা। এর সঙ্গে সংস্কার-কুসংস্কারের যোগ নেই।
পশ্চিমি প্রাচ্যবিদ্যার্ণবেদের প্রচারে যে বন্ধুরা মনে করেন বাংলায় এবং অন্যান্য প্রদেশে দেশিয় জ্ঞানচর্চা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রাচীন যুগের পরে, মনে করিয়ে দেওয়া যাক চার্লস উইশ ১৮৩৪ সাল নাগাদ তেলেঙ্গা প্রদেশে কলন বিদ্যাচর্চা দেখেছিলেন, লিখেছিলেন জ্ঞানলুঠের জন্য তৈরি এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায়। জ্ঞানচর্চা সংক্রান্ত এ রকম হাজারো উদাহরণ দেওয়া যায় — সে কাজটি করেছেন ধরমপালজী তাঁর নানান লেখায় — উতসাহীরা দেখে নিতে পারেন। বিদ্যাসাগর বা রামমোহন বা দ্বারকানাথ দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভাবের জন্য কর্পোরেট লুঠেরা, খুনি, অত্যাচারী শিক্ষা ব্যবস্থা এ দেশে প্রণয়নের জন্য ধুয়া তুলেছিলেন, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং কর্পোরেট স্বার্থবাহী এবং দেশের স্বার্থ বিরোধী।
এখণ আমরা ১৩১২, অর্থাৎ আজ থেকে ১১২ বছর আগে প্রকাশিত একটি বই-এর ছোট্ট একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। কেন? কেন না বইটি প্রমাণ যে দেশে দেশজ জ্ঞান, লব্জ নির্ভর পণ্ডিতি যুক্তি (তা পশ্চিমি পদ্ধতিতে নাও হতে পারে) তর্কের অবকাশ শেষ হয়ে গিয়েছিল এ কথা যারা মনে করেন, তারা হয় লুঠেরা জ্ঞানচর্চার তরফদারি করছেন নয়ত মিথ্যা বলছেন। এর ফলে আমরা মনে করি পশ্চিমি জ্ঞানচর্চায় নাদ, জল্প, বিতণ্ডা (যেগুলোর মানে আপনারা ভুলে গিয়েছেন — মনে রেখেছেন ডিসকোর্স) ইত্যাদির স্থান আছে, দেশিয় বিদ্যা চর্চায় নেই।
পঞ্চানন সাহিত্যাচার্য মহাশয় দেশীয় পদ্ধতিতে অঙ্ক করেই কামাখ্যানাথ তর্কবাগীশের মত খণ্ডন করেছেন সেটাও উল্লেখ্য। কবে? আজ থেকে ১০০ বছর আগে। তিনি বলছেন, ‘কোন সংক্রান্তির কত পূণ্যকাল? কোন মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গাস্নান করিতে হয় বা তিল দান করিতে হয়, সে ব্যবস্থা স্মার্ত্যরা [অর্থাৎ যারা সামাজিক বিধি নিষেধের পাঁতি দেন, সামাজি আচার আচরণেরক রীতিনীতি তৈরি করেন] করিবেন। জ্যোতিষ শাস্ত্রের সহিত তাহার কোন সম্বন্ধ নাই। জ্যোতিষ শাস্ত্র সূক্ষ্ম সংক্রমণ কাল গণনা করিয়া দিয়া প্রস্থান করিবে।’ ব্রিটিশ পূর্ব সময়ে পণ্ডিতি আলোচনা মানে ধর্মীয় আলোচনা এমন তথ্য মিথ্যা প্রমান করতে এই বিতর্কটি উপস্থাপন করব।
১৩০০ সালের প্রথম দশকে দ্বারকামঠের অধীশ্বর শ্রীশ্রীশঙ্করাচার্যের নেতৃত্বে বোম্বাইতে একটি পঞ্চাঙ্গ শোধন মহাসভা আয়োজিত হয়। দৃকপ্রত্যয়সিদ্ধান্ত ও ধর্মশাস্ত্রের শৌত স্মার্ত্ত কর্মানুষ্ঠান, পঞ্জিকার গণনা কিভাবে করতে হবে তাই নিয়ে একটি সভা ডাকা হয়। সেই সভায় সারাদেশের ১৫০ পণ্ডিতের স্বাক্ষরযুক্ত একটি নির্ণয়পত্র প্রকাশিত হয়। বাংলা থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন ৯ জন পণ্ডিত, তাঁদেরও স্বাক্ষর ছিল (যেমন গুপ্তপ্রেস পত্রিকার গণক বিশ্বম্ভর জ্যোতিষার্ণব, ধীরানন্দ কাব্যনিধি ইত্যাদি)। বিচারের সময় নাদ জল্প এবং বিতণ্ডা হয়। ৮ দিন ধরে বিচার চলে। তাঁর পরে তাঁরা সাতটি প্রশ্ন আর সমাধান তারা ছাপান। সেই লেখাটি ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯০৫ সালে হিতবাদীতে ছাপা হয়।
সংস্কৃত কলেজের জ্যোতিষের অধ্যাপক পঞ্চানন সাহিত্যাচার্য সেই সমগ্র বিষয়টি নিয়ে একটি বই লেখেন যার নাম পঞ্চাঙ্গ প্রভাকর। এখানে তিনি বিশদভাবে সাতটি প্রশ্নের কূট সমাধান বিষয়ে আালোচনা করেছেন।
এই প্রকাশনা সূত্রে শুধু বলতে চাচ্ছি, লেখক এই বই-এর উপসংহারে কামাখ্যানাথ তর্কবাগীশের গ্রহের গ্রহণ, উদয়, অস্ত ইত্যাদিতে সূর্য সিদ্ধান্ত অশুদ্ধ শুদ্ধ করার ইচ্ছেয় সম্মতি প্রকাশ করলেও তিথির সমস্ত পারিভাষিক মিথ্যের দাবিকে অযৌক্তিক বলে মনে করেন। তিনি লিখছেন, (এই বইতে) ‘তিথি যে মিথ্যা কল্পনা নহে, যথার্থ, ইহার পদার্থ আছে, ইহা উত্তমরূপে বুঝাইয়াছি।…গ্রহণে ও তিথিতে গ্রহস্ফুটীকরণের প্রভেদ দেখাইবার জন্য, কতগুলি সিদ্ধান্ত বাক্য তুলিয়া তাহার সম্পূর্ণ মিথ্যা অর্থ কল্পনা করিয়া, যে কথার উত্থাপন করিয়াছিলেন, আমরা সেই সেই সিদ্ধান্ত বাক্যের যথার্থ অর্থ, করিয়া উত্তমরূপে মীমাংসা করিয়া দিয়াছি, যে প্রসিদ্ধ শাস্ত্র প্রণেতৃগণ তিথি ও গণনার জন্য একই প্রকার স্ফূট গ্রহ ব্যবহার ক্রিয়া থাকেন। স্ফূটী করণ ভেদ কোন সিদ্ধান্ত শাস্ত্রে নাই। যথার্থ উত্তরায়ণ সংক্রান্তির প্রায় বাইশ দিন পরে মকর রাশির সংক্রান্তি হয়। এই উভয় সংক্রান্তিতেই সূক্ষ্ম সংক্রমণ কাল গণিত দ্বারা নিরূপিত হয়ে থাকে। কোন সংক্রান্তির কত পূণ্যকাল? কোন মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গাস্নান করিতে হয় বা তিল দান করিতে হয়, সে ব্যবস্থা স্মার্ত্যরা করিবেন। জ্যোতিষ শাস্ত্রের সহিত তাহার কোন সম্বন্ধ নাই। জ্যোতিষ শাস্ত্র সূক্ষ্ম সংক্রমণ কাল গণনা করিয়া দিয়া প্রস্থান করিবে।’
আদতে এই বিতর্ক হয় কর্পোরেট পড়াশোনার বাইরের জগতে — যার খবর মেকলে-ট্রেভলিয়নের প্রপৌত্র মধ্যবিত্ত আজও রাখে না। আমাদের আপনারা আপনার লুঠেরা কর্পোরেট জ্ঞানচর্চায় নিলেনই না, তাতে আমার বয়েই গেল। আমাদের ধারণা সেই প্রশ্ন-উত্তরগুলি দেখলে আজকের যারা মেকলিয় পদ্ধতিতে কর্পোরেট লুঠেরা অন্যকে অস্বীকার করার জ্ঞানচর্চা করেন তাদের ধাঁধা লাগবে। কেন না এই শিক্ষা এবং জ্ঞান দান পদ্ধতি পশ্চিমি শিক্ষা আর জ্ঞানদান পদ্ধতি থেকে আলাদা — এর লব্জগুলো আলাদা, এর সংখ্যা লেখা, ব্যবহৃত চিহ্ন, পাঠপদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা চর্চার বিষয় — ঠিক যেমন পশ্চিমি জ্ঞানচর্চায় তাঁর নিজস্ব ধারা রয়েছে, পূর্বের জ্ঞানচর্চাতেও নিজস্ব ধারা রয়েছে — কিন্তু পশ্চিম যেহেতু এটাকে জ্ঞানচর্চা বলে স্বীকার করে না (যদিও বহু জ্ঞান এখান থেকে সে চুরি করেছে) তাই একে সে মিথ্যা জ্ঞানচর্চা বলতে একটুও বাধে না।
যিনি ছোটবেলা থেকে অন্য জ্ঞানচর্চার মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছেন, তিনি অন্যের জ্ঞানটা নাও জানতে পারেন — না সেটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর জন্য আপনার অজানা সম্পূর্ণ জ্ঞানচর্চা ব্যবস্থাটাকেই কুসংস্কার, মিথ্যা, অলৌকিক বলে দাগিয়ে দেবেন সেটা তো আর চলবে না।
প্রতিশ্রুতি মত নিচে সেই সাতটি প্রশ্ন-উত্তর দিলাম — এবারে বুঝে নিন এই প্রযুক্তি চর্চা আপনার কাছে কুসংস্কার আর বোধ আর গোচরহীন — কোনটা।
প্রথম প্রশ্ন
পঞ্জিকা গণনা করিতে সূর্যের বৎসর পরিমান কত দিন, কত দণ্ড, কত পল ইত্যাদি স্বীকার করিতে হইবে? এবং সূর্য ভিন্ন অন্য গ্রহের গতির মান (যেমন এক দিনের গতি) কিরূপে স্বীকার করিতে হইবে?
উত্তর
সূর্য সিদ্ধান্তোক্ত বর্ধমান স্বীকার করিতে হইবে। সূর্যাতিরিক্ত গতিতে, বোধোপলব্ধ বীজ (যন্ত্রাদি দ্বারা গ্রহ গতির পরীক্ষা করিয়া যে অন্তর পাওয়া যায় তাহা) সংশোধন করিয়া লইতে হইবে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন
বৎসরের অয়ন গতির মান কি, স্বীকার করিতে হইবে?
উত্তর
সূর্য সিদ্ধান্তোক্ত সূর্যের বর্ষপরিমান যাহা স্বীকার করা হইয়াছে, তদনুসারে বর্ষে, অয়নগতি কিঞ্চিত আধিক ৫৮ বিফলা হইবে। তাহাতেও যদি বোধস্থলে বৈগুণ্য উপস্থিত হয়, তাহা হইলে, বোধোপলব্ধ বীজ সংস্কার ক্রিয়া গ্রহণ করিতে হবে।
তৃতীয় প্রশ্ন
আয়নাংশ ভিন্ন ভিন্ন মতে ১৮ হিতে ২৩ অংশের অধিক পাওয়া যায়। গ্রন্থারম্ভ কালে অয়নাংশ, কত স্বীকার করিতে হইবে?
উত্তর
আমাদের গ্রন্থারম্ভ কাল শকাব্দা ১৮২৬ হইতে ২২ অংশের অধিক ও ২৩ অংশের কম অয়নাংশ স্বীকার করিতে হইবে।
চতুর্থ প্রশ্ন
আরম্ভ স্থান (ভগনাদি) কি, স্বীকার করিতে হইবে?
উত্তর
ক্রান্তিবৃত্ত আরম্ভস্থান, অয়নাংশ অনুসারে সচল ও নিশ্চল, দুইই স্বীকার করিতে হইবে। এবং পঞ্জিকার সায়ন সংক্রান্তি ও নিরয়ণ সংক্রান্তি, দুইই দেখাইতে হইবে। আয়নারম্ভ দ্বয়, প্রত্যক্ষ সিদ্ধ হইবে।
পঞ্চম প্রশ্ন
দৃকপ্রত্যয়ের জন্য বোধোপলদ্ধ নব্য সংস্কার গ্রহণ করা যাইবে কি না?
উত্তর
দৃক প্রত্যয়ের জন্য যে বিষয়ের যে যে সংস্কার আআবশ্যক সে সকলই বীজ সংস্কাররূপে গ্রহণ করিতে হইবে।
ষষ্ঠ প্রশ্ন
তিথি কিরূপে সাধন করিতে হইবে?
উত্তর
স্ফূট চন্দ্র ও সূর্য হইতে তিথিমান সিদ্ধ করিতে হইবে, স্থূল ও সূক্ষ্ম উভয় রীতিতেই করণ গ্রন্থে দেখাইতে হইবে।
সপ্তম প্রশ্ন
মধ্যরেখা কি স্বীকার্য?
উত্তর
করণ গ্রন্থে ক্ষত্র সাধন, সাভিজিৎ, নিরাভিজিৎ এই উভয় প্রকারেই দেখাইতে হইবে।
আপনি পশ্চিমি জ্ঞানচর্চায় বড় হয়েছেন, স্বাবভাবিকভাবে এই প্রাযুক্তিক লব্জগুলি জানে না, তাঁর মানে কি এই জ্ঞানটা মিথ্যা হয়ে গেল?
আজ আমাদের নতুন করে দেশীয় জ্ঞানচর্চায় প্রবেশ করতে হবে।