২০১২ সালের ২০ মে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়— সরকারের বর্ষপূর্তির দিনে একদিকে যখন চলছে সরকারি, দলীয় উৎসব, আরেকদিকে দলেরই সহ সম্পাদক, প্রাক্তন বিধায়ক, প্রাক্তন আইএএস অফিসার দীপক ঘোষ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে লেখা এক বিস্ফোরক বই প্রকাশ করলেন। আর সেই বই প্রকাশ হল কলকাতা প্রেস ক্লাবে মমতাপন্থী শিক্ষাবিদ সুনন্দ স্যান্যালের হাত দিয়ে। দীপক ঘোষ যেহেতু এখনো তৃণমূল দলেরই সহ সম্পাদক, সেই কারণে বিষয়টি অন্য মাত্রা পেয়ে গিয়েছে। দীপক ঘোষের লেখা এই বই ঘিরে তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহলে। বইটির নাম ‘মমতা ব্যানার্জি এজ আই হ্যাভ নোন হার’ বা বাংলাতে বলা যেতে পারে ‘মমতা ব্যানার্জিকে আমি যেমন দেখেছি’। লক্ষ্য করার মতো বিষয়, এই বইতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর পরিবার ও তৃণমূল কংগ্রেস দল সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের একাধিক অভিযোগ তুলে ধরেছেন দীপক ঘোষ।
বইটির প্রচ্ছদে দু’টি ছবি আছে। একটি দুর্গা ঠাকুরের পূজা শুরুর। তাতে আছে ২০ মে ২০১১ তারিখ। আরেকটি ছবি আছে সেই ঠাকুর বিসর্জনের। তাতে আছে ১৯ মে ২০১২ তারিখ। মানে এক বছরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শুরু এবং শেষ হয়ে গিয়েছে। বইটিতে তিনি লিখেছেন— মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে তৃণমূল কংগ্রেস এবং মুখ্যমন্ত্রীর পরিবার নিয়ে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগের কথা। দুর্নীতির অভিযোগ এনে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকেও চিঠি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বইটির লেখক দীপক ঘোষ। সেই চিঠির প্রতিলিপি তিনি পাঠিয়েছেন সোনিয়া গান্ধী, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং মুখ্য নির্বাচনী অফিসারকে। চিঠির সঙ্গে সদ্য প্রকাশিত বইটির প্রতিলিপিও পাঠিয়েছেন প্রাক্তন এই তৃণমূল বিধায়ক। চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবার, পারিষদ এবং তৃণমূলের একাধিক গরমিলের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি।
দুই ভাষায় লেখা দুটি বই। বই না বলে কিছু আরটিআই করা এফিডেভিডের সমাহার বলা ভাল, যা ছাপার আকারে প্রকাশ করেছেন। সেই বইটি হয়ে গেল সিপিএমের ভোট প্রচারের হাতিয়ার। কমপক্ষে এই দল ২০,০০০ হাজার কপি কিনে সারা রাজ্যে বিলি করেছিল মমতার পাল থেকে হাওয়া কেড়ে নিতে। পারেনি। বাংলা বইটির নাম ‘মমতা বন্দ্যোরপাধ্যােয়কে যেমন দেখেছি’। ইংরেজিতে ‘মমতা ব্যানার্জী অ্যাজ আই হ্যাভ নোন হার অর গডেজ দ্যাট ফেইলড’। ‘ব্যর্থ দেবী’। মমতা ব্যর্থ। তাঁকে ব্যর্থ দেবীতে ভূষিত করেছেন লেখক দীপক কুমার ঘোষ। মুকুল রায় আদালতে মমতার হয়ে দীপকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করেছেন। যা আদালতে এখনো চলছে। হলপ করে বলা যেতে পারে, মমতার নামের ছোঁওয়া না থাকলে এই বইটি আদৌ বিক্রি হতো কিনা সন্দেহ। একযুগ পর আবার বিরোধীরা পঞ্চায়েত ভোটের আগে সেই বইকে কেন্দ্র করে ভোটের ময়দানে ঘোলা জলে মাছ ধরতে লেগে পড়েছে।
এবার আসি, লেখক পরিচয়ে দীপক ঘোষকে কি কেউ চেনেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে লেখা বই ছাড়া লেখার জগতে অন্য কোনও বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন বলে জানি না। দীপক ঘোষ প্রাক্তন আইএএস অফিসার। চাকুরী থেকে অবসর নিয়েই তিনি তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন। এমএলএ হন। এক সময় কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কিন্তু খুব সহজে দীপক ঘোষকে দল থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিচ্ছিন্ন করতেও পারছিলেন না। নিজের কেন্দ্র পরিবর্তন করে ২০০৬ সালে সম্ভবত যাদবপুর বিধানসভা কেন্দ্রে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে তাঁকে প্রার্থী করে তৃণমূল কংগ্রেস। দীপক ঘোষ ভেবেই নিয়েছিলেন তাঁকে হারানোর জন্যই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে প্রার্থী করা হয়েছে। তিনি হেরে যান। দলের সাথে সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটে। তীক্ততা থেকে শত্রুতার পর্যায়ে চলে যায় সম্পর্ক। দশ-এগারো বছর আগে পড়া স্মৃতি থেকেই বলছি এসব কথা। ভুল কিছু হলে নিশ্চয়ই ক্ষমাপ্রার্থী। তবে হ্যাঁ, এরপর দলবদলও করেছিলেন— ২০১৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর সবং-এর এক জনসভায় দিলীপ ঘোষের হাত থেকে বিজেপির পতাকা নিয়ে বিজেপিতে জয়েন করেন।
২০১২ সালের দিকে যখন দীপক ঘোষের বইটি প্রকাশ হয় তখনই কিনেছিলাম। বইটি আমি পুঙ্খানুপুঙ্খ পড়েছিলাম তখনই। বইটির ক্রয় মূল্য ছিল ২০০ টাকা। আমার কাছ থেকেই সিপিএমের এক কমরেড বইটি পড়ার জন্য নিয়ে অনেককে পড়িয়েছিলেন। তিনি বই ফেরত দেননি, পরিবর্তে ২০০ টাকা আমাকে দিয়েছিলেন আর একটি বই কিনে নেওয়ার জন্য। আমি আর কেনার প্রয়োজন মনে করিনি। এসব বই দ্বিতীয়বার বা এখন আবার পড়তে হবে তারও প্রয়োজন মনে করছি না। না চাইতেও এ বইয়ের পিডিএফ এসেছে। কিন্তু পড়ব না, সময় নষ্ট। ছোটকালে ‘পথের পাঁচালী’ পড়েছি। পরিণত বয়সে এই বই কিনে আবার পড়েছি। তার পরেও পড়েছি আরও একবার। এখনও পড়তে ইচ্ছে করে। ‘শ্রীকান্ত’ পড়েছি কয়েকবার। ‘গোরা’ পড়েছি দু’বার। একই বই একাধিকবার পড়ার অনেক উদাহরণ আছে আমার এবং অনেকের।
দীপক ঘোষ নামের প্রাক্তন আইএএস এবং দু’বার তৃণমূল কংগ্রেস দলের এমএলএ লোকটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ‘সততার প্রতীক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যেমন দেখেছি’ বইটি লিখেছেন। এই বই নিয়ে তখনও হইচই কম হয়নি। তখন কংগ্রেস নয়, সিপিএম এই বইয়ের প্রচার এবং বাজারজাত করেছিল। এবার কংগ্রেস সিপিএম মিলে করছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বইটির পিডিএফ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। একটি বহুল প্রচারিত টেলিভিশন চ্যানেল পরিকল্পিতভাবে একজন তরুণ আইনজীবীকে নেতা বানাতে চাইছে— সেটাও ক্রমশ প্রকাশ্য। প্রধানত নেতা হতে যাওয়া এই তরুণ আইনজীবীই দীপক ঘোষের বইটির প্রচার ও প্রসারের এখন মূল নিয়ামক শক্তি।
রাজ্যের শাসন ক্ষমতার প্রধান হলে বিরোধীরা নানাভাবে রাজনৈতিক আক্রমণ করবেন— এটা গণতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রবণতা। সাগরদিঘীর নির্বাচনী সাফল্যে অধীর চৌধুরী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করেছেন সেটাও ওই গণতান্ত্রিক স্বাভাবিকতার গন্ডির মধ্যেই। চোখা চোখা অধীর চৌধুরীর সেই বাক্যবাণ ছিল অবশ্যই রাজনৈতিক। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাম না করে অধীর চৌধুরীর পারিবারিক বিষয়ে মন্তব্য করেন— যেটা রাজনৈতিক গন্ডী অতিক্রম করেছে। মমতার এই অনভিপ্রেত মন্তব্যের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ, সোশ্যাল মিডিয়ায় বহু মানুষ নিন্দা করেছেন। আমরাও করেছি এবং এখনও করছি।
কৌস্তুভ বাগচি তরুণ আইনজীবী এবং কংগ্রেস নেতা। ক’দিন আগে কংগ্রেস দলের কোনও পদ থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়, তাতেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে কান্নাকাটি করছিলেন। এই তরুণ কৌস্তুভ উদ্ধত মানসিকতা নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে লেখা সেই দীপক ঘোষের বইটির সাংবাদিকদের ডেকে পাতা খুলে বসেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিতান্ত ব্যক্তিগত জীবনের আপত্তিকর অংশগুলো পড়তে শুরু করেন। যেন বইটি আগে কেউ দেখেননি, পড়েননি। তাঁর ঔদ্ধত্য দেখে মনে হচ্ছিল, কৌস্তুভই একমাত্র ব্যক্তি, যাঁর কাছেই শুধু বইটি সংরক্ষিত ছিল। ২০১২ সালেই রাজনৈতিক মাইলেজ পেতে সিপিএম দীপক ঘোষের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে লেখা বইটি ভাইরাল করেছিল। তখন হাঁটুর বয়সী কৌস্তুভ নিশ্চয়ই শীতঘুমে ছিলেন! তাঁর দল কংগ্রেস কোথায় ছিল? কৌস্তুভ কি জানেন না, তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে জোট বেঁধে ভোট করে মমতার মন্ত্রিসভায় ছিল? নির্লজ্জ ও উদ্ধত হওয়ারও একটা সীমা থাকে— যে সীমা লঙ্ঘন করেছেন কৌস্তুভ।
মনে রাখতে হবে, নেতা নিজের যোগ্যতায় হতে হয়। টেলিভিশন চ্যানেলের প্ররোচনার ফাঁদে পড়ে আবার নিঃশেষও হতে হয়। তরুণ প্রজন্মের নেতারা এটা যত সহজে বুঝবেন, আমাদের ততই মঙ্গল। রাত জেগে পিডিএফ পড়ে কোন বিষ বুকে ধারণ করবেন! শেষ কথা এটাই— আমরা আশাবাদী, নৈরাশ্যবাদী নই।
ভালো লাগলো।