গুলেন বারি সিনড্রোমে (জিবিএস) অযথা আতঙ্ক ছড়াবেন না। উদ্বেগের কোনও কারণ নেই। এমনটাই জানিয়েছেন চিকিৎসক বিশেষজ্ঞরা। করোনার পর বিশ্ব স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নতুন আতঙ্ক গুলেন বারি সিনড্রোম বা জিবিএস। ক্রমশ দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে এই রোগ। ইতিমধ্যেই মুম্বই, পুণেতে অনেকে, বিশেষ করে ছোটরা বিরল এই স্নায়ুরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এই রাজ্যেও আক্রান্তদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে। এবার দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্রের মৃত্যুর খবর সামনে এসেছে। এই ঘটনা রাজ্যে প্রথম বলেই জানা যাচ্ছে।উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সদর বারাসতের প্যারীচরণ সরকার রাষ্ট্রীয় উচ্চ বিদ্যালয়ের দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া ছিল সে। জিবিএসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবরে তীব্র চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। স্থানীয় ও পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, আমডাঙা ব্লকের বেড়াবেরিয়া পঞ্চায়েতের টাবাবেরিয়ে গ্রামের বাসিন্দা তাঁরা। ওই দম্পতির একমাত্র সন্তান ছিল সে। গত ২২ তারিখ সন্ধ্যায় সে ঘুম থেকে উঠে মাকে গলা ব্যথার কথা জানিয়েছিল। পরিবার তখন বিষয়টিকে ঠান্ডা লেগেছে বলেই মনে করেছিল। রাতে তাঁর জ্বর আসার কারণে ওষুধ খেয়েছিল। পরের দিন ঘুম থেকে ওঠার পর আর দু’হাতে আর জোর পায় না সে। একথা শুনে তৎক্ষণাৎ ছেলেকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান মা। সেখানে চেয়ারে বসে থাকা অবস্থাতেই নাবালক পড়ে গিয়েছিল বলেই জানা গিয়েছে। তখনই চিকিৎসকের পরামর্শে তড়িঘড়ি পড়ুয়াকে বারাসত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তৎক্ষণাৎ শুরু হয় চিকিৎসা। কলকাতার ভালো হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর কথা পরে পরিবারকে জানানো হয়। সেই মতো কলকাতার এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করানো হয় তাঁকে। তারপর বেলা যত গড়িয়েছে, শরীর তত অচল হতে শুরু করে তার। রাতের খাওয়ার ক্ষমতাটুকু ছিল না শরীরে। শুক্রবার তাঁকে আই সিসিইউতে স্থানান্তরিত করা হয়। তারপর থেকে ক্রমাগত শরীরের অবনতি হতে থাকে। গত সোমবার সকালে মৃত্যু হয় ছাত্রের। মৃতের মা বলেন, “হাসপাতালের তরফে একটা ইনজেকশন দিতে হবে জানিয়েছিল। কিন্তু সেটা হাসপাতালে ছিল না। যত টাকা লাগুক আমরা বাইরে থেকে এনে দেব বলেছিলাম, কিন্তু অনুমতি দেয়নি।” তিনি আরও বলেন, “হাসপাতালের তরফে আমাদের জানায় জিবিএসে আক্রান্ত হয়েই মৃত্যু হয়েছে ছেলের।
এই প্রসঙ্গে আরামবাগ প্রফুল্ল চন্দ্র সেন মেডিক্যাল কলেজের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. সুব্রত ঘোষ বলেন, “এই রোগ নতুন নয়। রাজ্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অত্যন্ত সুসজ্জিত। যে কোনও পরিস্থিতিকে সামলানোর জন্য পরিকাঠামোগত ভাবে যথেষ্ট স্থিত অবস্থায় রয়েছে। এ নিয়ে নতুন করে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। “গুলেন বারে সিনড্রোম (ইংরেজি Guillain-Barré syndrome) বা ল্যান্ড্রির প্যারালাইসিস, প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণকারী অ্যাকিউট বা তীব্র পলিনিউরোপ্যাথি রোগ, যার ফলে হাত-পা খুব দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে। কোনো সংক্রমণ বা ইনফেকশনের পর এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। অনুভূতিতে ভিন্নতা কিংবা ব্যাথার পর হাতে এবং পায়ে দুর্বলতা দেখা যায় যা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। রোগ খুব তীব্র হলে প্রাণঘাতী হতে পারে, তখন কৃত্তিমভাবে শ্বাসকার্য চালানোর জন্য ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট বা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। কিছু ব্যক্তির স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রে ডিসঅটোনমিয়া হলে হৃদ স্পন্দন ও রক্তচাপে গোলযোগ দেখা যায়।ক্লিনিক্যালি এই রোগ অন্যান্য বিকল্প কারণ ব্যতিরেকে স্নায়ু পরিবহন পরীক্ষা ও সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়। যাদের অবস্থা সংকটাপন্ন, তাদের আন্তঃশিরা ইম্যুনোগ্লোবিউলিন বা প্লাসমাফেরেসিসের মাধ্যমে নিবিড় পর্যবেক্ষণে উত্তরণ হওয়া সম্ভব, যদিও কিছু ব্যক্তির ব্যাথা, হাঁটাচলায় সমস্যা থাকতে পারে।
উল্লেখ্য, গুলেন বারে সিনড্রোম বিরল, প্রতি ১,০০,০০০ জনে এক/দুটি ঘটনা দেখা যায়। এই রোগের নামকরণ ফরাসি চিকিৎসক জর্জ গুলেন ও জিন আলেকজান্ডার বারির অনুসরণে হয়েছে, যারা ১৯১৬ সালে আন্দ্রে স্ট্রোলের সাথে বর্ণনা করেছিলেন। মনে রাখতে হবে গুলেন বারি সিনড্রোমের প্রথম দিকে অসাড়তা, ব্যাথা থাকতে পারে। এর পরবর্তীকালে দেহের উভয় পাশের হাত পা সময়ের সাথে সাথে দূর্বল হয়ে যায়। এই দূর্বলতা একদিন থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে তীব্র আকার ধারণ করে স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে। পাঁচজনে একজনের দুর্বলতা ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত অগ্রসর হতে থাকে। ঘাড়ের পেশীও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং অনেকেরই কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের অসাড় হয়ে যাবার কারণে মুখের পেশি দুর্বল, খাবার গিলতে অসুবিধা, চোখের পেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। ৮ শতাংশের ক্ষেত্রে দুর্বলতা শুধু পায়েই সীমাবদ্ধ থাকে। সব মিলিয়ে, গুলেন বারি সিনড্রোমে আক্রান্তদের এক তৃতীয়াংশ হাঁটতে পারে। এছাড়া শরীরে বিভিন্ন জায়গা যেমন ঘাড়, পিঠ, কোমর ইত্যাদি জায়গায় ব্যথা থাকতে পারে। প্রসঙ্গত, গুলেন বারি সিনড্রোম হতে কিছু জটিলতা, যেমন- তীব্র সংক্রমণ বা ইনফেকশন, রক্তজমাট ইত্যাদি কারণে মৃত্যু হতে পারে। অধিকাংশ রোগীর প্রথম এক থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত লক্ষণ বেশি দেখা যায়। চতুর্থ সপ্তাহ থেকে অবস্থার উন্নতি হতে থাকে, কিন্তু এই উন্নতির হারের কিছু হেরফের আছে। ৮০% মানুষই কয়েক মাস থেকে বছর খানেকের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠে, যদিও সামান্য কিছু ছোটোখাটো সমস্যা থাকতে পারে। সুস্থ হয়ে উঠার পরও প্রায় ৫-১০% মানুষের কিছু শারীরিক অক্ষমতা দেখা যায়। আবার ৫-১০% মানুষের পরবর্তিতে পুনরায় রোগাক্রান্ত হবার আশঙ্কা আছে।
ফরাসি চিকিৎসক জা ব্যাপ্টিস্ট অক্টাভ ল্যান্ড্রি এই অসুখ সম্পর্কে ১৮৫৯ সালে বর্ণনা করেন। ১৯১৬ সালে জর্জ গুলেন, জিন আলেকজান্ডার বারি এবং আন্দ্রে স্ট্রোল দুজন সৈনিকের মাঝে এই অসুখ লক্ষ্য করেন এবং রোগের প্রধান শনাক্তকারি বৈশিষ্ট্য কোষ থেকে অ্যালবুমিন বিচ্ছিনকরণ বা albuminocytological dissociation নিয়ে আলোচনা করেন। এই রোগের প্রধান উপসর্গ হল — হাঁটাচলায় সমস্যাই গুলেন বারি সিনড্রোমের প্রধান উপসর্গ। পা দুর্বল লাগবে। পরে ধীরে ধীরে শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গ অকেজো হতে শুরু করবে। দ্বিতীয়ত, যত সময় এগোবে, ততই শারীরিক দুর্বলতা বাড়তে থাকবে। সেক্ষেত্রে ওঠাবসা, হাঁটাচলা সবেতেই সমস্যায় পড়বেন আক্রান্তকারী। তৃতীয়ত, গুলেন বারি সিনড্রোম বা জিবিএসে আক্রান্ত হলে পক্ষাঘাতও হতে পারে। চতুর্থত, শ্বাস নেওয়ার হার বেড়ে যাওয়া, শ্বাস নিতে সমস্যা হলে গুলেন বারি সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।আক্রান্ত ব্যক্তির আঙুল এবং পায়ের তলায় জ্বালা অনুভব হতে পারে। পঞ্চমত, যাঁরা গুলেন বারি সিনড্রোমে আক্রান্ত ধীরে ধীরে মুখ বেঁকে যেতে পারে। ষষ্ঠত, গুলেন বারি সিনড্রোমে আক্রান্তদের কথাও জড়িয়ে যেতে পারে। সপ্তমত,রক্তচাপ অত্যাধিক হারে বেড়ে যাওয়া গুলেন বারি সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ। তাই শারীরিক দুর্বলতা, হাঁটাচলায় সমস্যা অনুভব করলেই রক্তচাপ পরীক্ষা করে দেখতে হবে। অষ্টমত, গুলেন বারি সিনড্রোমের ফলে প্রস্রাবে জ্বালা, এমনকী বারবার সংক্রমণজনিত সমস্যাতেও ভুগতে হতে পারে। নবম, বিরল স্নায়ুরোগের ফলে বুকে জ্বালা। হজমের সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. পীতবরণ চক্রবর্তীর মতে গুলেন বারি সিনড্রোম থেকে বাঁচতে অবিলম্বে সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। অযথা চিন্তা ভাবনা করার করার প্রয়োজন নেই। এই রোগের উদ্বেগের কোনও কারণ নেই। যেটা করার দরকার ঘন ঘন হাত পরিষ্কার রাখতে হবে। রাস্তার কাটা ফল, স্যালাড খাওয়া বন্ধ করুন। রান্না করা খাবার খেতে হবে। উপসর্গ দেখলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। চিকিৎসকদের মতে, নার্ভ কন্ডাকশন ভেলোসিটি টেস্ট এবং সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড — এই দুটি পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ চিহ্নিত করা সম্ভব। রোগীকে সারাক্ষণ নজরে রাখতে হবে। তাকে ভর্তি করতে হবে হাসপাতালে। ভেন্টিলেশনের সুবন্দোবস্ত রয়েছে এমন হাসপাতালেই ভর্তি করতে হবে তাকে। ইন্ট্রাভেনাস ইমিউনোগ্লোবিউলিন এবং প্লাজমা থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা হয়। বহু ক্ষেত্রে রোগী সুস্থ হয়েও বাড়ি ফেরে। তবে সময়মতো সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত না হলে গুলেন বারি সিনড্রোম প্রাণঘাতী রূপ নিতে পারে।হাঁটাচলায় সমস্যাই গুলেন বারি সিনড্রোমের প্রধান উপসর্গ। পা দুর্বল লাগবে। পরে ধীরে ধীরে শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গ অকেজো হতে শুরু করবে। যত সময় এগোবে, ততই শারীরিক দুর্বলতা বাড়তে থাকবে। সেক্ষেত্রে ওঠাবসা, হাঁটাচলা সবেতেই সমস্যায় পড়বেন আক্রান্তকারী। গুলেন বারি সিনড্রোম বা জিবিএসে আক্রান্ত হলে পঙ্গাঘাতও হতে পারে। শ্বাস নেওয়ার হার বেড়ে যাওয়া, শ্বাস নিতে সমস্যা হলেও গুলেন বারি সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
উল্লেখ করা যেতে পারে ‘গুলেন বারি সিনড্রোম’ বা জিবিএসে আক্রান্ত আরও দুই রোগীর মৃত্যুর খবর সামনে এসেছে। ফলে রাজ্যে এবার এই উপসর্গে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল তিন। সোমবার মৃত্যু হয়েছিল আমডাঙার এক কিশোরের। বুধবার মারা গেলেন ধনেখালির ভবানীপুর গ্রামের বাসিন্দা সতীনাথ লোহার (৪৮)। এছাড়াও ভাটপাড়া এলাকায় এক নাবালকেরও মৃত্যুর খবর জানা গিয়েছে। বুধবার সকালে ধনেখালি থেকে কলকাতায় চিকিৎসা করাতে নিয়ে আসার পথে অবস্থার অবনতি হলে সতীনাথ লোহারকে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসক শুভ্র ভট্টাচার্যের আশঙ্কা, ওই ব্যক্তি গুলেন বারি সিনড্রোমে আক্রান্ত। শেষমেশ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসা চলাকালীন মৃত্যু হয় রোগীর।
যদিও তাদের নিয়ে অহেতুক উদ্বেগের কারণ নেই বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. জয়দেব রায়। তিনি বলেন, সারা বছরই এই বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে কিছু শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়। স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগম বলেন, জিবিএসের অস্বাভাবিক বাড়বাড়ন্ত এখনও বিশেষজ্ঞদের চোখে পড়েনি। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের সঙ্গে এই নিয়ে বৈঠক করা হয়েছে। পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছি আমরা।