জীবনযাত্রার বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে বাঙালির রুচি আর সেই মতো বদল এসেছে তাদের খাওয়া দাওয়া। আমরা এখন অনেক বেশি হেল্থ কন্সাস। তাই হেলদি ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে হেলদি ডিনারের প্রতি আমাদের মন।
কোভিড (COVID-19) পরবর্তী কালে বিশ্বজুড়েই সকলেই এখন ভীষণ রকম স্বাস্থ্য (Health Tips) সচেতনতা। ফলস্বরূপ বদল এসেছে আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোতেও। সুন্দর, সুস্থ জীবনযাত্রার জন্য যে নিজের শরীরের যত্ন নিতে হবে এই সারমর্ম কিন্তু সকলেই বুঝেছেন। আর তাই নিয়ম মেনে খাওয়া, সময়ে খাওয়া, রোজ শরীরচর্চা এসব আগের তুলনায় এখন অনেকটাই বেড়েছে।
কোভিডের সময় দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকায় কম বেশি রন্ধন পটিয়সী হয়ে উঠেছেন। বাড়িতেই চাইনিজ থেকে কন্টিনেন্টাল সবই বানিয়ে ফেলছেন। বেড়েছে হোম বেকারের সংখ্যাও। এমনকী অনেকেই বাড়িতে হরেক কেক, কুকিজ, পেস্ট্রি, চকোলেট বানিয়ে তা বিক্রিও করছেন। বিশ্বব্যাপী বেড়েছে এই বেকারি দ্রব্যের চাহিদাও। লকডাউনে যে আর্থিক মন্দা এসেছিল তা যেন খাদ্য শিল্পের মাধ্যমেই আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। মার্কেট সার্ভে বলছে ২০২১-২০২৬ সালের মধ্যে CAGR- বৃদ্ধি পাবে ২.৬ শতাংশ পর্যন্ত।
সম্প্রতি এই খাবারের ট্রেন্ড নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। আর সেখানেই দেখা গিয়েছে, লোকজনের গ্লুটেন ফ্রি,. সুগার ফ্রি খাবারের প্রবণতা এবং প্রাণীজ প্রোটিনের (animal protein) থেকে উদ্ভিজ প্রোটিনের (vegetable protein) প্রতি ঝোঁক বেড়েছে। সেই সঙ্গে ভেষজ খাবারের চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামী দিনে বিশ্বব্যাপী খাবারের ব্র্যান্ডগুলিও উদ্ভিজ প্রোটিনকে বেশি গুরুত্ব দেবে, এমনটাই দেখা যাচ্ছে।
এখন সকলে এমন খাবারের খোঁজ করছেন যাতে খিদেও মিটবে আর শরীর পুষ্টি পাবে। সেখান থেকেই কিন্তু ওটস, কুইনোয়া (quinoa), চিয়া সিডস, ফ্ল্যাক্সসিডসের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। অনেকেই আটার সঙ্গে মিশিয়ে নিচ্ছেন ওটস বা আমন্ডের গুঁড়ো। ওটস, ফল, দুধ, চিয়াসিডস দিয়ে স্মুদি খাবার ঝোঁক বেড়েছে আগের তুলনায় অনেকখানি।
ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অনেকেই বিদেশি খাবার, ফল, শস্যদানা এসব পছন্দ করতেন। কিন্তু লকডাউন পরবর্তী সময়ে সকলেই মজেছেন দেশি খাবারে। অঞ্চলভেদে যে সব ফল, সবজি পাওয়া যায়, সারা বছর বাজারে পাওয়া যায় এমন সবজির দিকেই ঝোঁক বাড়ছে। শাক খাবার প্রবণতাও বেড়েছে আগের থেকে।
চিনি আমাদের শরীরের জন্য খারাপ। অনেকেই চিনি খান না। আবার এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা একচামচ চিনি ছাড়া বাঁচতেই পারেন না। আর তাই ব্যবহার বেড়েছে চিনির সাবস্টিটিউটের। গুড়, জাগেরি পাউডার, স্টেভিয়া এসবই এখন বেশি লোকেরা ব্যবহার করছেন।
উদ্ভিদ প্রোটিন বা প্ল্যান্ট মিট :
যতই আমিষাশীরা নাক কুঁচকোন না কেন এই ট্রেন্ড নিয়ে, ইতিমধ্যেই ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে প্ল্যান্ট মিট। ভেগান (vegan) এই মাংস স্বাদে গন্ধে একবারে আসল মাংসের মতই, তবে তা নকল। রেস্তোরাঁ থেকে ক্যাফেতে বার্গার থেকে পপকর্ন সবেতেই প্লান্ট মিট আরো বেশি করে দেখতে পাওয়া যাবে আগামী বছর। এর জন্যই ‘ফ্লেক্সিটেরিয়ান’ (Flexitarian) ডায়েট এবছর জনপ্রিয় এতো হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে সামনে বছরের এই ট্রেন্ড বজায় থাকবে।
উদ্ভিদ প্রোটিন আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদ্ভিদ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার (অবশ্যই উদ্ভিদ-ভিত্তিক) যেমন কুইনো, টোফু, সয়া, লেগুম, বাদাম ইত্যাদি মাংসের চেয়ে এগুলি বেছে নেওয়ার প্রবণতা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। উদ্ভিদ প্রোটিন ফাইবার, ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস এবং ভিটামিন এবং খনিজগুলির মতো পুষ্টিতে সমৃদ্ধ।
বাজরা (Pearl Millet) : ২০২৩ সালকে বাজরার বছর হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। এখন অনেক শেফই বাজরা দিয়ে কিছু পুরানো কিছু নতুন ফিউশন রেসিপি ফিরিয়ে আনতে দেখা যায়। স্যালাড থেকে পাস্তা এবং রুটি পর্যন্ত, শেফরা বেস হিসাবে বাজরা ব্যবহার করে কিছু সত্যিই অভিনব আকর্ষণীয় রেসিপি তৈরি করছে ।
পুষ্টিগত উপকারিতা : বাজরা ফাইবার, প্রোটিন, জিঙ্ক, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস, ভিটামিন এবং খনিজ পুষ্টিতে ভরপুর। এগুলি গ্লুটেন-মুক্ত এবং ডায়াবেটিস পরিচালনা করতে, কোলেস্টেরল কমাতে এবং হজমশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। অ্যানিমিয়ার মতো সমস্যার সমাধানে, হৃদরোগকে নিয়ন্ত্রণ করতে বাজরার ভুমিকা অনবদ্য।
পোট্যাটো মিল্ক বা আলুর দুধ:
ওট মিল্ক, ওট, কাজুর ,আমন্ড মিল্কের পর গত বছর থেকে বিখ্যাত হয়েছে পোট্যাটো মিল্ক। নতুন খাবারের এই ট্রেন্ড দুধ খান না, নিরামিষভোজী, বিশেষত ভেগান মানুষদের মধ্যে পপুলারিটি বেড়েছে। আপাতদৃষ্টিতে আলুর মতো স্বাদও নয় এটির! হজমশক্তি বাড়াতে, কোষ্ঠকাঠিন্য, ফোলাভাব বা পেট ফাঁপার ভোগান্তি থেকে আলুর দুধ আপনাকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে।
খেঁজুর : কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসা খেঁজুর এখন সুপারফুড হিসাবে ফিরে আসছে। এটি মিষ্টান্ন এবং বেকড খাবারে পরিশোধিত চিনির বদলে ব্যবহার হয়। আজকাল মেনুতে খেঁজুর ব্যবহার করে প্রচুর নতুন রেসিপি তৈরি করতে দেখা যায়। শরীর গরম করার পাশাপাশি এটি ডায়াবেটিস, সায়াটিকা, কোষ্ঠকাঠিন্য সহ অনেক মারাত্মক রোগের মোক্ষম হাতিয়ার।
পুষ্টিগত উপকারিতা: এতে উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি দীর্ঘস্থায়ী রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে।মহিলারা ঋতুস্রাবের সময় পেট ব্যথা, পিঠে ব্যথা নানান সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে প্রতিদিন খেজুর খেতে পারেন।এছাড়াও, ঋতুস্রাব পরিস্কার হয়।
মরিংগা : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মরিঙ্গাকে সুপার ফুডের আওতায় ফেলেছে বছর তিনেক আগেই। ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন এবং ভিটামিন-এ, ডি, সি সমৃদ্ধ মরিংগা অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একাই একশো।
তাই চকলেট বার নানা রকমের ডেসার্ট প্রোটিন বারে অনেকদিন ধরেই ব্যবহার করা হচ্ছে এটিকে। সামনে বছরের এই ট্রেন্ড বজায় থাকবে। কলার থেকে সাত গুণ বেশি ভিটামিন-সি আর পনেরো গুণ বেশি পটাশিয়াম রয়েছে এতে।
আসলে কোভিড আমাদের সকলের চোখ খুলে দিয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতেই ফুড ব্লগিং এখন বেশ জনপ্রিয়। কম খরচে হাতের কাছে পাওয়া উপাদান দিয়ে খাবার তৈরি প্রবণতা বেড়েছে। বিদেশি ফল সবজির পরিবর্তে যেমন —পার্সিমনের পরিবর্তে আপেল, কিউয়ীর এর পরিবর্তে পেয়ারা খাওয়ার দিকে মানুষ বেশি ঝুঁকেছে, ঝুকবেন।
স্ট্রেস মোকাবেলা করার জন্য এবং তাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মানুষের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। আশা করা যায়, কিছু পুরানো এবং কিছু নতুন, তবে অবশ্যই স্বাস্থ্যকর এবং সুস্বাদু খাবার ট্রেন্ড হবে ২০২৩-এ।
পেজ ফোরের তরফ থেকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা রইলো সকলের জন্য। সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন সুষম খ্যাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন।
Source: Various sources have been referred to for information
চিকেন পুড়া বেশ সুস্বাদু খাবার।
তবে নিয়মিত খাওয়া স্বাসথ্যসম্মত নয়।