সালটা ১৮৭৯। বর্তমান মোহনবাগান মাঠের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। বয়সে তিনি তখন একজন বালক।হঠাৎ একটি বল রাস্তার উপর গড়িয়ে আসে। তিনি বলটিকে দেখতে পেয়ে তড়িঘড়ি লাথি মেরে মাঠে পাঠিয়ে দেন। সাহেবরা চিৎকার করে মাঠ থেকে বলেছিলেন, ‘কিক ইট বয়, কিক ইট’। ইনি হলেন বাঙালির মগজে ও মনে ফুটবলকে পরিচিত করার সর্বপ্রথম পুরুষ। এক কথায় ভারতীয় ফুটবলের জনক। আবার দর্শক ও খেলোয়ারদের কাছে ‘হুজুর’ নামেও পরিচিত। যার নাম নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী। এই কিংবদন্তী খেলোয়ারকে হয়তো অনেকে ভুলে গেছেন। ইংরেজ রাজত্বে বাঙালিদের ভীতু, কাপুরুষ ও অকর্মণ্য ভাবতো। এই ইংরেজদের মুখের উপর জবাব পায়ের মাধ্যমে দিয়েছিলেন ফুটবলার নগেন্দ্র। তিনিই বিশ্বের দরবারে ভারতীয় ফুটবলের বার্তা দিয়েছিলেন। আজ তাঁর ১৫৩ তম জন্মবার্ষিকী।
বাংলা-সহ দেশ জুড়ে কতটা তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করবে সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। আদি নিবাস হুগলির খানাকুলের রাধানগর গ্রামে। যেখানে আধুনিক নবজাগরণের পথিকৃৎ রামমোহন রায় জন্মেছেন। সেখানেই আর এক কিংবদন্তি খেলোয়ারের আর্বিভাব। তাঁর এখানে কোনও স্মৃতিসৌধ নেই, ফলে শ্রদ্ধা জানানোরও কেউ নেই। তাঁর নামে এখানে কিছু গড়ে ওঠেনি। ফলে হতাশ এখানকার মানুষ। এমনকি এ রাজ্যেও উল্লেখযোগ্য তাঁর নামে কিছু হয়নি। এইক্ষেত্রে আমরা তাঁর স্মৃতির কাছে লজ্জিত। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নগেন্দ্রপ্রসাদ অজানা রয়ে যাবে। তিনি যে দাগ কেটে গেছেন দেশের বুকে, সে দাগ কেউ কখনও মছুতে পারবে না ঠিকই, কিন্তু সেই দাগের উপর আস্তরণ পড়বে। আমাদের দুর্ভাগ্য সেটাই আমাদের দেখতে হবে। আজ জন্মদিনে বড্ড বেশি করে সেদিনের ইতিহাস মনে পড়ছে। যেদিন নগেন্দ্রপ্রসাদ বুঝিয়ে দেন বাঙালির খালি পায়ে লাথি বুট — পরা লাথির চেয়ে অধিক শ্রেষ্ঠ।
জন্ম ২৭ অগাস্ট, ১৮৬৯। নগেন্দ্রপ্রসাদের বাবা সূর্যকুমার সর্বাধিকারী ফ্যাকাল্টি অফ মেডিসিনে প্রথম ভারতীয় ডিন ছিলেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায় নগেন্দ্রপ্রসাদের খেলার মাঠে পা। কলকাতায় পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাকে ভালোবেসে ফেলেন। তাঁর উদ্যোগেই বাঙালি তো বটেই ভারতীয়দের মধ্যে ফুটবল জনপ্রিয় হয়। ফুটবলপ্রেমী ও খেলোয়ার হিসেবে নগেন্দ্রপ্রসাদের উল্লেখযোগ্য অবদান হল অনেকগুলি ক্লাব ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা।
প্রসঙ্গত, খুব কম সময়ের মধ্যে তিনি বাংলার অদ্বিতীয় সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে বিখ্যাত হন। তাঁর প্রতিষ্ঠা করা ওয়েলিংটন ক্লাব গড়েরমাঠে দেশীয় ব্যক্তিদের প্রথম খেলার তাঁবু। তিনি এই ক্লাবে ফুটবল, ক্রিকেট, রাগবি, হকি ও টেনিস খেলার ব্যবস্থা করেছিলেন। এছাড়া বয়েজ ক্লাব (ভারতের প্রথম ফুটবল সংগঠন), ফ্রেন্ডস ক্লাব, হাওড়া স্পোর্টিং ক্লাব, প্রেসিডেন্সি তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত সৃষ্টি। এই সমস্ত ক্লাবে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই খেলতে পারত। আবার তিনি ১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত শোভাবাজার ক্লাবের সম্পাদক হয়েছিলেন। এখানেই থেমে যায়নি খেলার পথচলা। হাওড়াতে বন্ধু বামাচরণ কুণ্ডুর সঙ্গে ভারতের প্রথম ফুটবল প্রতিযোগিতা ‘ট্রেডস কাপ’ আয়োজন করেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় ক্রিকেট হ্যারিসন শিল্ড প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল এবং সাহেবদের জন্য প্রতিষ্ঠিত ক্লাবে দেশীয়দের প্রতিযোগিতা করার রাস্তা খুলে গিয়েছিল। উল্লেখ্য, আই এফ এ শিল্ড গঠনে উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র ভারতীয়।
প্রসঙ্গত, ১৮৯২ সালে শোভাবাজার ক্লাব ইউরোপীয় সমস্ত ক্লাবকে পরাজিত করে ফ্রেন্ডস কাপ জয় করে। পরের বছর অর্থাৎ ১৮৯৩ সালে আইএফএ শিল্ডে শোভাবাজার ক্লাব একমাত্র ভারতীয় দল হিসেবে অংশগ্রহণ করে। যার মধ্যমণি ছিলেন নগেন্দ্রপ্রসাদ। খেলাজীবনে ৭০০-র বেশি ম্যাচ খেলেন। কেবল ফুটবল নয়, পারদর্শী ছিলেন ক্রিকেটেও। তিনি প্রথম ভারতীয় বোলার যিনি ইংরেজদের সঙ্গে খেলায় ওভারহেডিং বোলিং করতে পারতেন। আবার বাঙালি যুবকদের নিয়ে রাগবি দল তিনিই প্রথম তৈরি করেছিলেন। এই কিংবদন্তি নগেন্দ্রপ্রসাদ ভারতীয় ফুটবলের জনক ও ক্লাব ফুটবলেরও পথিকৃৎ। জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করতেই হয়।