দোল উৎসবের দিনে এক ভাবনার জন্ম। কিন্তু ভাবনার কথা এখন থাক, আগে দোল নিয়ে খোলসা করে কিছু বলা যাক। ফাল্গুনী পূর্ণিমায় এই উৎসব। প্রথমে ন্যাড়া (মেড়া) পোড়া, তারপর দোল, আর তারপরে হোলি। উৎসবের সময়কালটা দেখুন। বসন্ত। শীত নয়, গ্রীষ্ম নয়, নাতিশীতোষ্ণ। আর এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাধা-কৃষ্ণের অনুযঙ্গ। আর প্রেম।
বাংলার বাইরে রাধা-কৃষ্ণ দেবতা হয়ে বিরাজ করতে পারেন, কিন্তু বাংলায় তাঁরা প্রেমের প্রতিরূপ। আদর্শ প্রেমিক-প্রেমিকা। বাংলায় কৃষ্ণের ঐশ্বর্যরূপ একদম খাপ খায় নি। মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ তাই আপামর বাঙালি গ্রহণ করে নি। প্রেমের সঙ্গে ঋতুর যোগ স্বাভাবিক। বসন্ত তাই প্রেমের ঋতু। মনের কালিমা ভুলে, বিদ্বেষ ভুলে দোলের দিনে মিলিত হবে সবাই। বাংলা সব উৎসবের মধ্যে এই মিলনের সুরটা সবচেয়ে বড়।
কালিদাসের ‘শকুন্তলা’য়, শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিকে’, ‘মালবিকাগ্নিমিত্রে’, হর্ষের ‘রত্নাবলী’তে, জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দে’, শ্রীজীব গোস্বামীর ‘শ্রীগোপালচম্পু’তে, কবি কর্ণপুরের ‘আনন্দবৃন্দাবনচম্পু’তে দোল উৎসবের বর্ণনা আছে। উৎসবটির প্রাচীনত্ব বোঝানোর জন্য এই সব বই-এর উল্লেখ করলাম।
কৃষ্ণ বা রাধার উপর যতই দেবত্ব আরোপ করা হোক না কেন, দোল উৎসব ছিল অসাম্প্রদায়িক উৎসব। পাঠান ও মোগল আমলে মুসলমানরাও এই উৎসবে সামিল হতেন। প্রমাণ? প্রমাণ মানুচির লেখায়, প্রমাণ আলেকজাণ্ডার হ্যামিলটনের লেখায়। সেসব লেখায় দেখা যায় রাজস্থানে হোলির উন্মাদনা। সুর্মায়, আতরে, রঙিন পাগড়িতে সুসজ্জিত হয়ে পাঠান সেনাপতি কেতুনগড়ে আসেন হোলি খেলতে। আকবর আর জাহাঙ্গীরের আমলে এই উৎসবের জৌলুস ছিল নয়নলোভন। হুমায়ুন তো মিলিয়ে দিয়েছিলেন পারস্যের ‘নওরোজে’র সঙ্গে ‘হোলি’কে।
দোলের আগের দিনে যে হোলিকা দহন বা ন্যাড়া (মেড়া) পোড়া হয়, তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে হিরণ্যকশিপু ও প্রহ্লাদ ও হোলিকার কথা। হোলিকা দহনের মূল কথাটি হল অশুভ শক্তির বিনাশ।
এবার বলি ভাবনার কথা।
বলেছিলাম উৎসবের সঙ্গে ঋতুর যোগ আছে। দোল ও হোলির সঙ্গে যোগ আছে বসন্তের। কিন্তু সে বসন্ত কি আর আছে? কোথা হা হন্ত চিরবসন্ত আমি বসন্তে পুড়ি। বর্যের মতো, শরতের মতো, শীতের মতো, বসন্তকেও গ্রাস করেছে গ্রীষ্ম। কেন? কারণ মানুষের অত্যাচারে গ্লোবাল ওয়ার্মিং। এই উৎসবে আমরা কি ভেবে দেখছি সে কথা? আমরা কি প্রকৃতির প্রতিশোধের কথা ভেবে শিহরিত?
দ্বিতীয় ভাবনা প্রেমকে নিয়ে। প্রেম কি ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে না এই উন্নততর পৃথিবীতে? চারদিকে দেখছি বিদ্বেষের বিষবাষ্প, ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের একমাত্র আয়োজন, প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়, শৈশবের অকালমৃত্যু ; রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে, ধর্মে-ধর্মে, জাতিতে-জাতিতে হানাহানি। ইন্টারনেটে আর মুঠোফোনে পৃথিবী আজ হাতের মুঠোয়, ‘থার্ড ওয়েভে’র লেখক কল্পনা করেছিলেন ‘গ্লোবাল ভিলেজে’র। অথচ বাস্তবে দেখুন মানুষ আজ কত নিঃসঙ্গ, বৈদ্যুতিক আলোর ঝকমকানির মধ্যে কি নিবিড় অন্ধকার! কেন প্রমোদে (উন্নয়নে) ঢালিয়া দিনু মন/মন কেন কাঁদেরে।
দোল উৎসবের অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেছিলাম। আজ আমাদের দেশে কি শুনছি? শুনছি বিভাজনের কথা। যত মত তত পথ নয়, এক মত এক পথের কথা। তাই আজ রবীন্দ্রনাথের মতো কোন বাউল এসে যদি গান ধরেন, ‘ওরে ও গৃহবাসী/খোল দ্বার খোল/লাগল যে দোল’, তাহলে স্বার্থমগ্ন, বিভাজনপ্রমত্ত মানুষ সেই গায়ককে ‘ছিটেল’ বলতে দ্বিধা করবে না।
ন্যাড়াপোড়ায় অংশগ্রহণ করি আমরা, খড় বা কাঠের তৈরি অশুভ শক্তির প্রতীক যখন পুড়ে ছাই হয়ে যায়, তখন উল্লাস ও উত্তেজনা বোধ করি; কিন্তু বাস্তবের অশুভ শক্তির সঙ্গে সমঝোতা করে চলি। উলঙ্গ রাজারা দাপিয়ে বেড়ান, বলে যান ‘নিন্দারে করিব ধ্বংস কণ্ঠরুদ্ধ করি’ — আমরা তখন দেঁতো হাসি হেসে পাশ কাটিয়ে যাই।