বাঙালি লেখকদের সৃষ্টিশীলতায় বাংলা সাহিত্য আজ চরমভাবে ঋদ্ধ। সেলিনা হোসেন এমনই একজন বাঙালি লেখক যিনি লেখালেখির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে ঋদ্ধতার চরম স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। তিনি তার মেধা, মনন, চিন্তা চেতনা, বাস্তবতা ও কল্পনার মিশেলে বাংলা সাহিত্যেরভাণ্ডারকে পরিপূর্ণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলা সাহিত্যে তিনি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে অবদান রেখে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠত করতে সক্ষম হয়েছেন।
সেলিনা হোসেন ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন রাজশাহী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস বৃহত্তর নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুর জেলার হাজিরপাড়া গ্রামে। তার বাবা এ কে মোশাররফ হোসেনের আদিবাড়ি নোয়াখালী হলেও চাকরিসূত্রে বগুড়া ও পরে রাজশাহী থেকেছেন দীর্ঘকাল। একারণে সেলিনাকে একেবারে ছেলেবেলায় নোয়াখালীতে বেশিদিন থাকতে হয়নি। সেলিনা হোসেনের মায়ের নাম মরিয়ম-উন-নিসা বকুল। মোশাররফ-মরিয়ামুন্ননেছা দম্পতির সব মিলিয়ে নয় ছেলেমেয়ে। সেলিনা ভাইবোনদের মধ্যে চতুর্থ।
সেলিনা ১৯৫৪ সালে বগুড়ার লতিফপুর প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫৯ সালে রাজশাহীর নাথ গালর্স স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬২ সালে তিনি এখান থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে রাজশাহী মহিলা কলেজে ভর্তি হন। কলেজ জীবন শেষ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে বি.এ. অনার্স এবং ১৯৬৮ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ. পাস করেন।
সেলিনা হোসেনের লেখালেখি শুরু স্কুল জীবন থেকে। গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি, তিনি যখন রাজশাহী উইমেন্স কলেজের ছাত্রী তখন বিভাগীয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নশিপ স্বর্ণপদক পান। পরবর্তীকালে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে রাজশাহী প্রথম জীবনে কবিতা দিয়েই সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন। মধ্য ষাট দশকে গল্প লেখা শুরু করেন।
আদর্শবাদের আঙ্গিকে অসাধারণ সৃজনশীলতা ও মৌলিকতায় অনন্যসাধারণ পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছেন তিনি তার গল্প-উপন্যাসে। তার লেখার সংখ্যা অনেক; লেখার বিষয় বহুমাত্রিক। এখানে প্রথমেই তার গল্পগ্রন্থগুলোর নাম করা যায়। তাঁর গল্পগ্রন্থগুলো হলো— উৎস থেকে নিরন্তর (১৯৬৯), জলবতী মেঘের বাতাস (১৯৭৫), খোল, করতাল (১৯৮২), পরজন্ম (১৯৮৬), মানুষটি (১৯৯৩), মতিজানের মেয়েরা (১৯৯৫), অনূঢ়া পূরণিমা (২০০৮), সখিনার চন্দ্রকলা (২০০৮), একালের পান্তাবুড়ি (২০০২), অবেলার দিনক্ষণ (২০০৯) নারীর রূপকথা (২০০৯), নুনপান্তার গড়াগড়ি (২০১৪), মৃত্যুর নীলপদ্ম (২০১৫) ইত্যাদি। তিনি তার লেখা গল্পে পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারেন তার প্রমাণ পাই মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা ‘স্বর্ণচাঁপা’ গল্পটি পড়ে। কিশোর বেলার ভালবাসা অব্যক্ত অভিব্যক্তিতে সেলিনা হোসেন সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন এ গল্পে তা বলে শেষ করা যায় না। তার অনেক গল্পেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দামাল বাঙালি যুবকদের আত্মত্যাগের কথা গল্পে আকারে এমন ভাবে তুলে ধরেছেন যা ইতিহাসের কথা হলেও পাঠকের মনে হবে বাস্তবধর্মী জীবন্ত গল্পকথা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির আত্মত্যাগকে তিনি গল্পের আঙ্গিকে অনবদ্য কাব্যিক গদ্যে উপস্থাপন করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে তাঁর ‘অপেক্ষা’ গল্পের কথা বলা যেতে পারে। মুক্তিয়ুদ্ধেযাওয়া বাবা লাশ হয়ে ফিরলে তার অবুঝ ছোট ছোট মেয়েদুটো ভাবে বাবার লাশের নামই মুক্তিযুদ্ধ। তিনি বেদনাদীর্ণ মৃত্যুকে গল্পের ছলে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন।
সেলিনা হোসেনের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে। ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমির প্রথম মহিলা পরিচালক হন। ২০০৪ সালে তিনি এ পদ থেকে চাকরি থেকে অবসর নেন। তিনি এ বছর (২০২২) বাংলা একাডেমির ৩ বছরের জন্য সভাপতি পদে নিয়োগ পেয়েছেন। ৩৪ বছরের কর্ম সময়ে তিনি বাংলা একাডেমির অভিধান ও বিখ্যাত লেখকদের রচনাবলি প্রকাশের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পাদন করেন। এছাড়াও ২০ বছরেরও বেশি সময় ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।
১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’। স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে এই ক্রান্তিলগ্নে একজন নারীর সাহিত্য গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করাটা ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তিনি বাংলা সাহিত্যে যে বিপুল ও সমৃদ্ধ লেখনী দিয়ে সাহিত্যকেই পুষ্ট করেছেন। তিনি নারী অধিকারবিষয়ক বেশ কিছু প্রামাণিক ও গবেষণাগ্রন্থও রচনা এবং সম্পাদনা করেছেন। যা তার সমাজমনস্কতা ও বৈচিত্র্যকেই নির্দেশ করে। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘জলোচ্ছ্বাস’।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তার জীবন কাটে স্বৈরশাসকের স্বৈরতন্ত্রের প্রতিবাদ করে। স্বাধীনতার পরেও বাংলাদেশে স্বৈরশাসন ফিরে আসে। তিনি কখনোই স্বৈরশাসন মেনে নিতে পারেননি। তাই ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ উপন্যাসে সামরিক শাসনের প্রসঙ্গ নানা কথা উঠে এসেছে। এক বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান তার প্রিয় কন্যা বৈমানিক ফারিহা লারা। তার স্মৃতি থেকে লিখেছেন উপন্যাস ‘লারা’। উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত স্মৃতিজাত হলেও তাতে মা-মেয়ের সম্পর্কের চিরন্তন জায়গাটিই মুখ্য করে তুলেছেন। সাহিত্যে সমাজনিষ্ঠতা থেকেই সেলিনা হোসেন নারীর ক্ষমতায়নে সচেষ্ট। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে তিনি নারীর ক্ষমতায়নের প্রাথমিক ধাপ বলে মনে করেন। এজন্য ‘লারা ফাউন্ডেশন’ নামক একটি সামাজিক উন্নয়ন সংগঠনও গড়ে তুলেছেন।
‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সেলিনা হোসেনের সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস হিসাবে চিহ্নিত। ১৯৭৬ সালে এটি প্রকাশের পরই বোদ্ধাজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে এটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ সেলিনা হোসেনের একমাত্র ট্রিলজি (উপন্যাস ত্রয়ী)। ১৯৯৪ সাল থেকে পরপর এর খণ্ডগুলো প্রকাশিত হয়। এতে তিনি ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ কালপর্বের রাজনৈতিক ঘটনার অভিঘাত চিত্রিত করতে চেয়েছেন। উপন্যাসটির জন্য তিনি ফোর্ড ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ পান। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত তার গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস ‘যাপিত জীবন’। ১৯৮৭ সালে ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশ হয়। প্যারিসের দ্য গল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান লিটারেচার-এর অধ্যাপক পাস্কেল জিন্ক নেট থেকে বইটির ইংরেজি সংস্করণ সংগ্রহ করে অনুবাদের উদ্যোগ নেন, যা ভারতের রূপা প্রকাশনী সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়। তাছাড়া শিকাগোর ওকটন কমিউনিটি কলেজে এই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ চারটি সেমিস্টারে পড়ান হয়। ২০০১ সালে উপন্যাসটি ভারতের কেরালা থেকে মালয়ালাম ভাষায় অনূদিত হয়। তার গল্প – উপন্যাস ইংরেজি সহ নানা ভাষায় অনূদিত হবার কারণে তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে খ্যাতি লাভ করেছেন। প্রসঙ্গত, তার গল্প উপন্যাস ফরাসি, জাপানি, কোরিয়ান, রুশ, উর্দু, হিন্দি, মালয়ালাম, কানাড়ী, মারাঠি, ফিনিস, আরবি, অসমিয়া, উড়িয়া ইত্যাদি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। প্রকাশ থাকে যে সেলিনা হোসেনের ১১টি গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। পাশাপাশি সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন আদিবাসী ভাষায় তাঁর গল্প-উপন্যাস অনুবাদের কাজ চলছে।
তার উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে— জলোচ্ছ্বাস (১৯৭৩), জ্যোৎস্নায় সূর্যজ্বালা (১৯৭৩), হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৭৬) চৈতন্যে শিস (১৯৭৯) যাপিত জীবন জীবন জীবন (১৯৮১), নীল ময়ূরের যৌবন ময়ূরের যৌবন ময়ূরের যৌবন (১৯৮২), পদশব্দ (১৯৮২), চাঁদবেনে (১৯৮৪), পোকা মাকড়ের ঘরবসতি (১৯৮৬), নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি (১৯৮৭), ক্ষরণ (১৯৮৮), কাঁটাতারে প্রজাপতি (১৯৮৯), খুন ও ভালোবাসা (১৯৯০) কালকেতু ও ফুল্লরা (১৯৯২), ভালোবাসা প্রীতিলতা(১৯৯২) টানাপোড়েন (১৯৯৪), গায়ত্রী সন্ধ্যা-১ম খণ্ড (১৯৯৪), ২য় খণ্ড (১৯৯৫), ৩য় খণ্ড (১৯৯৬), দীপাম্বিতা (১৯৯৭), যুদ্ধ (১৯৯৮), লারা (২০০০), কাঠ কয়লার ছবি (২০০১), মোহিনীর বিয়ে (২০০১), আণবিক আঁধার (২০০৩) ঘুমকাতুরে ঈশ্বর (২০০৪), মর্গের নীল পাখি (২০০৫), অপেক্ষা (২০০৭), দিনের রশিতে গিটঠু (২০০৭), মাটি ও শস্যের বুনন (২০০৭), পূর্ণছবির মগ্নতা(২০০৮), ভূমি ও কুসুম (২০১০), যমুনা নদীর মুশায়রা (২০১১), আগস্টের একরাত (২০১৩), গেরিলা ও বীরাঙ্গনা (২০১৪), দিনকালের কাঠখড় (২০১৫) ইত্যাদি। তার একটি কবিতার বইও রয়েছে, নাম ‘বর্ণমালার গল্প’। শিশু সাহিত্যে সেলিনা হোসেন অসাধারণ তার প্রমাণ তার লেখা শিশুতোষ বইগুলো— সাগর (১৯৯১), বাংলা একাডেমী গল্পে বর্ণমালা (১৯৯৪), কাকতাড়ুয়া (১৯৯৬), বর্ণমালার গল্প (১৯৯৭), আকাশ পরী (২০০১), অন্যরকম যাওা (২০০১), যখন বৃষ্টি নামে (২০০২), জ্যোৎস্নার রঙে আঁকা ছবি (২০০২), মেয়রের গাড়ি (২০০৩), মিহিরুনের বন্ধুরা (২০০৪), রংধনু (সম্পাদনা) (২০০৪), এক রুপোলি নদী (২০০৫), গল্পটা শেষ হয় না (২০০৬), বায়ান্নো থেকে একাত্তর (২০০৬), চাঁদের বুড়ির পান্তা ইলিশ (২০০৮), মুক্তিযোদ্ধারা (২০০৯), সোনারতরীর ছোটমণিরা (২০০৯), পুটুসপুটুসের জন্মদিন (২০১০), নীলটুনির বন্ধু (২০১০), কুড়কুড়ির মুক্তিযুদ্ধ (২০১১), ফুলকলি প্রধানমন্ত্রী হবে (২০১১), হরতালের ভূতবাবা (২০১৪) ইত্যাদি। তিনি যে বহুমাত্রিক লেখক তার প্রমাণ মেলে লেখালেখি নানা শাখায় তার অবাধ বিচরণের কারণে। বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে তার ঋদ্ধতার কথা না বললেই নয়। আমরা এখানে তার লেখা প্রবন্ধ সংকলনগুলোর কথা বলতে পারি। সেগুলো হলো— স্বদেশে পরবাসী (১৯৮৫), ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন (১৯৮৫), একাত্তরের ঢাকা (১৯৮৯), নির্ভয় করো হে (১৯৯৮), মুক্ত করো ভয় (২০০০), ঘরগেরস্থির রাজনীতি (২০০৮), নিজেরে করো জয় (২০০৮), প্রিয় মুখের রেখা (২০১০), শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ (২০১০), পথ চলাতেই আনন্দ (২০১৪) ইত্যাদি।
সেলিনা হোসেনের লেখা উপন্যাসের সংখ্যা ৪৩টি। গল্পগ্রন্থ ১৬টি। প্রবন্ধ ১০টি। শিশু সাহিত্য ৩৫টি। ভ্রমণ কাহিনী একটি। প্রবন্ধ গ্রন্থ ১৫টি। এখন আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করবো তার লেখা গল্প ও উপন্যাসে সমকালীন দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও সংকটের যে চিত্র তিনি অংকন করেছেন তা নিয়ে। মুক্তিয়ুদ্ধ পূর্ব ও মুক্তিয়ুদ্ধোত্তর কালপর্বে বাঙালিরা সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট,দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের শিকার হয়েছে বারেবারে। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকবাহিনী বাঙালি জনগোষ্ঠীর উপর যে হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন তার বিবরণ তিনি তুলে ধরেছেন সাবলীল গদ্যে।হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের লেখা প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। এই উপন্যাসের পটভূমি হল মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোরের কালীগঞ্জের একজন মা দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে তাঁর নিজের প্রতিবন্ধী সন্তানকে তুলে দিয়েছিলেন পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে। ১৯৮৭ সালে হাঙর নদী গ্রেনেড ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। এই উপন্যাসটি ২০০৩ সালে ভারতের মালয়ালম ভাষায় অনূদিত হয়ে কেরালা থেকে প্রকাশিত হয়।
২০০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এলিনয় রাজ্যের ওকটন কমিউনিটি কলেজে দুই সেমিস্টারে পাঠ্য ছিল হাঙ্গর নদী গ্রেনেড উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ। পরবর্তীতে হাঙ্গর নদী গ্রেনেড উপন্যাস ইংরেজি অনুবাদ করেন বাংলাদেশ থেকে জ্যাকি কবীর। সেই পান্ডুলিপি পরিমার্জন করেন প্যারিসের দ্য গল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান লিটারেচার-এর অধ্যাপক পাস্কেল জিন্ক। ২০১৬ সালে উপন্যাসটি “রিভার অব মাই ব্লাড” নামে দিল্লির রুপা পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয়। হাঙর নদী গ্রেনেড উপন্যাসটি পড়ে মুগ্ধ হয়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় সেলিনা হোসেনকে তিনটি চিঠি লিখেন। ১৯৭৫ সালের ১৩ আগস্ট হাঙ্গর নদী গ্রেনেড উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুমতি চেয়ে কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় সেলিনা হোসেনকে প্রথম চিঠি লিখেছিলেন। পঁচাত্তরের পনের আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ১৯৭৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নিরাপত্তাজনিত কারণে ছবিটি নির্মাণ না করতে পারার কারণে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম হাঙ্গর নদী গ্রেনেড চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা!’ তার বিখ্যাত উপন্যাস আগেই বলা হয়েছে। এই উপন্যাসে ইতিহাসের কথাই ব্যক্ত করেছেন ঐতিহাসিকের চোখ দিয়ে নয়,কথাশিল্পীর অভিজ্ঞা, বাস্তব ও কল্পনার মিশেলে। ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ তে তিনি সাতচল্লিশ থেকে পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত সময়ের রাজনৈতিক, সামাজিক সংকট,সংঘাত,হানাহানি,দেশত্যাগ, বিশ্বাসঘাতকতার ছবি উপস্থাপন করেছেন,যার আভাস আগেই দেওয়া হয়েছে। সেলিনা হোসেন তার গল্প- উপন্যাসে প্রাচীন কালের কুসংস্কারের অন্ধকারকে আলোয় নিয়ে এসেছেন। এ প্রসঙ্গে তার লেখা ‘ নীল ময়ূরের যৌবন’ এর কথা বলা যেতে পারে।
সেলিনা হোসেনের ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ এক জীবনীভিত্তিক উপন্যাস। চর্যাপদে প্রাচীন সমাজের শিকড়ের সাথে যে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ছিল তার সামগ্রিক চিত্র এখানে ফুটে উঠেছে। ১৯৮৩ সালে ‘নীল ময়ূরের যৌবন ‘ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়। পরবর্তীতে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে’ নীল ময়ূরের যৌবন’ পাঠ্য করা হয়। তার লেখা ‘টানাপোড়েন’ সংঘাত, সংশয়ের দলিল। এই উপন্যাসটি ১৯৯৯ সালে ইংরেজিতে ও ২০০৩ সালে লাহোর থেকে উর্দু ভাষায় প্রকাশ পায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারী দেখভাল করার জন্য শিলাইদহ, পতিসর, শাহজাদপুর এসে বাংলার প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রকৃতি প্রেম নিয়ে সেলিনা হোসেনে লেখা উপন্যাস ‘মগ্নতা’। এই উপন্যাসটি অসমীয়া ও সিংহলী ভাষায় অনূদিত হয়।সেলিনা হোসেনের ‘নারীর রূপকথার গল্প’ উপন্যাস উড়িয়া ভাষায় এবং ‘মোহিনীর বিয়ে’ মালিয়ালাম ভাষায় অনূদিত হয় ২০০১ সালে কেরালা থেকে। এ উপন্যাসে পটপরিবর্তনের সময়কে তুলে ধরেছেন তিনি।
এই উপন্যাসে নাচোল বিদ্রোহ, খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড, বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, এগারো দফা, গণআন্দোলন, নকশাল আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথা বর্ণানা করা হয়েছে। তার ‘যাপিত জীবন’ উপন্যাসে তিনি দেশ ভাগের ফলে নির্মমতা ও বৈশম্যের শিকার একটি পরিবারের যাপিত জীবনের দুর্দশার চিত্র অংকন করেছেন। ‘নিরন্তর ঘন্টা ধ্বনি’ উপন্যাসটিনবাহান্নর ভাষা আন্দলেনর পটভূমিকায় লেখা। ‘কাঠ কয়লার ছবি’ উপন্যাসে তিনি পরিচয় হারানোর গল্প তুলে ধরেছেন। উপন্যাসটি একাত্তরের যুদ্ধশিশু ও সিলেটের চা শ্রমিকদের শোষণ ও বঞ্চনা নিয়ে লেখা। নাচলের তেভাগা আন্দোলনের বিপ্লবী নারীনেত্রী ইলা মিত্রকে নিয়ে লেখা তার অসাধারণ উপন্যাস ‘কাঁটাতারের প্রজাপতি’। সাম্প্রতিক সময়ে ছিটমহল প্রসঙ্গটি নানাভাবেই আমাদের দেশে আলোচিত। লেখক নিজে দহগ্রাম আঙ্গরপোতা এবং পঞ্চগড় এলাকার অনেকগুলো ছিটমহল ঘুরে দেখে এসে সেখানকার জীবনের সংকট ও নিয়ন্ত্রিত জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ‘ভূমি ও কুসুম’ উপন্যাসটি লিখেছেন।
তার সম্পাদিত বইগুলো হলো— নারীর ক্ষমতায়নঃ রাজনীতি ও আন্দোলন (যৌথ) (২০০৩), ইবসেনের নারী(২০০৬)’ ইবসেনের নাটক ও কবিতা (২০০৬), জেন্ডার বিশ্বকোষ (যৌথ) (২০০৬), বাংলাদেশ নারী ও সমাজ (যৌথ) (২০০৭), জেন্ডার ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন (যৌথ) (২০০৭), সাহিত্যে নারীর জীবন ও পরিসর (যৌথ) (২০০৭), জেন্ডার আলোকে সংস্কৃতি (যৌথ) (২০০৭),পুরুষতন্ত্র নারী ও শিক্ষা (যৌথ) (২০০৭),দক্ষিণ এশিয়ার নারীবাদী গল্প (যৌথ) (২০০৮), জেন্ডার ও উন্নয়ন কোষ (২০০৯), ধান শালিকের দেশ (বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত শিশু-কিশোর পত্রিকা, ২২ বছর), ছোটদের অভিধান (বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত) (অন্যতম সম্পাদক) ইত্যাদি। তার লেখা গ্রন্থের মধ্যে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে— Selected Short Stories of Selina Hossain (2007). Published by Bangla Academy, The Shark The River & The Grenade (1987) Published by Bangla Academy. Translated by Abedin Kader. Warp and Woof (1999). ‘টানাপোড়েন’ উপন্যাসের অনুবাদ। Published by Bangla Academy. Plumed Peacock (1st Published -1983. 2nd published -2009). ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাসের অনুবাদ। Translated By Kabir Chowdhury. Fugitive colours (2010)
সেলিনা হোসেন তার সৃজনশীল কাজের জন্য বহু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। সেগুলো মধ্যে বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮০), সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯১৮), একুশে পদক (২০০৯) উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সন্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রিতে ভূষিত করে।অন্যান্য পুরস্কার ও সম্মাননার মধ্যে রয়েছে:
ড: মুহম্মদ এনামুল হক স্বর্ণপদক,আলাওল সাহিত্য পুরস্কার — ১৯৮১, চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৭), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার — ১৯৯৪, অন্যান্য পুরস্কার ও সম্মাননার মধ্যে রয়েছে : ড: মুহম্মদ এনামুল হক স্বর্ণপদক,আলাওল সাহিত্য পুরস্কার — ১৯৮১, চলচ্চিত্র পুরস্কার ইত্যাদি। তাছাড়া ২০১৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রী প্রদান করে।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন এখনো সাহিত্য কর্ম নিরলস ভাবে তার সাহিত্যকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি তার সাহিত্যকর্মের মাঝে বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনে চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন।
৭৬তম জন্মদিনে বাংলা একাডেমির সভাপতি ও কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনকে শ্রদ্ধাঞ্জলি
মনোজিৎকুমার দাস, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা, বাংলাদেশ।
সুসমৃদ্ধ সুদীর্ঘ প্রবন্ধ।
লেখককে ধন্যবাদ।