১৮৫৭ সাল নাগাদ নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে নানা দিকে আন্দোলনের মহড়া শুরু হয়। ১৮৬০ সালে বাংলায় তার চুড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে। নদীয়ার দিগন্ত বিস্তৃত মাঠগুলিতে নীলচাষ হত। নীলচাষীরা দাদন নিয়ে নীলচাষ করতে বাধ্য হতো। নীলচাষে রাজি না হলে তাদের কপালে জুটত নির্মম অত্যাচার। অবাধ্য চাষীদের কুঠিবাড়ি বা কাছারিতে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হত। তার উপর তাদের উপর চলত নির্যাতন। ‘নীলদর্পণ’ নাটকের নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র ছিলেন নদীয়ারই মানুষ। তাঁর লেখনীতে বিষয়টি প্রাণোবন্ত হয়ে উঠেছে। তাঁদের বাড়ি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হত, তাদের হাঁস, মুরগী এমনকি গৃহপালিত পশুরাও বাদ যেত না। বাড়ির মা বোনেদের উপরও চলত নির্যাতন। নদীয়ার গোবিন্দপুর গ্রামের দিগম্বর বিশ্বাস ও চৌগাছার বিষ্ণুচরণ বিশ্বাসের নেতৃত্বে নীল বিদ্রোহ চুড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে। আবার আসাননগরের মেঘাই সর্দার ও বাংলার নীল বিদ্রোহের প্রথম শহিদ বিশ্বনাথ সর্দার বা বিশে ডাকাত, তিনিও নদীয়ার লোক। এদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলার নীল চাষীরা একত্রিত হয়। নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেন। বেতাই উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক তথা লোকসংস্কৃতি ও পুরাতাত্ত্বিক গবেষক শ্রী লোকেশ চন্দ্র বিশ্বাস মহাশয় লিখছেন — “তৎকালীন সময়ে বেতাই নতুন পাড়ার ইউসুফ বিশ্বাস ও বিষ্ণুগঞ্জের বৃন্দাবন দত্ত চাষীদের সংগঠিত করে বেতাই এর নীলকুঠিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।”
— এসবই এখন ইতিহাস। গ্রামের এক প্রাচীন ব্যক্তির মুখ থেকে বেশ কিছু তথ্য হাতে এসেছে সেখান থেকে কিছু লেখার পরিকল্পনা। মানুষটার নাম হীরবল মুন্ডারী। বয়স তার নিজের মতে ১০৭ বছর। তবে খুব একটা কম-বেশি চোখে পড়ে না। তার চোখে এখনও ফুটে ওঠে মাতঙ্গিনীর ভারতছাড়ো আন্দোলনের কথা, কিংবা বিষ্টুগঞ্জের জঙ্গলে বাঘ শিকারের গল্প। তবে বয়সের ভারে ন্যুব্জ, সকল স্মৃতিই ফিকে হয়ে গেছে তার। বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। বেশিরভাগ কথাই তিনি মনে করতে পারছেন না। তবুও ঝকঝকে সাদা দাঁতে হাসিটা এখনো অক্ষত আছে।
বিষ্টুগঞ্জ গ্রামে যে প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ‘বিষ্ণুগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়’ তার প্রতিষ্ঠারও একটা ইতিহাস রয়েছে। এখন যেখানে তারকাঁটার সীমানা তার ওপারে তখন ঘর কয়েক মুসলিম এবং ও জন কয়েক দেবনাথ পদবিধারী পরিবার বসবাস করত। এখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষরা তখন ওখানে চলে এসেছে। তারা বসবাস করছে দল বেঁধে। তখন পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের জমানা শুরু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন সিদ্ধার্থ শংকর রায়। তখন যুব কংগ্রেসের জোর প্রতিপত্তি ছিল গ্রামে-গঞ্জে, শহরের অলিতে গলিতে। তাদের দাপটে তখন বাংলার মানুষ ছিল ভীত, সন্ত্রস্ত। তবে হ্যাঁ এই যুব কংগ্রেসের বেশ কিছু ইতিবাচক দিক ছিল। যে জায়গায় স্কুল ছিল না তারা সমীক্ষা চালিয়ে দেখল সেই সেই জায়গায় স্কুল অর্গানাইজ করা যায় কিনা। এর ফলে সেই সময়টাই অনেক স্কুল স্থাপন করা হয়েছিল। কড়ুইগাছি গ্রামের জনৈক ধর্মদাস বিশ্বাস, যিনি সেই সময় লালবাজার বিএসএফ ক্যাম্পে কর্মরত ছিলেন, তিনি দেখলেন যে এই গ্রামে একটিও প্রাইমারি স্কুল নেই। তখনকার যে কজন ছেলে মেয়ে পড়াশোনা করত, তারা সকলে পড়তে যেত পার্শ্ববর্তী দেবনাথপুর বা তার পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়গুলিতে। শুরু হয়ে গেল তোড়জোড়। কে দেবে স্কুলের জন্য জায়গা? জায়গাও পাওয়া গেল এখনকার তারকাঁটার সীমানার ওপারে। বিষ্টুগঞ্জের বিনয়কৃষ্ণ দে স্কুলের জন্য দশ কাঠা জমি দান করলেন। বড়ো বটতলায় প্রতিষ্টা হল স্কুল। পরে ১৯৭১-এর ১ ফেব্রুয়ারি সরকারী অনুমোদন পেল। সেই স্কুলের প্রথম হেডমাস্টার হলেন কড়ুইগাছির ধর্মদাস বিশ্বাসের ভাই দিলীপ বিশ্বাস মহাশয়। চলতে লাগল স্কুল। আদিবাসী সম্প্রদায়-সহ মুসলিম ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষজন ওই স্কুলের পাশেই বিনিময় করে পাওয়া জমিতে বসবাস শুরু করল। পাশেই সরে এল BSF Camp। তার আগে অবশ্য ক্যাম্প ছিল কিছুটা দূরে। তখন এখানে ডাকাতের খুব উপদ্রব ছিল, সেই কারণেই ক্যাম্পটা এখানে এসে বসল। তখনও তারকাঁটা হয়নি। একেবারে পাকাপোক্ত তারকাঁটার সীমানা হল ২০০০-এর পর। তৈরি হল বিভাজন। তারপর ২০০৪-এর পর স্কুল উঠে এল তারকাঁটার এপারে। বিষ্ণুগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্রী সুখেন মুণ্ডারী মহাশয়ের নিকট প্রাপ্ত তথ্য থেকে এর ইতিহাস উদ্ধার করা গেল —
“১৯৯৯-এর শেষ দিকে বা ২০০০-এর গোড়ার দিকে আমি আর সুশান্ত মুণ্ডারী পরিকল্পনা করে কীভাবে স্কুলটাকে তারকাঁটার এপারে আনা যায়, তার ছক কষতে লাগলাম। আমরা এমন একটা জায়গা খুঁজছিলাম যেখানে বসবাসের পক্ষে উপযুক্ত। তখন তারকাঁটার বেড়া হয়ে গেছে। আমরা খুবই সমস্যায় পড়তাম। বাইরে থেকে কোন আত্মীয় স্বজন এলে তারকাঁটার এপারে থাকতে হতো। সময় না হলে গেট খোলা হতো না। এই সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি পেতেই আমাদের এই পরিকল্পনা। কিন্তু কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। এপারে স্কুলের আশেপাশে ছিল আখের জঙ্গল, বেত গাছ আর খড়ের মাঠ। এর জন্যই পাশের পাড়াটার নাম হয়েছিল খড়ের মাঠ। এখানে মানুষ তো দূরের কথা শেয়াল, বুনো শুয়োর আর ভাম বিড়ালের উৎপাত ছিল খুব। এ জায়গাগুলো সবই ছিল পাল চৌধুরীদের। পরে অবশ্য এখানে একটা কলোনি গড়ে উঠেছিল। দুর্গাপুজোও হতো এখানে। আজ যেখানে বীরসা ভগবানের মূর্তি বসানো হয়েছে সেখানে হতো দুর্গাপুজো। আর পাশে ছিল যুগি বিল, আজ যেটা ভাগ হয়ে গেছে ও পুকুরে পরিণত হয়েছে। পূর্বে এই বিলের সঙ্গে বেতাই চাঁদ বিলের সংযোগ ছিল। পরে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষরা যাদের দখলে ছিল এই জায়গা গুলি তাদের কাছে অল্প দামে কিনে নেন। এখানে এসে বসলো অনেক পরিবার। তারপর পরিকল্পনা করলাম কীভাবে স্কুলটাকে সরানো যায়। ২০০৪ সালে বামফ্রন্ট থেকে পঞ্চায়েত ভোটে আমাকে দাঁড় করানো হলো মেম্বার হিসেবে। অনেক ভোটের মার্জিনে জিতলাম। তারপরে নিজে উদ্যোগ নিয়ে এই স্থানে বিদ্যালয় সরিয়ে আনলাম। বহু টালবাহানার পর জনৈক অনন্ত বিশ্বাস ও অমল বিশ্বাস স্কুলের জন্য জমি দান করলেন। সরিয়ে আনা হলো স্কুল। আপাতত চাটাই এর বেড়া এবং টিন দিয়ে তৈরি হল ঘর। তারপর সর্বশিক্ষা এল, তার দৌলতে তৈরি হল পাকাপোক্ত বিল্ডিং। পরিকাঠামো উন্নয়নের এখন এই প্রাথমিক বিদ্যালয় সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আর ওপারের স্কুলের ভগ্নাবশেষ কালের কপোল তলে হারিয়ে গিয়েছে। শুধু দু-একটা ইট ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ে থেকে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে এখনও।”
জীবিকা
এখানকার মানুষদের জীবিকা মূলত কৃষিকাজ। তবে সবার তো আর জমি নেই। পরের জমিতে জন খাটা থেকে শুরু করে রাজমিস্ত্রীর লেবার খাটা, বাইরে সেন্টারিং-এর কাজের জন্যও যায় অনেকে। আগে এই উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকেরা চুবড়ি, চাঙারি তৈরি, মদ চোলাই ইত্যাদি কারবারের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবে বর্তমানে এরাও নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত। আদিবাসী মেয়েরাও কিন্তু বসে থাকে না। কাকভোরে উঠে বাড়ির কাজ সেরে তারা মাঠে যায়, জন খাটে। যাদের নিজের জমি আছে তারা জমির কাজ সেরে পড়ন্ত বেলায় এক বোঝা জ্বালানি কাঠ মাথায় নিয়ে শ্রান্ত শরীরে হেলতে দুলতে বাড়ি ফেরে। তারা খুবই কর্মঠ। তারা খুবই সহজ-সরল। তারা মানুষের সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি মিশতে জানে। যান্ত্রিক সভ্যতার অসৌজন্য, অসামাজিক আচার-আচরণ এরা বোঝে না। সকলে এদের খুব ভালোও বাসেন। তারা কোনো অসামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত নন। বর্তমানে এখানকার দু-একজন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ সরকারি চাকরিও করেন। মোটকথা উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষরা ঝা-চকচকে সভ্যতার সংস্পর্শে এসে জীবনধারাকে বদলে নিয়েছে। তাদের জীবন ও জীবিকার বিবর্তন ঘটেছে।
খাদ্য
এখানকার অধিবাসীদের প্রধান খাদ্য ভাত। তাছাড়া এদের খাদ্যাভ্যাস মোটামুটি এদেশীয় মানুষদেরই মতো। এই গ্রাম তথা বেতাই-এর সবথেকে প্রাচীন ব্যক্তি বোধ হয় এই গ্রামেরই হীরবল মুন্ডারী। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, এরা এককালে ‘ভেতো মদ’ তৈরি করত, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হতো ‘হাড়িয়া’। এই হাড়িয়া খেয়েই জীবন যন্ত্রণাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করত তারা। এখন অবশ্য এই ভেতো মদ বা হাড়িয়া তৈরির প্রচলন এখানে নেই। আগে যে কোন উৎসব অনুষ্ঠানে এরা এই ভেতো মদ খেয়ে গোল হয়ে বসে ঢাক, ঢোল, ধামসা, মাদল কাঁসর, ঘন্টা নূপুর, করতাল, আড়বাঁশি ইত্যাদি বাজিয়ে তারা আদিবাসী গান ধরত। বর্তমানে যান্ত্রিক যুগ এসে সব কিছু যেন হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। আর এসব কিছুই এখন ইতিহাস। (চলবে)
পড়ুন সকলে।।
সমৃদ্ধ হলাম