তেহট্ট-১ ব্লকের তেহট্ট থানার অধীন বেতাই-২ নং গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি ছোট্ট গ্রাম ‘বিষ্টুগঞ্জ’। গ্রামটির নিজস্ব কোনো মৌজা নেই। তবে তা বেতাই জিৎপুর-৯২ মৌজার অন্তর্গত।
নামটা কিন্তু ‘বিষ্ণুগঞ্জ’। অর্ধ তৎসমে উচ্চারণ দাঁড়িয়েছে ‘বিষ্টুগঞ্জ’। খাতায় কলমে কিন্তু এই নামটাই চোখে পড়ে। তবে অনেক মানুষ কিন্তু ‘বিষ্ণুগঞ্জ’ বা ‘বিষ্টুগঞ্জ’ কোনোটাকেই চেনেন না। তারা আবার এই স্থানকে ‘বেষ্টগঞ্জ’ বলেই জানেন। তবে বিষ্ণু, বিষ্টু বা বেষ্ট যাই হোক না কেন গ্রামের নামটা এমন হল কেন জানা যাই নি। গ্রামটি সীমান্তবর্তী। করিমপুর-কৃষ্ণনগর ১১ নং রাজ্য সড়ক ধরে বেতাই তেলপাম্পের আগে ‘শিক্ষাপীঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দেখবেন। দু-পা এগিয়েই যে গ্রাম পড়বে সেই গ্রামটিই ‘বিষ্টুগঞ্জ’।
সামনে ১ কিমি এগুলোই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত, তারকাঁটার ঘেরাটোপ। পাশেই বিএসএফ ক্যাম্প। আদি বিষ্টুগঞ্জ যদি বলতেই হয় তবে তা এখন তারকাঁটার ওপারে। সেখানে ঘর চল্লিশেক মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করে। তারকাঁটার ওপারে থাকলেও তারা আসলে ভারতবর্ষেরই মানুষ। কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে তাদের বসবাস। তারকাঁটার দরজা খোলে দিনে তিনবার — সকাল ছয়টা, তারপর সকাল দশটা এবং বিকেল তিনটে। প্রতি ক্ষেত্রেই দু-ঘণ্টা করে খোলা থাকে। নাম স্বাক্ষর করে তবেই তাদের ঢুকতে বা বেরোতে দেওয়া হয়। রাতে ইমার্জেন্সি প্রয়োজন হলে বা কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে বি এস এফ ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার এর স্পেশাল অর্ডার মেনে তবেই তাদের ছাড়া হয়। এমনই অসহায় ভাবে তারা দিন গুজরান করে। তবুও সকাল হলে সকলে কাজের প্রয়োজনে ছোটে, ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসে, যে যার কাজে যায়। আবার অনেকে এপারের উৎসব অনুষ্ঠানেও যোগ দেয়।
তারকাঁটার এপারের অনেক মানুষের জমিজায়গাও আছে ওপারে। সকালে গেট খুললে সবাই জমিতে কাজে যায়, আবার গেট বন্ধ হওয়ার আগেই তাদের ফিরে আসতে হয়।
তারকাঁটার এপারেও ঘর কুড়িক মুসলিম পরিবারের বাস। তাছাড়া আছে কিছু যুগী বা যোগী সম্প্রদায়ের মানুষ, তাদের উপাধি পন্ডিত বা দেবনাথ। তবে এই গ্রামের কয়েক ঘর হালদার, বেশ কিছু ঘর নমঃশূদ্র তাছাড়া বাকি সবটাই মুণ্ডারী উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ।মুণ্ডারা আদিবাসী উপজাতি সম্প্রদায়ের লোক বা শিডিউল ট্রাইব বা এসটি। প্রায় ৬৫ থেকে ৭০টি তপশিলি উপজাতি পরিবার বা এসটি পরিবার এখানে বসবাস করে। মুণ্ডারীরা নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে মূলত অস্ট্রিক গোষ্ঠীর মানুষ। দক্ষিণ এশিয়ার একটি বড় উপজাতি হচ্ছে মুন্ডা। ভারতের ঝাড়খন্ড, ছত্রিশগড় রাজ্যের ছোটনাগপুর অঞ্চল, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে এদের বাস। বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে এদের দেখতে পাওয়া যায়। এরা যে ভাষায় কথা বলে তার নাম মুন্ডারী বা মান্দারী। এটি অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্গত। তবে বিষ্টুগঞ্জের আদিবাসী মুণ্ডারা বাংলা ভাষায় কথা বলে।
কোল সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি বা সর্দারদের বলা হত মুণ্ডা বা গ্রামপ্রধান। এরা আদতে কোল সম্প্রদায়ের অংশ। ভারতে মুণ্ডাদের ১৩টি গোত্রের সন্ধান পাওয়া যায় যেমন — টপ, কছুয়া ইত্যাদি । তবে অনেকের মুখ থেকে শোনা গেল তাদের গোত্র কাশ্যপ। কাশ্যপ আর কছুয়া এক কিনা জানা জানিনা। এই গোত্রের মানুষেরা কচ্ছপ খাওয়া তো দূরের কথা, ছুঁলেও স্নান করে শুদ্ধ হয়। এই কচ্ছপ (কূর্ম) হচ্ছে ধর্মঠাকুরের বাহন। তাই তারা এই প্রাণীটি ছোঁয় না বা খায় না। এরা মূলত টোটেম সিস্টেমে চলে। তাদের কাছে কোনো কোনো গাছ বা মাছ দেবতা হিসাবে গণ্য হয়।তবে এখানকার মুণ্ডারা তাদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি তৈরি করে নিয়েছে। এদেশীয় মানুষদের সঙ্গে মিশে তাদের জীবনযাত্রাও যেন অনেকটা আমাদের মত হয়ে যাচ্ছে।
ধর্ম বিশ্বাসে মুন্ডারা প্রকৃতির পূজারী। তাদের প্রধান দেবতা হচ্ছেন শিং বোঙ্গা বা সূর্য দেবতা। তাদের মতে, তিনিই এ বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করেছেন এবং সমগ্র বিশ্বকে পরিচালনা করছেন।তাদের ভগবান বীরসা, যিনি মুণ্ডা বিদ্রোহের নেতা।মুণ্ডাদের কাছে তিনি ‘ধরতি আবা’ বা ‘পৃথিবীর পিতা’। বিষ্টুগঞ্জ গ্রামে সম্প্রতি বীরসার মর্মর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিবছর ১৫ নভেম্বর বীরসার জন্মদিন খুব ঘটা করেই পালন করা হয়।
এখানকার স্থায়ী অধিবাসী বলতে খুব কম। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষরা এখানে কীভাবে এলো তার একটা ইতিহাস আছে। বেতাই উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক তথা লোকতাত্ত্বিক ও পুরাতাত্ত্বিক গবেষক শ্রী লোকেশ চন্দ্র বিশ্বাস মহাশয় ‘স্বপ্নের ভেলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বেতাই’ প্রবন্ধে লিখেছেন—
“মৃত হাউলিয়া নদী বেতাইতে বিলের সৃষ্টি করে, যা ‘চাঁদবিল’ নামে পরিচিত। এই বিলের পশ্চিমপাশে প্রায় একশো বিঘা জমির উপর গড়ে উঠেছিল বেতাই এর নীলকুঠি। কুঠি সংলগ্ন ছিল আম এবং নারকেল বাগান। কুঠিবাড়ি ও আমবাগান ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। এই নীলকুঠির মালিক ছিল ওয়াটসন কোম্পানি। কুঠি বাড়িটি সংস্কার করে ডক্টর বি আর আম্বেদকর কলেজের প্রশাসনিক ভবনে পরিণত হয়েছে। শুধু চারদিকের দেওয়াল আর নিচের মেঝে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে এবং মহামারীতে বেতাই জনশূন্য হয়ে যায়। ফলে বেতাই এর মাঠ ঘাট জঙ্গলে ভরে যায়। জঙ্গলে বুনো শুয়োরের আখড়া গড়ে ওঠে। বড়দিনের মরশুমে কুঠিয়াল সাহেবরা এই অঞ্চলে আসতেন বুনো শুয়োর শিকার করতে। সাহিত্যিক দীনেন্দ্র কুমার রায় তাঁর ‘সেকালের স্মৃতি’-তে লিখেছেন — লর্ড ডাফরিন একবার পুত্র-সহ শুয়োর শিকার করতে বেতাই এর জঙ্গলে এসেছিলেন।” (শ্রী লোকেশ চন্দ্র বিশ্বাস, ‘স্বপ্নের ভেলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বেতাই’ প্রবন্ধ)
বেতাই-এর ওয়াটসন কোম্পানির এই নীলকুঠিতে নীল জ্বাল দেওয়া এবং তার আনুষঙ্গিক কাজের জন্য অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হত। এই শ্রমিকের প্রয়োজন মেটাতেই নানা জায়গা থেকে শ্রমিকদের নিয়ে আসা হতো। বিষ্ণুগঞ্জের এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদেরও নিয়ে আসা হয়েছিল মূলত নীলকুঠির কাজের প্রয়োজনে। এখানকার মানুষগুলো এসেছিল পূর্ববঙ্গের ভাটপাড়া থেকে, যা এখন বাংলাদেশে অবস্থিত।
বন জঙ্গল কেটে তারা আদি বিষ্টুগঞ্জে বসতি স্থাপন করেছিল। বিষ্টুগঞ্জের মত বেতাই-এর আরেকটি গ্রাম নফর চন্দ্রপুর। এটিও মূলত আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম। এখানকার ইতিহাস নিয়ে গবেষক মোহিত রায় লিখেছেন তাঁর “নফরচন্দ্রপুরঃ নদীয়া জেলার একটি গ্রাম” প্রবন্ধে —
“নদিয়ার নীল চাষের সূচনা পর্বে উনিশ শতকের গোড়ায় এ গ্রামে তথা এই এলাকায় অন্যান্য আদিবাসী-সহ মালপাহাড়ি আদিবাসী সম্প্রদায় বন কেটে বসতি গড়ে তোলেন।.
এখানে নীল চাষের জন্য কৃষি শ্রমিক হিসেবে নীলকর ইংরেজরা মাল পাহাড়িদের নিয়ে আসেন। কারণ, তখন এদেশীয় স্থানীয় চাষীরা নীল চাষে অনাগ্রহী ছিল, আপত্তি জানাত; এই সব নীলকরেরা ছিলেন বেঙ্গল ইন্ডিগো কনসার্ন নীল কারবারের সঙ্গে যুক্ত। নফরচন্দ্রপুর গ্রামের অদূরই আছে কয়েকটি নীল উৎপাদন কেন্দ্র এবং নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ। মালপাহাড়িদের বসতি গড়ে ওঠার পর ও নীলকর স্যাবি সাহেবের যাবতীয় বিষয় সম্পত্তি পালচৌধুরী জমিদাররা কিনে নেওয়ার পর গ্রামের নামকরণ হয়।” (“নফরচন্দ্রপুর নদীয়া জেলার একটি গ্রাম”, মোহিত রায়, ‘নদিয়ার সংস্কৃতি-চর্চা’, সম্পাদনা-মৃত্যুঞ্জয় মন্ডল।)
একসময় সারা বেতাই জুড়ে নাকি বেত গাছের ঘন জঙ্গল ছিল,জঙ্গল জুড়ে ছিল বাঘের আনাগোনা। কুঠির সাহেবরা অনেক সময় বাঘ শিকারও করতেন। বাঘের হানাতে মানুষ আহত হত, অনেকসময় নিহতও হত। সে আজ বহু বছর আগের কথা। বেত গাছের জঙ্গল থেকেই নাকি এই স্থানের নাম হয়েছে বেতাই। আবার জনশ্রুতি ছিল বেতাই-এর উপর দিয়ে নাকি প্রাচীন কালে বয়ে যেত বেত্রবতী নদী।এর থেকেই নাকি এই স্থানের নাম হয়েছে বেতাই।কোন মতটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তার কোনো প্রমাণ নেই।তবে সাহিত্যিক দীনেন্দ্র কুমার রায় তাঁর ‘সেকালের স্মৃতি’-তে লিখেছেন —”লর্ড ডাফরিন একবার পুত্র-সহ শুয়োর শিকার করতে বেতাই এর জঙ্গলে এসেছিলেন।” অর্থাৎ বেতাই এর নামকরণটা তার আগে থেকেই হয়েছিল সন্দেহ নেই। (চলবে)
খুব সুন্দর লাগলো
তথ্য সমৃদ্ধ ফিচার।