ঠাকুরকে আমরা ঠাকুর বানিয়েছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের কাছে ঠাকুর, দেবতা। দেবতা হতে রবীন্দ্রনাথ অসচেতনভাবে সাহায্য করেছেন আমাদের। তাঁর দীর্ঘ, গৌরবর্ণ দেহ, তাঁর লম্বা দাড়ি, তাঁর জোব্বা—এসব সাহায্য করেছে। ইউরোপের মানুষ তো তাঁকে সন্ত বলে মনে করতেন। মানুষকে ঠাকুর ভাবলে সুবিধে আছে। তখন তাঁকে বুঝতে, চিনতে হয় না। তিনি তো ঠাকুর। তাঁর কোন ত্রুটি থাকতে নেই। মানুষ হিসেবে সীমাবদ্ধতা থাকতে নেই। ঠাকুরের আবার আলোচনা-সমালোচনা কিসের?
পঁচিশে বৈশাখ এলে বোঝা যায় আমরা কিভাবে রবীন্দ্রনাথকে ঠাকুর বানিয়েছি। দিকে দিকে অনুষ্ঠান। যেন পুজো। ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই আঁচ করেছিলেন। না হলে লিখতেন না — ‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলে থাকি।’ এখন বেলা একটা বাজে। আমাদের পাড়ার ক্লাবে চলছে শতকণ্ঠে রবীন্দ্রবন্দনা। এই গরমেও সেজেগুজে ছেলে-মেয়ে এসেছে। একটা গান গাইবে, একটা আবৃত্তি করবে, সুযোগ পেলে একটা নাচ। তাই গরমকে উপেক্ষা করে অভিভাবকেরাও এসেছেন। রবীন্দ্রনাথের জন্য নয়, তাঁদের ছেলে-মেয়ের ‘পারফরমেন্স’ দেখার জন্য। এসবে রবীন্দ্রনাথের প্রচার হচ্ছে। ভালো কথা। কিন্তু আসল রবীন্দ্রনাথ যে চাপা পড়ে যাচ্ছেন।
আচ্ছা রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন একটু অন্যভাবে পালন করা যায় না? এই দিনে রবীন্দ্রনাথের বাছাই লেখা নির্জনে আমরা একটু পড়ার চেষ্টা করি না কেন? হইচই-এর মধ্যে নয়, একটি নির্জনভাবে তাঁর লেখার, বিশেষ করে গদ্য লেখার, উপর একটু চোখ বোলাই না কেন!
তবে রবীন্দ্রনাথ পড়া সহজ নয়। তাঁর রচনায় যে দীপ্তি, যে উপমা, যে অলংকার, যে বৈদগ্ধ্য আছে সহজে তার মর্মোদ্ধার করা যায় না। একদম ঠিক। তাই বারবার পড়তে হয়। ভাতঘুম দেওয়ার আগে উপন্যাস পড়ার মতো নয়, মনোযোগ দিয়ে পড়া।
কেন পড়ব রবীন্দ্রনাথ? শুধু রবীন্দ্রনাথই পড়ব কেন? আরও তো অনেক মনীষী আছেন। হ্যাঁ, আছেন বইকি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো বর্তমানের গণ্ডি পেরিয়ে দূর ভবিষ্যতকে দেখার দৃষ্টি ছিল না তাঁদের অনেকেরই। মানুষকে নিয়ে, মানুষের ধর্মকে নিয়ে, মানুষের সমাজ কে নিয়ে, জাতিসমস্যা নিয়ে, প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে তাঁর ভাবনাগুলি এখনও প্রাসঙ্গিক। আসুন না, পঁচিশে বৈশাখ আমরা ‘গোরা’, ‘ছিন্নপত্র’. ‘রক্তকরবী’, ‘মানুষের ধর্ম’, ‘মুক্তধারা’, ‘কালান্তর’ পড়তে শুরু করি। তাঁর বক্তব্যকে বর্তমান প্রেক্ষিতে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি। সংকীর্ণ দেশপ্রেম, প্রদেশিকতা, ভোগবাদী সভ্যতা, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা, পরিবেশের সংকট, যন্ত্রের যন্ত্রণা হবে ওঠা, যুদ্ধ এসব সম্পর্কে তিনি যা বলেছিলেন তার যাথার্থ বুঝতে চেষ্টা করি।
ঈশ্বর বলতে যদি ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর হন আর ঠাকুর বলতে যদি রবীন্দ্রনাথ হন তবে আপত্তি নেই, কিন্তু উভয়ই ব্যাক্তি পূজার ঘোর বিরোধী ছিলেন তাই তাঁদের মূল্যায়ন অন্য ভাবেই হওয়া উচিত।
আপনার বক্তব্য খুবই স্পষ্ট।