মেলা কুম্ভ হোক বা মহাকুম্ভ যাই হোক না কেন বছরের পর বছর ধরে এই মেলা একটি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিতর্ক থাকলে তাকে অস্বীকার করা তো দূরের কথা বরং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। কেউ কেউ এই মেলাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখেন যা মানুষকে তাদের বিশ্বাসের সঙ্গে সংযুক্ত করে, আবার কেউ কেউ যুক্তি সহকারেই বলেন যে এই মেলা গুরুতর জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি তৈরি করে। গুরুতর জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি কথাটি স্বাভাবিক ভাবেই এসে পড়ে কারণ, লক্ষ লক্ষ লোক জনবহুল একটি জায়গায় একত্রিত হলে সেই জায়গাটি কতটা নিরাপদ থাকতে পারে। কুম্ভ মেলার ক্ষেত্রেও সেই প্রশ্ন যে সেই কোটি কোটি মানুষের সমাগমস্থলটি সত্যিই কি নিরাপদ হতে পারে, বিশেষ করে আধুনিক স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপটে? যুক্তির উপর ভিত্তি করেই দেখা যেতে পারে কুম্ভ মেলা একটি ধর্মীয় অভিজ্ঞতা নাকি জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি।
লক্ষ কোটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীর কাছে কুম্ভমেলা একটি গভীর অর্থবহ আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, কুম্ভমেলা সমুদ্র মন্থন স্মরণ করে যখন দেবতা এবং অসুররা অমরত্ব পাওয়ার জন্য অমৃতের পাত্র নিয়ে লড়াই করেছিল। ‘কুম্ভ’ মানে একটি পাত্র আর ‘মেলা’ মানে একটি সমাবেশ। অমৃতের পাত্র নিয়ে দেবতা আর অসুরদের যুদ্ধের সময় অমৃতফোঁটা ভারতের চারটি স্থানে পড়েছিল, এলাহাবাদ, হরিদ্বার, উজ্জয়িনী এবং নাসিক। এই স্থানগুলি এখন কুম্ভমেলার জমি। কুম্ভ তীর্থযাত্রীরা পবিত্র নদীতে স্নান করার জন্য এই পবিত্র স্থানগুলিতে ভ্রমণ করেন, কারণ বিশ্বাস এই স্নান দেহ ও আত্মাকে শুদ্ধ করে। কুম্ভ নিয়ে আধ্যাত্মিক তাৎপর্য যাই থাক না কেন, কুম্ভমেলা জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত বেশ কিছু উদ্বেগ সৃষ্টি করে, বিশেষ করে সংক্রামক রোগ এবং মহামারী কোটি কোটি মানুষ সমাগমের প্রেক্ষাপটে এসেই পড়ে। আকারে প্রকারে মেলার বিশালতা, কোটি কোটি মানুষ গা ঘেঁষাঘেঁষি করে সমবেত হওয়ার ফলে, রোগ ছড়িয়ে পড়ার জন্য একটি আদর্শ পরিস্থিতি তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এর পাশাপাশি আরও উদ্বেগের বিষয় হল জলবাহিত রোগের সম্ভবনা এবং তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়া।
মেলা শুরু হলে যে স্নান শুরু হয় এবং তীর্থযাত্রীরা এমন নদীতে স্নান করেন যেখানে ভিড় লেগেই থাকে। সেই নদী ধর্মীয়ভাবে যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, যেহেতু সেখানে প্রচুর লোকের সমাগম, সেই সঙ্গে বর্জ্য এবং অত্যন্ত নিম্নমানের স্যানিটেশন ব্যবস্থা থাকার জন্য দূষণের প্রবণতা থেকেই যায়। কেবল তাই নয়, কলেরা, টাইফয়েড এবং হেপাটাইটিসের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনাও থাকে খুব বেশি। বিশেষ করে যেসব এলাকায় জলের গুণমান ভালো নয়। এর সঙ্গে আরেকটি বড় উদ্বেগের বিষয় হল ভাইরাল এবং ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের প্রবল ঝুঁকি। কাছাকাছি এলাকা এবং জনাকীর্ণ পরিবেশের কারণে ফ্লু, শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের মতো বায়ুবাহিত রোগ এবং COVID-19-এর মতো আরও ভয়াবহ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটা এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়া সহজ হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত, অতি সম্প্রতি আমরা দেখেছি, COVID-19 মহামারীটি কীভাবে বিশাল সমাবেশে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে লোকেরা নিজেদের অজান্তেই ভাইরাস বহন করে এবং বিশাল জনসমাগমের মধ্যে অন্যদের সংক্রামিত করে।
মুখে যাই বলা হোক, মেলার মাঠজুড়ে যথাযথ স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যসেবার যথাযথ পরিকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। সেই অভাব আরেকটি বিরাট সমস্যা। কর্তৃপক্ষ অস্থায়ী চিকিৎসা শিবির তৈরি এবং বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহের জন্য যত ব্যবস্থাই নিক না কেন, মানুষের সংখ্যা যে অঙ্কতে পৌঁছায় তা যাবতীয় ব্যবস্থাগুলিকে অতিক্রম করে যায়। দ্রুত সঠিক যত্নের সুযোগ না পেয়ে চিকিৎসা সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা আরও বেড়ে যাওয়াটা আরও একটি বাস্তব উদ্বেগের বিষয়, বিশেষ করে যে পরিবেশে শৃঙ্খলার থেকে বিশৃঙ্খলা বেশি আর নিয়ন্ত্রণ থাকে অতি দুর্বল। তাছাড়া, দুর্ঘটনা এবং পদদলিত হওয়ার ঝুঁকি আরেকটি উদ্বেগজনক বিষয়। এক জায়গায় এত লোকের সমাগম হওয়ায় অতীতে এমন ঘটনা ঘটেছে যেখানে অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে পদদলিত হয়ে প্রাণহানির মতো মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এত লোকের জমায়েতে যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। যদিবা ছোট ছোট জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়ন করা সহজ হয় কিন্তু সামাজিক দূরত্ব, স্যানিটেশন এবং এত বিপুল সংখ্যক মানুষের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করা একটি লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ।
অন্যদিকে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালে সঙ্গম এবং আশপাশ এলাকার গঙ্গা এবং যমুনার জলের দূষণ মাত্রার রিপোর্ট পেশ করা মাত্র তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। কোনো বেসরকারি সংস্থা বা কোনো বিদেশী প্রতিষ্ঠানও নয়, জল দূষণের তথ্য হাজির করেছে খোদ কেন্দ্রীয় সংস্থা। ভাগ্যিস সরকার বিজেপির তানাহলে যোগী হিন্দু বা হিন্দুত্ব বিরোধীতার কথা বলতন। কিন্তু কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার মাত্রা থেকে স্পষ্ট যে জলে মানুষ ও পশুর মল আছে। একইভাবে বায়োমেডিক্যাল অক্সিজেন ডিম্যান্ড (বিওডি)-র মাত্রা বলে দেয় যে ওই জল স্নানের অনুপযুক্ত এবং কুলকুচির জন্য মুখে নিলে আরও বিপজ্জনক এবং জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের কতটা ব্যাকটেরিয়া গিলে ফেলছে। জলে বিওডি’র মাত্রা নির্ধারিত মাত্রার বেশি থাকলে বোঝা যায় দূষণের পরিমাণ বেশি। নদীর জল স্নানের উপযুক্ত তখনই মনে করা হয় যখন প্রতি লিটার জলে বিওডি’র মাত্রা হবে ৩ মিলিগ্রামের কম। কিন্তু কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ যে রিপোর্ট এনজিটি-তে জমা করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ১৬ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি বিকেল পর্যন্ত সঙ্গমের জলে বিওডি’র মাত্রা ৫.০৯ মিলিগ্রাম থেকে ৫.২৯ মিলিগ্রাম। অর্থাৎ নির্ধারিত মাত্রার থেকে প্রায় দ্বিগুন। কিন্তু বৈজ্ঞানিক তথ্য মানবেন না উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এবং হিন্দুত্ববাদী নেতারা। তারা কুম্ভমেলায় কোটি কোটি মানুষের মল-মূত্রের দূষিত হলে স্নান করার বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে ধর্মীয় অভিজ্ঞতার জয়গান করছেন।