২০২৩ সালে বেশ রমরমিয়ে কৃষ্ণনগরে বারোদোলের মেলা হতে দেখা গেল। এ বছর বারোদোলের মেলা ঘিরে যেন মাত্রাতিরিক্ত উন্মাদনা ছিল। মেলা চলাকালে প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় চকের মোড়ে, আর এন ঠাকুর রোডে যানজট লেগেই থাকতো। কৃষ্ণনগরের বারোদোল মেলা এবছর ১ এপ্রিল শুরু হয়। সমগ্র এপ্রিল মাস ধরে এই মেলা চলে। অর্থাৎ এ বছর বারোদোলের মেলা ৩০ এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত বসেছিল। তারপর দুই-তিন দিন কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে ভাঙা মেলাও দেখতে পাওয়া যায়।
নদিয়া জেলা তো বটেই, বাংলার একটি অন্যতম পুরনো ও বড় মেলা হল কৃষ্ণনগরের বারোদোল মেলা। ঐতিহ্যের শহর কৃষ্ণনগরের একটি ঐতিহাসিক মেলা হল এটি। কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিবছর দোল পূর্ণিমার কয়েকদিন পর থেকে এই মেলা শুরু হয়ে যায়। অনেকেরই ভ্রান্তধারণা রয়েছে যে, দোল পূর্ণিমার বারোদিন পরে এই মেলা বসে, তাই এর নাম বারোদোলের মেলা। কিন্তু এই তথ্যটি সঠিক নয়। বারোটি বিগ্রহ থেকে ‘বারোদোল’ নামটি এসেছে বলে মনে করা হয়। আবার এই মেলার নামকরণ প্রসঙ্গে আরেকটি ভিন্ন মতও রয়েছে। উল্লেখ্য, ‘বাহির দোল’ থেকে ‘বারদোল’, আর সাধারণ মানুষের চলতি উচ্চারণে সেটি হয়েছে ‘বারোদোল’ — এমনও লোকশ্রুতি আছে। সেই বিষয়ের গভীরে যাওয়ার অবকাশ অবশ্য এখানে নেই। যাইহোক, বারোটি কৃষ্ণবিগ্রহের দোল, সেকারণেই এর নাম বারোদোল— এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলা প্রয়োজন। বারোদোল মেলার সময় কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির নাটমন্দিরে রারোটি নয়, মোট তেরোটি বিগ্রহ পূজিত হন। বারোটি কৃষ্ণবিগ্রহের সঙ্গে থাকেন নদিয়া-রাজের কুল বিগ্রহ বড়নারায়ণ। সেই রীতি এখনো চলে আসছে। যদিও কথাটি দোল, তবে কাঠের সিংহাসনে বিগ্রহগুলিকে শুধু বসানোই থাকে— দোল দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা থাকে না। মেলায় আগত এই বিগ্রহগুলি বিরহী, শান্তিপুরের সূত্রাগড়, নবদ্বীপ, অগ্রদ্বীপ, তেহট্ট এবং বহিরগাছির। অবশ্য এখন আর সব বিগ্রহ রাজবাড়িতে পাঠানো হয় না। তেহট্টের কৃষ্ণরায় বিগ্রহ আসা বহুদিন আগে বন্ধ হয়ে গেছে। অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ বিগ্রহও কয়েকবছর ধরে বারোদোল মেলায় পাঠানো হচ্ছে না। তাই বিগ্রহের বদলে নাটমন্দিরে কাঠের সিংহাসনে গোপীনাথ বিগ্রহের প্রতিকৃতি রাখা হয়। বারোদোল মেলায় যে তেরোটি বিগ্রহ বর্তমানে দেখতে পাওয়া যায়, সেগুলি হল— শ্রী শ্রী বলরাম, শ্রী শ্রী ছোট নারায়ণচন্দ্র, শ্রী শ্রী বড় নারায়ণচন্দ্র, শ্রী শ্রী গোবিন্দদেব, শ্রী শ্রী গোপীমোহন, শ্রী শ্রী নদের গোপাল, শ্রী শ্রী গোপীনাথ (প্রতিকৃতি), শ্রী শ্রী গড়ের গোপাল, শ্রী শ্রী গোষ্ঠবিহারী, শ্রী শ্রী নাড়ুগোপাল, শ্রী শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র, শ্রী শ্রী লক্ষ্মীকান্ত এবং শ্রী শ্রী মদনগোপাল।
২০২৩ সালের বারোদোল মেলায় এ বছর আবার সার্কাসের দেখা মিলল। অনেকদিন পর এই সার্কাস, সে কারণে সার্কাস ঘিরে কিছুটা বাড়তি উন্মাদনা ছিল বলা যায়। যদিও বর্তমানে বাংলা তথা ভারতের সার্কাস কোম্পানিগুলির অবস্থা শোচনীয়। কিন্তু আগাগোড়া এমনটি ছিল না। এখন যারা প্রবীণ তারা নিজেদের ছোটবেলায় বারোদোল মেলায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন— তাদের ছোটবেলায় নাকি বারোদোল মেলার প্রধান আকর্ষণই ছিল সার্কাস। কিন্তু বর্তমানে বারোদোল মেলায় সার্কাস খুবই অনিয়মিত। বিগত কয়েক বছর ধরেই সার্কাসের এই হাল প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। ডিজিটাল দুনিয়ায় হাতের নাগালে সব কিছু পাওয়া যাচ্ছে। বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়। কালের নিরিখে সার্কাসের প্রতি তাই মানুষের আগ্রহ ক্রমান্বয়ে কমেছে, যা এখন একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। এ বছর বারোদোল মেলায় আসা টারজান সার্কাস কোম্পানির ছেঁড়াফাটা তাবু, অন্যান্য সাজ সরঞ্জামের জীর্ণ দশা, প্রদর্শিত খেলার মান, জোকার সহ দলের অন্যান্য খেলোয়ারদের পারফরমেন্স ও উৎসাহ সবকিছু মিলিয়ে এক হতশ্রী অবস্থা প্রত্যক্ষ করা গেল।
ফি-বছর কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির চকের মাঠে একমাস ধরে বারোদোল মেলা চলে। শাস্ত্রমতে প্রতিবছর চৈত্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে বারোদোল মেলা শুরু হয়। ২০২৩ সালে যেমন ১ এপ্রিল বারোদোলের মেলা শুরু হয়। পূর্বে বারোদোলের মেলার চরিত্র একটু অন্যরকম ছিল। নদিয়া-রাজ স্থাপিত নানা জায়গার বারোটি কৃষ্ণবিগ্রহকে মহা-সমারোহে কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে আনা হত এবং মেলার প্রথম তিনদিন সুবিশাল নাটমন্দিরের পূর্বদিকের খিলানগুলির নীচে পাদপিঠের উপর কাঠের সিংহাসনে বিগ্রহগুলিকে স্থাপন করে পুজো করা হত। এখনো বারোদোল মেলার প্রথম তিনদিন বিগ্রহগুলিকে স্থাপন করে পুজো করার আয়োজন প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রথম তিনদিন তাই দর্শনার্থীরা বিগ্রহ দর্শনের বিশেষ আকর্ষণে মেলায় আসেন। তিনদিন বিগ্রহগুলির তিনরূপ দেখতে পাওয়া যায়। মেলার প্রথমদিন বিগ্রহগুলিকে রাজবেশে সাজানো হয়। পূর্বে মূল্যবান সোনার গহনা দিয়ে বিগ্রহগুলিকে সাজানো হত। দ্বিতীয়দিন বিগ্রহগুলিকে বিভিন্ন রকম ফুল দিয়ে সাজানো হয়, তাই সেই রূপের নাম ফুলবেশ। আর তৃতীয়দিন বিগ্রহগুলিকে দরিদ্র রাখালবেশে সাজানো হয়। বারোদোল মেলার একমাস বিগ্রহগুলি কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতেই থাকে। মেলার প্রথম তিনদিন বিগ্রহগুলি রাজবাড়ির নাটমন্দিরে পূজিত হয়। সেই তিন দিন সর্বসাধারণের বিগ্রহ দেখার সুযোগ থাকে। তারপরে সমগ্র মাস রাজবাড়ির দক্ষিণদিকের ঠাকুরবাড়িতে বড় নারায়ণের সঙ্গে বিগ্রহগুলি থাকে এবং সেখানেই পূজিত হয়। বারোদোল মেলা শেষ হলে বিগ্রহগুলিকে আবার যথাস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এই বিগ্রহগুলির বেশিরভাগই মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত। আর এগুলি নদিয়া-রাজ প্রদত্ত দেবোত্তর সম্পত্তিতে স্থাপিত মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত। বছরভর সেখানেই তাদের নিত্যপুজো হয়ে থাকে।
চৈত্রমাসে রাধাকৃষ্ণের এই দোল উৎসব শাস্ত্রীয়ও বটে। আসলে সে যুগে যে কোনো উৎসবই শাস্ত্রীয় বিধান মেনে করা হত। নদিয়া-রাজের আমলেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে একমাত্র কৃষ্ণনগরেই রংদোলের পর রাধাকৃষ্ণের এই বারোদোল মেলা হয়। ‘হরিভক্তিবিলাস’ নামক গ্রন্থে চৈত্রমাসে রাধাকৃষ্ণের এই দোলের কথা রয়েছে—
“চৈত্রে সিতৈকাদশ্যাঞ্চ দক্ষিণাভিমুখং প্রভুম।
দোলয়া দোলনং কৃর্যান্নীতন্বত্যাগিনোৎসবম।।
তথা চ গরুড়ে—
চৈত্রে মাসি সিতে পক্ষে দক্ষিণাভিমুখং হরিম।
দোলরূঢ়ং সমভ্যর্চা মাসমান্দোলয়েৎ কলৌ॥”
অর্থাৎ চৈত্র মাসে শুক্লা একাদশী তিথিতে নৃত্যগীতের উৎসব সহকারে দেব দেবীকে দক্ষিণ মুখ করে দোলনায় দোলাতে হয়। গরুড় পুরাণেও ঐ বিষয়ে লিখিত আছে যে কলিকালে চৈত্রমাসে শুক্লপক্ষে দক্ষিণমুখী জনার্দ্দনকে পুজো করে একমাস দোলনে দোলাতে হয়। সুতরাং নদিয়া-রাজ প্রবর্তিত চৈত্রমাসে রাধাকৃষ্ণের এই দোল উৎসবকে শাস্ত্রসম্মত বলতে দ্বিধা নেই।
নদিয়ার সর্বপেক্ষা বড় মেলা হিসেবে বারোদোল মেলার পরিচিতি। এখন মেলার যে আয়তন আগে নাকি তার থেকে অনেক বড় এলাকা জুড়ে বারোদোল মেলা বসত। নদিয়া-রাজের কৃষ্ণনগর গড় বা রাজবাড়ির বিস্তৃত ক্ষেত্রে এই মেলা বসত। শুধু নদিয়া নয়, বাংলার বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু মানুষ বারোদোল মেলায় আসতেন। মেলায় কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল থেকে শুরু করে কাঠের সামগ্রী, লোহার সরঞ্জাম, আসবাবপত্র, চুরিমালার দোকান, মুদির দোকান, মিষ্টান্ন সামগ্রী, বাদাম ভাজা, পাপড় ভাজা, চপ, শরবত সহ এমন কিছু ছিল না, যা কৃষ্ণনগরের বারোদোল মেলায় পাওয়া যেত না। গৃহস্থালির সকল প্রয়োজনীয় দ্রব্য মিলত মেলায়। বর্তমানে বারোদোল মেলার চরিত্র অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে। মেলায় কিছুটা কর্পোরেট ছোঁয়া লেগেছে। তবে সাংসারিক প্রয়োজনের দ্রব্যসামগ্রী, সৌখিন দ্রব্যের সমাহার, খাবারের হরেকরকম স্টল এখনকার মেলায় ভরপুর দেখতে পাওয়া যায়।
কৃষ্ণনগরের এই বারোদোল মেলা কত বছরের পুরনো সেবিষয়ে মতভেদ রয়েছে। মেলা প্রবর্তনের সন তারিখ নির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলা যায় না। অনেকের মতে এই মেলা ৩০০ বছর অতিক্রমের পথে। বহুল প্রচলিত মতটি হল নদিয়া-রাজ মহারাজাধিরাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের শাসনকালে (১৭২৮-১৭৮২ খ্রি.) বারোদোল মেলা প্রবর্তিত হয়। এই মেলার প্রবর্তন কিভাবে হলো সে সম্পর্কে একটি লোকশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে। মহারাজাধিরাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের দুই জন মহিষী ছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় মহিষী ছিলেন খুবই রূপবতী ও গুণবতী। তিনি লক্ষ্মীদেবী নামে পরিচিত। তিনি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিশেষ প্রিয় ছিলেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নাকি তাঁর এই দ্বিতীয় মহিষীর মন রক্ষার্থেই শাস্ত্রীয় বিধান মেনে পণ্ডিতদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে বারোদোল মেলার প্রবর্তন করেন। রানী লক্ষ্মীদেবী মেলা ঘুরতে বিশেষ পছন্দ করতেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর উলার (বীরনগর) জাতের মেলা দেখাতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইত্যবসরে মহারাজা রাজ্যের শাসনকার্যে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে, তাঁর পক্ষে রানীকে মেলা ঘুরতে নিয়ে যাওয়া আর সম্ভব হয় নি। সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে রাজমহিষীর পক্ষে মেলা দেখা সম্ভবও ছিল না। এমতাবস্থায় মহারাজাধিরাজ কৃষ্ণচন্দ্র কৃষ্ণনগর রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে একটি মেলার প্রবর্তন করেন। উদ্দেশ্য ছিল রাজমহিষী ও অন্যান্য অন্তঃপুরবাসিনীরা যাতে কৃষ্ণনগর রাজপ্রাসাদে থেকেই মেলা দেখতে পারেন। লোকশ্রুতি এভাবেই বারোদোল মেলার সূচনা হয়। এ প্রসঙ্গে অন্য মতটি হল নদিয়া-রাজ গিরীশচন্দ্র রায়ের শাসনকালে (১৮০২-১৮৪১ খ্রি.) বারোদোলের মেলা শুরু হয়। এ বিষয়েও লোকশ্রুতি রয়েছে যে, রাজমহিষীর অনুরোধেই মহারাজা গিরীশচন্দ্র এই মেলার প্রবর্তন করেছিলেন।
নদিয়ার রাজপরিবার এই বারোদোল মেলার প্রবর্তন করেছিল। সে দিক থেকে এটি রাজ পরিবারের নিজস্ব উৎসব। তবে ক্রমান্বয়ে এটি কৃষ্ণনগর তথা নদিয়া জেলার জনগণের সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য, বারোদোল মেলার এই বিশাল আয়োজন করা সম্ভব হয় নদিয়া-রাজের তত্ত্বাবধান এবং জনসাধারণের সমবেত প্রচেষ্টায়।
লেখক: আঞ্চলিক ইতিহাস লেখক, নদিয়া।
Sir besh valo hoeche
আবার পরিশ্রম করে লেখার চেষ্টা করছি তোমার খাতিরে। দেখি পাঠাতে পারি কিনা।
তোমার লেখাটা পড়েছি। একজন আঞ্চলিক ইতিহাসের লেখকের রচনা হিসেবে নিবন্ধটি যেন একটু এলোমেলোভাবে সাজানো হয়েছে বলে মনে হলো !
ইতিহাস এবং মেলার বিবরণবিষয়ক লেখা মিলেমিশে একটু লঘু করে দিয়েছে রচনার ওজনকে। ইতিহাসের কথা লিখতে গেলে আরও একটু তথ্যনির্ভর হওয়া দরকার বলে আমার মনে হয়।
ধন্যবাদ স্যর। সংস্কারের বিষয়টি মাথায় রাখবো।
ধন্যবাদ। পড়েছ ভালো লাগলো।
অবশ্যই খুব সুন্দর নান্দনিক উপস্থাপনা। গতিবান ভাষা প্রাণবান চিত্র লেখাটার প্রাণ।
আপনার মতো গুণীর মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হলাম। ধন্যবাদ।
Onek ajana Katha jante parlam! Onek onek dhonyobad apnake! Erakam onek ajana galpo janar jonno apnar opekhai thakbo!
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি অবশ্যই আপনার এই মূল্যায়নের মান রাখার চেষ্টা করবো।
ধন্যবাদ স্যার, আমার না জানা কথাগুলি জানানোর জন্য।
ধন্যবাদ স্যার, আমার না জানা কথাগুলি জানানোর জন্য।
পড়েছ বলে ভালো লাগলো।
Khub bhalo laglo pore
জেনে ভালো লাগলো।