কলকাতায় পাইকারি সবজি বিক্রির অন্যতম বড় বাজারের মধ্যে প্রথমদিকেই আসবে শিয়ালদহের কোলে মার্কেটের নাম। বিগত শতাব্দীর একেবারে গোড়ায় নফর কোলের ছেলে ভূতনাথ কোলে এই বাজার স্থাপন করেছিলেন বলে প্রচার। তাদের পদবি আজও এই বাজার বহন করে চলেছে। নফরবাবুর বাজার বলে মূল ফটকে লেখা থাকলেও লোকমুখে কোলে মার্কেট নামেই চলে আসছে।
পাইকারি বাজার বলতে যা বোঝায় সেটাই এই কোলে মার্কেট। আলু, কপি, পান, লেবু, টোম্যাটো ইত্যাকার হাজার রকম পণ্য বিক্রি হচ্ছে। চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা থাকে এই বাজার। আগে কয়াল বা মাপদাররা এখানে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করেই মাল দিত ক্রেতাকে। এখন দাঁড়িপাল্লার জায়গায় অনেক দোকানে ইলেকট্রনিক ওজনযন্ত্র বসেছে।
কয়ালদের কথা এখনকার নাগরিক বাঙালি ভুলে গেছে। বারাসাতের হৃদয়পুরে আছে একটি কোলে মার্কেট। এখানেও মাপদার বা ওজনকারী কয়ালদের রমরমা ছিল এককালে।
সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘দম্পতি’ গল্পটিতে নিধু শা নামে কয়াল চরিত্রটিকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ধান ও পাট মাপা ছিল তাঁর পেশা।
‘কয়াল’ একটি নিখাদ বাংলা শব্দ। আরবি থেকে এসেছে বাংলাভাষায়।
কয়াল-এর মানে, ‘মাপদার’ বা জিনিসিপত্রের ওজনকারী। মুঘল আমলে কয়াল সরকারি পদ ছিল। কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেরেস্তার কাগজপত্রেও কয়ালদের প্রাপ্য অর্থের হিসেব দেওয়া হয়েছে। বাঙালির পদবিও হয় ‘কয়াল’। কয়েক যুগ আগেও গ্রামের দিকে কয়ালদের দাপট দেখা যেত। পেল্লায় ওজনদাঁড়িতে একদিকে মন মন বাটখারা চাপিয়ে অন্যদিকে ধান বা পাট চাপিয়ে ওজন করত কয়াল বা মাপদাররা। কলকাতার কয়লাঘাট অঞ্চলেও পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখলে দেখা যাবে, সেখান থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে জিপিও, যেখানে ১৭৫৭-র আগে ছিল পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম। পাশে ব্যাঙ্কশাল ঘাটে ছিল ওলন্দাজদের শুল্ক আদায়ের অফিস। কেল্লার গোলাবারুদ মাপতে কয়ালদের ডাক পড়ত। আবার জাহাজের মালপত্রের ওজন করতেও এদের শরণাপন্ন হত ওলন্দাজরা। মালপত্রের সঠিক ওজন হলে তবেই না শুল্ক আদায় সম্ভবপর হবে! আসলে কয়লাঘাট জায়গাটির আদিনাম ছিল ‘কয়াল-ঘাট’। এখানেই ডেরা বেঁধেছিল মাপদার তথা কয়ালরা। হৃষিকেশ ও ভাগলপুরে গঙ্গার তীরে ‘কয়ালঘাট’ বলে দু’টি জায়গার অস্তিত্ব এখনও আছে। বাংলাদেশের খুলনাতেও আছে কয়ালঘাট। খোদ কলকাতাতেই ভবানীপুরে আদিগঙ্গায় একটি ঘাট আছে, যার নাম ‘গোলক কয়ালের ঘাট’। তার মানে, নদীমাতৃক ভারতবর্ষের নদ-নদীর ঘাটে ঘাটে ছিল কয়ালদের আস্তানা।
বর্ধমানে আছে কয়ালপাড়া। আছে কামদুনিতেও।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় আছে কয়ালবাজার নামে একটি জায়গা।
কয়ালদের কাজ ছিল মাপদারের। গ্রামে গ্রামে ধান-পাট মাপার কাজ তারাই করত।
কলকাতার কয়লাঘাটায় অনেকবার গিয়েছি বিভিন্ন কাজে। খুঁজে দেখেছি কয়ালদের ডেরাগুলি কোথায় ছিল। অনেককে জিজ্ঞেস করেও দেখেছি। অনেকে বলেছে, জানি না। অবাঙালি ব্যবসাদাররা বলেছে, পাতা নেহি। কেউ কেউ জিজ্ঞাসা শুনে মুখের দিকে তাকিয়ে হেসেছে।
মনে প্রশ্ন জাগে, কোলে মার্কেট কি আসলে ছিল কয়ালের মার্কেট? পরে লোকমুখের বিকৃত উচ্চারণে হয়ে গেল ‘কোয়ালে মার্কেট’ তথা কোলে মার্কেট?
কোলে পদবিটির উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেকে জোর করে কোল-ভিল জাতির সঙ্গে সস্পর্ক খোঁজেন। কয়ালের সঙ্গে কোলে-র কি কোনও সম্পর্ক আছে? নফর কোলের আসল নাম কি ছিল নফরচন্দ্র কয়াল?
গবেষকরা কী বলেন?