জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১২৭ নং কিস্তি
মনু তখন ক্লাস টেনের ছাত্র। আমি বিএ ক্লাসের। একদিন রাতের অন্ধকারে কয়েকজন এসে আমার হাত পা বেঁধে তুলে নিয়ে গেল। পরিবার পরিজনের কাছ থেকে হারিয়ে গেলাম। বাঁচার তাগিদে তখন কি না করেছি। একবার হিন্দু হয়েছি আর একবার মুসলমান। কখনও আমিনা সেজে থেকেছি, কখনও প্রতিমা সেজে থেকেছি।
তোর মল্লিকদা তখন যুদ্ধের সংবাদ পাঠাবার জন্য ওখানে ঘোরা ঘুরি করছে।
দেহটার তখন আর কোনও সারবত্তা নেই। যে যখন পারে লুটে পুটে খায়। আমি যেন পুরুষের হাতের খেলার পুতুল।
একদিন তোর মল্লিকদাও সেখানে গিয়ে হাজির। ভেবেছিলাম সেও হয়তো এসেছে আমার কাছে। কিন্তু দেখলাম কয়েকঘণ্টা আমার পাশে বসে গল্প করে চলে এলো।
প্রায়ই আসা যাওয়া করতো।
কথা বলতাম। বেরোবার সময় হাতে পয়সা গুঁজে দিয়ে চলে যেতো।
আস্তে আস্তে আমার সব জানলো। আমারও কেমন যেন মনে হলো অন্ততঃ একজনকে পেলাম বাঁচার জন্য।
যুদ্ধ তখন থেমে এসেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ফিরে যাবো নিজের দেশে। কিন্তু কোথায় যাবো। কার কাছে যাবো।
একদিন দেখলাম আমার ঘরে পুলিশ এলো। আমাকে তুলে নিয়ে গেলো থানায়। দেখলাম তোর মল্লিকদা থানায় বসে আছে। আমার স্থান হলো একটা হোমে। সেখানে মাস ছয়েক ছিলাম।
তারপর তোর মল্লিকদা হাত ধরে নিয়ে এলো তার ঘরে।
নিয়ে আসার সময় শুধু বলেছিল, হিন্দু ঘরের বৌ হয়ে থাকতে আমার আপত্তি আছে কিনা। না থাকলে তোর মল্লিকদা ধর্মান্তরিত হবে।
মেনে নিলাম না। মেয়েদের আবার ধর্ম। যে পাত্রে রাখবে সেই পাত্রটাই তার ধর্ম।
নিজের শ্বশুর বাড়ি বলতে কি জিনিষ আজও জানি না। তবে সবাইকে দেখেছি। তোর মল্লিকদা তার বাবার ত্যাজ্য পুত্র।
অনেক ঝড় মাথার ওপর দিয়ে গেছে। দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করেছি।
একবার মা হলাম। কিন্তু জন্মদিলাম একটা মৃত সন্তানের। বেঁচে থাকলে অনির মতো বয়স হতো। আমার থেকেও তোর মল্লিকদা বেশি আঘাত পেয়েছিল। অনেক করে ওকে বুঝিয়ে ছিলাম। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। ঈশ্বর আমাকে আর মা হওয়ার সুযোগ দেয় নি। কই তখনও তো আমার মধ্যে এসব চিন্তা আসে নি।
জানিনা অনি তোকে সব বলেছে কিনা। তবে আমি জানি ও সব জানে। ও সময়ের অপেক্ষা করে। একদিন না একদিন ও তার প্রতিশোধ নেবে। আমি হাজার বারন করা সত্ত্বেও ওকে থামিয়ে রাখতে পারবো না।
আর তুই ওর শরীরের সঙ্গে শরীর মিশিয়ে দিলি। আর এটা জানতে পারলি না, ও কি চায়।
ছোটোমার বুক থেকে মুখ তুললাম। চোখে চোখ রাখলাম।
ছেলে-মেয়ে দুটোকে কি বলি বলতো। তাদের মায়ের শরীর খারাপের কি উত্তর তাদের দেব।
ছোটোমা আমার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল।
পাগলির মতো ওই কানা রাতে সেজেগুজে….।
আমি আবার ছোটোমাকে জড়িয়ে ধরলাম।
তুই তো মরেই গেছিলি। সেখান থেকে তোকে একটা ছেলে এতো কষ্ট করে….।
আমি বুবুনকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না ছোটোমা।
তুই একা, আমরা কেউ নই। আমাদের জন্য কি ও কিছুই করে নি? আজ আমরা যে যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার জন্য ওর অবদান কতটা, এটা ভুলে গেলি। স্বার্থ পরের মতো….।
ছোটোমা কোনও কথা বলতে পারলো না। মুখ নিচু করে নিল। ধরা গলায় বললো।
আমরা প্রত্যেকে ওর কাছ থেকে শুধু নিয়ে গেছি। একটা বাপ-মা মরা ছেলেকে কি দিয়েছি বলতে পারিস? ভেবেছিলাম আমরা যাই হইনা কেন, তুই অন্ততঃ ওকে বুঝেছিস। সেই তুই এতটা স্বার্থপর হয়ে গেলি?
আমি কোনও কথা বলতে পারছি না। কেমন যেন বোবা হয়ে গেছি।
ডাইরীর মধ্যে ওসব কি লিখেছিস। অনি যেখানে এতটা বুদ্ধি ধরে, সেখানে ওর বাবা-মার মৃত্যু কিভাবে হয়েছে, সেটা কি ও জানে না ভেবেছিস? আমাদের কাছে প্রকাশ করে নি। সময় হলে দেখবি সেটাও বলবে। আর তুই বা জানলি কি করে?
ওর ঘরের আলমাড়িতে ওর বাবার একটা বই পেয়েছিলাম। তার মধ্যে দুটো চিঠি পেয়েছিলাম। সেখান থেকে।
তুই কি ভাবিস অনি এতো কাঁচা ছেলে, তার হদিস ও কখনও রাখে নি?
ও কখনও স্বীকার করে নি।
সময় হলে করবে। এখনও তার সময় আসে নি।
বাবাঃ সব আদর একলা খেয়ে নিলে চলবে কি করে, আমাদের জন্য কিছু রাখ।
মুখ তুলে তাকালাম। নীরু, কনিষ্ক ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে।
দুজনেরই মুখ একবারে চেনা যাচ্ছে না। কেউ যেন একপোঁচ করে কালি লেপে দিয়েছে মুখে।
এই তো চোখ মুখ একবারে স্বাভাবিক। নীরু বললো।
কনিষ্ক আমার মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
বুবুন কেমন আছে কনিষ্ক?
একইরকম।
আমাকে একটু দেখাবে।
কি দেখবে। একটা নিথর শরীর, গাদাখানেক মেশিনের সাহায্যে কোনও প্রকারে হার্টবিটটা চালিয়ে রেখেছি। সত্যি কথা বলতে কি….।
কনিষ্কর চোখটা ছল ছল করে উঠলো।
এ তুই কি করছিস! নীরু বলে উঠলো।
ও একজন পেসেন্ট।
আর পেসেন্ট।….
কনিষ্ক ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বিশ্বাস কর বুবুন বুকটা এখন আর কেঁপে উঠলো না। একটুও শরীর খারাপ লাগছে না।
ছোটোমা একদৃষ্টে নীরুর দিকে তাকিয়ে।
আমি মাথা নিচু করে বসলাম।
দাও দেখি তোমার বর্তমান অবস্থাটা একটু দেখে নিই।
নীরু এগিয়ে এলো।
অনেকক্ষণ ধরে চেকআপ করলো। তারপর আমার স্যালাইনটা হাত থেকে খুলে দিল।
দুটো দিন রেস্ট নাও ঠিক হয়ে যাবে।
দাদা কেমন আছে নীরু? ছোটোমা বললো।
ডেঞ্জার প্রিয়েড কেটে গেছে। তবে নতুন করে কি বলবো। একটা সাইড পরে গেছে। সময় লাগবে সেরে উঠতে।
দিদি কোথায়? ছোটোমা জিজ্ঞাসা করলো।
বড়োমার কথা বলছো?
হ্যাঁ।
তিনজনকে খেতে পাঠিয়েছি।
নীরু ওর মেশিন পত্র গোছাচ্ছে।
তুমি বাথরুমে গিয়ে একটু ফ্রেস হয়ে নাও।
নীরু আমার দিকে তাকাল।
যেতে পারবে একলা?
পারবো।
রেডি হও, খাওয়ার ব্যবস্থা করছি।
আমি নেমে বাথরুমে গেলাম।
বাথরুম থেকেই শুনতে পেলাম, নীরু ছোটোমকে বলছে।
ছোটোমা।
কি হয়েছে?
আর একটা ঘটনা ঘটেছে।
আবার কি হলো!
সৎপাল রানাকে অফিস যাওয়ার পথে কারা গুলি করেছে। হেবি ইনজিওর্ড ভাগ্যের জোড়ে বেঁচে গেছে। কিন্তু দুটো স্পট ডেড।
সব্বনাশ।
সব্বনাশের কিছু নেই। ওই দুটোও বাঁচবে না। কেউ বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না।
আমি বাথরুমে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বেরলে নীরু যদি কিছু না বলে।
অনির কিছু হবেনা তো?
অর্ক এসেছিল। শুধু বলে গেলো, নীরুদা ভয় পাবে না। তোমাদের গায়ে কেউ যদি হাত দেয়, তাহলে বুঝবে তার বডিটা ওখানেই পরে যাবে নড়া-চড়ার শক্তিটুকু থাকবে না।
নীরু চুপ করে থাকলো।
চারিদিকে আগুন জ্বলছে বুঝলে ছোটোমা। অর্ক হাতে-পায়ে ধরে বলে গেলো। যে ভাবে পার অনিদার সেন্স ফিরিয়ে আন। পারলে এখান থেকে অন্য কোথাও যদি নিয়ে যাওয়া যায় তার ব্যবস্থা করো। অনিদার কিছু যদি হয়ে যায়। কতো লোক যে মরবে, তুমি জানো না নীরুদা। কথাবার্তা যা কানে আসছে শুনে আমার বুক কাঁপছে।
ছোটোমা চুপ করে রয়েছে।
অর্কর কথা মতো, যে মেরেছে সে নাকি এই নার্সিংহোমে এসে ওকে দেখে গেছে। ওকে দেখার পর মাথার ঠিক ছিলো না। ফিরে যাওয়ার পথে ঝেড়ে দিয়েছে। তাও একবারে সৎপালের অফিসের সামনে। ওই রকম একটা ট্র্যাফিক ওরিয়েন্টেড জায়গা, তুমি একবার ভাব!
শ্যামতো ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন করছে। আমাদের বাপ বাপান্তর করে ছেড়ে দিচ্ছে।
কতো টেনশন মাথায় রাখি বলো।
এর মধ্যে ম্যাডাম বাধিয়ে বসলো। তবু অল্পের ওপর দিয়ে গেছে এই রক্ষে।
বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো। তাহলে কি নীরু জানে! ছোটোমা বললো কেউ জানে না।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
স্নান করো নিতো? নীরু আমার দিকে তাকালো।
না।
আজকের দিনটা করো না। অসুবিধে হলে চোখে মুখে জল দিও।
মাথা দোলালাম।
খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে নিও।
নীরু চলে গেলো।
ছোটোমা কেমন বিষণ্ণ মুখে বসে রইলো। কথা বলছে না।
তুই বোস, আমি একটু বাথরুম থেকে আসি।
যাও।
বুঝলাম ছোটোমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। বাথরুমে গিয়ে কিছুটা হয়তো কাঁদবে।
ইসলামভাইকে যে কালকে পুলিসে ধরেছে সেটা কি ছোটোমা জানে? শেষ পর্যন্ত কি হলো সেটা জানা হয় নি। ডাক্তারদাদা এখনও পর্যন্ত এ ঘরে এলো না।
কেমন যেন লাগছিল বুঝলি বুবুন।
ছোটোমা বাথরুম থেকে বেরল।
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। চোখদুটো জবা ফুলের মতো লাল।
বিছানা থেকে নেমে ছোটোমাকে জড়িয়ে ধরলাম।
কি হয়েছে বলো?
কিছু হয় নি।
ইসলামভাইয়ের খবর কি?
ছোটোমা আমার দিকে তাকাল।
এখনও ছাড়ে নি। অনুপ কোর্টে গেছে।
আমার ফোনটা একবার দেবে?
বুঁচকির কাছে আছে।
ওদের একবার ডেকে পাঠাও।
ডাকছি।
ছোটোমার কাপরটা ঠিক করে দিলাম।
ছোটোমা ফোন করার আগেই বড়োমাকে সঙ্গে নিয়ে ছেলে মেয়ে ঘরে এলো।
বড়োমার মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
কেমন আছিস। মিন মিনে গলা।
বড়োমার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ভালো আছি।
ছেলে-মেয়ে দুজনে দিদানের দুই হাত শক্ত করে ধরেছে।
মেয়ের চোখ ছল ছলে।
সামন্ত বললো, তোর নাকি আবার সেরকম হয়েছে।
না কিছু হয় নি। ঠিক হয়ে গেছে। আর শরীর খারাপ হবে না।
তোদের নিয়ে আর পারিনা বাপু।
জ্যেঠিমনি কোথায়?
জ্যেঠিদিদা নিচে বসে আছে। বললো ছুটকি কেমন আছে জানাও, তারপর ওপরে যাবো। দিদাকে ডেকে আনবো মা—ছেলে বললো।
যা। নিয়ে আয়।
ছেলে চলে গেল।
খাবার এলো।
আমি ছোটোমা ছাড়াও ওদের দিলাম।
সবারই মুখে একটা উৎকণ্ঠা।
কি করবো। ফোনা ফুনি করে যেটুকু খবর নেওয়া যায় সেটুকু নিচ্ছি।
বিকেলের দিকে অনুপ এলো। বললো, আজকে জামিন করতে পারিনি। পর্শু আবার হায়ার কোর্টে প্লিড করবো। ওদিকে আবার নাকি সুকান্তকে এ্যারেস্ট করেছে। চিকনা খবর পাঠিয়েছে।
পরের দিন সকালে আমার ঘরে পুলিশ এলো। ওরা নাকি আমার বয়ান নেবে।
আমি রাজি হইনি। অনিমেষদাকে ফোন করে সব জানালাম। বললো, তুই অনুপকে সঙ্গে রেখে বয়ান দে। তার একটা কপি নিয়ে রাখবি। অনুপকে বল সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। এখন ঠাণ্ডা মাথায় ওদের সঙ্গে কো-অপারেট করা আমাদের কর্তব্য।
আবার অনুপকে ফোন করে সব জানালাম। বললো, তুমি ওদের বলো সন্ধ্যার দিকে আসতে। ওদের কথা মতো তাই বললাম।
দেখলাম আমার ঘরের সামনে পুলিশ পোস্টিং হয়ে গেল। কারা আসছে কারা যাচ্ছে। তার হিসাব রাখা শুরু হয়ে গেলো।
আমি ঘরে বন্দী।
নিজের আত্মীয়স্বজন আর ডাক্তার ছাড়া কারুর ঢোকার পার্মিশন নেই।
সন্ধ্যের দিকে অনুপ এলো।
সঙ্গে এলো লোকাল থানার ওসি এবং সিআইডির লোক জন।
অনুপ কিসব কথা বললো, ওদের সঙ্গে। দেখলাম খুব উত্তপ্ত কথা বার্তা হলো কিছুক্ষণ। তারপর ওরা মেনে নিল।
একটা কম্পিউটার মেশিন আনা হলো। অনুপের সামনেই ওরা আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলো। তখন ঘরে শুধু ওদের লোকজন। কনিষ্ক, নীরু ডাক্তার হিসাবে আর অনুপ আমার ল-ইয়ার হিসাবে আমার সঙ্গে ঘরে থাকার পার্মিশন পেল।
সিআইডির একজন অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন।
আপনি অনি ব্যানার্জীকে চেনেন?
হ্যাঁ।
উনি আপনার কে হন?
স্বামী।
কি করে আপনার সঙ্গে পরিচয়?
কলেজ লাইফ থেকে।
বিয়ে করেছেন কবে?
সাল তারিখ বললাম।
আপনার কটি সন্তান?
বললাম।
আজ থেকে পনেরো দিন আগে অনি ব্যানার্জীকে কারা মেরেছে আপনি কিছু জানেন?
ওকে কে মারবে, অনি ব্যানার্জী আজ থেকে কুড়ি বছর আগে মারা গেছেন।
সবাই আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকাল।
আপনি ভেবে বলুন?
ভাবার কিছু নেই। আমার কাছে তার ডেথ সার্টিফিকেট আছে। এমনকি বার্নিং ঘাটে তাকে যে দাহ করা হয়েছে, তার কাগজ পত্রও আছে। দেখতে চাইলে দেখিয়ে দিতে পারি।
তাহলে এই নার্সিংহোমে যিনি ভর্তি আছেন?
তিনি অনিন্দ ব্যানার্জী। সবাই অনি ব্যানার্জী বলে ডাকে।
আপনার সঙ্গে ওনার সম্পর্ক?
উনি আমার খুব ভালো বন্ধু।
কবে থেকে আপনার সঙ্গে ওনার পরিচয়?
কুড়ি বছর হয়ে গেছে।
কোথায় পরিচয় হলো?
আমার কাগজে কাজ করতেন, আমি ওনাকে আমাদের লণ্ডনের অফিসের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলাম। বর্তমানে উনি লণ্ডনের বাসিন্দা। ওখানকার নাগরিক।
যিনি বয়ান নিচ্ছিলেন তার মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
আগে উনি কোথায় থাকতেন?
বলতে পারবো না। কাগজপত্র দেখে বলতে হবে।
ওনার স্ত্রী-পুত্র?
ওনার স্ত্রীর নাম তনুশ্রী ব্যানার্জী। নিঃসন্তান দম্পতি। তাই ইণ্ডিয়া থেকে এ্যাডাপটেসন নিয়ে গেছিলেন। সন্তানের নাম সুন্দর ব্যানার্জী।
ওরা কি এখন ওখানেই থাকে?
হ্যাঁ।
ওনাকে এই অবস্থার কথা জানানো হয়েছে?
হ্যাঁ।
আসেন নি?
এসেছিলেন, চলে গেছেন। আবার আসবেন।
ওনার ট্রিটমেন্টের খরচ?
কাগজের স্টাফ হিসাবে কাগজ বহন করছে।
বলছেন আপনার সঙ্গে ওনার কোনও সম্পর্ক নেই?
একবার বলে দিয়েছি। বারবার এককথা জিজ্ঞাসা করবেন না। তাছাড়া আমার মনে হয় আপনি ব্যক্তিগত ব্যাপারে একটু বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন।
নীরু মাঝখান দিয়ে ইনট্যারাপ করলো। বললো, আমি একবার পেসেন্টকে চেকআপ করবো।
বুঝলাম ব্যাপারটা নীরু লিঙ্গার করতে চাইছে।
বেশ কিছুক্ষণ চেকআপ চলার পর। নীরু বললো, আপনাদের আর পনেরো মিনিট সময় দেব। তারপর ডাক্তার হিসাবে আপনাদের এ ঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য করবো।
সবাই কেমন একটু থমকে গেল।
তারপর সব কেমন যেন তাল কেটে গেল।
পর পর তিনদিন আমার বয়ান নেওয়া চললো। এক একদিন এক একজন আসে, প্রায় দু-ঘণ্টা করে আমার মাথা চিবিয়ে খেয়ে চলে যায়।
পরের দিন ইসলামভাইরা মুক্তি পেল। আমার সঙ্গে দেখা করলো।
মুখের দিকে তাকাতে পারি না। সবার যেন এখন ধৈর্য ধরার সময়।
অনিমেষদা আসে মুখ দেখায় চলে যায়।
বৌদি নিচ থেকে কিছুতেই আর ওপরে ওঠে না।
সুরো, মিলিরা তবু আসে।
কনিষ্ক বললো, এখন তোমাকে ছাড়া যাবে না। কয়েকদিন থাকতে হবে।
ওদের কথা মেনে নিলাম।
নার্সিংহোমে থাকাকালীন একদিন বড়োমা কাঁদতে কাঁদতে এসে বললো আমাদের বাড়ি থেকে বিতাড়িত করে শিল করে দেওয়া হয়েছে।
খুব আপসেট হয়ে পরলাম।
একবার ভাবলাম অনাদিকে ফোন করে বলি। এটা তুমি কি করছো? আজ তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছো, তার জন্য তোমার বন্ধুর কি কোনও অবদান নেই। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তোমার এগুলো বন্ধ করা উচিৎ।
তুমি প্রথম যখন এমএলএ হলে আমার কাছে অফিসে এসে কি বলেছিলে মনে আছে?
তারপর ভাবলাম, না, আমি কিছুতেই এই কাজ করবো না। এতে তোকে অপমান করা হবে। থাকার তো অভাব নেই। সকলকে ও বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম।
দামিনীমাসি আসে কোনও কথা বলে না। শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। চলে যায়।
চারিদিকে গণ্ডগোল চলছেই।
আমি নার্সিহোম থেকে বাড়ি ফিরলাম।
প্রত্যেক দিন আসি, তোর খবর নিই, জ্ঞান এসেছে কিনা। ডাক্তারদাদা শুধু বলে একটু একটু ইমপ্রুভ করছে। যে ওষুধগুলো দেওয়া হচ্ছে সেগুলো শরীরটা নিচ্ছে। এর বেশি তোমাদের কিছু বলতে পারবো না।
এখন ডাক্তারদাদার বাড়ি ঘর এই নার্সিংহোম, মাঝে মাঝে এই বাড়িতে আসে।
আজ নার্সিংহোম থেকে তোকর খবর নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
তোর মনে আছে কি, আমাদের বাড়ির রাস্তায় ঢুকতে ডানদিকে একটা কয়লার দোকান আছে।
দেখেছিস হয়তো খেয়াল নেই।
রাতে খেতে বসেছি। হঠাৎ দেখি বাড়ির দারোয়নটা চেঁচা-মিচি করছে। খেতে খেতে উঠে এলাম। দাদা বাড়িতে চলে এসেছে। পরে দাদার কথা লিখছি। আগে এইটা লিখে নিই।
তারপর দেখলাম রবীন বেরিয়ে গিয়ে একজনকে সঙ্গে নিয়ে আসছে। সারাটা অঙ্গে কালি ঝুলি মাখা। একে তো মিশকালো তারওপর ওইরকম কালি ঝুলি মেখে একবারে চিন্তে পারা যাচ্ছে না। আমি দেখে চমকে উঠলাম। শ্যাম।
আমাকে প্রণাম করে বললো, বড়োমাকে ডাইকে দে।
ভেতরে এসো।
না, সময় লাই, সটকি যেইতে হবে।
আমি ছুটে গিয়ে বড়োমাকে ডেকে আনলাম, মেয়ে, ছেলে দুজনেই পেছন পেছন বেরিয়ে এলো।
বড়োমার পায়ে হাত দিয়ে শ্যাম কেঁদে ফেললো।
তুই বল বড়োমা, ওরা ঠিক কাজ কইরেছে। তুকে কথা দিলাম, অনিদার কিছু হইলে ওদের কাউকে ছারবেক লাই। শ্যাম মইরতে ভয় পায় না।
কিছুক্ষণ বড়োমার পা ধরে কাঁদলো।
তুমি কোথায় এসেছিলে?
কয়লা দিতে এইসে ছিলাম মোরের দুকানে।
তোর ছেলে মেয়ে শ্যামকে আগে কখনও দেখে নি। ওরা ওকে দেখে অবাক। ওদের বললো।
তুদের কোনও ভয় লাই। আমার লোক আছে তুদের সঙ্গে।
এক গ্লাস জল পর্যন্ত মুখে দিল না। বড়োমা কতো করে বললো।
বললো, অনিদা ঠিক হলে তবে জল খাবো এই বাড়িতে।
দাঁড়ালোই না হন হন করে চলে গেল।
শ্যাম চলে যাবার পর, তোর মেয়ে বললো, এইটা শ্যাম আঙ্কেল!
আমি মেয়ের দিকে তাকালাম। যেন ও বিশ্বাস করতে পারছে না।
এবার দাদার কথা বলি।
দাদা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারে নি। আমাদের ওই বাড়ি শিল করে দেওয়া হয়েছে। কেমন যেন প্রথমে থম মেরে গেছিল। তারপর নিয়ে আসা হলো। সেদিন থেকে বোচন দাদার দায়িত্ব নিল।
তোর কথা জিজ্ঞাসা করলো। তনুদের কথা জিজ্ঞাসা করলো। বড়োমা বললো।
কথা বলতে গেলে দাদার মুখ বেঁকে যাচ্ছে।
ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। কি করবো। কিছু করার নেই।
ইসলামভাই কখনও সখনো এসেছে বেশিক্ষণ থাকে নি। চলে গেছে।
তোকে নিয়ে সত্যি ভীষণ টেনশন। এক্ষুণ্ণি ভালো আছিস এক্ষুণ্ণি ডিটোরিয়েট করছিস।
আজ অনেক দিন পর অফিসে এলাম এখানেও সেই একই অবস্থা, ঘর ভর্তি লোক এসে জিজ্ঞাসা করছে অনিদা কেমন আছে।
কাকে কি উত্তর দেব। আজ একুশ দিন হয়ে গেল। তোর জ্ঞান ফেরে নি।
এই একুশ দিনে তোর মুখটা পর্যন্ত আমাকে দেখতে দেয় নি। কনিষ্ককে বলেছি। বলেছে, কি হবে দেখে। আমরা তোমায় মিথ্যে বলছি? বিশ্বাস হয় না আমাদের কথা।
এর ওপর আর কি বলা যাবে।
অফিসে বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না।
মিলিকে সঙ্গে নিয়ে নার্সিংহোমে এলাম। আর ভালো লাগছে না। তোকে ফিরে পাব এই আশাটুকুও ছেড়ে দিয়েছি। শুধু আমি নয় সবাই।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। নিজের ঘরে এলাম।
দেখলাম কেউ নেই। গেলো কোথায় সবাই। বুকের ভেতরটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠলো।
পরি কি মরি করে দোতলায় ছুটলাম।
দেখলাম তোর ঘর থেকে বড়োমা, ছোটোমা, জ্যেঠিমনি চোখ মুছতে মুছতে বেরচ্ছে।
মাথাটা চট করে কেমন যেন ঘুরে গেল। করিডরের দেয়াল ধরে দাঁড়ালাম। মিলি ধরে ফেললো।
মিত্রাদি।
মিলির দিকে তাকিয়ে আছি ঠিক কিন্তু কথা বলতে পারছি না। বুকের ভেতরটা কেমন ধরফর করে উঠলো। ওই টুকু করিডর যেন মনে হচ্ছে একশো মাইল পথ।
মেয়ে ছুটে কাছে এগিয়ে এলো। জড়িয়ে ধরলো।
মনে হয় শুধু বলতে পেরেছিলাম, তোর বাবা।
বাবা এখুনি তাকিয়েছে মা।
কথাটা যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। মেয়ের হাতটা শক্ত করে ধরলাম।
বড়োমা চোখ মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
অনি তাকিয়েছে মিত্রা, আমাকে দেখে চিনতে পেরেছে।
তখন আমার সারাটা শরীর কাঁপছে।
আমাকে ওরা ধরে ধরে সোফাতে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল।
ছোটোমা আমার বুক পিঠ ডলে দিচ্ছে। মিলি এক গ্লাস জল এনে দিল।
আমি ঢক ঢক করে জল খেলাম। শরীরটা কেমন আনচান করছে।
কনিষ্ক, নীরু কতবার আমার সামনে দিয়ে আসা যাওয়া করলো, আমি যে একটা মানুষ তোর বিবাহিত স্ত্রী কেউ পাত্তাই দিল না।
আমি আস্তে আস্তে ধাতস্থ হলাম।
আমাকে ঘিরে ওরা সব দাঁড়িয়ে। আমি কোনও কথা বলতে পারছি না।
প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর কনিষ্ক, নীরু, ডাক্তারদাদা হাসতে হাসতে বেরল।
কতদিন পর ডাক্তারদাদাকে হাসতে দেখলাম বলতে পারব না। তোর সেই ঘটনা ঘটার দিন থেকে ডাক্তারদাদা হাসতেই ভুলে গেছিল। চোখগুলো কেমন কোটরে ঢুকে গেছে। চোখ মুখ বসে একসা।
আমার সামনে এসে দাঁড়াল।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে ডাক্তারদাকে জড়িয়ে ধরলাম।
বুঝলি মিত্রা তোর সিঁদুরের জোড় আছে।
আমার মুখটা বুক থেকে তুলে ধরলো।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সমাপ্তি হলো। আজ রাতে একটু শান্তিতে ঘুমবো।
আমি সব বুঝতে পারলাম। তবু মন মানে না।
নিজের চোখে ওকে একবার দেখতে চাই ডাক্তারদাদা।
ভয় পাবি না? ডাক্তারদার কণ্ঠে স্নেহ ঝড়ে পরছে।
একটুও না।
কষ্ট পাবি না?
মাথা নিচু করলাম।
দেখ কিছু হলে তোর দিকে এখন তাকাবার ফুরসত পাব না। কাল থেকে আর একটা যুদ্ধ শুরু করতে হবে।
ডাক্তারদাদা আমাকে ধরে ধরে নিয়ে এলো।
ঘরে ঢুকেই বুকটা কেমন কেঁপে উঠলো।
অতো বড়ো বিশাল ঘরে তুই একা। তুই ছাড়া ঘরে শুধু মেশিন। শ্বেত শুভ্র বিছানায় তুই শুয়ে আছিস। চোখ বন্ধ। মাথাটা মোটা ব্যান্ডেজে মোড়া। নাকে নল। মুখে অক্সিজেন মাক্স। দু-হাতে দুটো স্যালাইনের বোতল ঝুলছে। শুধু চোখের কাছটা খোলা।
বুকের ভেতরটা চিন চিন করতে শুরু করলো।
তোকে এই অবস্থায় কোনওদিন দেখবো কল্পনা করতে পারি নি।
আগের বারের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। সেবার দেখতে যাই নি। বিশ্বাস করিনি।
মনিটরগুলোয় কতো ধরণের রং-বেরং-এর গ্রাফ, নম্বর ভেসে উঠছে। একজন নার্স তোর মাথার সামনে বসে আছে। সে নোট করছে। আমি ডাক্তারদাদার হাতটা শক্ত করে ধরে আছি।
ওকে এখন ঘুম পারালাম। ঠিক ঘুম নয়। সেন্স আছে একটা ড্রাউজি ভাব সব সময় কাজ করবে।
আমি একটু হাত দিই।
কোথায় হাত দিবি।
ওর মুখটায়।
ওর চোয়াল দুটো ফ্যাকচার হয়ে আছে। সেট করে ব্যান্ডেজ বাঁধা হয়েছে।
ডাক্তারদাদা থামল।
তোদের সেই দিনকার ভয়াবহ দৃশ্যের কথা কিছুই বলি নি।
নিজেরই সন্দেহ ছিল ওকে বাঁচাতে পারবো কিনা। ভেবেছিলাম হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসতে আসতেই মরে যাবে। তোদের মুখ দেখাব কি করে। মাথার আঘাতটা খুব জোরাল ছিল। ঈশ্বরের কাছে রাত দিন প্রার্থনা করেছি। ঈশ্বর আমার প্রার্থনা শুনেছে।
আমি ডাক্তারদাদাকে জড়য়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছি।
আমাকে আর দশটা দিন সময় দে। দেখি কতদূর টেনে নিয়ে যেতে পারি।
ও কথা বলবে?
আশা রাখছি বলবে।
ডাক্তারদা তোর হাতটা ধরে সামান্য নারালো। ডাকলো অনি অনি বলে।
তুই চোখ খুললি না।
ডাক্তারদাদা তোর হাতে চিমটি কাটলো। তুই একটু কেঁপে উঠলি। চোখে মুখে বিরক্তি। তুই চোখ খুললি, আবার বন্ধ করলি। আমাকে দেখেও দেখলি না।
দেখলি ও রেসপন্স করছে।
ডাক্তারদাদা শিশুর মতো বলে উঠলো।
গুড সাইন। বুঝলি মিত্রা, আমার জীবনে এত টেনশন কোনও পেসেন্টের জন্য নিই নি।
ও-তো তোমার সন্তান।
তাই জন্য তো….।
আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। আমার মাথাটা ধরে কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল।
শুধু তাই নয়। ও আমার জীবনের নতুন দিশা। যে কোনও মূল্যে ওকে ফিরে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়েছিলাম। কিছুতেই হারাতে চাইছিলাম না।
এই প্রথম ডাক্তারদাদার চোখ দুটো চিক চিক করে উঠতে দেখলাম।
তুই শরীর খারাপ হয়ে ভর্তি হলি, একবার চোখের দেখা দেখে চলে এলাম। কনিষ্ককে বললাম এই ওষুধগুলো দিয়ে ফেলে রেখে দে, দেখবি ঠিক হয়ে যাবে। ওর দিকে তাকাবার সময় নেই। কিছুতেই ওর থেকে কনসেনট্রেসন ব্রেক করতে চাইছিলাম না। সারা দিন রাত শুধু কনসাল্ট করেছি বন্ধুদের সঙ্গে। পড়াশুনা করেছি নতুন করে।….
তখন তোমার ধ্যান জ্ঞান শুধু বুবুন।
একবারে ঠিক তাই।
কিছুক্ষণ তোর মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো।
যে মেয়েটাকে ভালোবেসেছিলাম, সেই মেয়েটা যদি আমাকে একটা সন্তান উপহার দিত তাহলে ঠিক ওর মতো বয়স হতো।
আমি ডাক্তারদাদার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে। ডাক্তারদাদা আজ বাইশ বছরে আমাকে এরকম কথা কখনও বলে নি।
তোর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।
এই দ্যাখ কি বলতে কি বলে ফেললাম। চল, ওরা আবার কি ভেবে বসে।
বাইরে বেরিয়ে এসে বড়োমার কাঁধে হাত দিয়ে ঝাঁকুনি দিল।
চলো বান্ধবী আজ তোমাদের আমি চা খাওয়াব।
বড়োমা অবাক। ছোটোমার চোখের ভাষা পড়ে ফেললাম।
আমি অবাক হয়ে শুধু ডাক্তারদাদাকে দেখে যাচ্ছি। যে ডাক্তারদাদা বড়োমাকে কোনওদিন স্পর্শ করে নি, সে কিনা বড়োমার কাঁধে হাত দিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে বলছে, তোমাদের চা খাওয়াব!
মন বলছে ডাক্তারদাদা ঠিক ডাক্তারদাদার মধ্যে নেই। একটা ঘোরের মধ্যে আছে।
সেদিন প্রথম, এ্যাচিভমেন্ট কি জিনিষ অনুভব করলাম। তুই আমার পেছনে এই শব্দটা নিয়ে অনেক সময় ব্যায় করেছিস, অনেক বুঝিয়েছিস, মাথায় ঢোকে নি, আজ চাক্ষুষ দেখছি।
টুকরো টুকরো সিকোয়েন্স, সবার সঙ্গে কমবেশি খুনসুটি।
আবার ডাক্তারদাদা নিজের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে।
জানিস মিত্রা আর কোনওদিন ছুঁড়ি কাঁচি ধরবো না প্রতিজ্ঞা করেছি।
কেন! আমার যদি কিছু হয়।
অন্য কেউ করবে। ডাক্তারদা ধীর পায়ে শিঁড়ি দিয়ে নীচে নমছে।
অপারেসন টেবিলে ওর মাথায় ছুঁরি ছোয়াবার আগে ওর পীরসাহেবকে বলেছিলাম, যদি অনি ভালো হয়ে ওঠে, আর কোনওদিন ছুঁরি কাঁচি ধরবো না। ওইই আমার ছুঁরি কাঁচি কেরে নেবে।
সবাই পেছন পেছন আসছে। ডাক্তারদাদার কথা শুনছে।
ডাক্তারদাদা কিন্তু আমার হাতটা ছাড়ে নি। শক্ত করে ধরে আছে। আমি যেন পাঁচ বছরের শিশু। যদি ছুটটে পালিয়ে যাই।
জানিষ মিত্রা ওর পীরবাবার অসীম শক্তি। বিশ্বাস করতাম না। আজ বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। নেগেটিভ পেসেন্ট, এই ধরণের মারাত্মক ইনজুরি, কোটিতে একটা ঠিক হয়। যে ছেলেটা মরেই গেছিল। তাকে ফিরিয়ে আনলাম।
চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে আমার মুখ-মুখি দাঁড়াল। যেদিন প্রথম নিজের পৌরুষ প্রতিষ্ঠা করেছিলাম সেদিন যতটা আনন্দ পেয়েছিলাম, তার থেকেও আজ বেশি আনন্দ হচ্ছে।
ডাক্তারদার ওই রকম পাগলাম দেখে সকলের চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।
বুবুন তোকে কি বলবো, তোর চোখে মাঝে মাঝে ডাক্তারদাদার এই রকম দশা দেখেছি।
তখন তুই পাগলের মতো কখনও আমাকে জড়িয়ে ধরতিস, কখনও কোলে তুলে একপাক ঘুরে মাটিতে ধপাস করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আষ্টে পৃষ্ঠে জাপটে ধরে ঠোঁটটা কামরে ধরতিস। তখন তুই একবারে ছেলে মানুষ। আমি ভীষণ মজা পেতাম।
আজ ডাক্তারদাদার দেখছি সেই দশা।
এতো লোকজন যে ডাক্তারদাকে দেখছে সে দিকে কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই।
যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে।
ডাক্তারদাদা ঘরে ঢুকেই বললো, আজ তুই আমার চেয়ারে বস। আজ আমি তোর ছাত্র, তুই মাস্টারনি।
সবাই হাসছে।
একটা মজার কথা কি জানিষ। বড়োমা সব শুনছে, একটা টিপ্পনি পর্যন্ত কাটে নি।
ভাবলাম হয়তো বলবে ও ডাক্তার তুমি নেশাটেসা করেছো নাকি।
তুই বিশ্বাস কর বুবুন, ডাক্তারদাদা নিজের চেয়ারে আমাকে জোড় করে বসাল, কারুর কথা শুনলো না।
ছেলে মেয়ে বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে ব্যাপারটা উপভোগ করছে। ওদের চোখ মুখ তাই বলছে।
চা স্ন্যাকস এলো। সবাই মিলে খাচ্ছি। ডাক্তারদাদার কিন্তু সেই একই অবস্থা।
এইবার বড়োমা, ছোটোমা, জ্যেঠিমনি, দামিনীমাসি, বৌদিকে নিয়ে পরলো। ঠিক তোর কি হয়েছিল। কতোটা তোর মাথার ক্ষতি হয়েছিল সব বললো। সবাই শুনে থ।
শেষে বললো, ও মনে হয় আর কথা বলতে পারবে না। গলার স্বরটা রাখতে পারলাম না বুঝলে বান্ধবী। ঈশ্বর সব দেন না। কিছুটা নিজের হাতে রেখে দেন, না হলে ডাকবে কেন।
তবে আমি এখনও পর্যন্ত সিওর নই।
অক্ষত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। জানিনা কতটা সফল হবো। যদি কথা বলতে পারে তবে ওর গলার আওয়াজ বেরোতে মাস ছয়েক সময় লেগে যাবে। হয়তো একবছরও লেগে যেতে পারে। আবার নাও লাগতে পারে।
এখন তাহলে বাবা কথা বলতে পারবে না! বোচন বললো।
পারবে। হয়তো ফ্যাস ফ্যেসে একটা আওয়াজ বেরবে।
কনিষ্ক ঢুকলো।
কি হলো রে!
ডাক্তারদাদার গলা একবার চেঞ্জ। শিরদাঁড়া টান টান হয়ে গেল।
ওর সেন্স এসে গেছে।
ওখানে কে আছে?
নীরুকে রেখে এসেছি। সবাইকে ডাকছে।
ডাক্তারদাদা উঠে দাঁড়াল।
বে-আক্কেলে ছেলে তো। ওষুধের গুণ দেখেছিস। কি অদ্ভূত রেসপন্স। চল দেখি।
নিজের মনেই বললো।
এই মুহূর্তে বেশি বেশি প্যাথিডিন চার্জ করাও যাবে না।
প্রেসার কেমন দেখলি।
সামান্য আপ ডাউন করছে।
কারুর দিকে আর তাকালই না, হন হন করে বেরিয়ে গেল।
আমরা সব পেছন পেছন দৌড়লাম।
ওপরের সোফায় এসে বসলাম।
কিছুক্ষণ পর বড়োমার ডাক পরলো। কনিষ্ক মুখ বাড়িয়ে ডাকলো। বড়োমার পেছন পেছন ছোটোমা, দামিনীমাসি, বৌদি, মেয়ে দৌড়লো।
তারপরই দেখি ডাক্তারদাদার তারস্বর চিৎকার ভেসে আসছে ঘরের ভেতর থেকে।
আমার তো বুক দুর দুর করে উঠলো। বড়োমা, ছোটোমা, দামিনীমাসিরা বেরিয়ে এলো, মেয়ে আর বেরোয় না। বড়োমা চোখ মুছছে। কি জিজ্ঞাসা করবো। কিছু বলতেও ভয় পাচ্ছি।
চুপ চাপ বসে আছি। কারুর মুখে কোনও কথা নেই।
শুধু ছোটোমা বলে যাচ্ছে, কেনো তুমি ও সব কথা এই মুহূর্তে বলতে গেলে।
কিছুক্ষণ পর ডাক্তারদাদা বেরোল। চোখ মুখ উত্তেজনায় ফেটে পরছে।
বড়োমার সামনে এসে তারস্বরে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে চিৎকার করে উঠলো।
ন্যাকামো হচ্ছে। আমার পাকা ঘুঁটিটা ফন্দি করে কেঁচিয়ে দেওয়া।
আমি তো ডাক্তারদার মুখ থেকে ওই ভাষা শুনে অবাক।
এক মুহূর্ত আর দাঁড়াল না। হন হন করে নিচে চলে গেল।
মনে মনে আশ্বস্ত হলাম। তাহলে তুই অন্ততঃ পক্ষে ঠিক আছিস।
বেশ কিছুক্ষণ পর কনিষ্কর সাথে মেয়ে বেরিয়ে এলো।
বড়োমা তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
কি বিচ্ছিরি অবস্থা, তুই একবার ভাব। একটু আগে লোকটার একটা রূপ দেখলাম, পর মুহূর্তেই আর এক রূপ। মেয়ে বড়োমাকে কাঁদতে দেখে জড়িয়ে ধরলো।
দাদাইয়ের কথায় মন খারাপ করো না। দাদাইয়ের নিজের মনটাই ভালো নয়।
একটু থামলো।
তুমি দাদাইকে কতটা টেনশনে ফেলে দিলে বুঝতে পারলে।
বড়োমা মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো। আমি তখনও স্থবিরের মতো বসে আছি।
অনেকক্ষণ পর মেয়ের কাছে শুনলাম, বড়োমা নাকি ভেতরে গিয়ে দেখেছে তুই হাসছিস, তখন বলেছে শ্যাম বলেছে, তোর কিছু হলে ওদের একটাকেও জ্যান্ত রাখবে না।
উঃ ভগবান কাকে কি বলবো।
বোবা হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম, মনে মনে বললাম, বড়োমা কাঁদুক। বাড়ি গিয়ে সব ব্যবস্থা করবো।
ডাক্তারদাদা তারপর আর ওপরে এলোই না।
আমি নিজে দেখা করতে গেলাম। দেখা করলো না।
কনিষ্ক বললো আজ চলে যাও। স্যার ভীষণ আপসেট।
মনটা খারাপ হয়ে গেল।
ও ঠিক আছে তো?
কি করে বলি বলো তো। ওই সব কথা শুনে যদি ভেতর ভেতর কোনও রিপার্কেসন হয়। আর সার্ভাইভ করতে পারবো না। আবার একটা চাপা টেনশন সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
রাতে সবার খাওয়া হয়ে যেতে আমরা সব এক সঙ্গে খেতে বসলাম আমি, বড়োমা, ছোটোমা, দামিনীমাসি, জ্যেঠিমনি, মল্লিকদা।
ডাক্তারদার সঙ্গে আমার কি কথা হয়েছে, কেন ডাক্তারদাদা আমার সঙ্গে ওরকম ব্যাব্যহার করছিল, আমার কি অনুভূতি, সব ধীরে ধীরে ওদের বললাম।
ওরা সবাই খেতে খেতে আমার কথা গিলে খেলো। কখনও কখনও অবাক হয়ে যায়।
বড়োমা কনটিনিউ কেঁদে গেল।
কি খারাপ লাগছিল। কিন্তু আমার সান্ত্বনা দেবার কোনও ভাষা নেই। সাতদিন ডাক্তারদাদা এই বাড়ি মুখো হলো না। কাউকে একটা ফোন পর্যন্ত করে নি। নার্সিংহোমে গেলে দেখা করতো না।
কনিষ্কর মুখ থেকে শুনতাম ডাক্তারদাদা ঘণ্টায় ঘণ্টায় তোর ঘরে একবার যায়। তোর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে, আবার চলে আসে।
সাতদিন তোকে সারাক্ষণ ঘুম পারিয়ে রাখলো। জ্ঞান এলেই ঘুমের ওষুধ পুশ করে দেয়। আমাদেরও ঢোকা নিষেধ।
একদিন আমি দুপুরের দিকে একা একা গেলাম। বড়োমারা ওপরেই ছিল। দেখা করলাম না। কনিষ্ক ডাক্তারদাদার কাছে নিয়ে গেল। দেখলাম নার্সিংহোমের পেছনে দারোয়াণদের একটা ঘরে ক্যাম্প খাট পেতে ডাক্তারদাদা শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে। চোখ মুখ শুকিয়ে কাঠ।
আমি যেতেই উঠে বসলো।
আয়।
তারপরেই মাথা নিচু করে কেঁদে ফেললো।
আমি পাশে গিয়ে বসলাম। বুড়োর পিঠে হাত রাখলাম।
জানিস মামনি, বান্ধবী ছেলেটাকে আর একটু হলে মেরে ফেলতো।
তোর ডায়লগ মনে পড়ে গেল। এতক্ষণে অরিন্দম কহিল বিষাদে।
আমি অনুভব করলাম ডাক্তারদাদা কতো কষ্টে, কতটা ভেতর থেকে এই কথাটা বলছে। বুড়োর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক বোঝালাম। কান্না কিছুতেই থামে না।
তারপর বললো, ডাক বান্ধবীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই।
আমি ছুটে গিয়ে বড়োমাকে ডেকে নিয়ে এলাম। ছোটোমাও সঙ্গে এলো।
সে আর এক কেলো। দেখা মাত্রই দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না। তোকে নিয়ে যে দু-জনের মধ্যে এতো মারামারি আগে বুঝতাম না। কেউই সূচাগ্র প্রামাণ ভূমি বিনা যুদ্ধে ছেড়ে দেবে না।
আমি, ছোটোমা কিছুতেই গম্ভীর থাকতে পারি না। হাসতেও পারি না।
মান অভিমানের পালা শেষ হলো।
(আবার আগামীকাল)