“কলম, তুমি কত না যুগ কত না কাল ধ’রে
অক্ষরে অক্ষরে গিয়েছ শুধু ক্লান্তিহীন কাহিনী শুরু ক’রে।
কলম, তুমি কাহিনী লেখো, তোমার কাহিনী কি
দুঃখে জ্বলে তলোয়ারের মতন ঝিকিমিকি” — সুকান্ত ভট্টাচার্য।।
কলম মানে লেখনী। জীবনে প্রথম লেখা শুরু হয়
সরস্বতী পুজোর সময় শ্লেট পেন্সিল আর খাগের কলম দিয়ে। কাচের বদলে মাটির দোয়াতে, কালির বদলে দুধ আর ফাউন্টেন পেন বা বলপেনের বদলে খাগের কলম। ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে ওঠার সাথে সাথেই পেন্সিলকে পাকাপাকি ভাবে বিদায় জানিয়ে বল পয়েন্ট পেন হাতে তুলে নেওয়া।বর্তমানে কম্পিউটার,মোবাইল আমাদের লেখালেখির মূল মাধ্যম হলেও কাগজ কলম কালি আজও অপরিহার্য। তাই হয়তো কথায় বলে ‘কালি কলম মন লিখে তিন জন’। ছোটবেলায় সাধারণ জ্ঞানের বইতে বিজ্ঞানের আবিষ্কারে বল পয়েন্ট পেন আবিষ্কারের কথা পড়েছিলাম। কদিন আগে জানলাম প্রতি বছর ১০ জুন জাতীয় বলপয়েন্ট কলম দিবস পালিত হয়।
আজ তবে বলপয়েন্ট কলমের জন্মের কাহিনীতে ডুব দিই।
অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে কলম জগতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো বল পয়েন্ট পেনের আবিষ্কার।
জন জে লাউড (John J. Loud) নামে একজন আমেরিকান আইনজীবী ১৮৮৮ সালে বলপয়েন্ট কলমের প্রথম পেটেন্ট পান। আইন চর্চায় পাশাপাশি তিনি যন্ত্রাংশ নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসতেন। উদ্ভাবক লাউড এমন একটি কালির কলম চেয়েছিলেন যা কাঠ, চামড়ার পাশাপাশি কাগজের মতো রুক্ষ উপকরণেও লিখতে সক্ষম হবে। তার মাস্টারস্ট্রোক ছিল কলমের মুখে ঘূর্ণায়মান ইস্পাতের বল, যা একটি সকেট দ্বারা ধরে রাখা হত। কলমের মুখের স্টিল বল এবং সকেটের এমন মাপের হবে যাতে পিছনে থাকা তরল পদার্থটি
কোন ভাবে বেরিয়ে পরে না ছড়িয়ে যায় এবং এই ডিজাইনে কালির খরচাও কম হবে।
লাউডের কলমটি আসলে চামড়া এবং কাঠের উপর লিখতে সক্ষম ছিল কিন্তু কাগজের জন্য এটি খুব কঠিন ছিল। নিত্যদিনে ব্যবহার্য কাজে পাতলা কাগজে এটি দিয়ে লেখা যেত না তাই ধীরে ধীরে ডিভাইসটির বাণিজ্যিক মূল্য কমতে শুরু করলো এবং অবশেষে পেটেন্টটি বাতিল হয়ে যায়।
পরবর্তী দশকে বিভিন্ন উদ্ভাবক লাউডের নকশা উন্নত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ১৯৩০-এর দশকে একই প্রযুক্তি নিয়ে হাজির হলেন হাঙ্গেরিয়ান দুই ভাই। শুধু তাই নয় ১৯৪৩ সালে তা বাণিজ্যিকভাবে সাফল্যও পায়।
হাঙ্গেরির সাংবাদিক লাজলো বিরো প্রতিদিন ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করতেন এবং এর অসুবিধাগুলি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত ছিলেন। কেবল বলপয়েন্ট কলমে ফাউন্টেন পেন কালি যোগ করা সমাধান ছিল না। কালির পুনর্বিবেচনা করা দরকার ছিল।
লাসলো ভাই গিওর্গির পেশায় ছিলেন একজন দন্ত চিকিৎসা। শুধু তাই নয় তিনি একজন প্রতিভাবান রসায়নবিদও ছিলেন। ল্যাসলো বুঝতে পেরেছিলেন যে তরল কালি খুব ধীরে শুকায় এবং সংবাদপত্রে ব্যবহৃত কালি আরও কিছু প্রয়োজন। গিওর্গি বুঝেছিলেন কালিকে একটু ঘন করতে হবে অর্থাৎ রসায়নে ভাষায় কালির সান্দ্রতা বাড়াতে হবে। (তরল পদার্থের অভ্যন্তরীণ ঘর্ষণের ফলে প্রবাহে বাধা দেবার প্রবণতাকে সান্দ্রতা বলা হয়।) দুই ভাই মিলে কালির সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের আঠা মিশিয়ে কালির সান্দ্রতা বাড়ানোর পরীক্ষা শুরু করল ।তাদের কাজ এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনল।
আঠালো কালিকে রাখা হলো কলমের একটি নলে, নল থেকে মাধ্যাকর্ষণের টানে ধীরে ধীরে নিবের কাছে এসে কালি জমা পরবে আর বাইরে থাকা পেনের নিবের মুখে খুব ছোট আকারে পিতল স্টিল বা ট্যাংস্টেন কার্বাইডের তৈরি ছোট্ট শক্ত একটি ধাতব বল বা গোলক কাগজের উপর ঘুরতে থাকবে।আর ঘুরতে থাকার সময় সেই চাকা কালির সংস্পর্শে যেটুকু আসবে সেখান থেকেই লেখা হবে। শুধু তাই নয় এই ধরনের আঠালো কালি কাগজে লেখা মাত্রই শুকিয়ে যাবে।
বর্তমানে ব্যবহৃত রোল-অন ডিওডোরেন্টের ক্রিয়াটি বলপয়েন্ট কলমের মূল নীতিকে অনুসরণ করে বানানো হয়েছে। বিরো ভাইদের বানানো কলমের প্যাকেজটি ছিল লাউডের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
১৯৩৮ সালে ব্রিটেনে লাসলো তার নতুন কলমের পেটেন্ট পান, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে তার নতুন আবিষ্কার বাজারজাত করার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। লাসলো এবং তার ভাই ইহুদি হওয়ায়, ১৯৪১ সালে তারা ইউরোপ থেকে পালিয়ে আর্জেন্টিনায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে, লাসলো তার নতুন আবিষ্কারে ফিরে আসেন, তার সহযোগী পলাতক জুয়ান জর্জ মেইনের সাহায্যে। এখানে এসে তিনি চালু করেন ‘বিরোম’ নামের বল পয়েন্ট কলম।
১৯৪৩ সালে ‘বিরোম’যখন আর্জেন্টিনায় পরিচিতি লাভ করে, তখন ইউরোপ এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুদ্ধ চলছিল। কলমের নকশাটি রয়্যাল এয়ার ফোর্স (RAF) এর আগ্রহ জাগিয়ে তোলে, যারা ৩০,০০০ কলমের অর্ডার দেয়। কলমগুলি উচ্চ উচ্চতায় বিমান ক্রুদের দ্বারা ব্যবহার করা সম্ভব ছিল, আগে ফাউন্টেন কলম মাধ্যাকর্ষনের বিপরীতে চাপের পরিবর্তনের কারণে লিক হয়ে যেত।
সেই সময় আমেরিকান ব্যবসায়ী মিল্টন রেনল্ডস বুয়েনস আইরেস সফর করছিলেন এবং নতুন কলম দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন – তিনি বেশ কয়েকটি কলম কিনেছিলেন এবং আমেরিকায় ফিরে এসে একটি নতুন নকশা বাজারজাত করার জন্য রেনল্ডস ইন্টারন্যাশনাল পেন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, রেনল্ডসের নকশায় ল্যাসজলো বিরোর পেটেন্ট এড়িয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিবর্তন আনা হয়েছিল এবং সেই বছরের অক্টোবরে তাঁর উদ্ভাবিত নতুন কলম প্রচুর বিক্রি হয়েছিল। ধীরে ধীরে পার্কারের মতো আরো কয়েকটি বিখ্যাত ফাউন্টেন কলম নির্মাতা বল পয়েন্ট কলমের বাজারে প্রবেশ করতে শুরু করে।
ধাতব কলম দীর্ঘস্থায়ী তাই রিফিল কিনে নিলেই সমস্যা মিটে গেল। মানুষ এবার রিফিল কিনতে শুরু করে। ফলে এবার কলম কোম্পানির বাজারে নতুন সংকট এলো রিফিলের।
ইতালিয়ান ব্যবসায়ী মার্সেল বিক কলমের বাজারকে দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে বুঝেছিল কলম ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্য হয়ে উঠেছে। তাই উচ্চ দামের পরিবর্তে দাম কমানোর কথা তার মাথায় ঘুরেতে লাগলো। ষাটের দশকে তিনি প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার করে সুলভে কলম তৈরি শুরু করেন। ফলে বাজার থেকে খুব সহজেই কাঠ, ধাতু, কাঁচ,কাঠের কলম হারিয়ে যেতে শুরু করলো।
বল পয়েন্ট কলমের কালি একটি আবরণে (রিফিল) ভরা থাকে। দামি বল পয়েন্ট কলমে রিফিল শেষ হলে নতুন রিফিল ভরা যায়। কম দামি কলমে রিফিল শেষ হলে কলমটাই ফেলা হয় তাই এর আরেক নাম হল ‘ইউজ অ্যান্ড থ্রো’।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় এক ধরনের কলম বাণিজ্যিকভাবে পাওয়া গেল।এটি ‘সফট টিপ কলম’ তরল চলাচলে সমর্থ্য ছিদ্রযুক্ত পদার্থ দিয়ে তৈরি। এই ধরনের কলমে একটি সিনথেটিক পলিমার নিয়ন্ত্রিত ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে সংরক্ষিত আধার থেকে কালি লেখ্য উপাদানের পৃষ্ঠদেশে পাঠায়। এই ধরনের ফাইবার টিপ কলম গুলি আঁকা ও অক্ষর তৈরি এবং প্লাস্টিক ও কাচের ওপর লেখার কাজে ব্যবহৃত হয়।
বল পয়েন্ট পেনের মতো একই পদ্ধতির কলম হলেও ‘রোলার বল’ বা ‘জেল কলম’ কালির ঘনত্বের বদলে তরল কালি যোগান দেয়, লেখা স্পষ্ট করে তোলে।
ব্যক্তিগতভাবে আমিও কলম প্রীতি লালন করতাম। কলমবিলাস বজায় রাখতে পারিনি। তবে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম বল পয়েন্ট পেনে।
যাই হোক, বল পয়েন্ট কলম ফাউন্টেন পেনের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে এক অনবদ্য জায়গা করে নিয়েছে মানব জীবনে।আজকে বল পয়েন্ট কলম ছাড়া পুরো দুনিয়া অচল। পড়াশোনার টেবিলে ঘরে অফিসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অত্যন্ত অযত্নের জিনিসটির জন্মের ইতিহাসটা আসলে ছিল এতটাই দুর্গম।।