‘বিদ্যাসাগর বুঝি তাঁর নামই?’ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এর মত মানুষের কাছেও ঈশ্বরচন্দ্র এমনই ছিলেন। তিনি অবশ্যই জানতেন এটি উপাধি মাত্র, কিন্তু ‘স্বাধীনচেতা বিদ্যাসাগর’-এ স্যর আশুতোষ লিখেছেন যে ‘বিদ্যাসাগর’ আমার নিকট একজন মানুষের নামমাত্র নয়, ইহা আমার নিকট মন্ত্রস্বরূপ।
বিদ্যাসাগর বললে বাঙালি একজন মানুষকেই চেনে, তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর যে কারোর শিক্ষাগত যোগ্যতার পরিচায়ক এক উপাধি মাত্র, তা অনেকেই মনে করতে পারেন না। কিন্তু বিদ্যাসাগর উপাধির একচ্ছত্র মালিকানা ঈশ্বরচন্দ্রের নয়। অনেক বিদ্যাসাগর মাঝে ঈশ্বরচন্দ্র একজন মাত্র!
বিদ্যাসাগরের প্রথম জীবনী রচয়িতা, তাঁর ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নও ভাবতে পারেননি তাঁর বড় ভাইয়ের সংস্কৃত কলেজ থেকে পাওয়া কোন উপাধি ভবিষ্যতে এমন নাম বাচক পরিচয় বহন করবে! ঈশ্বরচন্দ্র কবে বিদ্যাসাগর উপাধি পেয়েছিলেন তা নিয়েও মতদ্বৈধতা কিছু কম নেই।
সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্য, ব্যাকরণ, অলঙ্কার শাস্ত্র ও ধর্মীয় শাস্ত্রে পন্ডিত ব্যক্তিদের যোগ্যতা ও দক্ষতার উপর নানা ধরনের উপাধি প্রদান এ দেশের এক প্রাচীন ঐতিহ্য। মুঘল আমলে ফার্সী রাজভাষা হলেও সংস্কৃতের গুরুত্ব কমেনি। হিন্দু শিক্ষিতজনের কাছে সংস্কৃতের বিসর্জন তখনও বাতুল কল্পনা ছিল। ইংরেজরা বাংলায় ক্ষমতালাভের পর যে সামাজিক অংশের সাহায্য সহযোগিতায় সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেছিল তারা ছিল মূলত হিন্দু। ক্ষমতায় আসীন বিদেশী শক্তি বিদ্রোহের ভয়ে এদেশের প্রচলিত ব্যবস্থায় শুরুতেই হস্তক্ষেপ না করে একে জিইয়ে রেখে শাসন করার নীতি নেয়। একারনেই কলকাতা মাদ্রাসা ও সংস্কৃত কলেজের সৃষ্টি। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে আগেকার নিয়মেই চলতে দেওয়া হয়। নানা ধর্মীয় পার্বনে ছুটি থেকে শুরু করে উপাধি প্রদানের ক্ষেত্রেও পুরনো নিয়ম বহাল রাখা হয়। তাই ইংরেজ শাসনের মধ্যগগনেও আমরা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির রমরমা লক্ষ্য করি। ১৮২৯ সালে রীতিমত সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী সংস্কৃত কলেজের নানা শ্রেণির সফল ছাত্রদের উপাধি প্রদান করা হয়। বলা যেতে পারে এই প্রচেষ্টা ছিল প্রচলিত সংস্কৃত শিক্ষালয়ের ধাচাকেই সরকারি মান্যতা দেওয়া।
গোপিকামোহন ভট্টাচার্য তাঁর ‘কলিকাতা সংস্কৃত কলেজের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন, — “১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দ হইতে সংস্কৃত কলেজে উক্ত উপাধি অর্পণের রীতি প্রবর্তিত হয়”। তিনি লিখেছেন, সংস্কৃত কলেজের ছাত্ররা নিজেদের পছন্দমতো উপাধি বেছে নিতে পারতো। তখনকার সময়ে প্রায় অর্ধশতক উপাধির একটি ছিল বিদ্যাসাগর। এমন উপাধিগুলির মধ্যে বিদ্যাসাগর ছাড়াও বিদ্যালংকার, তর্কভূষণ, তর্কসিদ্ধান্ত, বিদ্যাবাগীশ, তর্কবাগীশ, তর্করত্ন, বিদ্যাভূষণ ছিল অন্যতম। এই অজস্র উপাধিধারী পন্ডিতদের মধ্যে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি প্রাপ্ত পন্ডিতও ছিলেন অনেকেই। আমরা আরেকটু পিছিয়ে গেলে দেখবো কেবল সংস্কৃত কলেজ নয়, দেশের প্রচলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি নানা ধরনের উপাধি দিত এবং বিদ্যাসাগর উপাধি প্রদান অপ্রচলিত ছিলনা।
দেশে সর্বপ্রথম বিদ্যাসাগর উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে নবদ্বীপের নিমাই পন্ডিত। ঈশ্বরচন্দ্রের অনেক আগেই, প্রায় সাড়ে তিনশো বছর পূর্বে আচার্য বেদ পঞ্চানন তাঁর টোলের ছাত্র নিমাইকে এই উপাধি দেন। টোলের পাঠ শেষ করে নবদ্বীপে ফিরলে সারা নবদ্বীপ তাঁকে সম্বর্ধনা দেয়। এ প্রসঙ্গে বৃহৎবঙ্গ — এর রচয়িতা দীনেশ চন্দ্র সেন লিখেছেন, Nemai (Sri Chaitanya Dev) completed his education and was given the title ‘Vidyasagar’ (the ocean of learning) in 1501 A. D.
বাংলার ইতিহাসে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি পেয়েছিলেন অনেকেই। অর্থাৎ বিদ্যাসাগর উপাধির একচ্ছত্র মালিকানা ঈশ্বরচন্দ্রের নয়। সংস্কৃত কলেজ থেকেই ঈশ্বরচন্দ্রের অন্যতম সুহৃদ তারানাথ তর্কবাচস্পতির পুত্র জীবানন্দ বিদ্যাসাগর উপাধি পান। আবার সংস্কৃত কলেজের আওতার বাইরে অনেকেই এই উপাধি পেয়েছিলেন। যেমন ঢাকার বান্ধব সমিতির সম্পাদক কালীপ্রসন্ন ঘোষ পূর্ববঙ্গ সারস্বত সমাজ থেকে বিদ্যাসাগর উপাধি পান। আবার বাংলার পন্ডিত সমাজ মহামহোপাধ্যায় পূন্ডরীকাক্ষ ভট্টাচার্য এবং গণনাথ সেন কে এই উপাধিতে ভূষিত করে। সমাচার চন্দ্রিকা সম্পাদক প্রাণকৃষ্ণ, হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ-এর পুত্র শশিশেখর কাব্য ব্যাকরণতীর্থ — সকলেই বিদ্যাসাগর উপাধি পেয়েছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর পিতা হরানন্দ ভট্টাচার্য সংস্কৃত কলেজ থেকে এই উপাধি পান। আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীও ছিলেন অনন্য এক ‘বিদ্যাসাগর।
ঈশ্বরচন্দ্রের মতই সংস্কৃত কলেজের কৃতী ছাত্র ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রীর পিতা হরানন্দ ভট্টাচার্য। বর্তমান দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার মজিলপুর গ্রামে ১৮২৭ সালে তাঁর জন্ম হয়। দশ বছর বয়সে সংস্কৃত কলেজে যোগ দেন এবং বিদ্যাশিক্ষা শেষ হলে বিদ্যাসাগর উপাধি অর্জন করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গেও তাঁর সদ্ভাব ছিল। শিবনাথ শাস্ত্রীর আত্মচরিত থেকে জানা যায় প্রথম বিধবা বিবাহ সভায় শিবনাথ উপস্থিত ছিলেন। হরানন্দ-ঈশ্বরচন্দ্রের আন্তরিক সখ্যতাই এর কারণ ছিল। সামান্য সময়ের জন্য হরানন্দ জজ পন্ডিতের চাকরী করেন। পরে নিজের গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে সেখানেই থিতু হন। তিনি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্রের মতই একগুঁয়ে ও দৃড়চেতা। গ্রামের জমিদারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি তাঁর মেয়েকে গ্রামের স্কুলে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। সে সময় এ বড় সহজ কাজ ছিলনা।
রংপুর জেলার নলডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন নীলকমল লাহিড়ী। পিতা ছিলেন কালীমোহন লাহিড়ী, মায়ের নাম ছিল কাশীশ্বরী দেবী। স্থানীয় অধ্যাপকদের তত্বাবধানে কাব্য, ব্যাকরণ, স্মৃতি বিষয়ে বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়ে তিনি বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। পরবর্তী জীবনে পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত ‘কালীধামে’ চতুষ্পাঠী খুলে অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন। বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। এর মধ্যে শ্রী শ্রী সরস্বতী পূজা পদ্ধতি ছিল বহুল প্রচলিত। এছাড়াও তাঁর ‘কৃষিতত্ব’ বিষয়ক বই সে যুগের প্রেক্ষিতে স্বতন্ত্র উল্লেখের দাবি রাখে।
প্রাণকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরের জন্ম হরিনাভি গ্রামে। পিতা ছিলেন রামধন শিরোমনি। সংস্কৃত কলেজের এই অধ্যাপক প্রাণকৃষ্ণ কিছুদিন ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। তাঁর লেখা অন্যতম গ্রন্থ ছিল কুলরহস্য, শ্রী শ্রী অন্নপূর্ণা শতকম, ধর্মসভা বিলাস, শিবশতক স্তোত্র।
এমন অনেক বিদ্যাসাগরের মধ্যে ছিলেন রাজীবলোচন বিদ্যাসাগর, শশিশেখর কাব্য ব্যাকরণ পুরানতীর্থ বিদ্যাসাগর, হরিহর বিদ্যাসাগর। রাজীবলোচন মিথিলায় জ্যোতিষ শাস্ত্রে পান্ডিত্য দেখিয়ে বিদ্যাসাগর হন। অন্যদিকে হরিদাস সিদ্ধান্ত বাগীশ এর পুত্র শশিশেখরও ছিলেন বিদ্যাসাগর। নদীয়া জেলার নাকাশিপাড়ায় জন্মেছিলেন হরিহর বিদ্যাসাগর। নবদ্বীপে ব্যাকরণ ও কাব্যে বূৎপত্তি প্রকাশ পেলে পন্ডিত সমাজ তাঁকে বিদ্যাসাগর উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ঢাকার ভাওয়াল রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ-এর আমন্ত্রণে সারস্বত সমাজ চতুস্পাঠীর অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ব্যতীত যিনি বিদ্যাসাগর বলে বঙ্গদেশে সবচেয়ে পরিচিত ছিলেন তিনি হলেন জীবানন্দ বিদ্যাসাগর। বর্ধমানের অম্বিকা-কালনা ছিল তাঁর পৈত্রিক নিবাস। বিদ্যাসাগর সুহৃদ তারানাথ তর্কবাচস্পতি ছিলেন জীবানন্দের পিতা । অম্বিকা দেবী জীবানন্দের মা। পরবর্তী জীবনে ঈশ্বরচন্দ্র ও তারানাথের মধ্যে মনোমালিন্য হলেও পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছিল অটুট। ১৮৪৪ সালে জীবানন্দ জন্মগ্রহণ করেন। সংস্কৃত কলেজ থেকেই জীবানন্দ বি. এ পরীক্ষায় পাশ করেন এবং সংস্কৃতের নানা শাখায় পান্ডিত্যের জন্য ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করেন। কাশ্মীর ও নেপালের রাজার উচ্চবেতনের চাকরি উপেক্ষা করে জীবানন্দ পিতার পথ অনুসরণ করেন। তিনি বই লেখা ও সেই বই বিপননের ব্যবসা শুরু করেন। জীবানন্দ তাঁর পিতা ছাড়াও পিতৃসম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতই স্বীয় ক্ষমতায় স্বাবলম্বী হতে চেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগরের মত তিনিও ছিলেন এক অনন্য বিদ্যা-বনিক। নিজের বাড়ীতেই তিনি চতুষ্পাঠী খুলে অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ। জীবানন্দ তাঁর জীবৎকালে ১০৭ খানি সংস্কৃত বই টীকা-সহ প্রকাশ করেছিলেন। সোমদেবের কথাসরিৎসাগর সংস্কৃত গদ্যে প্রকাশ তাঁর এক প্রধান কীর্তি। সংস্কৃত গ্রন্থ সম্পাদনা ও প্রকাশে একক ভাবে কেউই জীবানন্দকে অতিক্রম করতে পারেননি।
কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর? তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। বিদ্যাসাগর বলতে শুধু একজন মানুষকেই বোঝায় এবং তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। অনেক বিদ্যাসাগর মাঝে তিনি একক। উনিশ শতকের বাংলায় তিনি এক সমাজ বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। কোন দল, কোন পক্ষ নয় ; একা তিনি ছিলেন এক অগ্নিশিখা। সেই সুদূর বীরসিংহ থেকে এসে ছোটখাটো মানুষটি বাঙালির অন্তরে আত্মবিশ্বাস ও স্বীয় ক্ষমতার আলো জ্বেলেছিলেন। তাই বিদ্যাসাগর নামের আড়ালেই রয়ে গেলেন ঈশ্বরচন্দ্র।
পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৩-এ প্রকাশিত