দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় না থাকলেও প্রায়ই মুখ বদলের জন্য বাঙালির হেঁসেলের মেনুতে ঢুকে পড়ে সয়াবিন। মাছ মাংসের বিকল্প হিসেবে নিরামিষাশীদের কাছে সয়াবিনের চাহিদা বিপুল। তবে শুধু নিরামিষাশীদের ক্ষেত্রে নয়, সয়াবিন সকলের জন্যই যথেষ্ট উপকারী। হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস, অস্টিওপোরেসিস, ক্যান্সার, ওবেসিটি, চোখের অসুখ, হজমের গোলমাল, উচ্চ রক্তচাপ এরকম অসংখ্য রোগের ক্ষেত্রেই প্রোটিন সমৃদ্ধ সয়াবিন খেলে যথেষ্ট উপকার পাওয়া যায়। এককথায় একে সর্বরোগহর বললেও অত্যুক্তি হবে না। একে’নিরামিষাশীর মাংস’ও বলা হয়।
সয়াবিনের গাছকে গ্রেটারবিনও (greater bean) বলা হয়। শব্দ টা মূলত এসেছে চিনা বা জাপানি ‘সয়া সস্’ থেকে। খ্রিস্টপূর্ব ১১ শতকে উত্তর চিনা বা মঙ্গোলিয়ান খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল সয়াবিন। জাপানী বৌদ্ধমঠে সয়াবিন অন্যতম খাদ্য হিসেবে গৃহীত হত বলে জানা যায়। ইউরোপে অষ্টাদশ উনবিংশ শতকে সয়াবিনের ব্যবহার প্রসারিত হয়। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হল বিশ্বের বৃহত্তম সয়াবিন উৎপাদনকারী দেশ। ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে সয়াবিনের ব্যবহার বেশি করে হচ্ছে। মধ্যপ্রদেশ হল ভারতের বৃহত্তম সয়াবিন উৎপাদনকারী রাজ্য, তারপরে রয়েছে যথাক্রমে মহারাষ্ট্র এবং রাজস্থান। আজকের অধিক ফলনশীল এবং উন্নত গুণমান বিশিষ্ট সয়াবিন কৃষি গবেষণায় অত্যাধুনিক জিন প্রযুক্তি প্রয়োগের ফসল। পশ্চিমবঙ্গের আবহাওয়া এবং পরিবেশ সয়াবিন চাষের জন্য উপযোগী।
মূলত সয়াবিন একটি ডাল জাতীয় শস্য। শুকনো সয়াবিনে রয়েছে ২০%তৈল, ৪০% প্রোটিন, ৩৫% কার্বোহাইড্রেট। অত্যাবশ্যক অ্যামিনো এসিড সম্মিলিত হওয়ায় দেহ গঠন বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্যালসিয়াম ম্যাগনেসিয়াম পটাশিয়াম বি এবং সি ভিটামিন সমৃদ্ধ সয়াবিনে ফাইবারে পরিমাণ যথেষ্ট বেশি। সয়াবিনের তেলে স্যাচুরেটেড মোনোস্যাচুরেটেড ও পলিস্যাচুরেটেডের মাত্রা সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় ভোজ্য তেল হিসেবে যথেষ্ট উপদেয়।
সাবান, গ্লিসারিন, রং, মুদ্রণের কালি প্রভৃতি দ্রব্য বাণিজ্যিক উৎপাদনে সয়াবিন অপরিহার্য উপাদান হিসাবে ব্যবহার হয়। খামারের পশুদের জন্য সয়াবিন হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিনের উৎস এবং এটি জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে ব্যবহার হয়। সয়াবিনের প্রোডাক্ট বলতে আমরা এখন সয়াবিনের বড়ি, টোফু, মিশো, সয়ামিল্ক, টেম্পে, সয়াসস, সয়াআটা, সয়াকার্ড এই ধরনের খাবার বুঝি। অঙ্কুরিত সয়াবিন স্যালাড হিসেবে খাওয়া হয়। সয়াবিনের বীজকে নানাভাবে প্রসেসিং করা হয়। প্রথমে সয়াবিনের বীজকে চাপ দিয়ে ভেঙে তার তেলটা বের করে নেওয়া হয়। এরপর এক্সক্লুডার নামে এক বিশেষ মেশিনের সাহায্যে অতি উচ্চ তাপমাত্রা ও চাপের মাধ্যমে তৈরি করা হয় সয়া নাগেটস। সেখান থেকেই আসে সয়াবিনের বড়ি। জেনে নেওয়া যাক সয়াবিনের হেলথ বেনিফিটগুলি —
কার্ডিওভাস্কুলার ডিসিজ (Cardiovascular disease): সয়াবিনের যে কোন আইটেম তিন-চার দিন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেতে পারলে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের বিপদসম্ভবনা থেকে অনেকাংশে এড়াতে পারেন হৃদরোগীরা। এতে উপস্থিত আইসোফ্ল্যাভেন (isoflavon) ও লেসিথিন (Lecithin) জোরালো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (Antioxidants) যা কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও সোডিয়াম কনটেন্ট যথেষ্ট কম ও উল্লেখযোগ্য ফাইবার ও পটাশিয়াম থাকে।
অস্টিওপোরেসিস (Osteoporosis): এক পর্যবেক্ষণ বলছে সপ্তাহে কম করে তিন দিন ৩০ থেকে ৫০ গ্রাম সয়াবিন বা তার তৈরি প্রোডাক্ট খেলে হাড়ের ক্ষয় প্রতিরোধ করা যায়। শুধুমাত্র অস্টিওপোরেসিসের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষের হাড়ের ক্ষয়জনিত সমস্যায় ভুগে পঙ্গু জীবনযাপন করতে হয়। শুধুমাত্র সয়া প্রোটিন ডায়েট এবং পাশাপাশি যোগাসন বা ব্যায়ামের দ্বারা এই সমস্যার অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
পোস্ট মেনোপজাল সিনড্রোম (Post menopausal syndrome): রোজকার ডায়েটে ফাইটোইস্ট্রোজেন (Phytoestrogens) সমৃদ্ধ সয়াপ্রোটিন থাকলে পঞ্চাশোর্ধ মহিলাদের দেহে ইস্ট্রোজেনের অভাব পূরণ করে এবং হটফ্লাশ, মানসিক অস্থিরতাবা মুড স্যুইং, অস্টিওপোরেসিস, ত্বকের রুক্ষতা ইত্যাদি পোস্ট মেনোপ্রাজল সিনড্রোমের মোকাবেলা করে।
ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স (Lactose intolerance): শিশু থেকে বৃদ্ধ যাদের ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স আছে অর্থাৎ দুধের কার্বোহাইডেট হজম হয় না, তাদের জন্য সয়ামিল্ক অত্যন্ত হিতকর।
হজমের গোলমাল (Digestive disorders): টোফু, টেম্পে জাতীয় ফারমেন্টেটেড প্রোডাক্ট এ ব্যাকটেরিয়া কালচারের ফলে ভিটামিন বি টুয়েলভ তৈরি হয়ে যায় এবং যা সহজেই হজম হয়। এতে অলিগোস্যাকারাইডের (Oligosaccharides) পরিমাণ কমে যাওয়া পেটে গ্যাস হয় না। দুর্বল হজম শক্তির মানুষেরা সয়াকার্ড, পনির বা টোফু ট্রাই করতে পারেন।
কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation): সয়াবিনের মধ্যে দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় ফাইবার থাকে। দ্রবণীয় ফাইবারটি শরীরের কোলেস্টেরলের (Cholesterol) ও ব্লাড সুগারকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। অদ্রবণীয় ফাইবার কোলন ক্যান্সারের সম্ভাবনা ও হজমের সমস্যা কমায়, কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমিয়ে শরীর ঝরঝরে রাখে। সয়াবিনের বাইরের ছালটি ডায়েটারি ফাইবারের ভালো উৎস।
অকালবার্ধক্য রোধ (Prevent premature aging): দীর্ঘ নিরোগ জীবন উপভোগ করতে চাইলে ডায়েটে সয়া প্রোডাক্ট রাখার চেষ্টা করুন কারণ সয়াবিনের আইসোফ্ল্যাভেন (Isoflaven) অত্যন্ত জোরালো ফাইটোইস্ট্রোজেন (Phytoestrogens) যা ত্বক ও চুল উজ্জ্বল ও ঝকঝকে রাখতে সাহায্য করে। এতে থাকা লেথিসিন ফ্যাট মেটাবলিজম কন্ট্রোলে সাহায্য করে।
সয়াবিনের ফাইবার ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ, জ্বরজারি ও অন্যান্য রক্ত দূষণ ঘটিত সমস্যা প্রতিরোধ ও প্রতিকার করতে সাহায্য করে। ভাবি মা, শিশু ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের অপুষ্টি দূর করে দেহে শক্তি আনতে সয়াবিনের জুড়ি নেই।চোখের স্বাস্থ্য, কগনিটিভ ফাংশন, অ্য্যালঝাইমার্স ডিজিজ, অ্যানিমিয়া, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, ওবেসিটির মত রোগকে কন্ট্রোলে রাখতে সপ্তাহে অন্তত তিন/ চার দিন ডায়েটে রাখতে পারেন সয়াবিন।
তবে সয়াবিন ব্যবহারের আগে কিছু জিনিস মনে রাখবেন। যাদের প্রোটিন বেশি খাওয়া বারণ তাদের সয়াবিন এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। সয়াবিনকে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে যে সকল খাদ্য তৈরি হয় তাদের মধ্যে প্রচুর ভেষজ ইস্ট্রোজেন (phytoestrogens) থাকে যা মহিলাদের ব্রেস্ট ক্যান্সারের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে। লিভারের সমস্যা ,কিডনির সমস্যা, হাইইউরিক অ্যাসিড, হাইপারটেনশনের মতো কিছু কিছু অসুখে দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় প্রোটিন ভীষণভাবে মেপে খেতে হয়, সে ক্ষেত্রে খাদ্য তালিকায় সয়াবিন না রাখাই ভালো।
সয়াবিন কখনো ধুয়ে বা না ভিজিয়ে খাবেন না কারণ সয়াবিন ভেজালে খানিকক্ষণ পরে দেখা যায় সাদা ফেনার মতো আস্তরণ এর উপর পড়েছে। সেই ফেনা যুক্ত জল ফেলে দিলে তাকে ক্ষতিকারক যৌগগুলোও বেরিয়ে যায়। তাই রান্না করার আগে ভালো করে ধুয়ে নেওয়া খুব জরুরী।
সয়াচাঙ্ক বা গ্রেনুয়ালের তুলনায় পুষ্টিগুণের বিচারে আস্ত সয়াবিন অনেক বেশি উপকারী। সয়াবিন ভাজা মাছের দুধ যেভাবেই খাওয়া হোক তাতে তার প্রোটিন ভ্যালু কিছু কমে না। কিন্তু ভাজা সবজিতে অতিরিক্ত মসলা মিশিয়ে খেলে তাতে শরীরের ফ্যাট বাড়ে, হজমের গোলমাল হয়।
প্রাণিজ মাংসের বিকল্প হিসেবে মর্যাদা বাড়ছে সয়া বড়ি বা সয়া নাগেটসের। ঘিসিপিটি সয়াবিনে ঝোল খেয়ে বোর হয়ে গেলে বৃহত্তর কিচেন কম্যুনিটি থেকে বাড়িতে তৈরি করে নিতে পারেন সয়াবিনের হরেক রকমের লোভনীয় রেসিপি। রোজের খাদ্য তালিকায় মাছ মাংস ডিম বা সাধারণ শাক সবজির পাশাপাশি সয়াবিনের চমকদার রেসিপি সপ্তাতে তিন চার দিন রাখতেই পারে। তাই সুস্থ থাকতে নিজে খান ও পরিবারের সকলকে খাওয়ান সয়াবিন।।
ডিসক্লেইমার (Disclaimer): এই প্রতিবেদনটি শুধুমাত্র সাধারণ তথ্যের জন্য। এটি কোনওভাবেই কোনও ওষুধ বা চিকিৎসার বিকল্প হতে পারে না। আরও বিস্তারিত জানার জন্য সর্বদা আপনার ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
চমৎকার প্রতিবেদন। খুব জরুরি কথাগুলো বলা হয়েছে। ধন্যবাদ।
অনেক ধন্যবাদ।
খুব সুন্দর প্রতিবেদন।
থ্যাঙ্ক ইউ