এবারে আমার প্রয়াগরাজে কুম্ভমেলা দেখতে যাওয়ার প্রধান কারণ ছিল ইতিহাসের সন্ধান। কোনও পৌরাণিক বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার বশবর্তী হয়ে কুম্ভমেলার যাইনি। ত্রিবেণীর আর একটি বেণী কোথায় গেল, সেটা কারোরই জানা নেই। সেটা সরেজমিনে দেখে আসার জন্যেই আমি পারিবারিক কুম্ভযাত্রার শরিক হই। শাস্ত্রজ্ঞদের তরফে বলে দেওয়া হয়, সরস্বতীও এখানেই মিশেছিল গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গে, এখন তা বিলুপ্ত বা অন্তঃসলিলা। অনেকে তো সরস্বতীর অস্তিত্বই নেই বলেন, পুরোটাই নাকি পৌরাণিক বিশ্বাস। এটি বৈদিক সরস্বতী নদীর স্মৃতিরোমন্থনমাত্র।
প্রসঙ্গত, আমি সপরিবারে বিমানে প্রয়াগরাজের বামরাউলি বিমানবন্দরে নামি ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা নাগাদ। ক্যাবে করে হোটেলে পৌঁছতেই বেলা ১২টা বাজলো। হোটেলে চেক ইন করে একই ক্যাবে করে যমুনার সরস্বতী ঘাটের উদ্দেশে রওনা দিলাম। আমার মতো নন-ভিআইপি লোকের তো আর কোনও উপায় নেই। কারণ আম্বানি-আদানিদের চার্টার্ড ফ্লাইট আর ব্যক্তিগত জেট বিমান আমাদের মতো ছাপোষা মানুষের কাছে অলীক কল্পনা, হেলিকপ্টারও স্বপ্নের ব্যাপার। শিবরাত্রির দিন ও শেষ শাহিস্নান ছিল সেদিন, রাস্তায় মারাত্মক ভিড়, বিপুল জনসমাগম সামলাতে পুরো প্রয়াগরাজই ছিল ঘোষিতভাবে নন-ভেহিকেল জোন। আমাদের মতো প্রৌঢ়ের পক্ষে দশ-পনেরো কিলোমিটার হেঁটে সঙ্গমঘাটে পৌঁছনোর চিন্তা তো বাতুলতামাত্র। কারণ এটা ফাঁকায় ফাঁকায় জিরোতে জিরোতে হাঁটা নয়, ঘাড়ের উপর অন্যলোক নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে হাঁটবে এখানে। চারপাশ থেকেই লোকের চাপ আসবে শরীরে, শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়াই কষ্টকর হয়ে উঠবে।
তাই আমরা নৌরাস্তাই ধরবো ঠিক করলাম। ক্যাব ড্রাইভার বলল, প্রচণ্ড ভিড়ে আরিয়াল ঘাটে কোনও মতেই যেতে পারবে না, সরস্বতী ঘাট পর্যন্ত যাওয়ার চেষ্টা করবে। সেখান থেকে পুরনো দাঁড়-বাওয়া নৌকা পাওয়া যাবে। কিন্তু কপালের লিখন খণ্ডাবে কে? কিছুদূর যেতে না যেতেই পুলিশ আটকালো তাকে। অনেক অনুনয়বিনয় করার পর পুলিশ সামনেই বোটক্লাব পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি দিল। ড্রাইভারকে বলল পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসতে। ফিরতে না পারলে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স ক্যানসেল করার হুমকি দিল। সে বেচারা তো পড়ি কী মরি করে সামনের একটি বোটক্লাবে আমাদের নামিয়ে দিল। পিচ রাস্তা থেকে মিনিট দশেক হেঁটে যমুনাকিনারে পৌঁছনো গেল। সেখানে তখন মাঝিদের লাগামছাড়া ফাটকাবাজি চলছে। জনপ্রতি পাঁচহাজার টাকা চাইল সঙ্গমের জায়গায় নিয়ে যেতে। ছেলে অনেকক্ষণ ধরে দরকষাকষি করে মাথাপ্রতি বারশো টাকায় রফা করল এক কিশোরের সঙ্গে। তবে একটাই শর্ত তার, দশ জন যাত্রী জোগাড় হলে তবেই ছাড়বে নৌকা। আমরা তাই মেনে নিলাম, কারণ কটকটে রোদে আর দাঁড়ানো যাচ্ছিল না। আর একটি অবাঙালি পরিবার উঠল মিনিট দশেক পরে।
ছইয়ের ছাউনি খোলা ছিল। লাইফজ্যাকেট প্লাস্টিক শিটের তলায ডাঁই করা ছিল। বলতে তবে বার করল। ছইয়ের মাথাটা কালো চট গিয়ে তাড়াতাড়ি ছেয়ে দিল।
তারপর দুগ্গা দুগ্গা বলে নৌকা ছেড়ে দিল। প্রসঙ্গত শাহিস্নানের দিনগুলোতে স্পিডবোট বন্ধ থাকে নিরাপত্তার কারণে।
দেখলাম,এই সুযোগে যমুনার ঘাটগুলো দেখে নেওয়া যাবে। বোটক্লাব ঘাট, চৌরাসিয়া ঘাট, সরস্বতী ঘাট, কুম্ভমেলা উপলক্ষে নবনির্মিত একটি ঘাট দেখা গেল। মিনিট কুড়ি দাঁড় বাইতে বাইতে কাকা-ভাইপো মাঝি মাঝযমুনায় এলো। তখন সেখানে অগুন্তি পাহিহাঁস, বালিহাঁস দেখলাম আমরা।অন্য এক নৌকার মাঝি আমাদের নৌকায় এসে পাখির খাবার দিল একজন মাঝবয়েসী অবাঙালি ভদ্রলোককে। ভদ্রলোক তো শ্লোক আউড়াতে আউড়াতে পাখিদের খাওয়াতে লাগলেন। আমার গিন্নিও খাবার কিনলেন দেখাদেখি। কিছু দানা তিনিও খাওয়ালেন। নদীর রঙ তখনও বদলায়নি। পাখির কলকাকলি, নদীর গহীন জল, সংস্কৃত মন্ত্র, সব মিলিয়ে আমার মনে হল, এইখানেই কি তবে সরস্বতী নদী যমুনার মধ্যে এসে মিশেছিল? তারপর দুই নদীর মিলিত ধারা কিছুটা গিয়েই গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছিল? মনের মধ্যে যখন এইসব তোলপাড় হচ্ছে, তখন যমুনার কিনারায় একটি কেল্লা বা ফোর্টের ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ল।
বইয়ে এর সম্বন্ধে অনেক তথ্য আছে। কেল্লাটি ১৫৮৩তে সম্রাট আকবরের আমলে তৈরি হয়। নাম এলাহাবাদ ফোর্ট। এই ফোর্টেই যুবক জাহাঙ্গীর পিতা আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সময় নিজের রাজসভা বসাত। ইংরেজ চিত্রকর উইলিয়াম হজেস ১৭৮৩তে এই এলাহাবাদ ফোর্টের একটি ছবি এঁকে গেছেন।
এই কেল্লার মধ্যেই আছে একটি কূপ। নাম তার সরস্বতী কূপ। সরম্বতী নদীর সঙ্গে এই কূপটির সংযোগ আছে বলে পুরাতাত্ত্বিকদের বিশ্বাস। সরস্বতীর জল এই কূপে এসে জমা হত। তার মানে সম্রাট আকবরের আমলেও সরস্বতী ক্ষীণধারায় প্রবাহমান ছিল। হিন্দু-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক সম্রাট আকবরের পক্ষেই সম্ভব হিন্দুদের পবিত্র নদী সরস্বতীকে এইভাবে বাঁচিয়ে রাখা। জায়গাটি কুম্ভমেলার দ্রষ্টব্য জায়গা অক্ষয়বটের কাছাকাছি।
সরস্বতী নদী নাকি উত্তরাখডের বদ্রীনাথের চাম্বোলী জেলার মানা গ্রামে উৎপত্তি হওয়ার পর ৬৫০ মাইলব্যাপী আঁকাবাঁকা পথে পুরো উত্তরপ্রদেশ পাড়ি দিয়ে এইখানেই যমুনায় মিশত। প্রায় পুরোটাই আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে গেছে ভূপ্রাকৃতিক পরিবর্তন আর টেকটনিক প্লেটের গতির কারণে। নদীর স্বাভাবিক মৃত্যু যেমন ঘটে। কিন্তু মারা গেলেও প্রাণীদেহের জীবাশ্মের মতো নদীয় কিছু চিহ্ন রেখে যায়। যমুনাতীরের এলাহাবাদ ফোর্টের সরস্বতী কূপ সেরকমই একটি চিহ্ন।
অনবদ্য ভাষার বিশ্লেষণে মনে হচ্ছিল আমরা একই নৌকার যাত্রী। এমনিতেই আপনার ভাষার বাঁধন অপূর্ব, সেটা আজ থেকে নয়, ছোটবেলা থেকেই দেখেছিলাম তখন স্যারেরও ভাষার বাঁধন বিশ্লেষণ দারুন ভাবে আকৃষ্ট করতো। যেমন ভাবে বিমল স্যারের ক্লাস কখনো আমরা মিস করতাম না ।পুরনো দিনের কিছু স্মৃতি ভেসে এলো বলে তাই রোমন্থন করলাম। কিন্তু সরস্বতী নদীর সম্বন্ধে বেশ কয়েক বছর আগে কাগজে পড়েছিলাম যে নাসার স্যাটেলাইটে সরস্বতী নদী যে আবার জাগছে তারা পর্যবেক্ষণ করেছিল। তাও সেটা অনেক বছর হয়ে গেল এখন সত্যি সত্যি তার কি অবস্থা
অনেক ধন্যবাদ। আমাকে যে মনে রেখেছ, তাতে আমি অভিভূত। ভালো থেকেো। তবে নাসা কোন সরস্বতীর কথা বলেছিল, তা ঠিক জানি না।