বৃহস্পতিবার | ২৪শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১১ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | সকাল ৯:৪২
Logo
এই মুহূর্তে ::
বৈশাখ মাসে কৃষ্ণপক্ষে শ্রীশ্রীবরুথিনী একাদশীর ব্রতকথা মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত সিন্ধুসভ্যতার লিপি যে প্রোটোদ্রাবিড়ীয়, তার অকাট্য প্রমাণ : অসিত দাস বাঙালির মায়াকাজল সোনার কেল্লা : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ট্যাটু এখন ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’ : রিঙ্কি সামন্ত ফের আমেদাবাদে হিন্দুত্ববাদীদের অন্য ধর্মের উপর হামলা : তপন মল্লিক চৌধুরী লোকসংস্কৃতিবিদ আশুতোষ ভট্টাচার্য ও তাঁর চিঠি : দিলীপ মজুমদার নববর্ষের সাদর সম্ভাষণ : শিবরাম চক্রবর্তী নববর্ষ গ্রাম থেকে নগরে : শিহাব শাহরিয়ার ফিরে আসছে কলের গান : ফজলুল কবির সিন্ধুসভ্যতার ফলকে খোদিত ইউনিকর্ন আসলে একশৃঙ্গ হরিণ : অসিত দাস একটু রসুন, রসুনের কথা শুনুন : রিঙ্কি সামন্ত ১২ বছর পর আরামবাগে শোলার মালা পরিয়ে বন্ধুত্বের সয়লা উৎসব জমজমাট : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কোনিয়াকদের সঙ্গে দু’দিন : নন্দিনী অধিকারী স্বচ্ছ মসলিনের অধরা ব্যুৎপত্তি : অসিত দাস বাড়বে গরম, চোখের নানান সমস্যা থেকে সাবধান : ডা. তনুশ্রী চক্রবর্তী আঠালো মাটি ফুঁড়ে জন্মানো শৈশব : আনন্দগোপাল হালদার মাইহার ঘরানার সম্রাট আলি আকবর খান (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত ওয়াকফ হিংসার জের কি মুর্শিদাবাদেই থেমে গিয়েছে : তপন মল্লিক চৌধুরী এক বাগদি মেয়ের লড়াই : দিলীপ মজুমদার এই সেনসরশিপের পিছনে কি মতাদর্শ থাকতে পারে : কল্পনা পাণ্ডে শিব কম্যুনিস্ট, বিষ্ণু ক্যাপিটেলিস্ট : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় ‘গায়ন’ থেকেই গাজন শব্দের সৃষ্টি : অসিত দাস কালাপুষ্প : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু হোক বাঙালি-অস্মিতার প্রচারযাত্রা : দিলীপ মজুমদার মাইহার ঘরানার সম্রাট আলি আকবর খান (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত পেজফোর-এর নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ১৪৩২ প্রকাশিত হল সিন্ধিভাষায় দ্রাবিড় শব্দের ব্যবহার : অসিত দাস সিন্ধুসভ্যতার জীবজগতের গতিপ্রকৃতির মোটিফ : অসিত দাস হনুমান জয়ন্তীতে নিবেদন করুন ভগবানের প্রিয় নৈবেদ্য : রিঙ্কি সামন্ত গল্প লেখার গল্প : হাসান আজিজুল হক
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এর আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

‘মেঘে ঢাকা তারা’র পিছনে একটা ইতিহাস আছে : শক্তিপদ রাজগুরু

শক্তিপদ রাজগুরু / ৬২০ জন পড়েছেন
আপডেট মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২২

প্রথমেই বলি, আমি উদ্বাস্তু নই, পশ্চিমবঙ্গের আদি বাসিন্দা৷ বাঁকুড়ায় আমাদের সাত পুরুষের ভিটে ছিল৷ কিন্তু আমার বাবা চাকরি করতেন ‘পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফস’-এ৷ মুর্শিদাবাদ জেলার পাঁচথুপি গ্রামের পোস্ট মাস্টার ছিলেন৷ আমার বারো বছর বয়স অবধি সেখানে কেটেছে৷ তখন আমি ভাবতাম যে ওই জায়গাটা আমার জায়গা৷ কিন্তু বারো বছর পর বাবা যখন ট্রান্সফার হয়ে গেলেন তখন আমি আবিষ্কার করলাম যে এই মাটির আমি কেউ নই৷ সরকারের এক কলমের খোঁচায় আমার পায়ের তলা থেকে মাটিটা সরে গেল৷ বন্ধুবান্ধব, বারো বছরের ইতিহাস, স্মৃতি সব কিছু ছেড়ে আমি উদ্বাস্তু হয়ে পথে নামলাম৷

তার কিছু কাল পর বাবা মারা গেলেন৷ খুব দুঃখ দুর্দশার মধ্যে কাটল আমার অনেক দিন৷ আমি উদ্বাস্তু হয়ে গেলাম তখন থেকে৷ এই যন্ত্রণাটা আমার অবচেতন মনে কোথাও ছিল৷ পরে দেশ বিভাগের পর বানস্রোতে ভেসে আসা খড়কুটোর মতো দলে দলে মানুষ যখন আসছেন, সেই সময়ে আবার আমি যন্ত্রণাটাকে অনুভব করলাম৷

সেই সময় থেকে আমার উদ্বাস্তুদের নিয়ে কাজ করা আরম্ভ হল৷

আমি নিজে বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে বাস করেছি৷ তাঁদের জীবনযাত্রা দেখেছি৷ উদ্বাস্তুদের মানসিকতা, যন্ত্রণাটাকে দেখেছি৷

তখন ‘উল্টোরথ’ গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ আমাদের মতো তরুণ সাহিত্যিকদের বেশ একটা ঠেক ছিল সেটা৷ এক শনিবারে আমার এক বন্ধুর ছেলের অসুখের জন্য পাঁচশো টাকা দরকার হয়ে পড়ল৷ তখন, ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ অন্য পাবলিশারদের দোকানও বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ উপায়ান্তর না দেখে ‘প্রসাদ’ পত্রিকার মালিক, প্রসাদ সিংহর কাছে গেলাম টাকা ধার করতে৷ তিনি ছিলেন খুব ভালো সম্পাদক৷ সাগরময় ঘোষের পর এই আর একজন সম্পাদক দেখেছি যিনি সাহিত্য বুঝতেন৷ তখনই পাঁচশো টাকা দিয়ে দিলেন কিন্তু শর্ত তিন সপ্তাহের মধ্যে একটা লেখা দিতে হবে৷

যাই হোক, অগ্রিম নেওয়া টাকার পরিবর্তে ‘চেনামুখ’ নামে একটা বড়ো গল্পের কপি দিলাম৷ প্রসাদ দু-তিন পাতা উল্টেপাল্টে দেখে বললেন, ‘না হে অথর, লেখাটা খাবে৷’ লেখা ছাপা হল৷ চার-পাঁচ দিন পরে প্রসাদ আমাকে টেলিফোন করে জানালেন, ‘ঋত্বিক ঘটক তোমায় খুঁজছে৷ বড়ো ডিরেক্টর৷ ও ছবি করতে চাইছে তোমার চেনামুখ নিয়ে৷ দিয়ে দাও, ভালো ছবি হবে৷’

আমি তখন জিপিও-তে কাজ করি, অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে৷ এক দিন দেখি, লম্বা, সুন্দর চেহারার ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক তরুণ, এসে বললেন, ‘আমি ঋত্বিক ঘটক৷ আমি আপনার ‘চেনামুখ’ পড়েছি৷ ওটা ছবি করতে চাই৷ তা আপনি যদি…৷’ বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে৷ নিশ্চয়ই করবেন৷’ উনি ঠিকানা দিলেন৷ ভবানীপুরে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির পিছন দিকটাতে টাউনসেন্ড রোড পড়ছে৷ ওই বাড়ির পিছনের অংশে একতলার একটা ফ্ল্যাটে উনি থাকতেন তখন৷ সেই বাড়িতে প্রথম গেলাম৷ বুঝলাম যে ইনি ডিরেক্টরদের মতন নয়, বরং প্রফেসরের মতো৷ পড়াশুনো জানা লোকের মতোই কথা বলেন৷ এবং পরিষ্কার কথা৷ এ ডিরেক্টর, ইংরেজিতে এম.এ করেছেন কিন্তু বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে তাঁর একটা সুন্দর জ্ঞান৷ আমার সঙ্গে অতীতের ইতিহাস, বৈষ্ণব সাহিত্য, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচনা হল৷ আমার লোকটাকে ক্রমশ ভালো লাগতে শুরু করল৷ তার পর কাজ আরম্ভ হল৷ এক দিন ঋত্বিকবাবু আমাকে একটা কথা বললেন, ‘গল্প লিখছেন, সাহিত্য লিখছেন, লিখুন, চিত্রনাট্য লেখার কাজটাও শিখে রাখুন৷ আখেরে কাজ দেবে৷’ আমি দেখলাম, এটা খুব বাস্তব কথা৷ এ বিষয়ে কোনও ট্রেনিং তো আমার নেই৷ তাই এ রকম একটা গুরু পেয়ে আমি শুরু করে দিলাম চিত্রনাট্য লিখতে৷ ঋত্বিক প্রথমে ইংরেজিতে লিখে আমাকে দিতেন এবং আমি সেই লেখা ডেভলপ করে নিয়ে যেতাম৷ আবার তার উপরে উনি কাজ করতেন৷ সেটাকে আবার আমি ডেভলপ করতাম৷ এই ভাবে চিত্রনাট্য লেখা হত৷

আমি এক সময়ে বেলেঘাটায় একটা বাড়িতে ভাড়া থাকতাম৷ বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন৷ ভাড়ার টাকাতেই সংসার চলত তাঁদের৷ ছেলেরা বেকার, কাজকর্ম সে রকম কিছু করত না৷ তাঁর এক ছেলে, নাম বিনোদ, তার জীবনে স্বপ্ন ছিল বড়ো সরোদ বাজিয়ে হবে৷ ছেলেটা পাগলের মতো ঘুরে বেড়াত সরোদ নিয়ে আর প্রায়ই রাত জেগে কনফারেন্স শুনতে যেত৷ ভোরবেলা বাড়িতে কাউকে ডাকতেও পর্যন্ত পারত না৷ সদর দরজায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছে৷ এক এক দিন আমি সকালে সদর দরজা খুলতে গিয়ে দেখতাম সে দরজায় হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে আছে৷

তার পরে আমি দেখেছি ওই বাড়ির একটি মেয়েকে, সে গ্র্যাজুয়েশন করল৷ একটি স্কুলে শিক্ষিকার চাকরিও পেল৷ একটি ছেলের সঙ্গে তার একটা লাভ-অ্যাফেয়ার ছিল৷ ছেলেটির গেঞ্জির ফ্যাক্টরি ছিল৷ আমিই শেষ অবধি ঘটকালি করে তাদের বিয়ে দিই৷ বিয়ে তাদের হয়ে গেল বটে৷ কিন্তু এক দিন মেয়েটির মা আমাকে খুব আক্ষেপ করে বললেন, ‘মেয়ে আমাকে দেখল? তখন চাকরি করছিল, মাইনেটা আমাকে দিত, তিন হাজার টাকা৷ বিয়ের পরে সে অন্য সংসারে চলে গেল, আজকে আমার সংসার চলবে কী করে? আজ এই অন্ধ স্বামী আর বেকার ছেলেদের মুখে কী করে অন্ন জোগাব? সে তো আমার কথা ভাবল না৷’ সে দিন আমি দেখেছিলাম যে, মা হয়েও এক জন মানুষ মেয়ের সুখের সংসারে আপত্তি জানাচ্ছেন শুধু নিজের বেঁচে থাকার তাগিদে৷

আমার মা ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখে এসে বললেন, ‘হ্যাঁরে, মায়েরা কি অমনি হয়?’ আমি তখন বলেছিলাম, ‘না তুমি দেখনি, তুমি এই পরিস্থিতিতে পড়োনি৷ তুমি যদি পড়তে তা হলে এই ভাবেই নিজের বেঁচে থাকার তাগিদে, মেয়েকেও আটকাবার চেষ্টা তুমি করতে৷’

শুটিং-এর সময়ে আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল শিলং-এ৷ সেখানে গিয়ে দেখি প্রডিউসার, টেকনিশিয়ান, আর্টিস্ট অনিল, সুপ্রিয়া-সহ আরও অনেক লোক রয়েছেন৷ সন্ধেবেলায় স্ক্রিপ্ট পড়া হল৷ তার পর বুঝলাম আমাকে কেন ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল৷ আসলে প্রডিউসার চাইছিলেন, যে নীতাকে শেষ কালে মারা যাবে না৷ নীতাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, সমাজে ফিরিয়ে আনতে হবে৷ সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে৷ আমি তো অবাক৷ এ আবার কী করে হয়?

শেষ অবধি ভোট হল নীতা বাঁচবে না মরবে তাই নিয়ে! ঋত্বিক নিউট্রাল রোল নিয়ে ভোট দিলেন না৷ দেখা গেল আমি, অনিল, সুপ্রিয়া, আর মিস্টার সান্যাল বলে একজন ক্যামেরাম্যান — এই চার জন অরিজিনাল স্ক্রিপ্টে রইলাম৷

বাকি এগারো জন ভোট দিল বিপক্ষে, অর্থাৎ নীতাকে বাঁচানোর পক্ষে৷ সিদ্ধান্ত হল, নীতাকে ফিরিয়ে আনতে হবে৷ আমি তো কী করব কিছু বুঝতেই পারছি না৷ হোটেলে ফিরে এলাম৷

হোটেলে আমি আর অনিল এক ঘরে ছিলাম৷ খানিক পরে ঋত্বিক এসে অনিলকে বললেন, ‘তুই একটু বাইরে যা৷’ অনিল বেরিয়ে গেল ঘর থেকে৷

দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ঋত্বিক বললেন, ‘দেখুন, সব নাটক তো দেখলেন৷ কী করব আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না৷ কেন আপনাকে এখানে ধরে এনেছি, আপনি এ বার বুঝতে পারছেন তো! আপনি যে ভাবে হোক একটা মিলনান্তক লাইনে নীতাকে এন্ড করুন৷ আমি সেটা শুট করব৷ আর যেটা অরিজিনাল, সেটাও শুট করব৷ আজকে যদি বলি আমি, শুধু স্ক্রিপ্ট অনুসারে শুট করব, প্রোডিউসার চটে যাবে, শুটিং হবে না৷ ক্যানসেল হয়ে যাবে ছবি৷ তাই ওকে স্যাটিস্ফাই করার জন্যে আমাকে এ কম্ম করতে হবে৷ পরে করে দেখালে বুঝতে পারবে গাড়োলগুলো যে হোয়াট ইজ ওয়ার্ক৷ এখন বুঝল না৷ সুতরাং, আপনাকে লিখতে হবে৷ আপনি লিখুন৷ এটার ট্র্যাজিক এন্ড পসিবল৷’

ওরা শুটিং করতে যায়৷ একা হোটেলে বসে বসে লিখে চলি৷ এক সময়ে লেখা শেষ হল৷ প্রোডিউসারের খুব পছন্দ৷ এত ক্ষণে জমেছে৷

শুটিং করতে গিয়ে, পাঁচ দিন আমি লেখায় ব্যস্ত ছিলাম৷ শুটিং-এ যেতে পারিনি৷ ষষ্ঠ দিনে শুটিং-এ বেরোলাম৷ সতী ফল্‌স বলে একটা জায়গা আছে শিলং-এ৷ একটা ঝরনা৷ পাহাড়ের উপর থেকে পড়ছে৷ জায়গাটা অনেক নীচে নেমে যেতে হয়৷ এবং নীচে নামলে, চারিদিক ফানেলের মতো পাইন বনে ঢাকা পাহাড়৷ ঝরনা নামছে তার মাঝখান দিয়ে৷ ঋত্বিক ওই জায়গাটা দেখেই ক্যামেরাম্যানকে বললেন, ‘তুই একটা কাজ কর, থ্রি হানড্রেড অ্যান্ড সিক্সটি ডিগ্রির একটা শট এখানে নিয়ে রাখ৷’ ক্যাজুয়ালি ওটা নিয়ে রাখলেন৷ তার পরে শুটিং যা হল হল৷

শুটিং তো শেষ হয়ে গেল৷ শুটিং-এর মধ্যেও নানান অর্থাভাবের মধ্যে দিয়ে আমি দেখছি ঋত্বিকের স্টাইল অফ ওয়ার্কিং৷ স্টাইল অফ থিঙ্কিং৷ ‘অথর তুমি শুধু গল্পটা লিখে দাও, সংলাপগুলো লিখে দাও৷ হাউ টু এক্‌জিকিউট ইট, লিভ ইট টু মি৷’ পরবর্তীকালে, আমি তরুণ মজুমদার, শক্তি সামন্ত, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, বি আর চোপড়ার সঙ্গে কাজ করেছি৷ কিন্তু আমি দেখতাম, দিজ ঋত্বিক ঘটক ইজ আ ডিফারেন্ট এলিমেন্ট৷ আমি সত্যজিৎ বাবুর সঙ্গেও কাজ করেছি৷ তিনি ছিলেন ঘষা মাজা পরিশীলিত লোক, সব কিছুতে তাঁর একটা মার্জিত প্রচেষ্টা ছিল, খুব সুন্দর করে গড়ে তোলার৷ ঋত্বিকের ছিল স্বতঃস্ফূর্ততা৷ সত্যজিৎবাবুর চোখ ছিল, মাথা ছিল, হৃদয়টা একটু কম ছিল৷ ঋত্বিকের চোখ ছিল, হৃদয় ছিল কিন্তু রসবোধটা তাঁর বেশিই ছিল সত্যজিৎ রায়ের তুলনায়৷ দেখছি এক দিন শুটিং হচ্ছে৷ একটা সিন-এ মা শঙ্করকে বলছে যে ‘কিছু কর কাজকর্ম সংসারের জন্যে৷’ শঙ্কর বলছে, ‘ওস্তাদে বলেছে, মা, আর কিছু দিন তালিম নিলেই আমি গান গাইতে পারব৷ বছর দুই-তিন এখন তালিম আমাকে নিতেই হবে৷’ মা তিরস্কার করছে৷ এই দৃশ্যে বোন নীতা বলছে, ‘দাদাকে কেন বকাবকি করছ… সংসার তো যেমন করে হোক আমি চালাচ্ছি৷’ হঠাৎ দেখি ‘কাট’৷ ঋত্বিক চিত্কার করে উঠলেন৷ আসলে সুপ্রিয়ার শাড়িটা ইচ্ছে করে হোক বা অনিচ্ছেতে একটু আলগা হয়ে ছিল৷ বডিলাইন কিছুটা বেরিয়ে এসেছে৷ কোনও কথা না বলে ঋত্বিক গিয়ে সুপ্রিয়ার শাড়িটা ঢেকে দিয়ে বললেন, ‘আমি সুপ্রিয়াকে চাইছি না, নীতাকে চাইছি৷ গো ব্যাক৷ কাম টু দ্য ফ্রেম এগেন৷’

যাই হোক, ছবি শেষ হয়ে গেছে, মোটামুটি৷ এডিটিং হচ্ছে৷ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঋত্বিকবাবু ছবি আর কতদূর? ছবি তা হলে আর হবে না?’ উনি বললেন, ‘শেষ কী করব কিছু খুঁজে পাচ্ছি না৷ পয়সাও নেই যে শুট করে আসব৷ ওই নীতার ডেথ৷ আমার মনে হচ্ছে, ছবি শেষ পর্যন্ত পুড়িয়ে ছাই করে ফেলে দিতে হবে৷’ তার পরেই হঠাৎ, বললেন, ‘রমেশ, সেই সতী ফলস-এর থ্রি হানড্রেড অ্যান্ড সিক্সটি ডিগ্রি শট বার কর৷’ মিনিট দশেক খোঁজার পরে শটটা বেরল৷ ওই রোটেটিং হিলস, ওই ঝরনা, ওই পাহাড়, পাইন বন রোটেট করছে৷ কিছু ক্ষণ চুপচাপ কাটল, দু-তিন মিনিট এদিক ওদিক ঘুরলেন৷ তার পরে পুনুকে (পুনু দাশগুপ্ত) বললেন, ‘যেখান থেকে পারিস কালকে ওই সুপ্রিয়াকে ধরে নিয়ে আয়৷ আর আমাকে বললেন, ‘অথর, কাল তুমিও সাড়ে বারোটায় এসো৷’

পরের দিন নিউ থিয়েটার্স ১-এ স্টুডিওয় একখানা মাইক একটা ঝাউগাছের ডাল, সঙ্গে একটা ছেলেদের খেলনা বেরুলো৷ তার শব্দ দিয়ে পাহাড়ি ঝড়ের সাউন্ড তৈরি করে তার মধ্যে সুপ্রিয়াকে দিয়ে বলালেন সেই বিখ্যাত সংলাপ, ‘দাদা আমি বাঁচতে চাই৷ দাদা আমি বাঁচতে চাই৷’

টেক শেষ হল৷ আমি জড়িয়ে ধরলাম, ‘আমি তো ভাবতে পারিনি যে এর থেকে এই হতে পারে৷

সংকলন শ্ৰী অমিত ভাদুড়ি


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন