রবিবার | ১৯শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ১১:৪৪
Logo
এই মুহূর্তে ::
চর্যাপদে সমাজচিত্র : নুরুল আমিন রোকন বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (শেষ পর্ব) : আবদুশ শাকুর ‘প্রাগৈতিহাসিক’-এর অনন্য লেখক মানিক : ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (একাদশ পর্ব) : আবদুশ শাকুর ভেটকি থেকে ইলিশ, চুনোপুঁটি থেকে রাঘব বোয়াল, হুগলির মাছের মেলায় শুধুই মাছ : রিঙ্কি সামন্ত দিল্লি বিধানসভায় কি বিজেপির হারের পুনরাবৃত্তি ঘটবে : তপন মল্লিক চৌধুরী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে রাখাইন — বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (দশম পর্ব) : আবদুশ শাকুর রামলোচন ঠাকুর ও তৎকালীন বঙ্গসংস্কৃতি : অসিত দাস দধি সংক্রান্তি ব্রত : রিঙ্কি সামন্ত বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (নবম পর্ব) : আবদুশ শাকুর সপ্তাহে একদিন উপবাস করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো : অনুপম পাল অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত’র ভাষা : ড. হান্স্ হার্ডার সবগুলো গল্পেই বিজয়ার নিজস্ব সিগনেচার স্টাইলের ছাপ রয়েছে : ড. শ্যামলী কর ভাওয়াল কচুর কচকচানি : রিঙ্কি সামন্ত বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (অষ্টম পর্ব) : আবদুশ শাকুর রামলোচন ঠাকুরের উইল ও দ্বারকানাথের ধনপ্রাপ্তি : অসিত দাস বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (সপ্তম পর্ব) : আবদুশ শাকুর যে শিক্ষকের অভাবে ‘বিবেক’ জাগ্রত হয় না : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভিয়েতনামের গল্প (সপ্তম পর্ব) : বিজয়া দেব বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (ষষ্ঠ পর্ব) : আবদুশ শাকুর দিল্লি বিধানসভা ভোটেই নিশ্চিত হচ্ছে বিজেপি বিরোধি জোটের ভাঙন : তপন মল্লিক চৌধুরী দ্বারকানাথ ঠাকুরের গানের চর্চা : অসিত দাস মমতা বললেন, এইচএমপি ভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে দুষ্টচক্র হু জানাল চিন্তা নেই : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (পঞ্চম পর্ব) : আবদুশ শাকুর পৌষ পুত্রদা একাদশী : রিঙ্কি সামন্ত বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (চতুর্থ পর্ব) : আবদুশ শাকুর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজায় কবিগান ও যাত্রার আসর : অসিত দাস সসীমকুমার বাড়ৈ-এর ছোটগল্প ‘ঋতুমতী হওয়ার প্রার্থনা’ সামাজিক মনস্তত্ত্বের প্রতিফলনে সিনেমা : সায়র ব্যানার্জী
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই পৌষ পার্বণ ও মকর সংক্রান্তির শুভেচ্ছা আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

বাবরি মসজিদ ভাঙার ‘ঐতিহাসিক যুক্তি’ : ইরফান হাবিব

ইরফান হাবিব / ১৬৮ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কুখ্যাত রথযাত্রার সূচনা করেছিলেন এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ব্যাপারে নিজে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার এই সৌধ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েও শেষ পর্যন্ত অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। সুপ্রিম কোর্ট তার রায় লঙ্ঘন করার শাস্তি হিসেবে মাত্র একজনকে একদিনের জন্য আটকে রেখেছিল। আজ পর্যন্ত বর্তমান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ কারওরই বিচার হয়নি। চারশো পঁচাত্তর বছরের পুরোনো মসজিদ ধ্বংস হওয়ার পর সঙ্ঘ পরিবার নানাভাবে এই কাজের পিছনে যুক্তি খাড়া করছে। তারা সজোরে বলছে, এই ধ্বংস নাকি জাতীয়তাবাদের এক মহান কীর্তি।

ডান্ডি অভিযানের পরেই নাকি এর স্থান। তবে যে যাই বলুক, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ফলে বিশ্বের কাছে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেছে। আর যারা ততটা শিক্ষিত নন, তাঁদের কাছে বলা হচ্ছে এই ধ্বংসের প্রয়োজন ছিল। কারণ নাকি আগেকার রামজন্মভূমি মন্দিরের জায়গাতেই এই মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। গত দশ বছরে এই মসজিদ ধ্বংসের যৌক্তিকতা প্রমাণ করার জন্য এসব কথা বলা হচ্ছে।

দাবির পিছনে যুক্তি নেই

বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার এই ধ্বংসের কাজে নামার অনেক আগে থাকতেই এসব ‘সাক্ষ্য প্রমাণ’ হাজির করার চক্রান্ত করেছিল। কারণ বাবরি মসজিদ যে কোনও হিন্দু মন্দিরের জায়গায় তৈরি হয়েছিল এমন কোনও গ্রহণযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যদি তাই হত তা হলে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মূল নির্মাণকালের (১৫২৮-২৯) সময় পাওয়া চোদ্দটি ফার্সি শিলালিপির কোনওটিতেই এর কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় নি। এই লিপি সরকারিভাবে প্রকাশিত Epigraphia Indica, Arabic and Persian Supplement, 1965-তে ছাপা হয়েছে। যদি সত্যিই মন্দির ভাঙা হত তাহলে এই লিপিতে তার উল্লেখ সুনিশ্চিতভাবেই থাকত। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত আর এস শর্মা, এম আখতার আলী, টি এন ঝাঁ, এবং সুরাজ খান লিখিত ‘হিস্টোরিয়ানস রিপোর্ট টু দ্য নেশন’ গ্রন্থে সুষ্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কোনও মন্দিরের জায়গায় বাবরি মসজিদ নির্মিত হয়েছে বলে কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। এই মসজিদ তৈরির আড়াই’শো বছরের মধ্যেও এ রকম কোনও দাবি তোলা হয়নি। একমাত্র ১৮১১ সালে একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক নাকি এ রকম দাবির কথা শুনেছিলেন। তখনও পর্যন্ত ওই দাবির পিছনে কোনও সত্যতা নেই বলেই ঐতিহাসিকেরা মনে করেন।

সারবস্তুর অভাবের দরুনই সঙ্ঘ পরিবার শেষ পর্যন্ত ‘স্থাপত্যবিদ্যার’ শরণাপন্ন হয়। অধ্যাপক বি বি লাল অর্থাৎ ‘মহাভারত স্থাপত্যবিদ্যা’র উদ্‌দ্গাতার কাছে যায় যিনি তাঁর ‘রামায়ণ স্থাপত্যবিদ্যা’র গবেষণার জন্য কংগ্রেস আমলে প্রচুর পরিমাণে সরকারি অর্থ পেয়েছিলেন। তিনি বাবরি মসজিদের কাছে খননকার্য শুরু করেছিলেন। এর ভিত্তিতে ১৯৭৬-৭৭ সালে একটি রিপোর্ট দেন। (ইন্ডিয়ান আর্কিওলজি-এ রিভিউ, ১৯৭৬-৭৭) ১৯৯০ সালে অক্টোবর মাসে আর এস এস-র মুখপত্র ‘মন্থন’-এ এক প্রবন্ধে তিনি তাঁর আগের রিপোর্টের পুনর্ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, তিনি সেখানে যে স্তম্ভ উদ্ধার করেছেন সেগুলি আসলে মূল মন্দিরের সম্প্রসারিত অংশেরই অঙ্গ। ওখানেই বাবরি মসজিদ তৈরি হয়েছিল বলা হচ্ছে। এই বক্তব্য নিছক অনুমান ভিত্তিক। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত ‘অযোধ্যা, আর্কিওলজি আফটার ডেমোলিশন’ গ্রন্থের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে দেখানো হয় যে বি বি লালের ওই বক্তব্য ভিত্তিহীন। এবং লাল তাঁর বক্তেব্যের দুর্বলতা সম্পর্কে সম্ভবত সজাগ ছিলেন। তাই তিনি এই যুক্তি খাড়া করেছিলেন যে বাবরি মসজিদের ভিত্তি পুরোপুরি খনন করলে তবেই মূল সত্য বেরিয়ে আসবে! অর্থাৎ যেন প্রথমে মসজিদ ধ্বংস করতে হবে। এইভাবেই এই ধারণার জন্ম নিল যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হলেই তবেই সাক্ষ্য প্রমাণ মিলবে বা মেলার পথ প্রশস্ত করা যাবে।

বিজেপি সরকার যখন অবৈধভাবে বাবরি মসজিদের লাগোয়া জমির একটা বড়ো অংশ বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে দিল তখনই চক্রান্তের আভাস পাওয়া গেল। তখন দাবি তোলা হল ১৯৯২ সালের জুন মাসে যখন ওই জমি সমান করা হচ্ছিল তখন একটি গর্ত পাওয়া যায়। সে গর্ত থেকে খোদাই করা কিছু মূর্তি পাওয়া গেছিল। অদ্ভুত বিষয় হল, যখন এসব মূর্তিগুলি ‘উদ্ধার’ করা হল তখন কিন্তু আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াকে জানানো হয়নি। অথচ কোনও প্রত্নতত্ত্ব উদ্ধার তা ওই সংস্থাকে জানানো আইনগত দিক থেকে বাধ্যতামূলক। বরং এই উদ্ধারের সংবাদ বিশ্ব হিন্দু পরিষদ হঠাৎ ঘোষণা করল। তাদের ‘বিশেষজ্ঞরা’ বলতে শুরু করলেন, ওই মূর্তিগুলি একাদশ শতাব্দীর। এরকম একজন বিশেষজ্ঞ হলেন স্বরাজ প্রকাশ গুপ্ত, যিনি কোনও দিনই মধ্যযুগের গোড়ার দিকের স্থাপত্য সম্পর্কে কোনও কাজ করেননি। অপরদিকে মনে হচ্ছে এটাই ঠিক যে ওই মূর্তি বা স্থাপত্যগুলি কোনও একটি নির্দিষ্ট সময়কালের নয়। এগুলি সম্পর্কে আর এস শর্মা ‘দি হিন্দু’ পত্রিকায় (১০/১১/৯২) প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেছেন, এই মূর্তির স্থাপত্যগুলির সময়কাল সপ্তদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে। সুতরাং এগুলি নিশ্চয় কোনও একটি মন্দিরের নয়। তাছাড়া মণ্ডল আরো বলেছেন, বেশ কিছু মূর্তির রঙ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে সেগুলি আংশিকভাবে মাটিতে গ্রোথিত ছিল। অর্থাৎ সেগুলি কোনও গহ্বর থেকে তোলা হয়নি। অর্থাৎ এগুলি বাইরে থেকেই আনা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। অর্থাৎ যখন উত্তর প্রদেশ সরকারের মাধ্যমে ওই জায়গাটি বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বিজেপি-র পুরোপুরি দখলে ছিল। সেজন্যেই ওই মূর্তিগুলি বিভিন্ন সময়কার।

এরপর আমরা চলে আসি ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। অর্থাৎ যেদিন বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিল। ধ্বংসের পর ওই সময় খোদিত প্রস্তর পাওয়া গেছে বলে দাবি তোলা হল। এটি নাকি দক্ষিণ ও মধ্য গম্বুজের পিছনে ছিল। মধ্যযুগের বড়ো বড়ো সৌধের মতোই বাবরি মসজিদের বাইরে মোটা দেওয়াল দুভাগে বিভক্ত ছিল।

ভি এইচ পি-র বক্তব্য

ভি এইচ পি-র বক্তব্য লিপিবদ্ধ আছে ২০০ পৃষ্ঠারও বেশি একটি বইয়ে। বইটির নাম ‘অযোধ্যাকা ইতিহাস এবং পুরাতত্ত্ব’। এই বইটি লিখেছেন আর এস এস-এর মুখ্য প্রত্নতত্ত্ববিদ এস পি গুপ্ত এবং ডি পি ভার্মা। শেষোক্ত ব্যক্তি বাবরি মসজিদ মামলায় ভি এইচ পি-র পক্ষে পক্ষভুক্ত হয়েছেন এই বইয়ে পাঠককে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে যে, ওই শিলালিপি রামজন্মভূমি নির্মিত মন্দিরে পাওয়া গেছে। ওই মন্দিরটি ওখানেই পুনর্নিমিত। কারণ, আগের মন্দিরটি নাকি মুসলিমরা ধ্বংস করেছিল। বাবরি মসজিদ তৈরির জন্য মন্দিরটি আবার ১৫২৮-২৯ সালে ধ্বংস করা হয়।

কিন্তু বাস্তব সত্য হল, এই শিলালিপিতে ওই ধরনের কিছু লেখা নেই। এখানে যে জন্মভূমির উল্লেখ আছে, তার সঙ্গে রামের জন্মভূমির কোনও যোগসূত্র নেই। এই প্রসঙ্গে ভি এইচ পি-র এক সাক্ষী কে ভি রমেশের অনুবাদের উল্লেখ করা যেতে পারে। রমেশ আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার এপিগ্রফি বিভাগের অধিকর্তা ছিলেন। ভি এইচ পি এই অনুবাদটি দলিল হিসাবে বাবরি মসজিদ মামলায় হাইকোর্টে পেশ করেছিল। এই অনুবাদ থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম লাইনটি উদ্ধৃত করা যায়। ‘Noble was that very family (of the local rulers), which was the birth-place (Janmabhoomi) of Valour which had successfully re- moved the sufferings of the other (Khatriya Clans)’।

সুতরাং সেখানে জন্মভূমি বলে কোনও নির্দিষ্ট জায়গার উল্লেখ নেই। ওই জায়গার সঙ্গে যুক্ত আছে একটি অভিজাত পরিবার।

ওই অনুবাদের ১১-১৫ লাইনে বিষ্ণু হরি মন্দিরের কথা উল্লেখ আছে। রমেশ এখানে বলছেন ওই মন্দিরের নির্মাতা হলেন মেঘসূত্র। যিনি অনয়াচন্দ্রের জায়গায় সাকেতের রাজা হয়েছিলেন। আরেকজন পেশাদার এপিগ্রাফিস্ট কাট্টি এইসব লাইনের ব্যখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন অনয়াচন্দ্র ওই মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন। সুতরাং এসব ব্যাপারে গোবিন্দচন্দ্রকে যুক্ত করবার ব্যাপারে মন্দিরটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। বারানসী ছিল গোবিন্দচন্দ্রের রাজধানী। যা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তা হল এই শিলালিপির সঙ্গে পুনর্নির্মিত মন্দিরের কোনও যোগ নেই। এক্ষেত্রে রমেশ এবং কাট্টির অনুবাদের মধ্যে কোনও অমিল নেই। তাছাড়া আরেকজন বিখ্যাত এপিগ্রাফিস্ট প্রয়াত অজয় মিত্র একইরকম কথা বলেছেন। সকলেই মন্দির প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন যে, মন্দিরটি তৈরি হয়েছে বা নির্মিত হয়েছে।

মুসলিমদের কোনও উল্লেখ নেই

এই দু’জনের অনুবাদে দেখা যাচ্ছে মুসলিমদের কোনও উল্লেখ নেই। যদিও ভি এইচ পি-র মামলার ক্ষেত্রে মুসলিমদের যোগাযোগের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে কাট্টি কোনওরকম যৌক্তিকতা ছাড়াই ‘পশ্চিমী শত্রু’র কথা উল্লেখ করেছেন।

সুতরাং আমাদের সামনে রইল অন্য কোনও জায়গা থেকে আনা একটি শিলালিপি। যাতে বলা হয়েছে, অন্যান্য কাজ ছাড়াও, সাকেতের রাজা বিষ্ণুহরির জন্য একটি চমৎকার মন্দির বানিয়েছিলেন। তবে এটি রামের জন্মভূমি বা আগের কোনও মন্দিরের জায়গায় নির্মিত হয়নি। এই শিলালিপিতে রামের কোনও উল্লেখ নেই। তাছাড়া এই শিলালিপিতে মুসলিমদের ব্যাপারে ভয় বা মুসলিমদের হাতে মন্দির ধ্বংসের উল্লেখ নেই।

তাদের অজ্ঞতার মাত্রা

উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ভি এইচ পি দাবি করেছে রামের জন্মভূমির কথা বরাবরই সবার জানা আছে এবং ওই জায়গায় বরাবরই একটি মন্দির ছিল। ওই খোদিত শিলালিপি সম্পর্কে ভি এইচ পি-র ভাষ্য অনুসারে ওই মন্দিরটির উল্লিখিত স্থানে থাকার কথা দ্বাদশ শতাব্দীতে। কারণ, তার আগেই মুসলিমদের অযোধ্যায় আসার কথা এবং রামজন্মভূমি মন্দির ধ্বংস করার কথা। ভি এইচ পি-র ভাষ্য অনুসারে, এই মুসলিমদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সালার মাসুদ। তাঁর কবরস্থান রয়েছে বাহরাইচতে। সম্ভবত তাঁকে ধরে নেওয়া হয় গজনির মাহমুদের ভাইপো হিসাবে। মাহমুদের মৃত্যু হয়েছিল ১০৩০ সালে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, সালার মাসুদের প্রসঙ্গটি প্রবাদের মত। চতুর্দশ শতকের আগে তার কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। যে ‘মিরাত-ই-মাসুদি’ গ্রন্থে সালার মাসুদ সম্পর্কে বিশদ তথ্য আছে সেটি লেখা হয়েছিল ১৬১১ সালে। মহম্মদ নাজিম তাঁর ‘লাইফ অ্যান্ড টাইমস্ অব সুলতান মাহমুদ অব গজনি’ গ্রন্থে পুরো কাহিনিটি নিছক প্রবাদ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। একে যদি আমরা সত্য বলেও মেনে নিই, তাহলে দেখব অযোধ্যার কোনও উল্লেখ নেই। ‘মিরাত-ই-মাসুদি’ গ্রন্থে দেখা যাচ্ছে সালার মাসুদ সুলতান থেকে অযোধানের দিকে এগোচ্ছেন। তারপরে দিল্লি, মীরাট, সাত্রিক এবং বাহারাইচ। এখানেই তিনি নিহিত হন। ভি এইচ পি-র এস পি গুপ্ত এবং টি পি ভার্মা এবং অযোধানকে ‘অযোধ্যা’ হিসাবে প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করেছেন। লক্ষ্ণৌয়ের কাছে এরা বাকি জেলার এখানকার ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়র অনুসারে সালার মাসুদের কাহিনি যুক্ত আছে সাত্রিকের সঙ্গে। অর্থাৎ, অযোধ্যার সঙ্গে এই কাহিনির কোনও যোগ নেই। সুতরাং দেখা যাচ্ছে দ্বাদশ শতাব্দীতে বা তার আগে অযোধ্যায় কোনও মন্দির থাকা বা মুসলিমদের হাতে তার ধ্বংস হওয়ার কোনও চূড়ান্ত প্রমাণ নেই। অর্থাৎ বোঝাই যাছে যে, ভি এইচ পি যে শিলালিপিগুলি পুঁতে দিয়েছিল, তাতে শেষ পর্যন্ত তাদের বক্তব্যই অসার বলে প্রমাণিত হচ্ছে। যদি এই শিলালিপিগুলি দ্বাদশ শতাব্দীতে কোনও মন্দিরের গায়ে থাকলেও তার সঙ্গে রাম জন্মভূমির কোনও যোগ নেই। আর ঐ রাম জন্মভূমিতে আগে কোনও মন্দিরও ছিল না। মীর-বাকি যেখানে বাবরি মসজিদ তৈরি করবেন বলে স্থির করেছিলেন সেখানেই রাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে যে প্রচার হিন্দুদের মধ্যে চালানো হয় তা অমূলক। বাবরি মসজিদ কোনও মন্দিরের জায়গায় তৈরি হয়েছে বলে ভি এইচ পি দাবি তুললেও তারা এর সমর্থনে যে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পেশ করছে তাতে অনেক কারচুপি আছে। কারণ, ওইসব মূর্তি বা শিলালিপি উদ্ধারের সময় কোনও পেশাদার প্রত্নতত্ত্ববিদকে থাকতে দেওয়া হয়নি। ওইগুলির রঙ এবং প্রাকৃতিক অবস্থা দেখে বোঝাই যায় সেগুলিকে হাল-আমলে মাটিতে পোঁতা হয়েছে। ভি এইচ পি তাদের বক্তব্যের পিছনে কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি স্থাপন করতে পারছে না।

বাবরি মসজিদের ইতিহাসের ক্ষেত্রেও সঙ্ঘ পরিবার বিকৃতি ঘটিয়েছে। এন সি ই আর টি-র নতুন পাঠ্যপুস্তকের ক্ষেত্রেও তারা একই কাজ করেছে। এইসব কারণেই বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের মিথ্যাচার ও চক্রান্তের মুখোশ খুলে দিতে হবে। বিজেপি খোলাখুলি প্রচার করছে যে, তারা ক্ষমতায় এসেছে বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষের ওপর দিয়ে। তাই এখন আরও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে হবে যে, তারা ক্ষমতায় এসেছে প্রতারণা ও ভণ্ডামির মধ্য দিয়ে।

লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে। বইমেলা উপলক্ষে গণশক্তি থেকে প্রকাশিত বাবরি থেকে গুজরাট গ্রন্থে। বাবরি মসজিদ ভাঙার একদশক পর। গুজরাট গণহত্যার ঠিক পরেই। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানি। আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন