কাজী নজরুল ইসলাম ও বিপ্লবী হেমন্তকুমার সরকার তথা কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত সরকার পরিবারের স্মৃতিধন্য গোলাপট্টির লুপ্তপ্রায় ঐতিহাসিক ভবন মদনমোহন কুটিরের সম্মুখে সুজন-বাসর (গ্রেস কটেজ) ও অগ্নিবীণা (ভারত) সংস্থার যৌথ উদ্যোগে ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ (সোমবার) একটি স্মৃতিফলক বসানো হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে সেই স্মৃতিফলকের আবরণ উন্মোচন করেন অগ্নিবীণা সংস্থার সম্পাদক রবীন মুখার্জি। উপস্থিত ছিলেন হেমন্তকুমার সরকারের দাদা চিকিৎসক জ্ঞানেন্দ্রনাথ সরকারের পুত্রবধূ চায়না সরকার, সুজন-বাসরের সভাপতি দীপঙ্কর দাস, সম্পাদক ইনাস উদ্দীন এবং নজরুল-অনুরাগীবৃন্দ যথা— রতনকুমার নাথ, সম্পদনারায়ণ ধর, শঙ্খশুভ্র সরকার, দীপাঞ্জন দে, সতীনাথ ভট্টাচার্য, শিল্পী বাপী দাস, সুকৃতি ঘোষ, শোভনা দাস প্রমুখ। অগ্নিবীণার পক্ষে আরো ছিলেন চন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রদীপ দত্ত, মধুমিতা ব্যানার্জি, রীতা দে, সুমিতা ভট্টাচার্য, পৌষালী রায়, সঙ্গীতা মুখার্জি, কুমকুম সেনগুপ্ত, মধুমিতা দাস প্রমুখ।
ইতিপূর্বে ২৯ আগস্ট, ২০২৪ (বৃহস্পতিবার) নজরুলের ৪৯তম প্রয়াণদিবসে গ্রেস কটেজে যথাযথ মর্যাদায় কবিকে স্মরণ করা হয়। নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ উপলক্ষে কবিসৃষ্ট প্রমিত বাণী ও শুদ্ধ সুরকে তুলে ধরতে ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ (রবিবার) ‘অগ্নিবীণা’-র সহযোগিতায় ‘সুজন-বাসর’ গ্রেস কটেজে ‘নজরুলসঙ্গীতের কর্মশালা’-র আয়োজন করেছিল। প্রশিক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ‘অগ্নিবীণা’-র সদস্য বিশিষ্ট নজরুলসঙ্গীতশিল্পী রেবা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেইদিন সন্ধ্যায় ‘সুজন বাসর’ ও ‘অগ্নিবীণা’-র যৌথ আয়োজনে গ্রেস কটেজে নজরুলের ৪৯তম প্রয়াণদিবস উপলক্ষে একটি স্মরণানুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছিল।
oppo_1024
পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন কর্তৃক নজরুল-স্মৃতিধন্য কৃষ্ণনগরের গ্রেস কটেজ হেরিটেজ ভবনের স্বীকৃতি পেয়েছে। সরকারি তত্ত্বাবধানে দুইবার সেই ভবনের সংস্কারও হয়েছে। কিন্তু, নজরুল ও হেমন্ত সরকারের স্মৃতি-বিজড়িত ‘মদনমোহন কুটির’-এ কবির কোনও স্মৃতিচিহ্নই এযাবৎ ছিল না। প্রায় শতাধিক বছর পেরিয়ে আসা এই বাড়ি শরিকি ভাগ-বাঁটোয়ারা, বিক্রি-বাটার কারণে এবং আধুনিকতার করাল গ্রাসে এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন। তবে পুরনো বাড়ির সামান্য অংশ এখনও টিকে আছে, যেখানে জ্ঞানেন্দ্র সরকারের পুত্রবধূ চায়না সরকার বসবাস করেন। ২ সেপ্টেম্বর সেই বাড়ির সামনেই স্মৃতিফলকটি বসানো হয়। সুজন-বাসরের পক্ষ থেকে হেমন্ত সরকারের পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে স্মৃতিফলক স্থাপনের অনুমতি নেওয়া হয়। কৃষ্ণনগর পৌরসভার স্থানীয় কাউন্সিলর অয়ন দত্তের সহযোগিতাও পাওয়া যায়। স্মৃতিফলকটিতে এই কথাগুলি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে— “মদনমোহন কুটির: বিপ্লবী হেমন্তকুমার সরকারের (১৮৯৭-১৯৫২ খ্রি.) পৈতৃক নিবাস কৃষ্ণনগরের গোলাপট্টি অঞ্চলস্থিত ঐতিহাসিক ভবন ‘মদনমোহন কুটির’-এর অংশবিশেষ হলো এই বাড়িটি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অনুগামী বিপ্লবী হেমন্তকুমার সরকার ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং তাঁর অন্যতম রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু। ম্যালেরিয়ায় ভগ্নস্বাস্থ্য বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়ে হেমন্ত সরকার হুগলি থেকে কবিকে কৃষ্ণনগরে নিয়ে আসেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ৩ জানুয়ারি নজরুল তাঁর স্ত্রী প্রমীলা দেবী এবং শাশুড়ি গিরিবালা দেবীকে নিয়ে কৃষ্ণনগরে পদার্পণ করেছিলেন বলে জানা যায়। হেমন্তকুমার সরকারের পারিবারিক আশ্রয়ে এই মদনমোহন কুটিরে কয়েক মাস কবি বসবাস করেছিলেন। পরবর্তীতে প্রায় আড়াই বছর কবি বসবাস করেন কৃষ্ণনগরের চাঁদসড়ক এলাকায় ‘গ্রেস কটেজ’ নামক ভবনে।”
বিপ্লবী হেমন্তকুমার সরকার চর্চার বাইরে রয়ে গেছেন ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। সুভাষচন্দ্র বসুর সহপাঠী ও সহচর হেমন্তকুমার সরকার ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অনুগত শিষ্য। নেতাজির স্বীকারোক্তি— হেমন্তকুমার সরকারই তাঁকে রাজনীতিতে আসার প্রেরণা যুগিয়েছিলেন। বাস্তবে চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে সুভাষের পরিচয় করিয়েছিলেন তিনিই। আবার হেমন্তকুমারের সাথে সুভাষের পরিচয় হয়েছিল তাঁদের শিক্ষক বেণীমাধব দাসের সূত্র ধরে। অসহযোগ আন্দোলনকালে তিনি স্বাধীনতা-সংগ্রামে আবির্ভূত হন। একাধিকবার তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। ১৯২৫ সালে হেমন্তকুমারের রাজনৈতিক পথদিশারী দেশবন্ধুর অকাল প্রয়াণ তাঁকে কিছুটা দিগ্ভ্রান্ত করে এবং তিনি মতবিরোধের কারণে কংগ্রেস ছাড়েন। অতঃপর তিনি মুজফ্ফর আহমদের সান্নিধ্যে আসেন। এবং পরবর্তীতে তিনি সর্বহারা শ্রেণীর নেতা হিসাবে পরিচিত হন। হেমন্তকুমার সরকার একদিকে চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ পার্টির প্রধান হুইপ ছিলেন, অন্যদিকে তাঁর ‘বাংলার কথা’ দৈনিক সংবাদপত্রের সহ-সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া সাপ্তাহিক ‘জাগরণ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক এবং ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পর ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামে দৈনিকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্যে তাঁর প্রতিভার কথাও বলতে হয়। দেশবন্ধু সম্পাদিত ‘নারায়ণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ‘ভিখারি’ গল্পের সূত্র ধরে তিনি প্রথম দেশবন্ধুরও সুনজরে এসেছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি হলো— স্পষ্টকথা (১৯২১ খ্রি.), যুগশঙ্খ (১৯২১ খ্রি.), স্বরাজ কোন পথে? (১৯২২ খ্রি.), বিপ্লবের পঞ্চঋষি (১৯২৩ খ্রি.), ভাষাতত্ত্ব ও বাংলা ভাষার ইতিহাস (১৯২৩ খ্রি.), উল্টোকথা, সুভাষচন্দ্র (১৯২৭ খ্রি.), ভৈরবী চক্র (১৯২৮ খ্রি.), দেশবন্ধু স্মৃতি (১৯৩১ খ্রি.), ধাপার মাঠ (১৯৩৩ খ্রি.), স্বাধীনতার সপ্তসূর্য, সুভাষের সঙ্গে বারো বছর (১৯৪৬ খ্রি.), The Intellectual Laws of Language (Thesis for P.R.S. 1920), Revolutionaries of Bengal (1923)। এছাড়া তাঁর রচিত কয়েকটি পাঠ্যপুস্তক হলো— নব বাংলা ব্যকরণ, প্রাথমিক ভূ-পরিচয় ও সমাজ-বিধান, ভারত-কথা প্রভৃতি।
১৯২৬ সালের ৩ জানুয়ারি ম্যালেরিয়ায় অসুস্থ, দেনায় জর্জরিত নজরুল ইসলামকে সপরিবার কৃষ্ণনগরে নিয়ে এসেছিলেন হেমন্তকুমার সরকার। নজরুলের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা— একপ্রকার সবরকম ব্যবস্থাই করেছিলেন তিনি। আশ্রয় হয়েছিল গোয়াড়ি বাজারের গোলাপট্টিতে হেমন্তকুমার সরকারের এজমালি পৈতৃক ভবন মদনমোহন কুটিরে, হেমন্ত সরকারের দাদা স্বনামধন্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক জ্ঞানেন্দ্রনাথ সরকারের বাড়ির এক অংশে। প্রায় আটমাস কবি সপরিবার বাস করেছিলেন। এই বাড়িতেই রচিত বিখ্যাত ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ উদ্বোধন-সঙ্গীত। ‘চল চল চল’-এর মতো রণসঙ্গীত, ‘ওঠরে চাষী জগদবাসী’-র মতো কিষাণের গান, ‘ওরে ধ্বংসপথের যাত্রীদল’-এর মতো সব জাগরণী গান। এই বাড়িতেই আসতেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র, মুজফফর আহমদের মতো ব্যক্তিত্বগণ। পরবর্তীতে কৃষ্ণনগরের গোলাপট্টি থেকে কবি সপরিবার চলে এসেছিলেন অঞ্জনা নদীর তীরবর্তী চাঁদসড়ক পল্লির ‘গ্রেস কটেজ’ নামক বাগানবাড়িতে।
একশো বছর অতিক্রম করেছে। গোলাপট্টির সেই মদনমোহন কুটির আর অক্ষত অবস্থায় নেই। আগ্রহী মানুষজন প্রায়শই মদনমোহন কুটিরের সন্ধান করতে গিয়ে হতাশ হন। কোনো স্মৃতিচিহ্ন না থাকায় সেই ঐতিহাসিক বাড়িকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না। ছয় ভাইয়ের শরিকি বিভিন্ন অংশ, ছোটো ছোটো ভাগে ঘরবাড়ি, ফ্ল্যাট হয়ে যাওয়ায় ও কিছু অংশ হাতবদল হওয়ায় সেই ইতিহাস হারিয়ে গিয়েছে। তবে হেমন্ত সরকারের দাদা স্বনামধন্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ডা: জ্ঞানেন্দ্র সরকারের ভাগের কিছুটা অংশ এখনো আছে। সেখানে তাঁর পুত্রবধূ চায়না সরকার বসবাস করেন। নজরুল-হেমন্ত স্মৃতিধন্য মদনমোহন কুটিরের সেই জীর্ণ ভগ্নাংশের সম্মুখেই সুজন-বাসর (গ্রেস কটেজ) ও অগ্নিবীণা সংস্থার যৌথ উদ্যোগে একটি স্মৃতিফলক বসানোর মধ্যে দিয়ে হারিয়ে যেতে থাকা এক ইতিহাসকে চিহ্নিতকরণের প্রচেষ্টা করা হয়েছে।
লেখক: অধ্যাপক, চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়, নদিয়া।