চৈত্রমাসের শুক্লা প্রতিপদ মহারাষ্ট্রে ‘গুড়ি পড়বা’র দিনরূপে প্রচলিত। ‘গুড়ি পড়বা হল বসন্ত উৎসব যা মারাঠী ও কোঙ্কনী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পারম্পরিক নববর্ষ।গুড়ি পড়ওয়া প্রধানত মহারাষ্ট্র এবং গোয়াতে চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে পালন করা হয়। চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথি সৌরচন্দ্র হিন্দী দিনপঞ্জীর প্রথম দিন। পড়বা/পড়ওয়া শব্দটি সংস্কৃত শব্দ প্রতিপদ থেকে এসেছে। চন্দ্রমাসের প্রথম দিনকে প্রতিপদ বলা হয়। এই দিনটি বসন্ত ঋতুর সূচনা এবং ফসল কাটার উৎসব হিসেবে বিবেচিত হয়।
গুড়িপড়োয়া নিয়ে পৌরাণিক গল্প বা মিথ উল্লেখ রয়েছে। ব্রহ্মপুরাণে উল্লেখ আছে যে, ভগবান ব্রহ্মা ‘গুড়ি পড়বা’র দিনেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছিলেন। ব্রহ্মার প্রচেষ্টায়, এই দিনে পৃথিবীতে ন্যায় ও সত্যের যুগ স্থাপিত হয়। এই কারণেই এই দিনে ভগবান ব্রহ্মার পূজা করা হয়।
গুড়ি পড়বার ইতিহাস এবং তাৎপর্য অনুযায়ী বিশ্বাস করা হয় যে, গুড়ি পড়বার দিনেই ভগবান রাম রাবণকে পরাজিত করে অযোধ্যায় ফিরে এসেছিলেন। ভগবান রামের বিজয়ের প্রশংসা ও সম্মান জানাতে, অযোধ্যার লোকেরা তাঁকে স্বাগত জানাতে গুড়ি (সজ্জিত পতাকা) উত্তোলন করেছিলেন বলে জানা যায়। সেই থেকে, গুড়িগুলি বিজয়, সমৃদ্ধি এবং অশুভের উপর শুভের বিজয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
আরেকটি গল্পে বলা হয়েছে যে, এই দিনে শ্রীরামচন্দ্র বালির অত্যাচার হতে দক্ষিণ ভূমিকে মুক্ত করেছিলেন। বালির পতনে প্রজাগণ ঘরে ঘরে উৎসব পালন করে ঘরের আঙ্গিনায় গুড়িয়া অর্থাৎ পতাকা বা ধ্বজা উত্তোলন করেছিলেন। আজও মহারাষ্ট্রে এই দিন ঘরে ঘরে পতাকা উত্তোলনের প্রথা রয়েছে। তাই এই দিনটিকে ‘গুড়ি পড়বা’ নাম দেওয়া হয়েছে। ঘরের আঙিনায় যে পতাকা উত্তোলন করা হয় তা বিজয়ের সংবাদ বহন করে অর্থাৎ ঘর থেকে বালির নির্বাসন হয়েছে। আসলেই আসুরী সম্পদ বিনাশ করে শ্রীরামচন্দ্র দৈবি সম্পত্তির প্রতিষ্ঠা করলেন ওই পতাকা এই বার্তাই বহন করে। গুড়ী অর্থাৎ বিজয়া পতাকা, ভোগের ওপর যোগের বিজয়, বৈভবের উপর বিভূতির বিজয়।
তবে, গুড়ির আরেকটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ মুঘলদের পরাজিত করেছিলেন এবং রাজ্যের জনগণকে মুঘল শাসন থেকে মুক্ত করেছিলেন। মহারাষ্ট্রের লোকেদের এই দিনে গুড়ি উত্তোলনের অন্যতম প্রধান কারণ এটি। বিশ্বাস করা হয় যে, পতাকাটি ঘরের প্রাঙ্গণে যেকোনো ধরণের মন্দ প্রবেশকে প্রতিহত করে। গুরুরামদাসকে সমর্পিত রাজ্য ফিরে পাওয়ার পর ছত্রপতি শিবাজী প্রসাদরূপে যেভাবে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন, ঠিক সেই ভাব সহকারে সারা বছরই প্রভু দ্বারা প্রেরিত ঐশ্বর্যের উপযোগ করা উচিত। এই প্রথা এমন সুন্দর ভাবটুকু প্রকাশ করে।
বৈদিক পঞ্জিকা অনুসারে, চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের প্রতিপদ তিথি ২৯ মার্চ বিকাল ৪টা ২৭ মিনিটে শুরু হবে এবং ৩০ মার্চ দুপুর ১২টা ৪৯ মিনিটে শেষ হবে।
উদয় তিথি গণনা অনুসারে, ৩০ মার্চ গুড়ি পদওয়া উদযাপিত হবে। চৈত্র নবরাত্রির নয় দিনব্যাপী উৎসবও এই দিনে শুরু হবে।
বছরের সাড়ে তিন মুহূর্তকে গুড়িপড়বা রূপে গণনা করা হয়। এই দিন হতেই শালিবাহন শকাব্দের শুরু। শালিবাহন ছিলেন প্রাচীন ভারতের একজন কিংবদন্তি সম্রাট, যিনি মহারাষ্ট্র থেকে শাসন করতেন বলে কথিত আছে। তাকে সাতবাহন রাজাদের একজন বলে মনে করা হয়। তার সম্পর্কে বেশ কিছু পরস্পরবিরোধী কিংবদন্তি রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো —
শালীবাহন নামে এক কুমোরের পুত্র মাটির সৈন্য তৈরি করে তাতে জলের ছিটা দিয়ে প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন এবং সেই সৈন্যদলের সাহায্যে শত্রুদের পরাজিত করেছিলেন। সেদিন হতে শালীবাহন শকাব্দের শুরু। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে শালিবাহন মাটির সৈন্যের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করেছিলেন… একি সত্য?
না এটি একটি রূপক। সেই সময় লোকেরা চৈতন্যহীন, পৌরুষহীন, পরাক্রমহীন হয়ে পড়েছিলেন। আর তাই তারা শত্রুকে পরাজিত করতে পারছিলেন না। মাটির মানুষ কি কখনো বিজয়ী হতে পারে? সেই সময় শালীবাহন লোকেদের মধ্যে চেতনার সঞ্চার করেছিলেন। তাঁর প্রেরণায় প্রস্তরসম মানবগনের মধ্যে পৌরুষ ও পরাক্রম জেগে উঠেছিল তাই তারা শত্রুদের পরাজিত করেছিল।
এইদিন তেলুগু এবং কানাড়া হিন্দুরা উগাদি পালন করে। উত্তর-পূর্ব রাজ্য মণিপুরে এটি সাজিবু নংমা পানবা চেইরাওবা নামে পরিচিত। এর সঙ্গে কিছু অঞ্চল এইদিন আলাদা আলাদা নামে নববর্ষ পালন করে। সিন্ধী সম্প্রদায়ের লোকরা এইদিন চেতি চান্দ হিসাবে ভগবান ঝুলেলালের আবির্ভাব তিথি পালন করে। চেতি চান্দে ঝুলেলালের পূজা-অর্চনা করা হয় এবং টেহরী (মিষ্টি ভাত) এবং শাই ভাজা (ডালে দেওয়া পালং শাক) প্রস্তুত করা হয়।
মহারাষ্ট্রে, এই উৎসবের একটি অপরিহার্য অংশ এবং আসন্ন বছরের জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করার জন্য গুড়ি উত্থাপন করা হয়। গুড়ি পড়োয়া উদযাপন ভোরবেলা পবিত্র স্নানের মাধ্যমে শুরু হয়। গুড়ি উত্তোলন, যা একটি উজ্জ্বল কাপড় (সাধারণত কমলা বা হলুদ), একটি তামা বা রূপার পাত্র এবং আমের পাতা দিয়ে সজ্জিত বাঁশের খুঁটি। বিজয় এবং সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে এই গুড়ি বাড়ির বাইরে উত্তোলন করা হয়। ভক্তরা স্বাস্থ্য, সম্পদ এবং সুখের জন্য আশীর্বাদ কামনা করার জন্য একটি বিশেষ গুড়ির পূজা করেন।বাড়ির প্রবেশপথে রঙিন রঙ্গোলি আঁকা হয়।হলুদ ও সিঁদুর দিয়ে শুভ স্বস্তিকা চিহ্ন আঁকা হয় এবং মোমবাতি জ্বালানো হয়।অভাবীদের জল ও খাদ্য পরিবেশন করা হয়।
এদিন ‘পুরাণ পোলি’ এবং ‘শ্রীখণ্ড’-এর মতো ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি প্রস্তুত করা হয়। এই দিনে নিম পাতা, তেঁতুল, গুড় এবং লবণের মিশ্রণও খাওয়া হয়, যা জীবনের মাধুর্য এবং তিক্ততার ভারসাম্যকে নির্দেশ করে। অনেক মন্দিরে দর্শনাদিদের নিম ও মিছরির প্রসাদ বিতরণ করা হয়। নিমতিক্ত কিন্তু আরোগ্য দায়ক, প্রথমে কষ্ট দিয়ে পড়ে মঙ্গল কারিগনের মধ্যে এটি একটি। অনেক অঞ্চলে, শোভাযাত্রা এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশনার আয়োজন করা হয়, যার মধ্যে নাচ, গান এবং ভোজসভা অন্তর্ভুক্ত থাকে।
মন্দিরে বিতরণ করা নিম ও মিছরির প্রসাদের পিছনে এক অতি মধুর ভাব লুকিয়ে আছে। জীবনের সুখ বা দুঃখ কখনো একাকী আসে না, সুখের পিছনে দুঃখ আর দুঃখের পিছনে সুখ আসে। এইভাবে “সুখে দুঃখে সমে কৃত্বা”-র মত সাম্যবৃত্তির তত্ত্বজ্ঞানের ভগবত প্রসাদ প্রত্যেকের রক্তে প্রবাহিত আছে। তাকে উপলব্ধি করে জীবনে ব্যবহারে এনে পুষ্ট করে তুষ্ট হওয়াই আমাদের কর্তব্য।
গুড়ি পড়োয়া কেবল একটি উৎসব নয়; এটি উৎসাহ ও নিষ্ঠার সাথে নতুন সূচনাকে আলিঙ্গন করার একটি আধ্যাত্মিক স্মারক। যথাযথ আচার-অনুষ্ঠান, সুস্বাদু প্রসাদ এবং পারিবারিক বন্ধনের মাধ্যমে ঘরে উদযাপন করে আপনি দিনটিকে গভীরভাবে পরিপূর্ণ এবং শুভ করে তুলতে পারেন। গুড়ি উত্তোলন, প্রার্থনা, ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি রান্না, অথবা দান-খয়রাতের মাধ্যমে, গুড়ি পড়োর প্রতিটি দিকই আমাদের জীবনে আনন্দ, সমৃদ্ধি এবং ঐশ্বরিক করুণা নিয়ে আসে।
২০২৫ সালে গুড়ি পদওয়া উদযাপনের সময়, আপনার ঘর শান্তি, সুখ এবং আধ্যাত্মিক বিকাশে ভরে উঠুক। আপনাকে এবং আপনার পরিবারকে আশীর্বাদপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ হিন্দু নববর্ষের শুভেচ্ছা!