নদিয়া জেলা আগাগোড়াই শিক্ষা-সংস্কৃতির জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এই জেলাকে চিন্তা ও মননের উর্বর ক্ষেত্র বলে অনেকেই মনে করে থাকেন। আর তার যথেষ্ট নজিরও রয়েছে। হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ের জন্যেও এই জেলা বিশেষ ঐতিহ্য বহন করে আসছে। প্রায় পাঁচশত বছর আগে আবির্ভূত চৈতন্যদেবের আমল থেকেই প্রবাহিত এই ধারা। প্রসঙ্গত হুসেন শাহের আমলের একাধিক ঘটনা, কিংবা চৈতন্য ও চাঁদ কাজীর ঘটনাবহুল বিবরণ আমরা অনেকেই পড়েছি বা শুনেছি। এই জেলাতেই জন্ম লালন সাহ ফকিরের, কুবের গোঁসাইয়ের। কর্তাভজা, খুশি বিশ্বাসী, বলাহাড়ি, সাহেবধনী সম্প্রদায়ের মতো একাধিক গৌণ ধর্মের জন্ম এই জেলায়। এই জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগর। সেও এক সাংস্কৃতিক পীঠস্থান। এছাড়া এই জেলায় রয়েছে নবদ্বীপ, রানাঘাট, অনুলিয়া, ফুলিয়া, শান্তিপুরের মতো একাধিক জনপদ, যেখানে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভাষাচর্চার এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। কৃষ্ণনগর তো আধুনিক শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র কৃষ্ণনগর কলেজের ঐতিহ্যও বহন করে চলেছে।
আঞ্চলিক পত্র-পত্রিকার মধ্যে দিয়ে কোনো জায়গার শিক্ষা সংস্কৃতির অগ্রগতি, খবরা খবর, ইতিহাস যেমন জানা যায়, তেমনি সেই জায়গার শিক্ষা সংস্কৃতির বর্তমান রূপটিও প্রত্যক্ষ করা যায়। পত্র-পত্রিকার মধ্যে দিয়েই সেখানকার জ্ঞানবিদ্যা চর্চার এক ধরনের প্রকাশ ঘটে। প্রসঙ্গত কৃষ্ণনগরের একটি বিশেষ পত্রিকার কথা এখানে বলা যাক। কৃষ্ণনগর তথা নদিয়া জেলার একটি অন্যতম খবরের কাগজ হল ‘গ্রাম গ্রামান্তর’। দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিতভাবে এই কাগজটি প্রকাশ পাচ্ছে। এই কাগজের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৭৭ সালে। নীহার ব্যানার্জীর উদ্যোগেই মূলত সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে ‘গ্রাম গ্রামান্তর’-এর পথচলা শুরু হয়। তবে প্রকাশক হিসেবে পত্রিকায় তাঁর নাম থাকত না। ‘গ্রাম গ্রামান্তর’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশক হিসেবে যার নাম থাকত, তিনি হলেন নির্মলা ব্যানার্জী। তিনি একজন গৃহবধূ এবং সম্পর্কে তিনি ছিলেন নীহার ব্যানার্জীর মেজ বৌদি। পত্রিকা প্রকাশ পেত কাঁঠালপোতা, কৃষ্ণনগর থেকে। আর এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন শতঞ্জীব রাহা। যিনি পরবর্তীতে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে বিশেষ পরিচিতি পান। যাইহোক, শুরুতে এই টিম নিয়েই ‘গ্রাম গ্রামান্তর’ পত্রিকার রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়। ক্রমান্বয়ে ‘গ্রাম গ্রামান্তর’ কৃষ্ণনগরের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাগজ হয়ে ওঠে।
একসময় ‘গ্রাম গ্রামান্তর’ পত্রিকার জেলা জুড়ে প্রায় ত্রিশ জনের অধিক সাংবাদকর্মী ছিলেন, যারা পত্রিকার জন্য নিয়মিত সংবাদ সংগ্রহ করতেন। জগদ্ধাত্রী পুজো নিয়ে ‘গ্রাম গ্রামান্তর’-এর বিশেষ সংখ্যা পাঠকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করত। স্থানীয় সিনেমা হল চিত্রমন্দির নিয়ে ‘গ্রাম গ্রামান্তর’-এর স্পেশাল ইস্যুটির কথাও বলতে হয়। ‘গ্রাম গ্রামান্তর’-এর সঙ্গে লেখক সঞ্জিত দত্তর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি দীর্ঘদিন এই কাগজের সহ-সম্পাদক ছিলেন। পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশে সঞ্জিত দত্ত মুখ্য দায়িত্ব নিতেন। পরবর্তীতে এই কাগজের সম্পাদক হয়েছিলেন শচীন বিশ্বাস, যিনি শক্তিনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলা শিক্ষক ছিলেন। গল্পকার হিসেবেও তিনি সুনাম অর্জন করেছিলেন। তারপর চন্দন সান্যাল সম্পাদক হন। আর আগাগোড়াই পত্রিকা প্রকাশে আর্থিক সহযোগিতা ছিল নীহার ব্যানার্জীর। বছরে একবার এই পত্রিকার বাৎসরিক সভা হত। শ্রদ্ধেয় নীহার ব্যানার্জী দীর্ঘ ২৮ বছর ‘গ্রাম গ্রামান্তর’ পত্রিকা চালানোর পর প্রবীরকুমার বসুকে দায়িত্বভার অর্পণ করেন। পত্রিকার নামে গচ্ছিত ৪০০ টাকাও হস্তান্তরিত হয়। ‘গ্রাম গ্রামান্তর’ ২০০৪ সাল থেকে পাক্ষিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে। আর তখন থেকেই এর সম্পাদক ও প্রকাশক প্রবীর কুমার বসু। ২০২৩ সাল থেকে বার্তা সম্পাদক হিসেবে পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন দীপাঞ্জন দে। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে ‘গ্রাম গ্রামান্তর’ ৪৭তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। এই কালপর্বে একাধিক উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে চলেছে এই পত্রিকাটি। দীর্ঘ ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে ‘গ্রাম গ্রামান্তর’ কাগজ এখনো নিয়মিত প্রকাশ পেয়ে চলেছে। প্রতি মাসে পত্রিকার দুটি সংখ্যা পাঠকেরা হাতে পান। কৃষ্ণনগর থেকে কাগজটি প্রকাশ পায়। ‘গ্রাম গ্রামান্তর’-এর মতো যেকোনো ক্ষুদ্র পত্র-পত্রিকার সংগ্রামময় অস্তিত্বকে কুর্ণিশ জানাতেই হয়।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, ‘গ্রাম গ্রামান্তর’ পত্রিকা।
ভালো লাগলো।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
Kub valo laglo pore🙏❤️🙏
অনেক ধন্যবাদ।
Khub sundor
ধন্যবাদ।