চাষের জমিতে নাড়া পোড়ানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। দ্বিগুণ জরিমানা। জমির উপকারী ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের মৃত্যু। পরিবেশ দূষণ। এসব চাষিদের কাছে এখন গ্ৰাহ্য নয়। আমন ধান কাটার পর্ব শুরু হতেই অসচেতন চাষিরা। বিঘার পর বিঘা ধান কাটার পরই শুরু হয়েছে নাড়া পোড়ানোর ধ্বংসলীলা। চিন্তিত বিশেষজ্ঞরা। রাজ্য সরকার নাড়া পোড়ানো নিয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। পাশাপাশি কেন্দ্র সরকারও নাড়া পোড়ানো বন্ধ করতে জরিমানা দ্বিগুণ করেছে। তবুও টনক নড়েনি চাষিদের।
প্রসঙ্গত, সাধারণত ফসল কাটার পরে শিকড়-সহ অবশিষ্টাংশ জমিতে থেকে যায়। পরবর্তী ফসল চাষের জন্য জমি তৈরি করতে গেলে ফসলের এই অবশেষ তুলে ফেলতে হবে। তাতে সময় লাগে আর মজুরি বাবদ বেশ কিছু টাকা খরচ হয়। তাই তাৎক্ষণিক লাভের জন্য জমির ফসলের অবশিষ্টাংশে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। দিন পেরিয়ে রাতের গাঢ় অন্ধকারকে ভেদ করে আগুনের লেলিহান শিখা দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। ছড়িয়ে পড়ে মাঠের পর মাঠ। ধোঁয়ায় ভরে যায় চারদিক। সেই সঙ্গে দৃশ্যমানতা কমে যায়। ফলে সড়ক দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়ে। এছাড়া শ্বাসরোধকারী পরিস্থিতি তৈরি হয়। পরদিন মাঠ জুড়ে দগদগে ঘায়ের মতো কালো কালো পোড়া চিহ্ন পড়ে থাকে। যেহেতু এই আগুন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন তাই মাঠ ছাড়িয়ে বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে রূপান্তরিত হতে পারে। পুড়িয়ে শেষ করে দিতে পারে গ্রামকে গ্রাম। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, মানুষ, গৃহপালিত পশুপাখি, গাছপালাও কৃষিকর্তাদের একাংশ জানান, ফি- বছর দক্ষিণবঙ্গের জেলা জুড়ে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে ধান তুলে নেওয়ার পরে নাড়া পোড়ানোর ঘটনা নজরে এসেছে। চলতি বছরেও তার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, একটন মাটি পোড়ালে মাটি থেকে বেড়িয়ে যায়- ৫.৫ কেজি নাইট্রোজেন, ২.৩ কেজি ফসফরাস, ২৫ কেজি পটাশিয়াম, ১.২ কেজি সালফার। প্রতি টন খড় পোড়ালে বাতাসে মেশে- ২ কেজি সালফার ডাই- অক্সাইড, ৩ কেজি বস্তুকণা, ৬০ কেজি কার্বন মনোক্সাইড, ১৪৬০ কেজি কার্বন ডাই অক্সাইড এবং ১৯৯ কেজি ছাই। এইভাবেই নাড়াপোড়ার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বাতাস দূষিত হচ্ছে। নাড়া পোড়ানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নাড়া পোড়ানোর বিরুদ্ধে তাই সর্বস্তরে প্রচারাভিযান চলছে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে নাড়া পোড়ানোর বদলে তাকে সম্পদ হিসাবে পেতে কিছু সুপারিশ আছে। “পুসা বায়ো ডিকম্পোজার” ক্যাপসুল ব্যবহার করলে নাড়া পচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে মাত্র পঁচিশ দিন সময় লাগে, একর প্রতি ১০০০ টাকার কম খরচ হয়। কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রগুলো ও কৃষিজেলা কৃষিকর্তাদের একাংশ জানান, দক্ষিণ বঙ্গের জেলা জুড়ে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে ধান তুলে নেওয়ার পরে নাড়া পোড়ানোর ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে। পরিবেশ দূষণ রুখতে তা বন্ধের দাবি অনেক দিন ধরেই উঠছে। ধান তোলার পরে দ্রুত জমি পরিষ্কার করতে গাছের গোড়া (নাড়া) আগুনে পুড়িয়ে দেন চাষিদের একাংশ।
এক কৃষিকর্তা বলেন, “ধান উঠে যাওয়ার পর ওই সমস্ত জমিতে আলু চাষ শুরু করেন চাষিরা। তা ছাড়া, নাড়া পোড়ালে জমি উর্বর হয় এ ধারণা চাষিদের এখনও মাথা থেকে যায়নি। চাষিদের মনে রাখতে হবে তাদের উপর নির্ভরশীল জীববৈচিত্র্য। পোড়া মাটি ইটের মতো শক্ত হয়ে যায়। সুতরাং সাবধান হওয়ার প্রয়োজন আছে। সম্প্রতি বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত কৃষিমেলায় এ বিষয়ে কৃষকদের সচেতন করার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের পক্ষ থেকে প্রদর্শিত হয়েছিল একটি বিশাল ফ্লেক্স , যার শিরোনাম ছিল ‘নাড়াই সম্পদ, নাড়া পোড়াবেন না, পুনর্ব্যবহার করুন।’ এই শিরোনামে নাড়া পোড়ানোর বিপদ ও তার থেকে উদ্ধার পেতে যে পরামর্শগুলো দেওয়া হয়েছে তা উল্লেখ করতেই হয়। নাড়া পোড়ালে মাটির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। মাটির উপরিস্থ ২.৫ সেমি পর্যন্ত স্তরের উপকারী ব্যাকটেরিয়া আর ছত্রাককে মেরে ফেলে। পরবর্তী ফসলের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেতে থাকে। যেখানে অত্যধিক নাড়া পোড়ানো হয় সেই অঞ্চলে মানুষের ফুসফুসের রোগ বেশি হয়।বাতাসে উড়ছে পোড়া খড়। এলাকা ঢেকে যাচ্ছে ধোঁয়ায়। কুয়াশার সঙ্গে সেই ধোঁয়া মিশে তৈরি করছে ধোঁয়াশা। এ ভাবে জমিতে নাড়া পোড়ানোয় ভয়ঙ্কর দূষণ ছড়াচ্ছে। তা নিয়ে চাষিদের সতর্ক করতে ও নাড়া পোড়া রুখতে শিবির করে ও ট্যাবলোয় প্রচারের মাধ্যমে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য কৃষি দফতর।টাকার কম খরচ হয়। স্থানীয় কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র, কৃষি দপ্তরে যোগাযোগ করে এর প্রাপ্যতা বিষয়ে অবহিত হতে হবে। অন লাইনেও পাওয়া যেতে পারে। “হ্যাপি সীডার” যন্ত্র ব্যবহার করলে একসাথে নাড়া কাটা, গমের বীজ বপন ও নাড়ার টুকরোগুলো বপিত বীজের উপর আচ্ছাদন হিসাবে কাজ করে। ফলে জমিতে জল সংরক্ষণ হয়, সঠিক সময়ে বপন করা বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম হয়, আগাছার উপদ্রব কমে ও জমি জৈব উপাদানে সমৃদ্ধ হয় ও সঠিক সময়ে গমের বীজ বোনা যায়। স্থানীয় “কাস্টম হায়ারিং সেন্টারে” এই যন্ত্র কেনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এছাড়া নাড়া তুলে জমির এক কোণে স্তরে স্তরে জমা করে তার থেকেও বহুমূল্য জৈবসার প্রস্তুতি বা কেঁচোর খাবার হিসাবে ব্যবহার করে কেঁচো সার বা ভারমি কম্পোস্ট তৈরি করা যায়। মাশরুম চাষের উপাদান হিসাবেও এই নাড়া ব্যবহৃত হতে পারে। সুতরাং এখন থেকে আর নাড়া পোড়ানোর দরকার নেই।
উল্লেখ্য, নাড়া পোড়ানো বন্ধে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কেন্দ্র নাড়া পোড়ানো জরিমানার অঙ্ক দ্বিগুণ করে দিল। চাষের জমিতে নাড়া পোড়ানো বন্ধ করতে জরিমানার পরিমাণ বাড়ানোর উপরই ভরসা করছে কেন্দ্রীয় সরকার। সেজন্য জরিমানা বাড়িয়ে এক ধাক্কায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। নতুন নিয়মে নাড়া পোড়ালে দু’একরের কম জমির মালিককে ৫ হাজার টাকা, ২ থেকে ৫ একরের জমির মালিককে ১০ হাজার টাকা এবং ৫ একরের বেশি জমির মালিককে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার সংস্থান রাখা হয়েছে। সম্প্রতি দিল্লিতে দূষণ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে দিল্লি ও কেন্দ্রীয় সরকার। দিল্লির দূষণের অন্যতম কারণ প্রতিবেশী পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় নাড়া পোড়ানো। বন্ধ করতে দুই রাজ্যের সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে সরব হয় শীর্ষ আদালত। পরিস্থিতি বদলাতে জরিমানার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও আদালত প্রশ্ন তোলে। ক্ষুব্ধ আদালত জানায়, ‘দূষণ নিয়ন্ত্রণে জরিমানার ব্যবস্থা নখদন্তহীন।’ জরিমানা ধার্য করা, তা সংগ্রহ করা এবং অনাদায়ে শাস্তির মতো বিষয় তদারকির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই বলে আদালত জানায়। কিন্তু এরপরেই জরিমানার অঙ্ক বাড়িয়েই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। দূষণ নিয়ন্ত্রণে ২০২১ সালে এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট আইন পাশ করে কেন্দ্র। এবার সেই আইনকে সংশোধন করে জরিমানার অঙ্ক বাড়ানো হল। নতুন ব্যবস্থা অনুযায়ী, বায়ুদূষণ সংক্রান্ত অভিযোগ বিচার করবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড এবং কমিশন ফর এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট।ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানো প্রতিরোধী দিবস উদযাপন করে খড় পোড়ানো ক্ষতিকারক, খড় পোড়ানো বন্ধ রাখুন। ধান ক্ষেতের খড় ও নাড়া পোড়ানোর ফলে ক্ষতিকারক গ্যাস, তাপ, ধোঁয়া, ছাই কণা উৎপন্ন হয়-যা বিশ্ব উষ্ণায়ন ডেকে আনে। অত্যাধিক গরম, অনাবৃষ্টি, বন্যা, শীত হ্রাস, পাহাড়ের বরফ গলে সমুদ্রের জলোচ্ছাস প্রভৃতি ঘটছে। এছাড়াও অস্বাভাবিক আবহাওয়া বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা চিন্তার ভাঁজ বিশেষজ্ঞদের কপালে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মাটির উপরের অংশ পুড়ে শক্ত হয়ে যায়, জৈব পদার্থ ও উদ্ভিদ খাদ্য নষ্ট হয় এবং মাটিতে থাকা বহু উপকারী জীবাণু মারা যায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিবেশ দপ্তরের বিজ্ঞপ্তি অনুসারে ধান ক্ষেতের খড় ও নাড়া পোড়ানো আইনত নিষিদ্ধ। কৃষি দপ্তরের সহযোগিতা ও পরামর্শ মেনে খড় না পুড়িয়ে মালচার, রোটাভেটর, হ্যাপি সিডারের মাধ্যমে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে মাটির উর্বরতা ও জলধারণ ক্ষমতা বাড়ান কিংবা বেলার এর সাহায্যে তুলে নিয়ে অন্য কাজে লাগান। মাটির স্বাস্থ্য বজায় রেখে অধিক ফলন পেতে এবং দূষণমুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতে। খড় পোড়াবেন না। পরিবেশ রক্ষায় আপনার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন। এভাবেই চাষিদের সচেতন করতে পথে নেমেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও।