বারো মাসে তেরো পার্বণের স্বরলিপি বাংলাদেশের অতিপ্রাচীন। যার কোনোটিতে ধর্মের প্রভাব, কোনোটিতে খাদ্যশস্য উৎপাদন বা কোনোটিতে নিয়ম নীতি পালনের গুরুত্ব আরোপ করার নিয়ম বলা থাকে। পার্বনগুলির অধিকাংশ সৃষ্টি ধর্মীয় কারণে কারণ ‘ধর্ম’কে সবাই একটু আলাদা চোখেই দেখে। পুণ্য অর্জনের সম্ভাবনাকে সামনে রেখে সমাজে কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলার রীতির নাম ব্রত।
মায়েরা সর্বদা চিন্তিত থাকে সন্তানের মঙ্গল কামনায়।
জননীর এই মাঙ্গলিক ভাবনা বাস্তবরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে মঙ্গলচন্ডী বা জয় মঙ্গলবারের ব্রত-র মধ্যে দিয়ে। সন্তানের মঙ্গলচিন্তাই যেহেতু মুখ্য উদ্দেশ্য তাই ব্রতের জন্য সপ্তাহের মঙ্গলবারটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। বিশ্বাস করা হয়, এই ব্রত পালন করলে শুধু সন্তানের মঙ্গলই হয় না কূপুত্র সুপুত্র হয় এবং মৃতপুত্রও পুনঃ জীবন লাভ করে।
জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রতি মঙ্গলবার পালন করা হয় মঙ্গলচন্ডী ব্রত। অনেকেই বৈশাখ মাসের প্রতি মঙ্গলবারেও এই ব্রত করে থাকেন। আসলে যার যখন মন চায় তখনই করেন। ‘মঙ্গল’ শব্দের অর্থ শুভ বা হিতকর এবং ‘চন্ডী’ শব্দের অর্থ ‘দেবী দুর্গা’। বর্ষায় সুজলা সুফলা হয়ে উঠুক ধরিত্রী এবং স্বামী, পুত্র, কন্যা নিয়ে সংসারের মঙ্গল কামনায় পালন করা এই মঙ্গলচন্ডী ব্রত।
সুকুমার সেনের মতে চন্ডী শব্দটি এসেছে চন্ডী থেকে। চন্ডী একজন অনার্যা দেবী। যিনি ওঁরাও, বির, হোড় প্রভৃতি উপজাতিদের দ্বারা পূজিত দেবী দুর্গার রূপ। মা মঙ্গলচন্ডী হলেন দ্বিভুজা ও গৌরবর্ণা, রক্তপদ্মাসনে উপবিষ্টা ও মুকুট দ্বারা উজ্জ্বলরূপে ভূষিতা।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে শ্রীমন্ত সওদাগরের মঙ্গলচন্ডী কাহিনী প্রচলিত আছে। সওদাগর তার বাণিজ্যের জাহাজ নিয়ে যাচ্ছিলেন সিংহলের দিকে। মাঝসমুদ্রে ঝড়ের প্রকোপে ডুবে যায় জাহাজ। সওদাগর কোনোমতে বেঁচে উঠে যান সিংহল বন্দরে। সেখানকার রাজার রক্ষীরা তাঁকে কারারুদ্ধ করে। সেই অবস্থায় তিনি মঙ্গলচন্ডী দেবীর বন্দনা করেন এবং কারা থেকে মুক্তি লাভ করে গ্রামে ফেরেন। তখন থেকেই মঙ্গলচন্ডী পূজার প্রচলন।
জ্যৈষ্ঠ মাসের ব্রত কথায় জয়দেব-জয়াবতীর উপাখ্যান পাওয়া যায়। যেখানে জয়াবতীর দ্বারা দেবীর মাহাত্ম্য প্রকাশ পেয়েছে। সংসারের মঙ্গলকামনা করা ছাড়াও গ্রীষ্মের দাবদাহে ফুটিফাটা বাংলার মাঠের জন্য বর্ষার আগমনের হেতু এই ব্রত।
অভীষ্ট মনস্কামনা পূরণের মঙ্গলচন্ডী দেবীর ব্রত পালন করা হয়। ধনপতি সওদাগরের পত্নী খুল্লনা বাংলাদেশে প্রথম এই পূজার প্রবর্তন করেন। তাঁর নাম অনুসারে বাংলাদেশের ‘খুলনা’ জেলার নামকরণ হয়েছে বলে জনশ্রুতি।
ব্রতি সারাদিন উপবাসি থেকে ব্রত পালন করে। এই ব্রতে প্রয়োজন হয় ১৭টি কাঁঠাল পাতা, ১৭টি আম পাতা, ১৭টি বেলপাতা। ১৭টি তুলসী পাতা ১৭টি ধান, ১৭টি যব, ১৭টি দূর্বা, একটি চাঁপাকলা একটি গোটা সুপরি এবং বিবিধ ফল। পূজা শেষে ব্রতকথা শুনতে ব্রতীকে পুকুর ঘাটে গিয়ে ধানের খোসা ছাড়িয়ে চাল বের করে ১৭টি চাল, যবের খোসা ছাড়িয়ে নিয়ে ১৭টি যব, ১৭টি তুলসী পাতা এবং একটি চাঁপাকলা দিয়ে মেখে তিন ভাগ করে তিনবারে গিলে খেতে হয় (দাঁতে যেন না লাগে, একে ‘গদ’ বলে) এরপর তিনবার একটু করে জল খেতে হয় এবং পূজার বাকি সব দ্রব্য পুকুরের জলে ফেলে দিতে হয় সাধারণত কয়েকজন সধবা নারী একত্রে বসে মা চন্ডীর কাছে অর্ঘ্যদান করে এবং চন্ডীর ঘট সামনে রেখে ব্রতকথা শোনে। ব্রত কথা বলেন একজন ব্রতিনী এবং অন্যান্য ব্রতিরা একটি গোটা সুপারি হাতে নিয়ে ব্রত কথা শোনেন এবং নিচের ছড়াটি বলেন —
“আটকাটি,
আটমুঠি সোনার মঙ্গলচণ্ডী রুপোর পা ,
কেন মাগো মঙ্গলচণ্ডী হল এত বেলা?
হাসতে খেলতে, নির্ধনকে ধন দিতে,
অপুত্রককে পুত্র দিতে,
তেলহলুদ মাখতে,
আঘাটায় ঘাট করতে,
আইবুড়োর বিয়ে দিতে,
অন্ধের চক্ষু দিতে ,
বোবার বোল ফোটাতে,
ঘরের ঝি বৌ রাখতে ঢাকতে হল তাই এত বেলা৷” —
ছোটবেলায় মা কাকীমাদের সঙ্গে আমিও পালন করতাম এই ব্রত। মঙ্গলকামনা কী করতাম মনে নেই, তবে ফলাহারের লোভে এটুকু মনে আছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রতি মঙ্গলবার ব্রত পালন করা হলেও, ঘরে ছোটোদের পারমিশন হতো প্রথম আর শেষ মঙ্গলবারের। সকালে স্নান করে পিতলের থালায় সতেরোটি সুপুরি, ধান, দুর্বা, ফুল, পাকা আম, কলা, মিষ্টি, কালোজাম, পৈতে, কাঁঠাল ইত্যাদি নিয়ে এবং একটি ঝুড়িতে কাঁঠালপাতা নিয়ে যেতাম বাড়ির কাছেই ঠাকুর বাড়িতে পুজো দিতে।
পুজো শেষে ব্রতের বইয়ে পেন্নাম ঠুকে মন হু হু করতো গরম লুচি আর আলুরদম খাওয়ার জন্য। দুপুর বেলায় চিঁড়ে, মুড়ি, দই, কলা, আম, প্রসাদের সন্দেশ, বাতাসা দিয়ে মাখা হত ফলাহার। আহা, সে যেন অমৃতের সমান। রোজের একঘেয়ে ভাত, ডাল, চচ্চড়ি, মাছের ঝোল খাওয়ার থেকে, এই খাবারের মজাই ছিলো আলাদা। মানুষের ধর্ম প্রবৃত্তি না প্রকৃতির অনুশাসন না সমাজের নিয়ম নীতির বেড়াজাল, কিসের প্রেরণা থেকে ব্রতের জন্মলাভ হয়েছে তা বলা কঠিন। ব্রতকথার আড়ালে যে গল্পগুলো প্রচলিত আছে সেগুলো লোকশিক্ষার চলন।
গ্রীষ্মের দাবদাহে কৃষিপ্রধান বাংলার ফুটিফাটা মাঠঘাটে বর্ষার আগমন হেতু মা চন্ডীর শরণাপন্ন হওয়া ছিলো এর অন্যতম কারণ। কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ, আম, জাম ইত্যাদি মরশুমী ফল এই সময় বাজারে পাওয়া যায়। বহুবীজ ফলগুলি প্রচুর ফলনশীল। ফলের সঙ্গে মানুষের সংসারেও ফলন হওয়ার একটি প্রচ্ছন্ন ধারণা লুকিয়ে থাকে ব্রত পালনে। কুমারী ও সধবা নারী জীবনে শ্রেষ্ঠ মাঙ্গল্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই ব্রত পালন করে।
ঋতুপরিবর্তনের সঙ্গে জীবনে যে দশাবিপর্যয় ঘটতো সেগুলোকে ঠেকানোর জন্য এই ব্রতক্রিয়ার উৎপত্তি। বাইরের খোলসটার পরিবর্তন হলেও অন্তঃপুরটা একই হওয়ার দরুন পুরুষানুক্রমে চলে আসা মেয়েলী ব্রতগুলো আজো চলমান।
***
মা মঙ্গলচণ্ডীর ধ্যান
যৈষা ললিতকান্তাখ্যা দেবী মঙ্গলচণ্ডিকা।
বরদাভয়হস্তা চ দ্বিভুজা গৌরদেহিকা।
রক্তপদ্মাসনস্থা চ মুকুটোজ্জ্বলমণ্ডিতা।
রক্তকৌষেয়বসনা স্মিতবক্ত্রা শুভাননা।
নবযৌবনসম্পন্না চার্ব্বঙ্গী ললিতপ্রভা।।
অর্থ — যাঁহার নাম মধুর ও মনোহর, যাঁহার হস্তে বর ও অভয় মুদ্রা, যিনি দ্বিভুজা ও গৌরবর্ণা, যিনি রক্তপদ্মাসনে উপবিষ্টা ও মুকুট দ্বারা উজ্জ্বলরূপে ভূষিতা, যিনি রক্তবর্ণ কৌষেয় (চেলির) বস্ত্র পরিধান করিয়া আছেন, যিনি সহাস্যবদনা, সুন্দরাননা ও নবযৌবনা, যিনি সুন্দরাঙ্গী ও মধুর লাবণ্যযুক্তা, তিনিই দেবী মঙ্গলচণ্ডী।
দেবীমায়ের প্রণাম মন্ত্র —
ওঁ সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বাথসাধিকে। শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোহস্তু তে।।
অর্থ — ওঁ, আপনি সর্বমঙ্গলস্বরূপা, সর্বাভীষ্টসাধিকা, একমাত্র স্মরণযোগ্য, ত্রিভুবন জননী বা ত্রিনয়না (সূর্যচন্দ্রাগ্নিলোচনা ) ও গৌরবর্ণা। হে নারায়ণী ,আপনাকে প্রণাম করি।।
শিবশম্ভুপাঠকৃত মঙ্গলচণ্ডিকা স্তোত্র
রক্ষ রক্ষ জগন্মাতর্দেবী মঙ্গলচণ্ডিকে।
হারিকে বিপদাং রাশের্হর্ষমঙ্গলদায়িকে।।
হর্ষমঙ্গলদক্ষে চ হর্ষমঙ্গলদায়িকে।
শুভে মঙ্গলদক্ষে চ শুভে মঙ্গলচণ্ডিকে।।
মঙ্গলে মঙ্গলার্হে চ সর্বমঙ্গলমঙ্গলে।
সতাং মঙ্গলদে দেবী সর্বেষাং মঙ্গলালয়ে।।
পূজ্যে মঙ্গলবারে চ মঙ্গলাভীষ্টদেবতে।
পূজ্যে মঙ্গলবংশস্য মনুবংশস্য সন্ততম্।।
মঙ্গলাধিষ্ঠাতৃদেবী মঙ্গলানাঞ্চ মঙ্গলে।
সংসারমঙ্গলাধারে মোক্ষমঙ্গলদায়িনী।।
সারে চ মঙ্গলাধারে পারে চ সর্বকর্মণাম্।
প্রতিমঙ্গলবারে চ পূজ্যে মঙ্গলসুখপ্রদে।।
বঙ্গানুবাদ — হে জগজ্জননী! বিপদবারিণি! হর্ষমঙ্গলপ্রদায়িনী! দেবী! মঙ্গলচণ্ডিকে! রক্ষা কর, রক্ষা কর। তুমি হর্ষ এবং মঙ্গলদানে দক্ষা — তুমি হর্ষ এবং মঙ্গল দান করিয়া থাক। তুমি শুভ এবং মঙ্গল বিষয়ে নিপুণা বলিয়া শুভা এবং মঙ্গলচণ্ডিকা নামে প্রসিদ্ধা হইয়াছ। হে মঙ্গলে! মঙ্গলার্হে! সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে! সাধুগণের মঙ্গলদায়িনী! হে দেবী! তুমি সকলের মঙ্গল দান কর। হে মঙ্গলরাজের অভীষ্ট দেবী! মঙ্গলবারেই তোমার পূজা বিধেয় এবং মণুবংশজাত মঙ্গল রাজা নিরন্তর তোমার অর্চনা করেন। হে মঙ্গলাধিষ্ঠাতৃদেবি। পৃথিবীতে যত প্রকার মঙ্গলকর বস্তু আছে , তুমি সেই সকলের স্বরূপা। হে সংসারমঙ্গলাধারে। তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ মোক্ষ দান করিতে পার। হে মঙ্গলজনয়িত্রি। হে সাররূপিনী! তুমি সকল কর্মের অগোচর এবং প্রতি মঙ্গলবারে পূজিতা হইয়া বহু সুখ প্রদান কর।
মঙ্গলচণ্ডিকা স্তোত্র সম্পূর্ণম্।।
শ্রী ব্রহ্মবৈবর্তপূরাণের প্রকৃতিকাণ্ডের ৪৪/২০-৩২ শ্লোক
খুবই কঠিন কাজ। বেশ ভালো হয়েছে।
Dhonyobad