এক. এখন থেকে আড়াই হাজারের বেশি বছর আগের কাহিনি। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক। আশ্বিন মাস। মেঘমুক্ত নীল আকাশ। চরাচরে সোনালি রঙের উজ্জ্বল রোদ ছড়িয়ে আছে। বৈশালীর (প্রাচীন ভারতের একটি শহর। বর্তমানে বিহারে অবস্থিত) প্রকৃতি অত্যন্ত মনোরম। নগরময় অসংখ্য উদ্যান ও পদ্মপুকুর। গৌতম বুদ্ধ এর আগেও বেশ কয়েকবার বৈশালী নগরে এসেছেন। বোধিলাভের পঞ্চম বছরের বর্ষাকাল ওই নগরেই কাটিয়েছেন। বৈশালীর অভিমুখে ধ্যানস্থ ভঙ্গিতে হাঁটছেন গৌতম বুদ্ধ। বুদ্ধের পরনে রক্তবর্ণের গেরুয়া। মস্তক মুণ্ডিত। চোখ অর্ধমুদিত। দূরে বৈশালী নগরের প্রাচীরটি আবছা দেখা যায়। বুদ্ধের সঙ্গে প্রিয় শিষ্য ভিক্ষু আনন্দ, ভিক্ষু সারিপুত্র ও ভিক্ষু উপালি। মাটির পথটি সংকীর্ণ। দুই পাশে কলা গাছ আর ফসলের মাঠ। ভিক্ষু শুভব্রত বুদ্ধকে উদ্দেশ করে বললেন, আসুন আসুন তথাগত, মহামায়া বিহারের সবাই অপেক্ষা করছেন আপনার জন্য। ভিক্ষু সারিপুত্র বললেন, আম্রপালী আগেই তথাগতকে নিমন্ত্রণ করেছেন। আমরা এখন আম্রপালীর ভবনে যাচ্ছি। ভিক্ষু শুভব্রতর চোখেমুখে বিস্ময়ের চিহ্নটি গভীর হয়ে উঠল যেন। আম্রপালী বৈশালী নগরের সুন্দরী ‘রূপাজীবা’ (royal courtesan); তাঁর আতিথ্য বরণ করবেন তথাগত বুদ্ধ? বিস্ময় চেপে রাখতে না পেরে ভিক্ষু শুভব্রত বললেন, তথাগত! আপনি বৌদ্ধ বিহারে না গিয়ে সামান্য একজন নগরনটীর আতিথ্য গ্রহণ করবেন! বুদ্ধ নীরব রইলেন। মনে মনে হয়তো বললেন, সমাজের বেশ্যারাও তো তোমার মতোই মানুষ হে ভিক্ষু শুভব্রত! ভিক্ষু উপালী বিরক্ত দৃষ্টিতে ভিক্ষু শুভব্রতর দিকে তাকালেন। এঁরা সব বৌদ্ধমঠের অধ্যক্ষ, দীক্ষাও নিয়েছেন ভগবান বুদ্ধের কাছে। প্রতিটি মুহূর্ত বুদ্ধের অহিংস মন্ত্র জপ করে। তথাপি এঁরা মানবিক হৃদয়ের অধিকারী হতে পারেননি। বুদ্ধের নীরবতায় হতাশ বোধ করেন ভিক্ষু শুভব্রত। তিনি কিছুতেই নটী আম্রপালীর ঘরে পা দেবেন না। নারীটি অপবিত্রা। বহুভোগ্যা। বুদ্ধ বললেন, আমরা আম্রপালীর ভবনে যাচ্ছি। তোমার ইচ্ছে হলে আমাদের সঙ্গে যেতে পার। তবে আমি তোমাকে জোর করব না। এই বলে বুদ্ধ হাঁটতে শুরু করেন। বুদ্ধকে অনুসরণ না করে মঠে ফিরে গেলে নানা প্রশ্ন উঠবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভিক্ষু শুভব্রত বুদ্ধের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলেন। সন্ন্যাসজীবন বড় পবিত্র। শুভব্রত মনে মনে ভাবলেন, আজ সন্ন্যাসজীবনের পবিত্রতা নষ্ট হতে চলেছে…
স্নান সেরে পদ্মপুকুরের মর্মর পাথরের ঘাটের ওপর চুল এলো করে বসে ছিল আম্রপালী। আম্রপালীর পালক মা বিধবা হরিবালা আম্রপালীর দীঘল চুলে জবাকুসুম তেল মাখিয়ে দিচ্ছিলেন। সে তেলের গন্ধ ঘাটে ছড়িয়েছে। আম্রপালী তপ্তকাঞ্চনবর্ণা। পানপাতার মতো মুখের গড়ন। যুগল ভ্রু। আয়ত চোখ। ৩২ বছরের লাবণ্যপূর্ণ কোমল শরীর। পদ্মপুকুরের জলে ধুয়ে পবিত্র হয় আম্রপালী। একটি ১৩-১৪ বছরের ফুটফুটে কিশোর ‘গৌতম বুদ্ধ এসেছেন’, ‘গৌতম বুদ্ধ এসেছেন’ বলে চিৎকার করতে করতে পুকুরঘাটে ছুটে এল। আম্রপালী বুকের আঁচল ঠিক করতে করতে ছেলেকে বলল, কী বলছিস তুই বিমল! তথাগত বুদ্ধ এসেছেন? হ্যাঁ, মা। কিশোর বিমল বলল। আম্রপালীর বুক কাঁপছে। বেশ কিছুকাল আগের কথা। বুদ্ধ সে সময় পাটলিপুত্রে ছিলেন। এক বার্তাবাহকের মাধ্যমে বুদ্ধকে নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছিল আম্রপালী- ‘কখনো বৈশালী নগরে এলে আমার আতিথ্য গ্রহণ করবেন।’ আজ কি তথাগত এলেন তাহলে? বেশ্যা বলে অবহেলা করলেন না! এবার বৃদ্ধা হরিবালা জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি কইছিস তো বিমল?
হ্যাঁ। ঠাকমা। আমি সত্যি কইছি। মিথ্যে কইতে যাব কেন? চল তো দেখি। বলে আম্রপালী অলিন্দে ছুটে এলো। দূর থেকে আমবাগানের পথে বুদ্ধকে ধ্যানস্থ ভঙ্গিতে আসতে দেখল আম্রপালী। বুদ্ধের সঙ্গে শিষ্যের দল। তথাগত সত্যিই এলেন তাহলে? আম্রপালীর বুকের ভিতরে কলকল করে ছুটল এক অদৃশ্য জলধারা। চোখে জল এসে গেল তার। হরিবালার রান্না শেষ। আম্রপালী নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করল। সন্ন্যাসীদের আহারের উপকরণ সামান্য। দুধমণি ধানের ধোঁয়া-ওঠা শুভ্র অন্ন আর ঘরে তৈরি টকদই। শিষ্যদের সঙ্গে বসে সামান্য নুন মিশিয়ে বুদ্ধ তা-ই তৃপ্তি ভরে খেয়ে উঠলেন। অথচ রাজপুরুষ এলে ১৪ পদ রেঁধে সাজিয়ে দিতে হয়। রান্না বিস্বাদ ঠেকলে কটু ভাষায় তিরস্কার করে। তীর ছুড়ে ময়ূর, হরিণ বা রাজহাঁস হত্যা করে। খাওয়া শেষে বুদ্ধ বললেন, এবার আমি উঠি মা। এখন মহামায়া বিহারে যেতে হবে। ওরা দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করে আছে।
আম্রপালী বলল, তথাগত! আপনার কাছে আমার কিছু নিবেদন ছিল। বুদ্ধ বললেন, বল মা। আম্রপালী বলল, এ আম্রকুঞ্জটি আমি আপনার বৌদ্ধসংঘকে দান করতে চাই। আপনি গ্রহণ করলে বাধিত হব। আর্যাবর্তের অন্য কোনো ধর্মনেতা হলে অচ্ছুত এক বেশ্যার আম্রকুঞ্জ গ্রহণ করতেন না। বুদ্ধ সে রকম নন। তিনি বললেন, বেশ। আমার সংঘের জন্য তোমার আম্রকুঞ্জটি গ্রহণ করলাম। আম্রকুঞ্জে একখানি বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা করলে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হব। বেশ। আর? আম্রপালী এবার বিমলকে ডাকল। বিমল এলো। বিমলকে দেখিয়ে আম্রপালী বলল, এর নাম বিমল। আমার একমাত্র সন্তান। একে আপনার সংঘে গ্রহণ করলে আমি শান্তি পাব। বুদ্ধ মনে মনে এই প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী নারীকে প্রণাম করলেন। তারপর বললেন, বিমল এখন বালকমাত্র। আগে ও বড় হোক মা। যথাসময়ে ওকে বৌদ্ধসংঘে গ্রহণ করব। আর কিছু বলবে?
আম্রপালী বলল, আমি… আমি আমার পেশা ত্যাগ করতে চাই। বেশ। আর? কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকে আম্রপালী। তারপর চোখ খুলে বলল, এবার আমাকে উপদেশ দিন তথাগত। আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। বুদ্ধ খানিকক্ষণ ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে রইলেন। সম্ভবত কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছেন। বুদ্ধ ছোট্ট শ্বাস টানলেন। তারপর বললেন, সর্বদা স্মৃতিমান, সজ্ঞান ও সচেতন থাকবে। জীবন ক্ষণভঙ্গুর এবং ততোধিক ক্ষণভঙ্গুর এই জীবনাধার এই দেহ- এ কথা মনে রেখে নিজেকে সর্বদা পর্যবেক্ষণ করবে। সুখ-দুঃখ জাত যেসব অনুভূতি মনে উৎপন্ন হয় সেগুলোর ওপর লক্ষ্য রেখ। হিংসা-অহংকার-লালসা জাত কুপ্রবৃত্তি মন থেকে দূর করে দেওয়ার জন্য সর্বদা স্মৃতিমান জাগ্রত থেক। বুদ্ধ প্রসন্নচিত্তে বলে যেতে থাকেন …।
দুই. মহাভারত যারা পড়েছেন তারা সবাই জানেন মহাভারতের শেষ পরিচ্ছেদে পঞ্চপাণ্ডবের সবাই স্বর্গের দিকে গমন করতে থাকেন। একে বলে ‘মহাপ্রস্থানের পথে’। ঠিক এ নামেই বিখ্যাত লেখক প্রবোধকুমার সান্যালের একটি ভ্রমণকাহিনি আছে। বইটি অসাধারণ একটি ভালো গ্রন্থ। পাঠক যদি মনে করেন বইটি পড়ে দেখতে পারেন। যা হোক, তো সেই মহাপ্রস্থানের পথে যখন সবাই যাত্রা করেছেন তখন যাত্রাপথে হঠাৎ দ্রৌপদী পড়ে গেলেন। ভীম প্রশ্ন করলেন, এই রাজপুত্রী কখনো অধর্ম আচরণ করেননি, ইনি কেন পড়ে গেলেন? যুধিষ্ঠির বললেন, আমাদের সবার থেকে অর্জুনের প্রতি তার বেশি ভালোবাসা ছিল, ইনি সেই দোষে পড়লেন। আর কিছুদূর অগ্রসর হতেই সহদেব পড়ে গেলেন। ভীম প্রশ্ন করলেন, সহদেব ভীষণ ভালো মানুষ ও সর্বদা আমাদের সেবায় তৎপর, সে কেন পড়ে গেল? যুধিষ্ঠির বললেন, সহদেব নিজেকে সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞ মনে করত, সেই অহংকারে ওর পতন হলো। তাকে ফেলে সবাই অগ্রসর হয়ে গেলেন, কিন্তু কিছুদূর গিয়ে নকুলের পতন হলো। ভীমের প্রশ্নে যুধিষ্ঠির বললেন, নকুল নিজেকে সর্বাপেক্ষা রূপবান মনে করত, সেই অহংকারে তার পতন হলো। আরও কিছুদূর অগ্রসর হলে অর্জুন পড়ে গেলেন। ভীম প্রশ্ন করলেন, অর্জুন পরিহাস ছলেও কখনো মিথ্যা বলেনি, তার কেন পতন হলো? যুধিষ্ঠির বললেন, অর্জুন বলেছিল, এক দিনেই এ পৃথিবী শেষ করে দিতে পারে, সেই অহংকারে তার পতন হলো। আরও একটু ওপরে উঠে ভীমের পতন হলো, পড়ে গিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, কী দোষে আমি পড়লাম ভ্রাতা যুধিষ্ঠির? যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি বড় বেশি ভোজন করতে এবং বাহুবলের গর্বে সবাইকে অবজ্ঞা করতে, তাই তোমার পতন হলো। তারপর যুধিষ্ঠির একাকী পর্বতের ওপরের দিকে উঠতে লাগলেন। চূড়ায় পৌঁছে যোগযুক্ত হয়ে প্রাণ বিসর্জন করতে উদ্যত হলে তার বিমান (আকাশযান) এসে তাকে স্বর্গে নিয়ে গেল।
উপরোক্ত দুটি কাহিনি থেকে স্পষ্ট, যারা জীবনে অনেক বড় ও মহান মানুষরূপে আবির্ভূত হন তারা নিরহংকার হন এবং দিন শেষে অহংকারীরই পতন ঘটে। এখন থেকে ২ হাজার ৬০০ বছর আগে গণিকা আম্রপালী ছিলেন শুধু বৈশালী নয় সমগ্র ভূ-ভারতের মধ্যে একজন নামকরা ‘নগরবধূ’। কোনো চরিত্রবান মানুষ সেই বেশ্যার বাড়িতে অন্নগ্রহণ তো দূরের কথা সেখানে যাওয়ার কথাও চিন্তা করতেন না। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ শুধু সেখানে গমনই করেননি, অন্নগ্রহণও করেছিলেন। অন্যদিকে দ্বিতীয় কাহিনিটিতে আমরা দেখি শুধু দ্রৌপদীর পতন হয়েছিল স্বজনপ্রীতির জন্য আর বাদবাকি সবার পতন হয়েছিল তাদের সীমাহীন অহংবোধের জন্য। তাদের সবার অন্য আরও অনেক গুণ থাকা সত্ত্বেও শুধু অহংকারের জন্য তাদের পতন হয়েছিল। তাদের মধ্যে একমাত্র যুধিষ্ঠির ছাড়া আর কেউ স্বর্গে যেতে পারেননি। কারণ যুধিষ্ঠিরের অহংকার তো ছিলই না বরং তিনি ছিলেন অপাপবিদ্ধ।
তিন. শুধু বৌদ্ধ কিংবা হিন্দু ধর্মেই নয়, ইসলাম ধর্মেও অহংকারকে ভীষণভাবে নিন্দনীয় ও গুরুতর পাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ‘অহংকার পতনের মূল’- এ কথাটি বহুল প্রচলিত। নৈতিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে এটি যেমন সত্য, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এ কথা প্রমাণিত যে অহংকার ও দাম্ভিকতা পতন ডেকে আনে। আত্ম-অহমিকা, দাম্ভিকতা ও অহংকার গর্হিত অপরাধ। অহংকারী মানুষকে আল্লাহ ভীষণ অপছন্দ করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) অহংকারীদের ভালোবাসেন না।’ সুরা নাহল আয়াত ২৩।
পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম অহংকারী ও দাম্ভিকতা প্রদর্শনকারী হলো শয়তান। অহংকার করে হজরত আদম (আ.)-কে সিজদা করতে আল্লাহর নির্দেশের অমান্য করেছিল এবং তার শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি ঘোষণা করেছিল। মহান আল্লাহর সঙ্গে কৃত সর্বপ্রথম গুনাহ হলো অহংকার। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম তোমরা আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলিশ ছাড়া সবাই সিজদা করল। শুধু শয়তান অহংকারবশত সিজদা করতে অস্বীকার করল। আর সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।’ সুরা বাকারা আয়াত ৩৪।
শুধু আল কোরআনই নয়, হাদিসেও মানুষের ভিতরের অহংকার নিয়ে বিশদভাবে বলা হয়েছে।
চার. প্রশ্ন হচ্ছে এ ধরনের একটি প্রবন্ধ কেন লিখতে প্রলুব্ধ হলাম? এর কারণ বোধকরি এটাই, চারদিকে এখন ‘মুই কী হনু রে’ লোকের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে মাঝেমধ্যে বেশ বিরক্তই লাগে। এসব দেখার পর একটি প্রশ্ন প্রায়ই মনে উদয় হয়, এরা কি আদৌ নিজেদের মুখ আয়নায় দেখে না? একজন মানুষের কী আছে আত্ম -অহংকার করার মতো? পৃথিবীতে কত বড় বড় মহান মানুষ যাঁরা নিরহংকার ছিলেন। সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন। অথবা কথাটি এভাবে বললেই বোধকরি ভালো শোনায়, অহংকার ছিল না বলেই হয়তো জীবনে এঁরা বড় হতে পেরেছিলেন, ইতিহাসে নাম লেখাতে পেরেছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলা যখন জেলে ছিলেন তখন তিনি তাঁর বহু বন্ধু-সুহৃদের কাপড় কেচে দিতেন। তাদের হাঁড়িকুড়ি থালাবাসন ধুয়ে দিতেন নিজ হাতে। তাতে তাঁর জাত যায়নি। অথচ তিনি ছিলেন একজন গোত্রপ্রধানের ছেলে ও ডাকসাইটে আইনজীবী। আবরাহাম লিঙ্কন ছিলেন আমেরিকার ১৬তম রাষ্ট্রপতি। যদি প্রয়োজন হতো তিনি মন্ত্রীদের ঘরে চলে যেতেন কোনো নথিপত্রে স্বাক্ষরের জন্য। অপেক্ষা করতেন না কখন সেই মন্ত্রী এসে কাগজে স্বাক্ষর করবেন। এভাবেই তাঁরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারকে তো আপনারা সবাই চেনেন। গ্রিস ও মেসিডোনিয়ার সম্রাট ছিলেন। আপনারা জেনে অবাক হবেন সেই দু-আড়াই হাজার বছর আগেও গ্রিসে রাজা কিংবা সম্রাটদের তেমন কোনো জেল্লা জৌলুস ছিল না। সাধারণ মানুষও তাদের দিকে যে কোনো সময় যে কোনো বিষয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারত। কেন তুমি এটা করলে? কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, দু-আড়াই হাজার বছর পরও আমরা আজ সেই প্রশ্ন করতে পারি না। যা হোক, পারসিয়া জয় করার পর আলেকজান্ডার বোধকরি ঈষৎ অহংকারী হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ করে পারসিয়ানরা যখন তাঁকে উঠতে বসতে জি হুজুর জি হুজুর করতেন তখন তাঁর ভিতর কিছুটা আত্মশ্লাঘা কাজ করত।
আলেকজন্ডারের বন্ধুবান্ধবরা রাগান্বিত হলেন যখন তাঁরা দেখলেন রাজদরবারে উপস্থিত পারসিকরা তাঁদের নিজস্ব আগের প্রথামত আলেকজান্ডারের পায়ের কাছে মুখ রেখে শুয়ে পড়ে তাঁকে সম্মান দেখান আর আলেকজান্ডার তা করতে তাদের অনুমতি দেন। অবশ্য এজন্য পারসিকদের দোষ দেওয়া যায় না। যুগ যুগ ধরে তাঁরা তাঁদের সম্রাটকে এমনি করে সম্মান দেখিয়ে এসেছেন। কিন্তু একদল মেসিডোনীয় শঙ্কিত হয়ে ভাবল এর পরিণতি কোথায়? তারা ভাবল আলেকজান্ডার প্রাচ্যদেশীয় রীতিনীতির দিকে ঝুঁকে গেছেন, হয়তো একদিন গ্রিকসহ সবাইকে তা করতে বাধ্য করবেন। আলেকজান্ডার তাঁর দুজন বন্ধুকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন, ক্লিটাস ছিলেন তাদের অন্যতম। একদিন নৈশভোজের সময় ক্লিটাস সাহস করে মুখ খুললেন। সেই ভোজে আলেকজান্ডার এবং আরও অনেক উচ্চপদস্থ ও সম্ভ্রান্ত গ্রিক-পারসিক উপস্থিত ছিলেন। সবাই গভীর রাত পর্যন্ত মদপান করছিলেন। ক্লিটাস জোরেশোরেই বললেন, ‘পারসিকরা যা খুশি করতে পারে। কিন্তু আমরা যখন গ্রিসে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যাব তখন কী হবে? তখনো কি আমাদের রাজা চাইবেন যে আমরা প্রাচ্যদেশীয় ক্রীতদাসের মতো তাঁর সামনে মাথা নত করে থাকব?’ আলেকজান্ডার তখন ছিলেন মদপানে বেসামাল। তিনি রাগে ঠোঁট কামড়ালেন। কিন্তু কোনো উত্তর দিলেন না। ক্লিটাস বলতে লাগলেন, ‘আমাদের রাজা কি আমাদের মতোই মানুষ নন? তিনি কি নিজকে দেবতা মনে করেন?’ এর পরবর্তী সময়গুলোয় তিনি আরও নমনীয় ও অহংকারহীন জীবন যাপন করেন। মহাত্মা গান্ধী রাজনীতিতে এক বিস্ময়। অথচ তাঁর এক তিল পরিমাণ অহংকারও ছিল না। তিনি ছিলেন বিলেতফেরত ব্যারিস্টার। অথচ পরিণত বয়সেও শৌচাগার নিজ হাতে পরিষ্কার করতেন। এজন্য তাঁর মধ্যে এতটুকু লজ্জা কিংবা সংকোচ ছিল না। যখন তিনি মাত্র ১২ বছরের কিশোর, তাঁর রাজকোটের বাড়িতে যে মহিলাটি তাঁদের শৌচাগার পরিষ্কার করত তার নাম ছিল উকা, গান্ধীর মা গান্ধীকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলতেন, গান্ধী যদি উকাকে স্পর্শ করে তবে তাঁকে সব রাত ঘরের বাইরে কাটাতে হবে এবং তাঁকে স্নান সেরে তবেই ঘরে প্রবেশ করতে হবে। উত্তরে কিশোর গান্ধী মাকে বলেছিলেন- রামায়ণে গুহাকা নামে এক চণ্ডালকে রাম যখন আলিঙ্গন করেছিলেন তাতে রামের জাত গিয়েছিল কি না। কিশোর গান্ধীর মুখে এসব কথা শুনে গান্ধীর মা পুতলিবাই আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকার সময়ও তাঁর নিজ ঘরের নোংরা পুরীষ তিনি নিজেই পরিষ্কার করতেন এবং ভার্যা কস্তুরবাকে উৎসাহ জোগাতেন এ কাজ করতে। কিন্তু তাঁর স্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করলে তিনি তাঁকে ভর্ৎসনা করতেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় ধাঙড়গিরি কিংবা ঝাড়ুদার হিসেবে গান্ধীর বেশ নামডাক। সেখানে তাঁর বন্ধুবান্ধবরা প্রায়ই তাঁকে দুষ্টুমি করে মেথর গান্ধী বলে ডাকতেন। সে দেশে প্রথমবার যখন তাঁকে গারদে পোরা হলো, তিনি স্বেচ্ছায় সেখানকার শৌচাগারের বর্জ্য পরিষ্কার করতে চাইলেন। এর পর থেকে জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে দিয়েই সব সময় জেলের মলমূত্র পরিষ্কার করাতেন। ভারতেও তিনি কংগ্রেস কিংবা অন্যান্য সভা-সমিতিতে স্থাপিত অস্থায়ী শৌচাগারগুলোর নোংরা বর্জ্য নিজে উদ্যোগী হয়ে পরিষ্কার করতেন। গৌতম বুদ্ধ ও তাঁর শিষ্যরা মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। একদিন এক গৃহস্বামী বুদ্ধকে উদ্দেশ করে বললেন, আচ্ছা তোমরা তো সবাই গাট্টাগোট্টা স্বাস্থ্যবান মানুষ। তোমরা ভিক্ষা করে খাও কেন! উত্তরে বুদ্ধ বলেছিলেন, আমরা ভিক্ষা এজন্য করি যেন আমাদের মধ্য থেকে অহংকার দূর হয়ে যায়। কারণ মানুষের মধ্যে অহংকারই হচ্ছে সবচেয়ে বড় রোগ। আর এ রোগ থেকে মুক্তি মানে হচ্ছে সব রোগ থেকে মুক্তি।
লেখক : গল্প, নিবন্ধ, প্রবন্ধকার ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।