দুর্দৈবকে পরিহার করতে পারেন না প্রতিভাশালী মনীষী ও মহাপুরুষারাও। এমন কি মৃত্যুর পরেও তাঁদের ভোগ করতে হয় দুর্দৈবজাত দুর্ভোগ। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী মশায় ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ‘রাম রতন ধন পায়ো’ নিবন্ধে কৌতুক করে রামায়ণের নায়ক রামচন্দ্রের দুর্ভোগের কথা বলেছেন। মৃত্যুর বহু বছর পরেও তাঁর রেহাই মেলে নি। রাম মন্দির-বাবরি মসজিদ মামলায় তাঁকে হাজিরা দিতে হয়েছে আদালতে। রবীন্দ্রনাথ একালের এক মনীষী। তিনিও দুর্দৈবকে পরিহার করতে পারেন নি। জীবদ্দশায় তাঁকে যেমন নানা দুর্ভোগ ভোগ করতে হয়েছে, মৃত্যুর পরেও তেমনি দুর্দৈব তাঁকে মুক্তি দেয় নি।
দুর্দৈবের প্রথম কারণ তাঁর দেহাকৃতি ও পোশাক পরিচ্ছদ। শালপ্রাংশু দীর্ঘদেহ তাঁর। তার উপর কাঁচা সোনার মতো গায়ের রঙ। তার উপর কুঞ্চিত কেশদাম। আয়ত চক্ষু। পরিণত বয়েসে শ্মশ্রুপরিবৃত মুখমণ্ডল। তার উপর জোব্বা আলখাল্লা। এই পোশাক কেন নির্বাচন করেছিলেন তিনি? সচেতনভাবে নির্বাচন করেছিলেন কি? এটা কি খাটো ধুতি গান্ধীব্রাণ্ডের মতো একান্তভাবে রবীন্দ্রব্র্যাণ্ড? শ্রীচৈতন্য দেবের মতো রূপবান রবীন্দ্রের রূপে আকৃষ্ট হয়েছেন বহু নারী-পুরুষ। মনে পড়ে অধ্যাপক শশিভূষণ দাশগুপ্তের কথা। প্রথম রবীন্দ্র-দর্শনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথেরই একটি কবিতা উদ্ধৃত করে বলেছিলেন : ‘রাজার দুলাল গেলা চলি মোর ঘরের সমুখপথে।’ এ রকম দেহাকৃতির, এ রকম পোশাক পরিহিত মানুষকে সাধু-সন্ত বলেই মনে হয়। আর্জেন্টিনার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর পোশাকনির্মাতার মতো সেই ভুল করেছিলেন আরও অনেকে। আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথকে ‘ঋষি’ বলে সম্বোধন করারও রেওয়াজ আছে। পাশ্চাত্যের অনেকে তাঁর মধ্যে যিশুখ্রিস্টের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছেন। সাধু-সন্ত সমালোচনার ঊর্ধ্বে। তাই রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা শুনলে অনেকে কানে আঙুল চেপে ধরেন। এ সব যে পাপ! অথচ বাস্তবে দেখা যাবে যাঁরা সমালোচনা শুনে কানে আঙুল চেপে ধরছেন, তাঁরা শৈশবের পাঠ্যগ্রন্থের রবীন্দ্ররচনা ছাড়া রবীন্দ্রের আর কোন লেখা পড়েন নি। এই আরোপিত দেবত্ব রবীন্দ্রনাথের দুর্ভোগের একটি কারণ।
দুর্দেবের দ্বিতীয় কারণ তাঁর ভক্তমণ্ডলী। এই ভক্তমণ্ডলীকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় : উত্তম, মধ্যম ও অধম। উত্তম ভক্তরা নিজেদের ভক্ত বলে জাহির করেন না। পোশাকে- আশাকে রবীন্দ্রনাথকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে তাঁরা ময়ূরপুচ্ছধারী কাক হতে চান না। তাঁরা রবীন্দ্রনাথের নানাবিধ লেখা পড়েন মনোযোগ দিয়ে, বোঝার চেষ্টা করেন, রবীন্দ্রনাথের কোন বক্তব্যের সঙ্গে সহমত না হলে প্রশ্ন করেন, সমালোচনা করেন, কারণহীন প্রশংসা বা নিন্দা থেকে বিরত থাকেন। দুঃখের বিষয় এই শ্রেণির ভক্ত নিতান্তই স্বল্প। মধ্যমশ্রেণির ভক্তরা চালাকির দ্বারা বাজিমাৎ করতে চান। এঁদের মধ্যে একটা সবজান্তা ভাব আছে। এঁদের ঘরের আলমারিতে শোভা পায় রবীন্দ্র রচনাবলি। গুটিকয় রবীন্দ্র রচনা পড়ে এঁরা রবীন্দ্রনাথকে বুঝে ফেলার বাহ্যাড়ম্বর করেন। আত্মীয়-বন্ধুর কাছে গর্ব করে বলেন যে রবীন্দ্রনাথ তাঁদের অস্থিমজ্জায় মিশে আছেন। সম্ভবত এঁদের সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু বক্রোক্তি করেছিলেন তাঁর ‘তিথিডোর’ উপন্যাসে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অজিতকুমার চক্রবর্তী, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ সপ্ত রবীন্দ্র ভক্তকে এই শ্রেণিতে ফেলা হলেও তাঁদের কিছু বিশিষ্টতা ছিল। রবীন্দ্র সমালোচকদের বিরুদ্ধতা করার দা্য়ভার এঁরা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেন। ১৩৩৪ সনে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘আমি এই কর্ম করে বহুকাল বহু লোকের বিরক্তিভাজন হয়েছি।’ রবীন্দ্রনাথের ৫০ বছর পূর্তির সময় রবীন্দ্রনাথকে মাঝখানে রেখে সাত ভক্ত চৌরঙ্গীর হপকিন্স কোম্পানিকে দিয়ে একটা ফটো তুলিয়েছিলেন। ফটোর তলায় লেখা ছিল ‘সপ্তাশ্ববাহিত সূর্য’ (‘বেদে’ কিন্তু সূর্যের রথের চালকদের বলা হয়েছে ‘অশ্বী’)। এই মধ্যম শ্রেণির ভক্তদের কথা বলতে গিয়ে নীরদচন্দ্র চৌধুরী তাঁর ‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ’ বইতে লিখেছেন, ‘ইঁহাদের মধ্যে রবীন্দ্র রচনা সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান ছিল কি না সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে, উহার বোধ বা উপলব্ধি ছিল কি না তাহা আরও বেশি সন্দেহস্থল। কিন্তু ইঁহাদের মধ্যে গোঁড়ামি পুরামাত্রায় ছিল। এইরূপ গোঁড়া সম্প্রদায়ীদের একটা আশ্রম বা মঠের প্রয়োজন হয়। রবীন্দ্র-সম্প্রদায়ীদের সেই আশ্রম ও মঠ ছিল বোলপুরে শান্তিনিকেতনে।’ নীরদচন্দ্র মনে করেন যে এইসব ভক্তদের দ্বারা রবীন্দ্রনাথের কোন উপকার হয় নি, ‘রবীন্দ্রনাথের উপর যে সব আক্রমণ হইত তাহার কোন উত্তর তাঁহারা দিয়াছেন বলিয়া আমি পড়ি নাই। বরঞ্চ এইসব গালিগালাজ শুনিলে ছোট শিশুরা যেমন কাঁদিয়া মায়ের কোলে যায়, তেমনই ইঁহারা রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়া উপস্থিত হইতেন।’এই মধ্যম শ্রেণির ভক্তরাই রবীন্দ্র পূজার সূত্রপাত করেছেন। অধম শ্রেণির ভক্তরা গরিব ও প্রান্তিক মানুষ। লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত বলে রবীন্দ্রনাথের লেখার সঙ্গে এঁদের কোন পরিচয় নেই। এঁরা শুধু জানেন যে রবীন্দ্রনাথ এক বিরাট মানুষ। তিনি সাধু, তিনি ঠাকুর।
তৃতীয় দুর্দৈব রবীন্দ্রনাথের রচনার সীমাহীন বিশালতা। মানব প্রজ্ঞার প্রায় সমস্ত দিকেই তাঁর পদচারণা। কবি দীনেশ দাস তাই লিখেছিলেন, ‘তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা / কোনখানে রাখব প্রণাম।’ এর ফলে নিজের প্রয়োজনে (আসলে নিজের স্বার্থে) রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন উক্তি ব্যবহার করা যায়। ডান-বাম সব পন্থী বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক নেতারা তা করে থাকেন। তাঁদের ব্যবহারে রবীন্দ্রনাথ কখনও প্রগতিশীল, কখনও প্রতিক্রিয়াশীল; কখনও অত্যাচারী জমিদার, কখনও প্রজাদরদী জমিদার ; কখনও নিছক ভাববাদী, কখনও বাস্তববাদী। সংসদে-বিধানসভায় রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি, মাঠে-ময়দানে রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি। রবীন্দ্র ভাবমূর্তিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা। এভাবে রাজনীতির কুটিল আবর্তে জড়িয়ে পড়েন রবীন্দ্রনাথ। আবার অন্ধ ভক্তি জন্ম দেয় সংস্কারের। রবীন্দ্র সংস্কার। আজ রবীন্দ্রসংস্কারের নাগপাশে জড়িয়ে পড়েছেন রবীন্দ্রনাথ। আর ‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলে থাকি।’
চতুর্থ দুর্দৈব নোবেল পুরস্কার। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারকে নীরদচন্দ্র চৌধুরী ‘বরে শাপ’ (শাপে বরের বিপরীত) বলেছেন। তার মানে আপাতভাবে এই পুরস্কার ‘বর’ হলেও আখেরে তা ‘শাপ’। এতবড় একটা পুরস্কার, তার উপর বিদেশের পুরস্কার, ফলে রবীন্দ্রনাথের সমালোচকরা মুহূর্তে ভোল বদলে (একালের ভাষায় দল-বদল) ফেললেন এবং রবীন্দ্র সংবর্ধনায় অংশ নিলেন। ১৯১৩ সালের ২৩ নভেম্বর বোলপুর স্টেশনে নেমে যে ৪০০ মানুষ ‘রবীন্দ্রনাথের জয়’, ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি দিতে দিতে শান্তিনিকেতনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রচুর ভোল বদলানো ভক্ত ছিলেন। তাঁরা শান্তিনিকেতনের দিকে যেন রাজনৈতিক মিছিল নিয়ে হাঁটছিলেন। ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, তাই তিনি বললেন, ‘আজ আমাকে সমস্ত দেশের নামে আপনারা যে সম্মান দিতে এখানে উপস্থিত হয়েছেন তা অসঙ্কোচে গ্রহন করি এমন সাধ্য আমার নেই।’ কেন নেই তার কারণ দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘দেশের লোকের হাত থেকে যে অপযশ ও অপমান আমার ভাগ্যে পৌঁচেছে তার পরিমাণ নিতান্ত অল্প হয় নি এবং এতকাল আমি তা নিঃশব্দে বহন করে এসেছি।’ নোবেল পুরস্কার লাভের পরে রবীন্দ্রনাথের বিরাটত্ব একটা সংস্কারে পরিণত হয়।
পঞ্চম দুর্দৈব পণ্যে (অর্থনীতির ভাষায় commodity) পরিণত হওয়া। মৃত্যুর পরে, বিশেষ করে ১৯৬১ সালে জন্মশতবর্ষের পরে রবীন্দ্রনাথের পণ্যে রূপান্তর ঘটল ধীরবিলম্বিতলয়ে। রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে গড়ে উঠল এক বিশাল বাণিজ্যের জগৎ। কপিরাইট উঠে যাওয়ার আগে ও পরে তাঁর বই বিক্রি করে বিশ্বভারতী কত টাকা আয় করেছে, তার হিসেব আমাদের হাতে নেই। কয়েক শো কোটি নিশ্চয়ই। কপিরাইট উঠে যাওয়ার পর বিশ্বভারতীর মৌরুসি পাট্টায় ভাগ বসিয়েছেন অন্য প্রকাশকরা। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা বই-এর সংখ্যাও কয়েক হাজার। রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে বই লিখে, রবীন্দ্রনাথ পড়িয়ে রোজগার করে চলেছেন শিক্ষক-অধ্যাপক-গবেষকরা। তাঁর গান নিয়েও গড়ে উঠেছে বিরাট ব্যবসার জগৎ। কত শিল্পী, কত কলাকুশলী, কত ক্যাসেটনির্মাতা যে করে খাচ্ছেন, তার ইয়ত্তা নেই। তাঁর ছবির প্রদর্শনী, তাঁর কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্রনির্মাণ, তাঁর কবিতার আবৃত্তি, তাঁর নাটকের অভিনয়—এসবও রবীন্দ্র-ব্যবসার অঙ্গ। পর্যটনশিল্পকেও সমৃদ্ধ করে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ। পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ তাঁকে নিয়ে নানা অনুষ্ঠান হয় — এসবের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বহু মানুষের জীবন-জীবিকার প্রশ্ন।