বিখ্যাত সিন্ধুসভ্যতা বিশেষজ্ঞ ফিনল্যান্ডের আস্কো পারপোলার মতে মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় লিপি ও টেক্সটে উল্লিখিত মেলুহা আসলে সিন্ধুসভ্যতার ভূখণ্ড। এটি দ্রাবিড় মেল থেকে এসেছে বলে তাঁর বিশ্বাস। দ্রাবিড়ভাষায় মেল-এর অর্থ উচ্চভূমি, আকম-এর অর্থ অঞ্চল। যে জায়গা উঁচুতে অবস্থিত, তাই নাকি মেলআকম তথা মেলুহা।
যদিও আমার মতে প্রোটোদ্রাবিড়ীয় ‘মেল্ল’ থেকে এসেছিল মেলুহা নামটি। মেল্ল শব্দের অর্থ প্রাচুর্য, বহুলতা বা উদ্বৃত্ততা। সিন্ধুসভ্যতার ভূমির উর্বরতা ও শস্যের প্রাচুর্যের ফলে শস্য উদ্বৃত্ত হত, ফলে সেখানে গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েকটি শস্যভাণ্ডার। তাই মেলুহা নামটির উৎপত্তি হয়। সুমেরীয় ভাষায় মেলুহা মানে শস্যভাণ্ডার।
“উর’ বা ‘উরু’ শব্দটি তামিলে “স্থান” বোঝাতে ব্যবহৃত হয় এবং এটি তামিলে উপসর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয় “গ্রাম, শহর, জনপদ” বোঝাতে।
যেমন: কারুর, মেলুর, কালাম্বুর ইত্যাদি,- এগুলি সবই বর্তমান তামিলনাড়ুর শহরের নাম।
অন্য দ্রাবিড় ভাষা কন্নড়েও এর প্রচলন আছে স্থাননামে। যেমন কর্ণাটকের বেঙ্গালুরু, মাইসুরু,ম্যাঙ্গালুরু ইত্যাদি।
একইভাবে “উর” শব্দটি মেসোপটেমিয়ার সুমেরিয়ান অঞ্চলেও শহরের নামে দেখা যায়। সুমেরিয়ার অন্যতম বড় শহর ছিল “উর”। অনেকের মতে এটিই পৃথিবীর প্রথম নগর।
মেসোপটেমিয়ানরা নিজেদের “আং সাং সিগা” নামে পরিচয় দিত, সুমেরিয়ান ভাষায় তার অর্থ “কালো চুলবিশিষ্ট মানুষ”। এটি তামিলে “আঞ্জন সিগাই” অর্থাৎ “কালো মাথা/চুল”-এর সঙ্গে মিলে যায়।
“ইউফ্রেটিস” নদী সুমেরিয়া দিয়ে প্রবাহিত হয়, এটি সুমেরিয়ান ভাষায় ছিল “ফ্রাত”, ব্যাবিলোনীয় ভাষায় “পাহু রথ” এবং হিব্রু ভাষায় “পুগু রাথ”।
“ফ্রাত” হলো “পাহু” ও “রথ” শব্দের মিশ্রণ। ফ্রাত মানে, “যেটা ভাগ করা হয়”। নদীটি এমন নামেই পরিচিত ছিল কারণ এর জল অনেক শহর-রাষ্ট্রের মধ্যে ভাগ করা হতো। এই “পাহু”, “রথ”, শব্দ দুটি তামিল সঙ্গম সাহিত্যেও “পাহুরলি” নামে ব্যবহৃত হয়েছে। “পাহু” শব্দটি, যার মানে ভাগ করা, সুমেরিয়ান ও তামিল উভয় ভাষায় একই রকম।
শিলপাদকারম-এ বলা হয়েছে,, “মা কীর্তি” নামক এক রাজা “পাহুরলি” নদীর তীরে প্রথম তামিল সঙ্গম গঠন করেছিলেন। এই “মা কীর্তি”-ই সুমেরিয়ার “এনকি” দেবতার সমতুল্য।
সুমেরিয়ার বড় শহরগুলোর একটি ছিল এরিডু,-যেটি দেবতা মারদুক তৈরি করেছিলেন। “এর” শব্দটি সুমেরিয়ান ভাষায় “মার” হিসেবেও উচ্চারিত হতে পারে এবং “এরিডু” হয়ে যায় “মারদু”—যা পরে রূপান্তরিত হয়ে “মাদুরাই” হয়েছে। তাই প্রচলিত একটি মতে, তামিলরা যখন দুই দেশের দুটি শহরে বসতি স্থাপন করেছিল, উভয়ক্ষেত্রে তারা মাদুরাইয়ে ঘাঁটি গেড়েছিল।
সুমেরিয়ান ফলকে বলা হয়েছে “মারদু” ছিল একটি শহর যেখানে “মিষ্টি মানুষ” বসবাস করত। ঠিক যেমন “মাদুরাই” শব্দের সাথেও মাধুর্যের ধারণা জড়িয়ে আছে।
দ্বিতীয় তামিল সঙ্গম কাপাদুপুরমে হয়েছিল। সুমেরিয়ার ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদী দুটি Y আকৃতিতে প্রবাহিত হয়, যেটি তামিলে “কাভাডু” বলা হয়। গ্রীকরাও সুমেরিয়াকে “দুই নদীর মাঝখানের দেশ” বলত, যা এই “কাভাডু” বা Y আকৃতিকে চিত্ররূপে প্রকাশ করে। দ্বিতীয় সঙ্গম এই নদীর উপকূলে, সম্ভবত যেখানে দুই নদী মিলিত হয়, সেখানে গঠিত হয়েছিল।
সুমেরিয়ার(মেসোপটেমিয়ার) প্রধান কর্মকাণ্ড ছিল বাণিজ্য এবং তারা মেলুহা ও দিলমুন-এর সাথে বাণিজ্য করত। এখানে “মেলুহা” হলো সিন্ধু সভ্যতা (IVC), আর একটি মতে “দিলমুন” বর্তমান দক্ষিণ ভারত(মতান্তরে বাহারিন)।
তবে আমার মতে গুজরাটের লোথাল বন্দর থেকে আরব সাগর হয়ে পারস্য উপসাগরের তীরে দিলমুন তথা আজকের বাহারিন যাওয়া যতটা সোজা ও বাস্তবসম্মত, গুজরাট থেকে ভারতের পশ্চিম উপকূল ধরে দক্ষিণভারতে এসে সেখান থেকে আবার পারস্য উপসাগর ধরে মেসোপটেমিয়া যাওয়া ছিল ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। যদিও এর সপক্ষেও যুক্তি থাকতে পারে। তাই উচ্চাকাঙ্ক্ষী গবেষকরা যতই দাবি করুন যে দিলমুন দক্ষিণ ভারত, তার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
মাগান নামক দেশের সঙ্গেও মেসোপটেমিয়ার বাণিজ্য-সম্পর্ক ছিল। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ মাগানকে বর্তমান ওমান ভাবলেও একটি মতে এটি ইরানের দক্ষিণ উপকূলের মাকরান বা মাক্কান। দ্রাবিড়ভাষায় মগান শব্দের অর্থ পুরুষ। পুরুষশাসিত অঞ্চল হওয়ায় অঞ্চলটির নাম হয় মাগান। তাই মাগান শব্দটি দ্রাবিড়ীয় ব্যুৎপত্তি দাবি করে। বাস্তবিকই ইরান(পূর্বের পারস্য) দেশটির মানচিত্রে মাগান নামক গ্রাম এখনও বর্তমান।