পিরানদেলো, চেখভ, ওয়েসকর, বেট, কেসেলরিং; প্রধানত এঁদের নিয়েই নান্দীকার গোষ্ঠী এতকাল, প্রায় দশ বছর ব্যস্ত ছিলেন। বাংলা নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠা সমিতির এবারকার উৎসবে (স্থান : কলা মন্দির) তারা একটি মৌলিক বাংলা নাটক উপহার দিলেন। নটী বিনোদিনী (রচনা : চিত্তরঞ্জন ঘোষ)। প্রসঙ্গত, সমিতির পাঁচদিনব্যাপী উৎসবের (৪-৮ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠানসূচীতে যে-দুখানি মৌলিক বাংলা নাটক স্থান পেয়েছে, নটী বিনোদিনী তার অন্যতম।
নান্দীকারের পূর্ববর্তী যাবতীয় নাট্য প্রয়াস থেকে নটী বিনোদিনী স্বাদে এবং ভাবরসে স্বতন্ত্র। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা নাট্যজগতের পটভূমিতে বিস্তৃত, এ নাটক এক অসামান্য অভিনেত্রীর জীবন-কাহিনি—যা সময় আর ঘটনার সীমাকে ছাড়িয়ে যায়। বিষয়ে যেমন, তেমনই আঙ্গিক-কল্পনা এবং তার রূপায়ণেও এই নাট্য প্রয়াস বিশিষ্ট।
বলেছি, অভিনেত্রীর জীবন-কাহিনি। অভিনেত্রী বিনোদিনীর; কিন্তু এ কাহিনী তার জীবনের কতকগুলি ঘটনার সমষ্টি মাত্র নয়। এ নাটকের মূলে একটি প্রশ্ন: থিয়েটারকে যিনি প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন থিয়েটারের জন্য বারে বারে যিনি নিজেকে বঞ্চিত বলেছেন, ভোগ করেছেন অশেষ যন্ত্রণা খ্যাতির শিখরে অধিষ্ঠিত অবস্থায় সেই বিনোদিনী মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে নাট্যজগৎ থেকে কেন স্বেচ্ছায় বিদায় নিলেন? কোনো দুঃখবোধ অথবা আশাভঙ্গ কি তার হেতু? না কি থিয়েটারের চেয়েও বড়ো কোনও ভালোবাসার সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন, তাই স্বেচ্ছা-নির্বাসন? এই প্রশ্নের সূত্রে নাটকটি সাজানো হয়েছে। এবং ওই সূত্রেই বিশেষ সময়ের তার জীবনের প্রাসঙ্গিক ঘটনাগুলি উপস্থাপিত। সেই সব ঘটনার আলোয় বিনোদিনীকে এ কালের দর্শকরা নতুন করে চিনবেন—যিনি সারা জীবন ভালোবাসার একটি আশ্রয় খুঁজেছেন; উত্তীর্ণ হতে চেয়েছেন তার সামাজিক পরিবেশের গ্লানি থেকে, গণিকা-জীবনের অভিশাপ থেকে। থিয়েটার তার একটি মুক্তিক্ষেত্র। সেই থিয়েটারের স্বার্থে যে মূল্য তাকে দিতে হয়েছে (প্রণয়ীর সঙ্গে মিথ্যাচার, সম্পর্কচ্ছেদ; আত্মবিক্রয়), তার জন্য নিজেকে তিনি বোধ হয় ক্ষমা করতে পারেন নি। থিয়েটারের জন্য যারা তাকে ব্যবহার করলেন তাঁদেরও না। বিতৃষ্ণার যথেষ্ট কারণ সত্ত্বেও ওই রঙ্গমঞ্চের অভিনেত্রী-জীবনের পরিসরেই তাকে হয়ত আরও অনেক কাল সান্ত্বনা খুঁজতে হত, যদি না তিনি চৈতন্যলীলা অভিনয়ের পর দর্শন এবং আশীর্বাদ পেতেন রামকৃষ্ণদেবের এবং যদি না সংস্পর্শে আসতেন এক পুরুষের। গিরিশবাবুর সংলাপে যে বড়ো ভালবাসার কথা বলা হয়েছে, ওই পুরুষ সেই প্রেমের ডাক দিয়ে থাকবেন। আর ভিতরে ভিতরে একটি ভক্তিনম্র মনও কি কাজ করেনি, যে মন রামকৃষ্ণদেবেব আশীর্বাচন শোনবার পর কোনো একটা বড় ঠিকানায় পৌঁছে যাবার কথা ভাবত?
বর্তমানের অনুসন্ধিৎসা (যার প্রতীক সূত্রধার) মঞ্চে অতীতকে ডেকে এনেছে। অতীতের মুখপাত্র হয়েছেন গিরিশচন্দ্র। সূত্রধারের সঙ্গে গিরিশচন্দ্রের আলোচনার সূত্রে বিনোদিনীর জীবনের খন্ড খন্ড অংশ (প্রধানত অভিনেত্রীর আত্মজীবনী থেকে গৃহীত) দর্শকদের সামনে উপস্থিত করা হয়েছে। নাটকের মূল প্রশ্নের বিচারের ভার যেন তাঁদের উপর। মঞ্চের পিছন দিকে অর্ধবৃত্তাকার নাটকের কুশিলবদের বসানো হয়েছে। মঞ্চের সেই অংশ প্রায়ান্ধকার। নাট্যবর্ণিত ঘটনার প্রয়োজন অনুযায়ী তারা মঞ্চের সম্মুখীন ভাগে আলোকিত স্থলে উপস্থিত হয়েছেন, নির্মাণ করেছেন অতীতের পরম্পরা। এই ব্রেখটীয় আঙ্গিক যে অংশত যাত্রাভিনয়েরও স্মারক। এক্ষেত্রে লক্ষণীয়ভাবে ফলপ্রদ। মঞ্চসজ্জার কোনো ব্যাপার এখানে নেই, একটি চেয়ার সর্বদা মঞ্চ উপকরণও না। নির্দেশক শ্রীঅজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় একের পর এক দৃশ্যের অবতারণা করেছেন (সাহায্য নিয়েছেন। আলোক-সম্পাতের এবং প্রয়োজনমতো যন্ত্র সঙ্গীতে রাগাশ্রয়ী ঐকতানের), নাটকে এনেছেন বাঞ্ছিত গতিবেগ। তারই মধ্যে গড়ে উঠেছে সংঘাত, কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত। বিভিন্ন দৃশ্যের যোগ স্থাপনের অনায়াস ভঙ্গীটি সুন্দর। কিছুকিছু কমপোজিশনে পরিচালকের কল্পনাশক্তির পরিচয় পাই। অতীত ঘটনার মধ্যে বর্তমানের প্রক্ষেপের মুহূর্তে ফ্রিজ-এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। প্রেতাত্মার আগমনের দৃশ্যে একটি মৃত প্রেম যেন সহসা ক্ষণজীবন লাভ করেছে। দৃশ্যটি সুপরিকল্পিত—যেন কাব্যময়।
নাটকের সংলাপ সাধারণভাবে সুরচিত; বিনোদিনীর অংশ চমৎকার। গিরিশচন্দ্রের কথাবার্তায় অবশা মানুষটিকে ঠিক পাওয়া যায় না। সেখানে বিশেষ একটি আমেজ আনা যেতে পারত। সুরকারের প্রাথমিক ভাষণ আরও সংক্ষিপ্ত করা যায় না কি?
নাম-ভূমিকায় মঞ্জু ভট্টাচার্যর অপূর্ব অভিনয় এই নাট্যের প্রাণস্বরূপ। কামনায়, বেদনায়, বিবেকের তাড়নায়, ঘৃণায়, শূণ্যতাবোধে, উত্তরণের অভীপ্সায় তিনি এই চরিত্রের সঙ্গে আদ্যন্ত একাত্ম। তার স্বরক্ষেপ এবং উচ্চারণও যথোচিত। সেকালের নাট্যসাম্রাজ্ঞী’র একটি বিশ্বাস্য মূর্তি তিনি নির্মাণ করেছেন। এই চরিত্রের পাশে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুর্মুখ রায় আর রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের ‘অ-বাবু ছাড়া অন্য সকলেই যেন নিষ্প্রভ। অরুণ চট্টোপাধ্যায়ের গিরিশচন্দ্র ব্যক্তিত্বহীন। হিমাংশু চট্টোপাধ্যায়ের মতিকা বসু যথাযথ। দলগত অভিনয় বস্তুত দুর্বল, তবুও কী আশ্চর্য! ঠিক সময়ে চোখের পাতা ঠিকই ভিজল – আবেগ একাই বুঝি ধরে রাখলেন বিনোদিনী।
কী নাটক, কী তার অভিনব উপস্থাপন, দৃশ্যসজ্জা, আলোকসঙ্গীত—সব মিলিয়ে নটী বিনোদিনী বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের চলার পথে নতুন একটি মাইলফলক।
ঋণ স্বীকার : মধুময় পাল সম্পাদিত আগুনের খেয়া এবং মহালয়া চ্যাটার্জী
অভিনয় এবং লেখালেখি ছাড়াও কেয়া চক্রবর্তী ১৯৬৪ সালে দমদম ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে ইংরাজী শিক্ষিকা ছিলেন এবং ১৯৬৫ -১৯৭৪ সাল অবধি স্কটিশ চার্চ কলেজে ইংরাজী বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন।