এ চিঠির উত্তরের অপেক্ষায় দিন কাটে সেই ‘মেঘ’ বালিকার। সে কি বালিকা নাকি কোন বয়সহীন অজ্ঞাত পরিচয়হীন মহিলা, তবে এ চিঠি তার মনের দলিলদস্তা। হয়ত সে নিজেও জানে এ চিঠির জবাব আসবে না, আবার এমনও হতে পারে এ চিঠি তার সঠিক ঠিকানায় পৌঁছাবে না। তবু সে লিখে যায় রোজ কত কথা।
এ চিঠি হতে পারে নিষিদ্ধতায় মোড়া কোন নষ্ট মেয়ের, যে বহু পুরুষ সঙ্গের মাঝেও কখনো খুঁজে পেয়েছে তার স্বপ্নের পুরুষকে। শরীরের পরেও যে মনের জগৎ আছে, সেই ‘রোদ্দুর’ নামের মানুষটি তাকে বুঝিয়েছে। এ চিঠি জানান দেয় ওরা সমাজের চোখে নিষিদ্ধতার তকমা ধারি।
এ চিঠি হতে পারে… কোন ব্যর্থ প্রেমের আখ্যান। সমাজ যাদের জুড়ে দেয় নি এ জন্মে, তবু তারা গোপনে মিশে আছে একে অপরের সাথে। ভালবাসার স্বীকৃতি জোটে নি এ দু-জনের কপালে, তাই তো এমন আকুল আর্তি পরজন্ম ঘিরে।
এ চিঠি হতে পারে কোন পরকীয়া ভালবাসার উপখ্যান। সে ভালবাসাও তো সমাজের কাছে অবৈধ, গর্হিত। তবু ওরা কেমন যেন মিলে যায় অলীক বন্ধনে। ‘মেঘ’-এর মনের ব্যাকুলতা প্রতি ছত্রে তার অপ্রাপ্তিকেই বুঝিয়ে দেয়।
প্রিয় মেঘ,
ভালোবাসা মানে একা থাকা… ভালোবাসা মানে অপেক্ষা করা… তারপর একদিন আয়নার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া… মনের সব প্রশ্নের উত্তর মিলে যাওয়া… এক ঝলক স্বপ্ন। মনের মাঝে বয়ে চলা সব ভার এক পলকে আকাশে উড়ে গিয়েছিল এক রাতের অবিশ্বাস্য আলাপে… নিজের মন সত্ত্বার প্রতিরূপ খুঁজে পেয়ে বিকশিত হয়েছিল হাসি…
তারপর থেকে আজও আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য… সময়ের জন্য…।
সেদিন আমি তোমায় ভালোবাসবো চোখে চোখ রেখে… ভালোবাসবো তোমায় আমার আঙুলের স্পর্শে… সব দুর্নিবার দূরত্বের কষ্ট আমি উড়িয়ে দেবো বুকে চেপে ধরে… তোমার অভিমানের জল আমি ঠোঁটে ছুয়ে মুছে দেব… তোমায় ভালোবাসবো আমি সঙ্গীতের মূর্ছনায়… ভালোবাসা জড়িয়ে দেবো তোমার পরতে পরতে…। বলতে পারি, অদেখা ভবিষ্যৎ শুধু তুমি।
তুমি ভালো থেকো…
— তোমার রোদ্দুর
‘রোদ্দুর’-এর চিঠি কি পড়লো তার ‘মেঘ’? সে প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারোর। শুধু কষ্ট জমেছে বিষাদ ভরা চারপাশে। তার মাঝেও অভিমান ভোলানোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে অনেক খানি। কিন্তু তারা মিলতে কি পারে কখনো কোথাও?
প্রিয় রোদ্দুর,
শীতের সন্ধ্যা আমার কাছে বিষাদ ভরা, কারণহীন এক তীব্র মন খারাপ ঘোরাফেরা করে আসেপাশে। তবু সে বিষাদ কাহিনি মনের মাঝেই থাকে, বুঝতে দিতে মন চায় না। আমার বিষাদ, আমার উচ্ছ্বাস সবই একরকম। হাসির আড়ালে গোপন করার অভ্যাস বহুবছরের।
কিন্তু তেমনই এক শীতের সন্ধ্যা কখন যেন খুব বিশেষ দিনের একটা হয়ে গেল। তোমার সাথে দেখা হবে… এই কথা ভেবে আমার তার আগের কয়েকটা দিন হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছিলো। তারপর দিনটা যখন এলো, সেদিন আর কোন উদ্বেগ ছিল না। সন্ধ্যার শহরের ছুটির আমেজ নিয়ে মুখোমুখি হলাম তোমার। কিন্তু আমি পরিপার্শ্বের কাছে কেমন দিশাহারা হয়ে পড়ছিলাম। তাই একটু এলোমেলো হয়েছি সেদিন। তুমি তো বললে, সেদিন দুচোখ ভরে আমাকে দেখেছো, আমি কিন্তু সেটা পারি নি। যখনই তাকাতে গেছি, কেমন কিশোরী বেলার প্রেমের মত লাজুক হয়ে পড়েছিলাম। তাই নিজের চোখ সরিয়ে নিয়েছি তোমার থেকে…
অন্যদিকে, এটাও জানি যে, উল্টো দিকের আড়চোখের চাহনি আমাকে বিদ্ধ করছে। ঠিক তখনি কেমন একটা দ্বিধা মনে জায়গা করছিলো… এতদিন তো গল্পগাঁথা সবটা দূরে থেকে, এই কাছাকাছি দেখা-টা কেমন ভাবে নেবে তুমি? নারী সত্তা আমাকে লাজুক করছিলো, আবার প্রেমিকা হিসেবে মন টানছিলো তোমাকে একটু জানতে, বুঝতে। কিন্তু যখনই তোমার দিকে ফিরে দেখেছি… আমি তোমার চোখের চাহনি আর হাসিতে আটকে গেছি। কেমন উদ্ভ্রান্ত হচ্ছিলাম নিজের স্থিরতা থেকে। পালিয়ে গিয়ে অন্যত্র ঠাঁই নিলাম তাই। কিন্তু মনকে কি আর টেনে ওঠানো যায় ওখান থেকে? সে তো পড়ে আছে তার হলুদ রোদ্দুরের কাছে। আমিও তাই মেঘ হয়ে প্রবল প্রেমে ডুবতে চাইছিলাম।
তুমি বললে কেমন দেখলাম… আমি বলব, আমার দেখার ভাবার কিছুর নেই। তোমার মুখোমুখি হয়ে আমি সেদিন চিন্তা ভাবনার ক্ষমতা হারিয়েছিলাম। শুধু ঐ মুহূর্তে থেকে যেতে মন চাইছিলো, তোমার সামনে বসে হাতে হাত রেখে অগুনতি সুন্দর মুহূর্ত কাটাতে মন চাইছিলো।
আমার এখন একটাই অনুভূতি হয়… এ যোগাযোগ যেন থেকে যায় চিরকাল। এমন করে আমরা দুজন জুড়ে যাবো, সে তো কখনো ভাবি নি। তাই ওই ঈশ্বর নামী কোনো সর্বশক্তিও চায় মেঘ আর রোদ্দুরের কাহিনি চলুক অসীম পথ। তোমার হাত ধরে গোপনে আরও অনেক সুন্দর মুহূর্ত কাটাতে চাই।
আর একটা দিন… শুধু কিছুটা সময়, আমাকে উপহার দিও। তুমি আর আমি… একজীবনের যা যা অসম্পূর্ণ আছে, সেই মুহূর্ত কাটাতে চাই। যদি আমাকে তোমার কল্পনার মেঘের সাথে মিলিয়ে নিতে পারো… তবে একটা দিন এমন করে সাজিয়ে দিও।
অফুরান ভালোবাসা। একটু দেরি হলো চিঠি লিখতে। চিঠির জবাব আসবে না জেনেও আশায় থাকা…
—তোমার মেঘ
তাহলে কি মেঘ-রোদ্দুরের দেখা হয় এমন গোপন অভিসারের মত? তারা তবু মিলনের আর্তিতে ব্যাকুল থাকে প্রবলতর। তবু কোথাও মেলে না তাদের পথ। তাই থেকে যায় অনেক অসম্পূর্ণ স্বপ্নের গল্পগাঁথা?
প্রিয় মেঘ,
লিখব লিখব করে বড় দেরী হয়ে গেলো, রাগ রেখো না মনে, কষ্টের মন সুস্বাদকে নিমতিক্ততায় গড়ায়, তাই তোমার দুই কাজল চোখ স্মরণে রেখেই আজ লিখি। কবিতার ভাষা আসে না বলেই, চিঠিতে সমর্পণ করছি সব। এ হলো সেই ‘সব’ যা কিনা তুমি সমর্পণ করেছো আমাতে। এই ‘সব’ শব্দটি এতটাই অর্থবহ, যা কিনা ঘা দিয়ে প্রস্তরীভূত শবদেহকেও জাগাতে সমর্থ, যা কিনা জাগিয়েছে অনন্তকাল ধরে মানুষের মনে।
এসব কবিতার কথা হতে পারতো, অথচ তা কিনা কবিতা নয়… যে ইঙ্গিতে তীক্ষ্ণশীর্ষ নক্ষত্র ঝরে, যুবতী কথা বলে তার যুবকের সাথে, তীব্র আকুলতা শিরশির শিরশির করে বায় সারা দেহব্যাপী। তোমার আলোকিত নেত্র অন্ধকারেও জ্বলে। এই ইঙ্গিতে কবিতার জন্ম হতেই পারতো কিন্তু এটি কবিতা তো নয়। নির্মোহ গদ্যশরীর এখানে প্রধানতম বিষয়।
সমস্ত কর্মপ্রবাহরুদ্ধকারী চূড়ান্ত গভীর শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে জানি রাত্রি জেগে থাকে তোমার অমোঘ শীৎকারে, চূর্ণ তমসানিশা ঘন হয়ে জড়ায় অজগরে, আমি মোহগ্রস্থ আগেও ছিলাম, এখনো তাই।
এই মোহময়তার বিলীনপ্রায় রূপ সময়ের নির্বাপিত শিখায় নিভুনিভু হলেও, এই কাশবন পর্যায়ে চলে এসে, তোমার দেহ কল্পনায় পরম রমণীয় আজও।
তোমার রোমাঞ্চকর বক্ষবিভাজিকায় অদৃষ্টপূর্ব নিম্নমুখী নদী উপত্যকায়, সেইসব মেঘসঞ্চার ছুঁয়ে থাকে গভীর আস্বাদে।
বাজারের উদাত্ত খোলা হাওয়ায় দন্ডায়মান থাকি, মাথার উপর হাত বোলায় দেবদারু পত্রগুচ্ছ, ঝিরঝির শব্দ ওঠে বিশ্বচরাচরে। মাছের কানকোর রক্তিম আভাসে তোমার চেতনার রক্তাভ বিন্দুপল।
প্রবাহিত নদীর তরঙ্গ যেমনি, বছরগুলি পার হয়েছে সেই অনাদিঅতীত থেকেই, তুমুল এক ঝড়ের মতোই উপবিষ্ট, লক্ষ্য করি শীর্ণপাতা উৎক্ষিপ্ত হয় চারদিকে। তোমার শায়িত শরীরের উপর চক্রাকারে ঘোরে পাখা, তোমার খোলা চোখের পানকৌড়ি আমাকে জাগায়, লালাসিক্ত রক্তিম ওষ্ঠ আমাকে জাগায়, তোমার শানিত চিবুক আমি অনুভব করি আমার করতলে, উদাসী নাভিছিদ্র এক অপরূপ প্লেটটেকটনিক তত্ত্বকে হাতিয়ার করে, এক ঘুমন্ত আগ্নেয়পর্বতকে জাগিয়ে তোলে।
এই জাগ্রত তন্ময়তায়, রাত্রির গতি শ্লথ হয়ে আসে, তোমাকে লক্ষ্য করার আগেই পাটভাঙ্গা তমসার তরঙ্গকৌশল হঠাৎ আকাশে উত্থিত হয়ে, প্রজাপতির ডানায় ভেঙে গিয়ে, লুকিয়ে থাকে বুকের অগোচরে।
এইভাবেই, মেঘ, তুমি থেকে যাও আমার মধ্যে, সর্বদাই।
এটুকুই থাক।
—রোদ্দুর
তাহলে মেঘ-রোদ্দুরের খেলা এমন করেই চলতে থাকে জীবন ব্যাপী। ওরা দুজন মিলতে নাও পারে… কিন্তু কি ভীষণ তীব্রতায় দুজন দুজনের প্রতি বিলীন।
চলুক এই গোপন কথার আদান প্রদান জীবন ব্যাপী। থাকুক না হয় এটুকু জায়গা ওদের জন্য একটুখানি। নিষিদ্ধ, অবৈধ, পাপ… সে সব দেবে সমাজ গায়ে কালি মাখিয়ে। তবু কিছু কথা থেকে যাক্ এমন গোপনে।
সব সম্পর্ক একসরলরেখায় না মেলাই ভালো। রেলাইনের মতো সমান্তরাল ভাবেই চলুক একে অপরের পরিপূরক হয়ে।♥️