কত হয়েছে তোমার?
ছেলেটি বিল দেখাল।
তিনি একবার চোখ বুলিয়ে টাকা দিয়ে দিলেন। সামান্য রিফান্ড ছিল। সেটুকু আর নিলেন না। খাবারের দুটি কনটেইনার নিলেন দরজার কাছে হাত বাড়িয়ে। ছেলেটি বলল, আসি।
তিনিও বললেন, এসো।
ছেলেটি ঘুরে যাচ্ছিল। তিনি বললেন, এসো মানে ভেতরে এসো।
রোগাটে ছেলেটি তাকাল। তিনি বললেন, তোমার সঙ্গে অল্প কথা আছে আমার।
বেশ অবাক ছেলেটি। এমন কখনও হয় না। মানে হওয়ার কথা নয়। তার সমস্ত কাজই দরজায় দাঁড়িয়ে। সব-ই মিনিট কয়েকের ব্যাপার। সে বলল, আমি ব্যস্ত ম্যাডাম। পরের অর্ডারের পিক-আপ আছে। আপনি বলুন না!
তিনি বললেন, না, ভেতরে একটু আসতে হবে যে।
গলার স্বরে দৃঢ়তা ছিল এমন নয়। আবার অনুরোধও নয়। কোথাও একটা জোর, হয়ত সেটা ব্যক্তিত্বের। ছেলেটি অত্যন্ত দ্বিধায় দরজা পার হয়ে ভেতরে এসে দাঁড়ায়।
হাবভাবে বোঝা যায় সে একটা দৌড়ের মধ্যে রয়েছে। সামান্য ঘামছিল। ভদ্রমহিলা বললেন, পরের পিক-আপটি শিফট করিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়া যায় না!
কঠিন কাজ ম্যাডাম। ছেলেটি দৃশ্যতই নার্ভাস। বলল, ডেলিভারি রেটিং নিয়ে কিছু বলার আছে আপনার? পথে জ্যাম থাকায় আমার কয়েক মিনিট দেরি হয়েছে। রেটিংয়ে আপনি লিখে দিতে পারেন।
ভদ্রমহিলা বললেন, সেটুকু দেরিতে কী এমন যায় আসে। তুমি ভেতরে এসো। চোখেমুখে জল দাও। আজ আমরা এক সঙ্গে দুপুরের খাবার খাব। ওই জন্যই দুটো প্যাকেট।
ছেলেটি আরও অবাক। বলল, এ রকম কখনোই নিয়ম নেই ম্যাম্।
কে বানিয়েছে নিয়ম?
কেউ বানায়নি। তবে কম্পানির কিছু রুলস্ আছে। আমাদের মেনে চলতে হয়।
পরের অর্ডারটা কি ট্রান্সফার করা যায়?
ছেলেটি তাকিয়ে দেখল তার সামনে বয়স্ক এক মহিলা। বেশ বয়স্ক। পরনে নাইটি। মাঝারি উচ্চতা। বয়সের কারণেই শরীরটা খানিক ভেঙেছে হয়ত। ছেলেটি তখনও পুরোপুরি দ্বিধায়। আমতা-আমতা করে বলল, পথে লেট বা অন্যান্য কারণে মাঝেমাঝে আমাদের পরের অর্ডারের পিক-আপ শিফ্ট করিয়ে দিতে হয়। কিন্তু এই রকমটা অ্যালাউ নয়।
ভদ্রমহিলা তখন ছোট বসার ঘরটিতে টেবিলে খাবার নামিয়েছেন। পার্সেল খুলছেন। আগে থেকেই টেবিলের দুটি চেয়ারের সামনে খাবারের প্লেট পাতা। দুটি কাচের গ্লাস। তিনি আগের গলাতেই বললেন, অর্ডার শিফট করিয়ে দাও। বেসিনে মুখ-হাত ধুয়ে এসো। আমার কিন্তু খিদে পেয়ে গেছে।
ছেলেটি যেন ঘোরের মধ্যে পড়েছে। বিপন্ন ভাবে বলল, ম্যাডাম…
ভদ্রমহিলা পার্সেল খুলে খাবার বাড়ছেন। বাঙালি রেস্টুরেন্টে বলা বাঙালি পদের মেন্যু। ভেতরে কী আছে ছেলেটি জানত না। দেখল প্রতিটিতেই চার-পাঁচ রকমের ছোট কনটেইনার। বয়স্ক মহিলা বললেন, এসো, বাকি কথা খেতে খেতে হবে।
ছেলেটির প্রায় উপায় থাকল না। পিঠে ব্যাগ নিয়েই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনের বোতাম চেপে গেল কিছুক্ষণ। বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বলল, আপনি বলছেন, কিন্তু কাজটা মনে হয় ঠিক করছি না ম্যাডাম। তাছাড়া আমার ততটা খিদেও নেই।
তিনি চেয়ার টেনে দিলেন। বললেন, ঠিক আছে অল্প করে খাও। যেটুকু পার খাও। তারপর নিজে বসে গেলেন উল্টো দিকের চেয়ারে।
তোমার নাম মকবুল তো! অ্যাপের মেসেজে দেখলাম।
হ্যাঁ ম্যাডাম।
থাকা হয় কোথায়?
ছেলেটি তখন অল্প ভাতে ছোট বাটি থেকে ডাল ঢেলে নিয়েছে। সঙ্গে গোল বেগুন ভাজা। ভদ্রমহিলার প্লেটেও তাই। সে বলল, আপনি চিনবেন না। হাড়োয়া বলে একটা জায়গা আছে। সেখান থেকে ভেতরের দিকে আরও দু কিলোমিটার। আপনাদের এখান থেকে অনেক দূর।
ওখান থেকেই যাতায়াত করো।
রোগাটে ছেলেটি খেতে খেতে ম্লান হাসল। …করতে হয় ম্যাডাম।
ভদ্রমহিলা নিজের খাওয়ার মাঝেও বুঝলেন, মুখে খিদে নেই বললেও দুপুর এই আড়াইটায় ছেলেটি ক্ষুধার্ত। ভাত অল্প খেলেও বাকি পদ সব খেয়ে নিচ্ছে সে। পটল চিংড়ি, চিকেনের পাতলা ঝোল, চাটনি। এবং তার খাওয়ায় একটা দ্রুততা। যে দ্রুত ভাব দ্বিধা দিয়েও ঢেকে ফেলতে পারছে না।
খাওয়ার পর ছোট-মাঝারি প্লাস্টিকের পাত্র ক-টি ছেলেটি প্লেটের ওপর তুলল। বলল, এগুলো কোথায় রাখব?
ওনার খাওয়াও শেষের দিকে। বললেন, কোথাও না। তুমি ওঠো। আমিই সরিয়ে দেব সব।
ছেলেটি বেসিনে মুখ ধুয়ে নিল। পকেট থেকে রুমাল বার করে মুছে নিল হাত মুখ। নামানো ব্যাগটি আবার পিঠে। তার তো বেরনোর তাড়া। ভদ্রমহিলা তখন বেসিনে। ছেলেটি দেখল তিনি কিছুই পুরো খাননি। সব কিছু নিয়েছেন মাত্র। ছেলেটি বেরিয়েই যেত। তার আগে বেশ সংকোচের সঙ্গে বলল, একটা কথা কি জানতে চাইব আপনার কাছে!
তিনি ছোট টাওয়েলে মুখ মুছছেন। বলো।
আপনি হঠাৎ এটা করলেন?
তিনি হাসলেন। মকবুল দেখল হাসলে তাঁর মুখের পাশ কুঁচকে যায়। বললেন, ইচ্ছে হল তাই।
শুধুই ইচ্ছে?
আবারও অল্প হাসি। …তুমি তো ভীষণই ব্যস্ত। শুনতে হলে তোমাকে আর দু মিনিট দাঁড়িয়ে বা বসে যেতে হয়।
মকবুল দাঁড়িয়েই থাকল। বলল, আপনি বলুন, শুনছি।
ঘরের ছোট্ট সোফাটিতে তিনি বসলেন। মকবুল ব্যাগ পিঠে নিয়ে দরজার কাছে। তিনি বললেন, আসলে আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী। বিয়ের চল্লিশ বছর। যদিও আট বছর হল তিনি নেই। তবু ভাবলাম দিনটাকে একটু অন্য ভাবে পালনের চেষ্টা করি। এই আর কী।
ছেলেটির ব্যস্ত ভাব সাময়িক চলে গেছে। সে শান্ত হয়ে দরজার কাছে। নিচু গলায় বলল, কিন্তু আমি কেন!
ভদ্রমহিলার গলাও নামানো। বললেন, তুমি বিশেষ কেউ নও। মকবুল না হয়ে ইকবাল কিংবা সুভাষ এলেও একই কথা বলতাম। আসলে আজকের দিনটাই বিশেষ। যা হোক, এলে যখন তোমার নম্বরটি রেখে যাও। অ্যাপে তো কল-থ্রু হয়ে তোমার কাছে গেছে।
ছেলেটি গুণে গুণে দশটি ডিজিট বলল। ভদ্রমহিলা পাশের টেবিল থেকে সেট এনে তুলে নিলেন। সেভ করতে সময় লাগল একটু। একবার রিং করতে খুব সাধারণ একটা টোন বেজে উঠল ছেলেটির পকেটে।
সে বলল, ঠিক আছে। আসি তবে। তিনি বললেন, এসো।
জগতের অবাস্তব কিছু ঘটনার মতো এ কাহিনি এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। অবাস্তবকে সময় তো কখনও লম্বা ছাড় দেয় না। বাস্তবের সঙ্গে পা মিলিয়েই সময় হেঁটে যায়। আশ্চর্য ঘটনা আসে, আবার চোখের পলকে মিলিয়েও যায়। কিন্তু এই কাহিনির অবাস্তবতা কীভাবে যেন সময়ের আরও খানিকটা ছাড় পেল।
হাড়োয়ার মকবুল আট-দশ কিলোমিটার বাইক চালিয়ে শহরে আসে প্রতিদিন। এবং অন-লাইন কম্পানির হয়ে কখনও ফ্ল্যাটের দরজায়, কখনও লিফট থেকে বাড়ানো হাতে খাবার পৌঁছে দেয়। অন্য যারা তার মতো কাজ করে তাদের মতো তারও লক্ষ্য থাকে সারা দিনে যত বেশি অর্ডার পাওয়া যায়। খাবার পৌঁছনোর পর কেউ সামান্য কিছু টিপস দিলে অন্যদের মতো খুশি হয় সে-ও। এভাবেই চক্কর কাটে বছরে তার বেশির ভাগ দিন।
কিন্তু সেই হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা সহজে তার মাথা থেকে যায় না। তার বন্ধু আছে, কলিগেরা রয়েছে, তাদের সঙ্গে কখনও এক জায়গায় দেখা হলে এটা-ওটা কথা হয়। কিন্তু নিয়ম বিরুদ্ধতার কারণে এই ঘটনা সে কাউকে বলতে পারে না। প্রাণ খুলে বলার মতো একটা ব্যাপার নিজের ভেতরে চাপা দিয়েই রাখে।
হয়ত সেই অস্বস্তি থেকেই একদিন দুপুরে সে যখন খানিকটা ফাঁকা, তখন একটি কল করে ফেলে ভদ্রমহিলার নম্বরে। ক দিন টানা বৃষ্টির পর সেদিন খানিকটা ধরেছে। বর্ষাকালও চলে যাওয়ার মুখে। দুপুরে সেদিন টানা দু বার রিং হয়ে গেল ও দিকের ফোনে। মকবুল কিছু ভাবার আগেই ফোনে তারপর অর্ডার ঢুকল একটি। একটি অর্ডার, ডেলিভারি হতে না হতে আর একটি, পিছু পিছু আরও দুটি, মাঝেমাঝে যেমন হয়। মকবুল ছুটছে। আর সেই ছুটের মাঝে, শেষ বিকেলে দুই অর্ডারের মাঝে, দুপুরের প্রায় ঘন্টা তিনেক পর ফোন এল তার মোবাইলে। ও দিকের সেই নম্বর, সেই বয়স্ক স্বর। …বলো মকবুল, কল করেছিলে আমাকে!
হ্যাঁ ম্যাডাম।
কেমন আছ তুমি? কিছু বলতে?
মকবুল তখন একটি আবাসনের গেট দিয়ে বেরচ্ছে। বাইরে রাস্তার পাশে রাখা তার বাইক। সে একটু আমতা আমতা করে। …এমনি কল করেছিলাম। আপনি কেমন আছেন! সন্ধের দিকে কি ফাঁকা থাকবেন কিছুটা?
কেন বলো?
বাড়ি যাওয়ার আগে একবার আপনার ওখানে যেতাম…
ক-টা নাগাদ বলো।
এই ধরুন সাতটা। তবে আজ না হয়ে অন্য দিনও যাওয়া যায়।
ফোনের ও পাশের গলায় হাসির আভাষ। যেন একটু ক্লান্ত হাসি। …আমি প্রায় সব সময় ফাঁকা। মনে হলে আজই তুমি আসতে পার।
মকবুল এল সেদিন। তার সেই রোগাটে চেহারা। গায়ে কম্পানির গেঞ্জি, লাল রঙটি বেশ ফিকে হওয়া। হাতে ঝোলানো মাঝারি একটি প্যাকেট। ভদ্রমহিলা দরজা খুলে ভেতরে যেতে বলায় সে এগিয়ে ভেতরে গেল। প্যাকেটটি রাখল খাবার টেবিলে।
কী ওর ভেতর?
তেমন কিছু নয়।
কিছু তো বটেই।
অল্প একটু রাবড়ি ম্যাডাম। যেখান থেকে আনা আমাদের কাছে সেই দোকানের প্রায়প্রায় অর্ডার আসে। তাই একটু নিয়ে এলাম।
আমি কি মিস্টি খাই!
খান না?
আমার তো সুগার।
মকবুল চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে। ভদ্রমহিলা আজ অন্য একটি নাইটি পড়ে আছেন। বয়সের কারণে শরীর সামনে একটু ঝোঁকা। এবং রোগা চেহারায় এক ধরণের রুগ্নতা। সোফার উল্টো দিকের চেয়ারে হাত দেখিয়ে বসতে দিলেন ছেলেটিকে। বললেন, তুমি যখন এনেছ তখন একটু খাব। দুজনে ভাগাভাগি করে খেয়ে নেব। হঠাৎ কী মনে করে এলে তুমি?
বিশেষ কিছু মনে করে নয়। সোফার সিঙ্গল চেয়ারটিতে বসেছে মকবুল। পায়ের কাছে পিঠের ব্যাগ নামানো। বলল, সেদিনের পর থেকেই আসার কথা ভেবেছি। আপনাকে আর একবার দেখে যাওয়ার কথা। কিন্তু এও ভেবেছি আসা ঠিক হবে কি না। এসবের কিছুই তো আমাদের নিয়মে নেই।
নিয়মের কথায় উল্টো দিকের সোফায় ভদ্রমহিলা আলগা হাসলেন।
তিনি এক ফাঁকে উঠে গিয়ে জলের গ্লাস এনে রাখলেন মকবুলের সামনে। তারপর রাবড়ি ভাগাভাগি হল। মকবুলকে প্রায় পুরোটাই, নিজের জন্য দু চামচ। মকবুল বলে, তাহলে আনলাম কার জন্য!
তিনি হাসেন। …সুগার পেশেন্টের জন্য।
সেদিন কথা এগোল খেতে খেতে। মকবুলের বাড়িতে বাবা মা আর দুই দাদা। দুই দাদা বিয়ে করে আলাদা। বাবা মা মকবুলের সঙ্গেই থাকেন। বাবা মা মকবুলকে বিয়ে দিতে চাইলেও সে আরও বছর চার-পাঁচ কাজ করে নিতে চায়।
ওঠার সময় ছেলেটি বলে, আপনি মনে হয় একাই থাকেন। দু দিনে তো আর কাউকে দেখলাম না। সেদিন খাবারও আনালেন আপনার আর আমার জন্য।
না না আমার লোক আছে। ছেলে-বউমা আছে। ভদ্রমহিলা বলেন। …তবে তারা দূরে। বিদেশে। আমাকেও তারা তাদের দেশে নিয়ে যেতে চায়।
যাবেন না!
নাঃ! ভদ্রমহিলা মাথা নামান। এখানে একা, ও দেশে গেলে আরও একা হয়ে যাব। একবার দু মাসের জন্য গিয়েই আমার দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। এখানে তো তাও মানুষ দেখতে পাই। যারা দুধ নিয়ে আসে, সকালে পেপার দেয়, সুযোগ পেলেই সবার সঙ্গে একটু কথা বলি। ও দেশে কাজের বাইরে কারও একটি কথা নেই।
সেদিন চলে যায় মকবুল। কিন্তু সম্পর্ক আর যোগাযোগটা রয়ে যায়। এ দিকে কখনও ডেলিভারি পড়লে সে মিনিট খানেকের জন্য হলেও এসে দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলে। ভদ্রমহিলা এক-এক দিন রাত দশটা সাড়ে-দশটাতেও কল করেন। মকবুল তখন হয়ত বাড়িতে। তিনি বলেন, ঠিকঠাক পৌঁছে গেছ তো! পথে বৃষ্টি পেয়েছিলে না কি!
ইদের পর দিন সকালে মকবুল কাজ শুরুর আগে ঘুরে যায়। সঙ্গে বাড়িতে বানানো কয়েকটি খাবার, কিছু ফল। জুতো খুলে ঘরে ঢুকে টেবিলে সেসব নামিয়ে রেখেই চলে যায়। বলে, ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখুন। আপনার দু-তিন দিন চলে যাবে। আবার কখনও সন্ধেয় আসে। তখনও তার তাড়া। প্রেসক্রিপশান আর ওষুধ রেখে বলে, দুই নম্বরের ওষুধটা পাওয়া যায়নি কিন্তু। বেলগাছিয়ার একটা দোকানে অর্ডার করেছি। পরশু দিন এসে যাবে। চললাম।
ভদ্রমহিলা রাতে খেয়ে যেতে বললে হেসে বলে, আজ না। পরে। যেদিন আবার ডেলিভারির অর্ডার নিয়ে আসব।
সম্পর্ক গড়াচ্ছিল এভাবেই। মাসে এক বা দু দিন দেখা হওয়া। মকবুলের ফোনে অনেক সময় বিনা কারণে কল। কাজের ভেতর দুপুরে মকবুল কিছু খেয়ে নিয়েছে কি না তার খোঁজখবর। একদিন বললেন, আমিনাকে আমার কাছে একদিন নিয়ে আসবে না?
ব্যস্ততায়ও উত্তর দেয় মকবুল। হেসে বলে, কোন আমিনা?
তিনি ফোনে বলেন, ওই যে আমার এখানে তুমি একদিন দেখা করতে আসার পর একটা কল এল। আমি রান্না ঘর থেকে শুনলাম তুমি বলছ, আমার সময় নেই, কোনও ছুটি নেই আমিনা। সকালে বেরিয়ে ফিরতে রাত হয়ে যায়। সে-ই আমিনা। তাকে বরং আমার কাছে সারা দিনের জন্য একদিন রেখে যাও।
মকবুল হেসে ফোন কেটে দেয়। বলে, আমি খুব ব্যস্ত এখন। পরপর তিনটে ডেলিভারি মাথার ওপর ঝুলছে। বৃষ্টির জন্য আজ লোক কম।
তারপর সেই বৃষ্টির দিনগুলো কাটলে কয়েক দিনের জন্য শহরের আকাশেও যখন সাদা মেঘ আসে, তেমন একদিন বেশ সকালে কল আসে মকবুলের ফোনে। ও রকম সময়ে সাধারণত কল আসে না। ও পারের গলা বলে, আজ তুমি সকালেই একবার এসো, অবশ্যই এসো। মকবুল অবাক হয়। সেদিন ফোনের গলা আশ্চর্য রকমের ক্লান্ত।
সে একটু তাড়াহুড়োয় বের হয়। সময়ের বেশ খানিক আগেই পৌঁছয় শহরে। নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটটিতে পৌঁছে দেখে দরজা খুলে রাখা। পর্দা সরানো ভেতরের ঘরের, খাটে তিনি শোওয়া। মকবুল কাছে যেতে নরম গলায় বলেন, আজ তুমি কাজে যেও না মকবুল। একটা গাড়ি ডাকো। ভাড়া যা নেয় নেবে।
হাসপাতালে যাবেন?
তিনি বলেন, না, আমাকে কৃষ্ণনগরে পৌঁছে দিয়ে এসো।
মকবুল বোঝে তিনি অসুস্থ। হাতটি তুলে নিয়ে বলে, কৃষ্ণনগরে কী! এখানেই বরং আপনাকে বড় কোনও হাসপাতালে নিয়ে যাই।
তিনি ক্ষীণ স্বরে বলেন, এখন আমার কৃষ্ণনগরেই চলে যাওয়ার কথা।
ওখানেই! কেন?
তুমি গাড়ি ডাক, আমি যেটুকু পারি তৈরি হয়ে নিচ্ছি। যদি পারি তো যেতেযেতে বলব। তোমার আজকের কাজের ক্ষতিও পুষিয়ে দেব, তুমি নেবে।
মকবুল পিঠের ব্যাগটি নামিয়ে রেখে গাড়ির খোঁজে বেরিয়ে যায়। তিনি ধীরেধীরে উঠে তৈরি হতে থাকেন।
বারাসাত ছাড়িয়েও বেশ কিছু দূর পথ কলকাতার মতোই। রাস্তার দু পাশে বড় বাড়ি, বাজার, ব্যস্ত দোকান। পথে গাড়িও অনেক। কিন্তু আরও প্রায় মিনিট চল্লিশেক যাওয়ার পর সেসব তেমন আর নেই। দু পাশ প্রায় সবুজ। রাস্তার ধারে গাছ, অনেক দূর পর্যন্ত ধানক্ষেত, পাট চাষ। অ্যাম্বাসাডারের পেছনের সিটে হেলান দেওয়া তিনি, সঙ্গে কয়েকটি ব্যাগ। সামনের সিটে ড্রাইভারের বাঁ দিকে মকবুল। তিনি একবার বলেছেন, ফেরার সময় তুমি এ গাড়িতেই ফিরো। তোমার বাইক তো নিচের ফ্ল্যাটের বারান্দায়।
পথের এক জায়গায় বৃষ্টি চলল কিছুক্ষণ। রাস্তা প্রায় সাদা। কিছুটা পার হয়ে যেতে আবার রোদ। খানিক পথ মেঘলায় গেল। রোদ ফিরে এল আবার। আগস্ট মাসের এক-একটা দিন যেমন হয়। তিনি এক সময় বললেন, এই সেই পথ। পঁয়তিরিশ বছর আগে যে পথ দিয়ে কলকাতায় চলে গিয়েছিলাম।
মকবুল বলে, আপনার শরীর ঠিক আছে তো! আপনি বললেই কিন্তু আমরা দাঁড়াব।
মকবুল জানতে চায় না কিছু। তিনিই মাঝেমাঝে দু একটি কথা বলেন। মকবুল সারা পথ যেতে যেতে বুঝে যায়, ওনারা আসলে কৃষ্ণনগরের লোক। স্বামীর কর্মসূত্রে দুজনে এক সময় কলকাতায় চলে যান। পরে কলকাতাতেই ফ্ল্যাট, একমাত্র ছেলের পড়াশুনো। উনি কৃষ্ণনগরের বাড়িতে শেষ এসেছিলেন আট বছর আগে। ক্যান্সার সারবে না জেনে ওনার স্বামী যখন শেষ ক দিন পুরানো জায়গায় ফিরে এসেছিলেন। কৃষ্ণনগর থেকে পরে উনি একাই কলকাতায় ফেরেন।
ঘিঞ্জি কৃষ্ণনগরের ওই পাড়াটি ঘুর্ণি ছাড়িয়ে ভেতরের দিকে। বোঝা যায় পুরানো আমলের পাড়া। এক-একটা কোঠা বাড়ি, অথচ লোকজন তেমন নেই। মনে হয় সকলেই দূরে চলে গেছে। তেমন-ই একটি পুরানো বাড়ির উঠোনে গাড়ি দাঁড়ায়। মকবুল নামে। উনি খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে ধীরে ধীরে নেমে পড়েন। বলেন, এখানেই থাকব আমি। ধরে ধরে আমাকে একটু দোতলায় দিয়ে এসো। পরে ব্যাগগুলো নামিয়ো।
একতলার ঘর থেকে এই সময় কমবয়সি বউ বেরিয়ে আসে একজন। ভদ্রমহিলার কাছে এসে বলে, মেজো জেঠিমা যে! আপনি পুজোর সময় এসে ক দিন থাকবেন বলেছিলেন না! ওর বাবাও তো তাই জানে। কালও আপনাকে নিয়ে কথা হল।
মকবুল এক পাশ থেকে ধরে আছে ওনাকে। মকবুলের অন্য হাতে ওনার সঙ্গের নিজস্ব ব্যাগটি। উনি বউটিকে অল্প হেসে বললেন, তেমনটাই ভাবা ছিল। কিন্তু শরীরটা খারাপ করে গেল হঠাৎ। বুঝলাম এবার চলে আসা দরকার। এই আর কী…।
বউটিও ধরতে চাইছিল। কিন্তু সিঁড়িতে ওনাকে একাই ধরে রাখল মকবুল। বউটি পেছন পেছন উঠছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে টানা বারান্দা। তার ও পাশে তালাবন্ধ ঘর। উঁচু দরজা। ভদ্রমহিলা মকবুলের কাছ থেকে ব্যাগ চেয়ে নিয়ে চাবি বার করে বউটির হাতে দিলেন। লম্বা একটি চাবিতে খুলে গেল দরজা।
অন্ধকার ঘর। মকবুলকে বলায় সে আগে আগে ঢুকে দু তিনটে জানালা খুলে দেয়। জানালার বাইরে গাছপালা। বিকেলের আলো। ঘরের ভেতরও আলো এল। তিনি আস্তে আস্তে ঢুকে ও দিকে জানালার কাছে চওড়া বড় খাটটিতে বসলেন। পুরানো দিনের কাজ করা খাট। মকবুল হাতের ব্যাগটি ওনার গায়ের কাছে রাখল।
বউটি বলল, অবেলায় এলেন, কী খাবেন বলুন! অল্প করে লুচি ভেজে আনি?
উনি হাত তুলে না করলেন। বললেন, এখন আমাদের শুধু চা দাও। ও এই গাড়িতেই কলকাতায় ফিরে যাবে। তোমাদের ঘরে যে বউটি কাজ করে তাকে বোল কাল থেকে সে যেন আমার এখানেও আসে।
বউটি নিচে যায়। মকবুলও নিচে নামে। বাকি ব্যাগ নামাতে যায় সে। উঠোনে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখে সে ভাবে যা সে দেখছে, যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তা বাস্তব না কি সিনেমায় যেমন হয়। সে কি কোনও অন্ধকার হলে একা বসে থাকা দর্শক। না কি সিনেমায় সে-ও এক পাশের চরিত্র!
চায়ের সঙ্গে ছোট সিঙারা এসেছিল। ভদ্রমহিলা নিলেন না। নিজেরটাও মকবুলকে দিলেন। মকবুল কাঠের একটি টুলে বসা। ভদ্রমহিলা বললেন, এবার তুমি যাবে, তাই তো!
মকবুল কাপ নিচে নামায়। বলে, যেতে তো হবেই। তবে আবার আমি আসব। ছুটি করে এসে আপনাকে দেখে যাব।
সে তো তোমাকে আসতেই হবে। তবে যাওয়ার আগে দু একটি কথা শোন। টুলটা এগিয়ে এনে বোস।
তিনি হাত ব্যাগ খুললেন। ঘরে তখন আর কেউ নেই। বললেন, এদের কাছে তোমার নম্বর দেওয়া থাকবে। তুমি মাঝেমাঝে এলেও একদম শেষেও একটা কল পাবে। সেদিন তুমি আসবেই। সুমন একদিনের জন্যও আর এ দেশে আসছে না। তুমি এসে আমার শেষ কাজ করে যাবে।
একটি কথায় বুকে ধাক্কা খেল মকবুল। সে হাড়োয়ার গ্রাম থেকে আসা। প্রতিদিন কলকাতার পথে ছুটোছুটি করে যায়। বাইকের সিটে বসে জীবন কোনও রকমে চলছে। কোথা থেকে কোথায় জড়াল সে! শেষ কাজের কথায় তার গলা বুঁজে আসে।
ভদ্রমহিলা নির্বিকার ভাবে এবার একটি চাবি এগিয়ে দেন। বলেন, কলকাতার ফ্ল্যাটের চাবি। তোমার কাছে থাকল। পরে তুমি আর আমিনা ওখানে থাকবে। আমি এখানে বসেই দু-এক দিনে কাগজ বানিয়ে দেব।
মকবুল পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ওনাকে। তারপর উঠে দাঁড়ায়। বলে, উপরে যিনি আছেন তাড়াতাড়ি তিনি আপনাকে না নিন। তবে ফোন পেলে আপনার ইচ্ছা পূরণের জন্য আসব। চাবিতে আমার দরকার নেই। ওটা আপনার কাছেই থাক। সুমন দাদা না হোক তার ছেলেমেয়েরা কখনও যদি দেশে আসে তো থাকবে।
ওরা ওদের ব্যবস্থা ঠিকই করে নেবে। তুমি আমার কথা শোন। ভদ্রমহিলার গলায় চাপা উদ্বেগ।
মকবুল ওনাকে শান্ত হতে বলে। তারপর চাবিটি নিয়ে পাশে রাখা ওনার হাত-ব্যাগের ভেতরেই ভরে দেয়। বলে, ডেলিভারি বয়দের এত কিছু নিতে নেই ম্যাডাম। নিয়মে নেই।
বলে মকবুল চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। তিনি বাইরে সন্ধে হয়ে আসা গাছগাছালি ঘেরা ঘরটিতে চুপ হয়ে বসে থাকেন।