রান্নাঘরে গৃহস্থদের কাছে প্রধান মশলাই হল লঙ্কা। চাষিদের কাছে এখন উল্লেখযোগ্য ফল বলেও পরিচিত। আবার অসংখ্য চাষিদের কাছে অর্থকরী ফসলও। রাজ্য সরকারের সহায়তায় রপ্তানি করে আর্থিক লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। কেবল পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা দেশ জুড়ে এই ফসলের কদর। তা হল লঙ্কা। এই লঙ্কা রপ্তানি করেই কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছে দেশ। পশ্চিমবঙ্গ সহ সারাদেশে চাষিদের কাছে এখন অন্যতম অর্থকরী ফসল। তাই বিভিন্ন প্রান্তের চাষিরা লঙ্কা চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছে। একদিকে বাড়ছে চাষ, অপরদিকে মজবুত হচ্ছে চাষিদের অর্থনৈতিক শিরদাঁড়া।
প্রসঙ্গত, ভারতে ৮৮টি জাতের লঙ্কা চাষ হচ্ছে। এরমধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই রয়েছে ৫৪টি জাতের। ২০২২-‘২৩ বছরে ভারতে লঙ্কা চাষ হয়েছিল ১০.১৫ লক্ষ হেক্টর। পশ্চিমবঙ্গে ৬৮ হাজার ৯৩০ হেক্টরে। এর থেকে লঙ্কা উৎপাদন হয়েছিল ৮ লক্ষ ৪৩ হাজার ৬৭৭ টন। যা সমগ্র দেশের মধ্যে ৬ শতাংশ লঙ্কার উৎপাদন হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গেই। উল্লেখ করা যেতে পারে, পশ্চিমবঙ্গে যে ৫৪টি জাতের লঙ্কা চাষ হয়, তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বুলেট, তেজস্বিনী, ধুলিয়া, এস-৮, লাল লঙ্কা, ধানি লঙ্কা, আচার লঙ্কা, কুল লঙ্কা, এস-৯, ঘি লঙ্কা, সবুজ, বোম্বে, সূর্যমুখী ইত্যাদি। এছাড়া ক্যাপসিকামও উল্লেখযোগ্য হারে চাষ হচ্ছে। প্রসঙ্গত, বছরে দুটি মরশুমে লঙ্কা চাষ হতে দেখা যায়। রবি ও খরিফ মরশুমে। ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা, স্বল্প বৃষ্টি, বেলে, দোঁয়াশ বা এঁটেল মাটিতে লঙ্কা চাষ ভালো হয়। রাজ্যে প্রতি হেক্টরে ৫৭৪ থেকে ৯৫৭ কেজি লঙ্কা উৎপাদন হয়। সাধারণত ১ হেক্টরে ১ থেকে ১.৫ কেজি লঙ্কা বীজ লাগে। উল্লেখ করা যেতে পারে, পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর বাড়ছে লঙ্কার চাষ। প্রায় প্রতিটি জেলায় এর চাষ হচ্ছে। হাইব্রিড ছাড়াও বিভিন্ন জাতের লঙ্কা চাষ দেখা যাচ্ছে। ঝাল লঙ্কা থেকে শুরু করে আচার লঙ্কা চাষ হচ্ছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে সবজি হিসাবে ক্যাপসিকামের চাষ। যা লাভজনক। বাজারে চাহিদাও বাড়ছে।
রাজ্যে পাহাড় থেকে শুরু করে সমতলের বিভিন্ন ক্ষেত খামারে লঙ্কার চাষ হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের ঘুম, কালিম্পং, মাথাভাঙা, তুফানগঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, ইসলামপুর, কালিয়াচক, বহরমপুর, বেলডাঙা ছাড়াও বোলপুর, রামপুরহাট, চাকদহ, কল্যাণী, বর্ধমান, বিষ্ণুপুর, আরামবাগ, সোদপুর, ঝালদা, বাঘমুন্ডি ইত্যাদি জায়গায় উল্লেখযোগ্যভাবে চাষ হয়। প্রদীপ মাইতি, স্বপন চৌধুরি, অশোক পালদের মতো বর্ধিষ্ণু চাষিরা জানাচ্ছেন, সঠিক পরিচর্যায় লঙ্কা চাষ করতে পারলে বিঘা পিছু ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা লাভ হতেই পারে। বর্তমান বাজারে উত্তোরোত্তর চাহিদা বাড়ছে। সেইসঙ্গে নায্য দামও থাকছে। রাজ্যের অধিকাংশ ব্লকের কৃষি বিষয়বস্তু বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এখন লঙ্কা চাষে চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সরকার এই চাষে সহায়তাও করছে। ফলে চাষিদের উৎসাহ বাড়ছে। চাষিদের লঙ্কা বীজ, সার ও ওষুধ দিয়ে সরকার সহায়তা করছে। এদিকে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রায় সব ধরনের মাটিতে লঙ্কা চাষ করা যেতে পারে । বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, উচ্চ ফলনশীল লঙ্কা চাষে চাষিদের আগ্ৰহ বাড়ছে। হাইব্রিডের বুলেট ও অশ্বিনী বেশি চাষ হচ্ছে । সেইসঙ্গে ক্যাপসিকাম চাষে ঝোঁক বাড়ছে চাষিদের। লঙ্কা চাষকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা দেশে ছোট ছোট শিল্প যেমন গড়ে উঠেছে, সেইসঙ্গে নতুন বাজার তৈরি হয়েছে।
অর্থকরী ফসল আলু, ধানের, পাশাপাশি বিকল্প চাষ হিসেবে সরষে চাষ রাজ্যে বাড়ছে। এদিকে লঙ্কা উৎপাদন করে যাতে তা নষ্ট না হয়ে যায় এজন্য হিমঘরে মজুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের সবজির পাশাপাশি লঙ্কারও স্থান পাচ্ছে হিমঘরগুলিতে। এজন্য সারা বছর লঙ্কার যোগানও থাকছে। রাজ্য কৃষি বিপণন দফতর কিষাণ মাণ্ডি থেকে লঙ্কা কেনাবেচার সুযোগ করে দিয়েছে। পাশাপাশি চাষিরা যাতে নায্য দাম পান এজন্য কৃষি বিপণন দফতরও এগিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে কলকাতা, হাওড়া, শিয়ালদার কোলে মার্কেট, ঢাকুরিয়া, উত্তর ২৪ পরগণা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, হুগলি, নদিয়া ইত্যাদি জেলাতে লঙ্কার বড় বড় বাজার তৈরি হয়েছে। এখান থেকে লঙ্কা কিনে ব্যবসায়ীরা তা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠাচ্ছে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের লঙ্কা বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও উত্তরপ্রদেশ, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গনা ইত্যাদি রাজ্যে ব্যাপক হারে শুরু হয়েছে লঙ্কা চাষ। এরমধ্যে ঝাল ও আচার লঙ্কা দুইই আছে। আর আছে ক্যাপসিকাম। যা সবজি ও স্যালাড হিসেবে খাদ্যের তালিকায় প্রবেশ করেছে। প্রোটিন হিসেবেও লঙ্কার গুণগত মান নিয়ে সহমত পোষন করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ভিটামিন-সি ছাড়াও ক্যালসিয়াম আছে।
এছাড়াও উচ্চ অ্যান্টি অক্সিডেন্ট আছে। যা মানব শরীরে প্রয়োজন।