বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র ছবি বিশ্বাস। ১১ জুন ১৯৬২ সালে এক মোটড়গাড়ী দূর্ঘটনায় ছবি বিশ্বাস মারা যান। সিনেমায় নানারকম ভুমিকায় অভিনয় করেছেন। তিনি বিশেষত পঞ্চাশের দশকে শহর কলকাতায় বিলিতিকেতায় অভ্যস্ত অভিজাত গোষ্ঠীর একটি নিখুঁত ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।
ছবি বিশ্বাসের আসল নাম শচীন্দ্রনাথ বিশ্বাস। তিনি ১৩ জুলাই ১৯০০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ভূপতিনাথ বিশ্বাস। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেছেন। একই সাথে অ্যামেচার থিয়েটারে অভিনয় করেছেন। শিশির ভাদুড়ি ও নরেশ মিত্রের মত বড় মাপের অভিনেতাদের সাথেও অভিনয় করেছেন ছবি বিশ্বাস। পেশাদার অভিনেতা হিসেবে চিত্রজগতে এসেছেন বেশ খানিকটা বেশী বয়সে। তাঁর প্রথম ছবি অন্নপূর্ণার মন্দির (১৯৩৬)। পরবর্তীকালে তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় জালসাঘর, দেবী, কাঞ্চঞ্জঙ্ঘা ইত্যাদি ছবিতে অভিনয় করেন। তপন সিংহের পরিচালনায় কাবুলিওয়ালা ছবিতে অভিনয় করেন। এছাড়াও অজস্র ছবিতে তিনি অসাধারণ দক্ষতার সাথে অভিনয় করেছেন।
তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত জমিদার বংশের ছেলে তাই জমিদারি চলে গেলেও তাঁর মেজাজ তাঁকে যে কখনও ছেড়ে যায়নি সেটা তাঁর অভিনয়ের মধ্যেই ফুটে উঠেছে। ছবি বিশ্বাস মূলত সাহেবি এবং রাশভারি ব্যক্তিত্বপূর্ন চরিত্রে অভিনয়ের জন্যই খ্যাতি লাভ করেছিলেন। যে কোনো চরিত্রে অভিনয়ের সময়েই তাঁর সহজাত প্রতিভার প্রকাশ ঘটত।ছবি বিশ্বাস নাম শুনলেই এক বিশেষ ব্যক্তিত্বপূর্ন, গুরুগম্ভীর স্বরের একটি বিশিষ্ট ব্যক্তির ছবি ভেসে ওঠে আমাদের মানসপটে।
১৯০০ সালে জন্ম নেওয়া মানুষটি বাংলা ছবিকে হাত ধরে পৌঁছে দিয়েছেন আধুনিকতার আঙিনায়, বললে ভুল হবে কি? আর মঞ্চের ছবি বিশ্বাসও তো শুধু পটে নয়, ইতিহাসেও লেখা। বাঙালিরা শিল্প নিয়ে কথা বলতে গেলে ‘যুগ’ শব্দটি বলতে বড় ভালবাসেন। রবীন্দ্র যুগ, অহীন্দ্র যুগ। সে কালের থিয়েটার-ভক্তরা বলেন, অহীন্দ্র চৌধুরী-শিশিরকুমার ভাদুড়ীর পর বাংলার মঞ্চে ছিল ছবি বিশ্বাস যুগ। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুই পুরুষ’, মনোজ বসুর কাহিনি-আধারিত ‘ডাকবাংলো’, দেবনারায়ণ গুপ্ত-র ‘শ্রেয়সী’, ‘ঝিন্দের বন্দী’, কত ঐতিহাসিক নাটক! শিশির ভাদুড়ীর ভাই ছিলেন ছবি বিশ্বাসের সহপাঠী, তাই শিশিরবাবুকে ‘বড়দা’ বলতেন। কাছ থেকে অভিনয় দেখেছেন, শিখেছেন, তার পর পালটেছেন সেই অভিনয়কে। ম্যানারিজম-হীন সেই অভিনয়ের গা বেয়ে চুঁইয়ে পড়ত চরিত্রের আভিজাত্য, দাপট, কারুণ্য, ভাঙচুর। ফিল্ম-কেরিয়ারের তুঙ্গ পর্যায়ে ন-বছর বাদ পড়েছিল মঞ্চাভিনয়, শরীরও ভাল যাচ্ছিল না। ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে যে দিন স্টার থিয়েটারে ফিরলেন, বুকিং অফিস খুলতেই লম্বা লাইন, প্রতিটা শো হাউসফুল। বক্স অফিস টানেন নায়ক-নায়িকারা আর ছবি বিশ্বাস— এ ছিল অমোঘ সত্য।
ভারতীয় সিনেমায় ছবি বিশ্বাস একজনই ছিলেন। কিছু চরিত্রের তিনি কতটা অপরিহার্য ছিলেন তা স্বয়ং সত্যজিৎ রায় স্বীকার করে গিয়েছেন।
১৯৫৬ সালে তপন সিংহের কাবুলিওয়ালা-তে কাবুলিওয়ালার ভূমিকায় ছবি বিশ্বাসের অনবদ্য অভিনয় দর্শকরা কোন দিন ভুলতে পারবেন না। এই ছবিতে তিনি যখন পাগড়ি এবং জোব্বা পরে ‘হিং চাই হিং’ বলে পর্দায আসেন কাবুলিওযালার বেশে এবং একরত্তি মিনির সঙ্গে গড়ে ওঠে তাঁর অসমবয়সী সখ্য, আর ছবির শেষে যখন রবি ঠাকুরের সেই গল্পটি দেখায়, পিতৃহৃদয়ে কোথাও দেশভাগের কাঁটাতার নেই, তখন সেই বোধ একেবারে স্ব-শরীরে জেগে ওঠে আমাদের সামনে। কান্নাহাসির দোলে আকুল বাঙালি সেই আফগান পুরুষের বেশধারী বাঙালি অভিনেতাটিকে আপন করে নেয়। প্রায় প্রতিটি ছবিতে তাঁর অনবদ্য অভিনয়ের জন্য ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে সঙ্গীত নাটক আকাদেমি তাঁকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান জানান।
ছবি বিশ্বাস সঙ্গীতচর্চাও করেছিলেন। নাড়া বেঁধেছিলেন ওস্তাদ জামিরুদ্দীন খাঁ সাহেবের কাছে। অভিনয় জীবনের হাতেখড়ি মদন মিত্র লেনে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের বৈঠকখানায় বারবেলা বৈঠক ক্লাবে। এখানে ছিল শখের অভিনয়। করেছিলেন নাটক ‘ভীষ্ম’। ১৯৩৮-এ নাট্যনিকেতন মঞ্চে পেশাদারি শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ।
সিনেমায় অভিনয় করাটা হঠাৎই। একদিন ছবি বিশ্বাস কর্নওয়ালিস ক্রাউন (উত্তরা) সিনেমার সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিলেন। সেই সময় বুকিংয়ে বসেছিলেন পরিচালক প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি ডাকলেন ছবি বিশ্বাসকে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘সিনেমা করবেন?’ ছবি বিশ্বাস সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জানালেন। পরিচালক তিনকড়ি চক্রবর্তী তখন করছিলেন ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’। লম্বা সুদর্শন নায়ক খুঁজছিলেন তিনি। ছবি বিশ্বাসকে তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন প্রিয়নাথ। পরিচালকের পছন্দ হল ছবি বিশ্বাসকে। কালী ফিল্মসের ব্যানারে ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ (১৯৩৬) ছবি বিশ্বাসের প্রথম ছবি।
অভিনয়ের জন্য প্রশংসা পেলেও বেশ কিছু দিন সিনেমার প্রস্তাব তাঁর কাছে আসেনি। কারণ তিনি যে চরিত্রেই অভিনয় করতেন, তাতেই জমিদারি আভিজাত্য ফুটে উঠত। এই সময় নিজের অভিনয়, হাঁটাচলা, বাচনভঙ্গি নিয়ে কাজ করা শুরু করেন ছবি। বাংলা সিনেমায় যে ক’জন অভিনেতা যাত্রার ছায়া ছেড়ে পর্দার অভিনয়ের আলাদা জগৎ তৈরি করেছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রমথেশ বড়ুয়া একেবারে প্রথম সারিতে থাকবেন। একই সঙ্গে থাকবেন ছবি বিশ্বাসও।
বাংলা ছবিতে ছবি বিশ্বাসের আভিজাত্যপূর্ণ চেহারার অভিনেতা আসেননি। আসেননি এমন বড় মাপের অভিনেতা। তিনি ছিলেন একটা যুগ। বাংলা ছবিতে চলনবলন, পোশাকে এনেছিলেন পরিবর্তন। তাঁর অভিনয় ছিল ভীষণই সিনেম্যাটিক। থিয়েটারি প্রভাবকে একেবারে ভেঙেচুরে দিয়েছিলেন।
আভিজাত্যের সঙ্গে তাঁর কথা দিয়ে কথা রাখার জ্ঞানও ছিল প্রবল। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে অভিনয় করানোর জন্যে সত্যজিৎ রায় কথা বলতে গেলেন। চিত্রনাট্য পড়ে বেশ খুশি হলেন ছবি বিশ্বাস। কিন্তু যেই শুনলেন শুটিংয়ের জন্যে দীর্ঘদিন আউটডোরে থাকতে হবে সঙ্গে সঙ্গে বেঁকে বসলেন। সত্যজিৎ রায়কে তিনি বলেন, ‘সোম থেকে বুধ আউটডোরে শুটিং ঠিক আছে কিন্তু বৃহস্পতিবার আমাকে কলকাতা ফিরতেই হবে কারণ প্রত্যেক সপ্তাহে বৃহস্পতিবার থেকে রবিবার আমার থিয়েটার আছে।’ সব শুনে সত্যজিৎ রায় বললেন এটা অসম্ভব। সঙ্গে সঙ্গে তিনিও বলে দিলেন ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে অভিনয় করা তার পক্ষেও অসম্ভব। খালি হাতে ফিরে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। পর দিন ছবি বিশ্বাস থিয়েটারের সবাইকে জানান এই কথা। শুনে সকলেই অবাক! থিয়েটারের অভিনেতারাই তাকে বোঝালেন, এমন প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। থিয়েটার আসবে যাবে, কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় অভিনয়টা ইতিহাসে থেকে যাবে।
৬২ বছর বয়সে তিনি আবার গেলেন সত্যজিৎ রায়ের কাছে। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে অভিনয় করতে সম্মতি জানালেন। আর বাকিটা সত্যিই ইতিহাস হয়ে থেকে গেল। এর পর সত্যজিৎ রায়ের সাথে তিনি ‘জলসাঘর’, ‘দেবী’, ‘পরশপাথর’-এর মতো চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। স্বয়ং সত্যজিৎ রায় পরে বলেছিলেন, “ছবিবাবু না থাকলে ‘জলসাঘর’-এর মতো চিত্ররূপ দেওয়া সম্ভব হতো না। তাঁর অকালে চলে যাওয়ার ফলে এই বিশ্ববরেণ্য চিত্রনির্মাতা কিছু ছবি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ ছবি বিশ্বাস ছাড়া সে ছবিগুলি সম্পূর্ণ করার মতো অভিনেতা ছিলেন না।
১১ই জুন ১৯৬২ সালে এক মোটড়গাড়ী দূর্ঘটনায় ছবি বিশ্বাস মারা যান।
গাড়ির ভেতর ড্রাইভার; সঙ্গে সস্ত্রীক ছবি বিশ্বাস ও তাঁর নাতি। সবাই চলেছেন ছোটো জাগুলিয়ার দেশের বাড়িতে। দিব্যি চলছিল সব। হঠাৎই ছবি বিশ্বাস ড্রাইভারকে সরিয়ে নিজে ধরলেন স্টিয়ারিং। গাড়ি চালাতে তিনি সিদ্ধহস্ত। বেহেড মাতাল অবস্থাতেও তাঁর হাত এতটুকুও কাঁপে না, টানটান হয়ে গাড়ি চালান তিনি। আর ওইদিন তো একদম ফিট ছিলেন। কিন্তু বিধাতাপুরুষের ভাবনা বোধহয় অন্যরকম ছিল। একটা তাড়ির গাড়ি এসে সোজা ধাক্কা মারল গাড়িতে। গাড়ির স্টিয়ারিং সজোরে লাগল ছবি বিশ্বাসের বুকে। কিচ্ছু করা যায়নি। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল হৃদস্পন্দন। অথচ কি আশ্চর্যের, গাড়ির বাকি তিনজনের প্রায় কিছুই হল না! নিজের মস্ত বুক দিয়ে আগলে রাখলেন পরিবারকে।
বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে এই উজ্জ্বল নক্ষত্র চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন তার অভিনয়ের মাধ্যমে।
মনোজিৎকুমার দাস, প্রবন্ধিক। মাগুরা, বাংলাদেশ।