বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যেমন চুল পাকে, ত্বক বিবর্ণ হয়, তেমনি চালশে হল বয়সের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মনে রাখতে হবে চালশে বা প্রেসবায়োপিয়া (Presbyopia) কোনও অসুখ নয়। আবার এটা নিরাময় যোগ্যও নয়। সমাধান হিসেবে চশমা ব্যবহার করতে হবে। এ সমস্যা আজকের নয়। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে অ্যারিস্টটলের লেখনীতে চালশের উল্লেখ মেলে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে চশমার লেন্সের ব্যবহার শুরু হয়। চল্লিশে চালশে কথাটা প্রচলিত হলেও, অনেক সময় দেখা যায় চল্লিশের আগেও চালশে। তবে তার কারণও আছে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে বর্তমানে শতকরা ২৫ ভাগ মানুষ চালশের সমস্যায় ভোগেন। সারা বিশ্বে প্রায় ১৮০ কোটি মানুষ এই সমস্যায় আক্রান্ত।
চালশে কী?
চল্লিশ বছর বা তার আশপাশের বয়সে এসে স্বল্প বিস্তর কাছের জিনিস দেখতে বিশেষ করে তখন লেখা পড়তে কষ্ট হয়। চল্লিশোর্ধ্ব প্রতিটি ব্যক্তিই এ ধরনের একটি সাধারণ সমস্যায় আক্রান্ত হন। যার নাম হলো প্রেসবায়োপিয়া। প্রচলিত বাংলায় চালশে। চালশে শব্দটি চল্লিশ থেকে এসেছে। চালশে কোনো অসুখ নয়। এটি স্বাভাবিক দৃষ্টির ত্রুটি, যা বয়স্ক প্রতিটি মানুষেরই কমবেশি হয়। একটু বয়স্ক (চল্লিশ বা তদূর্ধ্ব) ব্যক্তিদের স্বাভাবিক দর্শনের নিকটবিন্দু ২৫-৩৫ সে.মি.। স্বাভাবিক বয়োবৃদ্ধির কারণে এ নিকটবিন্দু দূরে সরে যাওয়ার নাম চালশে। এর ফলে কাছের বস্তু দেখতে অসুবিধা হয়। পড়াশোনা ও সূক্ষ্ম কাজে ব্যাঘাত ঘটে।
চালশে কেন হয়?
চোখের উপযোগী বা প্রতিবিম্ব স্থাপন ক্ষমতা ক্রমে হ্রাস পাওয়ার কারণে এমন হয়। নিকটবর্তী বস্তু দেখার জন্য চক্ষু লেন্স এবং পেশির সমন্বয় ঘটানোর নাম উপযোজন। উপযোজন ক্ষমতা হ্রাস পায় বেশকিছু কারণে। প্রথমত, লেন্স শক্ত হয়ে গেলে। দ্বিতীয়ত, লেন্স ক্যাপসুলের স্থিতিস্থাপকতা কমে যাওয়ার জন্য। তৃতীয়ত, সিলিয়ারি (Ciliary) পেশির (চক্ষুপেশি) দুর্বলতার জন্য। মনে রাখতে হবে এগুলো সব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তাই বয়স বাড়লে এমনটি ঘটবে।
চালশের লক্ষণসমূহ কী কী?
ছোট ছোট লেখা যেমন বই, পত্রিকা ইত্যাদি পড়তে অসুবিধা হওয়া। সাধারণত মৃদু আলোয় এ অসুবিধা বেশি হয়। যারা সূক্ষ্ম কাজ করেন তাদের কাজে অসুবিধা হওয়া। যেমন : সেলাই করা, জাল বোনা ইত্যাদি। মাথাব্যথা অন্যতম একটি লক্ষণ। মাথাব্যথার অন্য কোনো কারণ না পাওয়া গেলে এবং বয়স চল্লিশের বেশি হলে অবশ্যই চালশের কথা চিন্তা করতে হবে এবং চক্ষুবিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ নিতে হবে। চল্লিশ এবং চল্লিশোর্ধ্ব সবাই চালশেতে আক্রান্ত হন। কিন্তু যাদের দূরের জিনিস দেখতে সমস্যা থাকে তারা অনেক সময় বার্ধক্যজনিত দৃষ্টিত্রুটি তথা চালশের ব্যাপারটি নাও বুঝতে পারেন। যাদের সূক্ষ্ম কাজ এবং পড়াশোনা করতে হয় না, তাদের ক্ষেত্রে চালশে সাধারণত অপ্রকাশিত থাকে।মনে রাখতে হবে উন্নত প্রযুক্তি র আশীর্বাদে নিত্য নতুন মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও অ্যান্ড্রুয়েড ফোনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে আমাদের চোখের শুষ্কতা বেড়ে যাচ্ছে। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে আমরা বলি ‘ড্রাই আইস’ (Dry eyes)। এটা থেকে সচেতনতা জরুরি।
চল্লিশের আগেও কি চালশে হতে পারে?
চল্লিশের আগেও চালশে হতে পারে। একে আর্লি প্রেসবায়োপিয়া বলা হয়। এটি স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই চক্ষুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে এবং গ্লোকোমার পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের (Diabetes) ব্যাপারটিও মাথায় রাখতে হবে। ডায়াবেটিসের পরীক্ষা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
চালশে অসুখ নয়, তাহলে চিকিৎসা কী?
চালশের চিকিৎসাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমত, নন সার্জিক্যাল চিকিৎসা এবং গোলাকার উত্তল লেন্স দিয়ে চিকিৎসা। তবে দূরের বস্তু দেখতে অসুবিধা থাকলে সেটিরও চিকিৎসা দেওয়া হয় প্রয়োজনীয় ক্ষমতার লেন্স ব্যবহার করে। বয়স অনুযায়ী এসব ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন লেন্স দিয়ে থাকেন ডাক্তাররা।
দ্বিতীয়ত, চালশের জন্য কিছু সার্জিক্যাল চিকিৎসাও রয়েছে। এই ব্যবস্থাগুলো জনপ্রিয় নয় এবং ব্যয়সাপেক্ষ। এগুলো খুব কম ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। বয়স বাড়লে যেমন চুল পাকে তেমনি চোখের কার্যক্ষমতাও কমে যায়। সঠিক চিকিৎসা, সাবধানতা এবং নিয়মিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করলে সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব।
পরিশেষে বলতে হয় একমাত্র নিয়মিত চোখ পরীক্ষার মাধ্যমেই ঠিকঠাকভাবে অসুখ ধরা পড়তে পারে। তাই প্রতি দু’ মাস বা প্রতি এক বছর অন্তর চোখের ডাক্তারের পরামর্শ নিন। চোখে কোনও সমস্যা না থাকলেও। মনে রাখতে হবে চোখের একটি ক্ষুদ্র সমস্যা অনেক সময় বৃহৎ ও জটিল করে তোলে। চোখের পাওয়ার কোনও রোগ নয়। বিশেষ করে চল্লিশ বছর যারা পার করেছেন। সচেতন থাকতে হবে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিক, হাতেপায়ে গাঁটে গাঁটে ব্যথা ও থাইরয়েড যাদের আছে। চোখের নজর কমে গেলে, চোখে কাজল লাগিয়ে কিচ্ছু হবে না। চোখের যে কোনও সমস্যা দেখা দিতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
ডা. তনুশ্রী চক্রবর্তী,
মোবাইল-৬২৮৯৭৭৬৭৪৭,
দৃষ্টিদীপ আই হসপিটাল,
ডানকুনি, হুগলি
সাক্ষাৎকার : মোহন গঙ্গোপাধ্যায়