“এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক।
এসো এসো… ”
বৈশাখের খরতাপে হৃদয় তৃষা হানলেও আমার ছোটবেলার সকালে রেডিওতে গানটা শুনে শুরু হতো পয়লা বৈশাখের সূচনা। দিনকালটা ছিলো একটু আলাদা। তখনো রাস্তায় অটো নামেনি, দুধকে প্লাস্টিকের প্যাকেটে বন্দি করা যায়নি, চাউমিনের জন্ম হয়নি, আল্ট্রামডার্ন হওয়ার জন্য জিন্সের প্যান্ট ছিঁড়তে হয়নি বা খুব সচেতন মানুষও জল কিনে খাওয়ার কথা ভাবেনি। নতুন বছর আসবে বলে সেই আছিলায় ঘর ঝাড়াপোঁছা চলতো। নতুন জামা, নতুন ক্যালেন্ডার, লাড্ডু আর রঙিন শরবত পাওয়ার জন্য অগ্নিস্নানই সই, কালবৈশাখিতেও ভয় নেই, গগন বিদীর্ণ করে চিৎকার করে গাইতাম, ‘এসো হে বৈশাখ।’
পয়লা বৈশাখের প্রতিটি ভাঁজে জড়িয়ে আছে বাঙালির নস্টালজিয়া, ভালোবাসা, ভালোলাগা। শুধু মাছে-ভাতে-মিষ্টিতে বাঙালি নয়, বরং তার সঙ্গে গান-বাজনা, কেনাকাটার প্রতিটি পর্বের সঙ্গে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বাঙালির পয়লা বৈশাখ।
চৈত্র মাসে শহরের অধিকাংশ দোকানে ক্রয়ের উপর দেওয়া হয়ে থাকে বিশেষ ছাড়, যার প্রচলিত কথ্য নাম ‘চৈত্র সেল’। তাই পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে এবং এই ছাড়ের সুবিধা গ্রহণ করতে অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ একমাস ধরে নতুন জামাকাপড়, বাসন, আসবাবপত্র ইত্যাদি কেনাকাটা করে থাকে।
আমাদের ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখের বিকালে গা ধুয়ে নেবার পর আমরা ছোটরা পরতাম চৈত্র সেলে কেনা একটু বড় মাপের নতুন জামা, মা পরতো নতুন ফোলা তাঁতের শাড়ি গায়ে সুগন্ধি পাউডার মেখে আর বাবা, কাকারা পড়তো নতুন ফতুয়া বা পাঞ্জাবি।
আসলে, চৈত্র সেলের সঙ্গে বাঙালির এক অদ্ভুত নস্টালজিয়া জড়িয়ে আছে, তা অধুনা শপিং মল হোক বা ফুটপাত। হারজ্বালানি গরমেও তাই বাঙালি সগৌরবে কেনাকাটা চালিয়ে যায়।
কিছু বছর আগেও গরিয়াহাট, হাতিবাগান, এসপ্ল্যানেড চত্ত্বর জুড়ে শুধু নয়, মফস্বলেও চৈত্র মাস জুড়ে ভিড়ে ঠাসা থাকত সেলের বাজার। ভিড়ের ঠেলায় দোকানির ঘাম লেগে যেত খদ্দেরের গায়ে। বিশেষ করে সন্ধ্যায় নামতো জনসমুদ্রের ঢাল। রাস্তায় ঢালাও বিক্রি হতো বিছানার চাদর থেকে হাতাখুন্তি, চিরুনি থেকে খেলনা বন্দুক, লুঙ্গি থেকে টুথপিক, জামা, কাপড়, জুতো থেকে আরম্ভ করে আরো কত কি!
সময় বদলের সঙ্গে পাল্টে গেল চৈত্রের ভিড়ে ঠাসা রাজপথ। ভিড় কমতে থাকলো এতটাই যে ট্রাফিক চলাচল করলো অনায়াসে প্রথমে শহরে পরে মফঃস্বলে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চৈত্রের সেলে থাবা বসিয়েছে অনলাইনে মানুষের কেনাকাটার অভ্যাস। এমনি করোনা আবহে কেনাকাটায় ভাটা পড়েছিলো। তার উপর চলে সারা বছরই নানান ডিসকাউন্ট। এখনতো ‘চৈত্র সেল’ বদলে হয়েছে ‘এন্ড অফ সিজিন সেল’।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন হয়েছে সেল’-এর কৌশলে। ব্র্যান্ডেড কোম্পানি, বড় বড় স্টোর ও বিশেষ করে বুটিকগুলি সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে তাদের প্রোডাক্টগুলি ক্রেতাদের নজরে নিয়ে আসছেন। এদের ফেসবুকে ফ্যান ফলোয়ার প্রচুর। ইউটিউব মারফৎ এদের ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাস্টমারদের সম্পর্ক আরো নিবিড় হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ছোট ছোট উদ্যোগগুলিও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এমন অনেক মাঝারি ও ছোট দোকাদার আছেন, যাঁদের এই বিক্রির উপর সারাবছরের ব্যবসা নির্ভর করে থাকে। তাঁরাও এখন সোশ্যাল মিডিয়ার সুবিধা নিয়ে নিজের পণ্যের বিপণন করতে পারছেন। এইগুলো থেকে এটাই প্রমাণিত যে সোশ্যাল মিডিয়া উৎসব ইকোনমিক্স-এ বেশ বড়ো ভূমিকা নিয়েছে।
আবার অনেকেই মনে করে চোখে দেখে হাতে নিয়ে পছন্দ করে কেনাকাটার একটা আলাদা মজা আছে। এখানেই স্বার্থত্যাগ করলে অনলাইন শপিংয়ের সুবিধা পাওয়া যাবে। অনেক স্টোরের মালিকরা চাইছেন না স্টোরে এসে ট্রায়াল দিয়ে লোকজন জিনিসটা কিনুক। এতে ঝক্কি বেশি। তাছাড়া অনলাইন শপিংয়ে জিনিষ পছন্দ না হলে ফেরৎ বা রিটার্ন অপশন তো থাকেই।
বাংলা নববর্ষ শুরু হওয়ার আগে জিনিসপত্র কেনাকাটার জন্য ‘সেল’ পাগল বাঙালির উন্মাদনা অনেকটাই পাল্টিয়ে গেছে। তবু চৈত্র সেলের প্রতি আবেগ বাঙালির হাড়ে-মজ্জায়। পয়লা বৈশাখে ফুলের মালা, আমপাতা ও রঙিন কাগজে সেজে ওঠে ছোট দোকান থেকে বড় বড় শপিংমলগুলো। বাংলা গান-পোশাক-রান্নার মাধ্যমে পয়লা বৈশাখের হাত ধরে নিজস্ব সংস্কৃতির কাছে অন্তত এই এক দিনের জন্য হলেও পুরোন মেজাজে জমে ওঠে বাঙালির পয়লা বৈশাখ৷
Sale sale….idea korun
A popular dialogue
একদম। থ্যাংক ইউ।
অপূর্ব *চৈত্র সেল* খুব ভালোলাগা।
Dhonyobad 🌹