লোকসভা নির্বাচন পেরনোর অর্ধবর্ষ পেরতেই বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’য় ভাঙন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জোট গঠনের গোড়াতে কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল তৃণমূল, তারপর সমাজবাদী পার্টি। এরপর একে একে প্রায় সব আঞ্চলিক দলই কংগ্রেসের বিরোধিতা করে। সম্প্রতি সেই তালিকায় যোগ হয়েছে শিব সেনার উদ্ধব শিবির। একই সঙ্গে জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিহারের প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদব, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অখিলেশ যাদব, অরবিন্দ কেজরিওয়াল প্রকাশ্যে বলছেন ইন্ডিয়া জোটের আর অস্তিত্ব নেই। বিশেষ করে দিল্লির বিধানসভা ভোটের আগে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি জোট থেকে কংগ্রেসকে বহিষ্কার করার দাবি তোলায় ‘ইন্ডিয়া’ জোটের মধ্যে যে বড় ধরনের ফাটল তৈরি হয়েছে সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না। উল্লেখ্য, কেজরির দল ইতিমধ্যে ‘ইন্ডিয়া’র সহযোগী দলগুলির কাছে ওই বার্তা পাঠাতে শুরু করেছে।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপিকে হটাতে সর্বসম্মিলিতভাবে অবিজেপি দলগুলি একজোট হয়ে ‘ইন্ডিয়া’ জোট তৈরি করেছিল। সেই জোটে কংগ্রেসের নেতৃত্বে চলা ইউপিএ-র দলগুলি ছাড়াও সামিল হয়েছিল সমাজবাদী পার্টি, তৃণমূল, ওমর আবদুল্লার ন্যাশনাল কনফারেন্স, বাম দলগুলি। উল্লেখ্য সামিল হয়নি অন্ধ্রের ওয়াইএসআর কংগ্রেস, ওড়িশার বিজেডি ও তামিলনাড়ুর এআইএডিএমকে। কিন্তু গোড়াতেই সেই জোট নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছিল। তবে বিরোধিতা, অস্বস্তি সত্ত্বেও জোটে অংশ নেওয়া দলগুলি কংগ্রেসের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল। যদিও জেডিইউ নেতা নীতীশ কুমারের দিক থেকে প্রথম ধাক্কা আসে যখন তিনি জোট ছেড়ে বেরিয়ে বিজেপির হাত ধরেছিলেন। তবে জোটে নীতিগতভাবে সবাই বিজেপি বিরোধিতায় সম্মত থাকলেও বিভিন্ন রাজ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে শরিকদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়। যেমন বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূল আসন সমঝোতা করতে রাজি হয়নি। অথচ সেই বাংলাতেই কংগ্রেস ও সিপিএম ভোটে লড়েছিল জোট বেঁধে। দিল্লি, হরিয়ানা ও চণ্ডীগড়ে আপ আর কংগ্রেস সমঝোতা করলেও পাঞ্জাবে তারা একে অন্যের বিরুদ্ধে ভোটে লড়াই করে।অন্যদিকে রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি আর কংগ্রেসের মধ্যে আসন সমঝোতা না হলেও উত্তর প্রদেশে তারা একজোট হয়ে লড়েছিল।
জোটের মধ্যে যে চাপা অসন্তোষ ছিল তা প্রকাশ্যে উঠে আসে, সেই সঙ্গে কংগ্রেসের রাজনীতি ও তার নেতৃত্ব দেওয়ার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে লোকসভা ভোটের পাঁচ মাস পেরতে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা বিধানসভায় বিজেপির নিরঙ্কুশ জয় এবং জম্মুতে কংগ্রেসের ব্যর্থতায়। সেই প্রশ্ন নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে দিল্লির ভোটে কারণ, কংগ্রেস ও আপ এবার দুই যুযুধান শিবির। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কংগ্রেস নেতা অশোক গেহলট বলেছেন, দিল্লিতে আপ তাঁদের প্রধান প্রতিপক্ষ। আর তার পাল্টা জবাব দিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছেন, এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, আপকে হারাতে আসলে কংগ্রেস বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। এই পরিস্থিতি কংগ্রেসের পক্ষে অস্বস্তিকর তাই তারা জানিয়েছে, লোকসভা নির্বাচনের জন্যই ইন্ডিয়া জোট তৈরি হয়েছিল। বিধানসভা নির্বাচনে লড়াইয়ের জন্য ইন্ডিয়া জোট তৈরি হয়নি। তাছাড়া বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে কে কোথায় জোট বেঁধে লড়বে, তা সেই রাজ্যের পরিস্থিতি অনুযায়ী কংগ্রেস ও আঞ্চলিক দলের নেতৃত্ব ঠিক করবে। এর আগে দিল্লির ভোটে আপকে সমর্থন জানায় সমাজবাদী পার্টি, তারপর তৃণমূল দিল্লির ভোটে আপকে সমর্থন জানায়। সবশেষে উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা আপ-কে সমর্থন জানিয়েছে। উদ্ধবের শিবসেনার নেতা সঞ্জয় রাউতের যুক্তি, দিল্লিতে আপ বড় দল। তাই বিজেপিকে হারাতে আপ-কেই সমর্থন দেওয়া উচিত। তৃণমূলের সাংসদ কীর্তি আজাদের বক্তব্য, প্রয়োজনে তৃণমূল দিল্লিতে আপ-এর হয়ে প্রচার করবে।
তবে শিব সেনার উদ্ধব শিবিরের নেতা সঞ্জয় রাউতের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, জোট বাঁচানোর পুরোপুরি দায় তিনি কংগ্রেসের উপরই ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ, তাঁর কথা, “আমরা একসঙ্গে লোকসভা ভোটে লড়লাম। ফলাফলও ভালো হয়েছিল। কিন্তু সেটার পর আমাদের সবার দায়িত্ব ছিল ইন্ডিয়া জোট বাঁচিয়ে রাখার। বিশেষ করে কংগ্রেসের।” সেইসঙ্গে তিনি এও বলেন, “কংগ্রেসের দায়িত্ব ছিল জোটের স্বার্থে সবার সঙ্গে আলোচনা করা। একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া। কিন্তু এখনও পর্যন্ত লোকসভার পর একটা ছোট বৈঠকও হয়নি।” কিন্তু এসব কথায় যে জোটের ভাঙন রোধ করা যাবে না সেটাও স্পষ্ট। কারণ, যত দিন যাচ্ছে ততই ইন্ডিয়া জোটে ভাঙনের জল্পনা বাড়ছে। এ বিষয়ে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা প্রকাশ্যেই বলেছেন, যেভাবে চলছে তাতে ইন্ডিয়া জোট ভেঙে দেওয়াই উচিত। তেজস্বী যাদবের কথাতেও ভাঙন জল্পনা উসকে গিয়েছে। বিহারের প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী বলেন, ইন্ডিয়া জোট শুধু লোকসভার জন্য তৈরি হয়েছিল। এবার সঞ্জয় রাউতও একই রকম কথা বললেন। জোটের প্রশ্নে কংগ্রেসের উপর চাপ বাড়ছে তো বটেই অন্যদিকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, দিল্লি ভোটের পর ইন্ডিয়া জোটের ভাঙন নিশ্চিত। কারণ দিল্লিতে আপ জিতলে কেজরী বলবেন, কংগ্রেস বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিরোধিতা করলেও তারা ভোটে জিতেছেন। আবার হেরে গেলে বা আসন কমলেও তিনি কংগ্রেসকেই দায়ী করবেন। ফলে দিল্লি বিধানসভার ভোটই বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র অস্তিত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। গত লোকসভা ভোটে বিজেপিকে রুখতে যে জোট গঠিত হয়েছিল, দিল্লিতে তারই দুই শরিক কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টি দিল্লি বিধানসভা ভোটে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেই জোটের ভাঙনকে তরান্বিত করলো।