এবারের শীতে ছাদবাগানে অনেক ফুল ফুটিয়েছে কাবেরী। সালভিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, অ্যাস্টর, প্যানজি। মরশুমী ফুলেদের রঙের বাহারে তাদের ছ্যাৎলা ধরা বিবর্ণ ছাদও যেন হৃতযৌবন পেয়ে গেল।
কাবেরীও পঁচিশবার লাফিয়ে লাফিয়ে ছাদে গিয়ে গাছগুলো দেখে আসে। মেরুন চন্দ্রমল্লিকাটা এদ্দিনে একটু একটু করে পাপড়ি মেলছে! তার গর্ব হয়, বাজারের অ্যাস্টরের সব রঙ এবার ওর বাগানে। স্বাস্থ্যবতী গাঁদাগুলো দেখে যেন চোখ ফেরানো যায় না। ব্যস পটাপট ছবি আর ফেসবুকে পোস্ট। বেশ কয়েকটা লাইক, লাভ সাইন পড়ে। মোটামুটি গোছের কয়েকটি মন্তব্য।
বান্ধবী কাজরী বলল
— ধুর এত মেহনত করে ফুল ফোটালি, এমন সাদামাটা পোস্ট করলে চলে! রীল বানা।
— আমি ভালো পারি না যে। উল্টোপাল্টা হয়ে যায়।
— মেয়েকে বল শিখিয়ে দেবে।
— বলেছি। শেখায় না রে। মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়! মাঝেমধ্যে দেখি নিজেও কত কি পোস্ট করে। তুইই আমাকে শিখিয়ে দে না কাজরী!
— শেখাব। বিরিয়ানি খাওয়াবি বল!
কাজরী রীল মাস্টার। সে কাবেরীকে শিখিয়ে দিল ভিডিওর চলনসই এডিটিং। “ফুল বলে ধন্য আমি” গানের সঙ্গে তার ফুলেরা বেশ হাওয়ায় দুলতে লাগল। দেখে তো কাবেরী আত্মহারা! বাড়ল তার পোস্টের রিচ। লাভ-লাইক পাওয়া দ্বিগুণ থেকে চৌগুণ হল।
কাজরী এখন কাবেরীর রীলগুরু। এবার ইউ টিউবের পথে কাবেরী। সাবস্ক্রাইবার, বেল আইকন নতুন নতুন শব্দ ঢুকছে তার মগজাভিধানে।
— এইসব দেখিয়ে পয়সা রোজগার করা যায়!
কাবেরী হতবাক।
— যায় তো! দর্শককে নতুন নতুন আইটেম দেখাবি। পুজো করা থেকে নাচাগানা। কিচেন থেকে বেডরুম। চাইলে বরের সঙ্গে প্রেম।
— ধ্যাৎ, কি যে বলিস!
— ন্যাকা !দেখিস নি নাকি এসব ফেসবুকে। আচ্ছা, তুই নাচ শিখতিস না বিয়ের আগে? নাচের ভিডিও ছাড় এবার।
— মাথা খারাপ নাকি তোর! যা মুটিয়েছি! এই হাতির নাচ কে দেখবে!
— দেখবে না শুধু, গিলবে!
এসব কথা শুনে কাবেরীর “নৃত্যরসে চিত্ত মম উছল হয়ে বাআআজে”।
প্রথম প্রথম ধূমায়িত ধোঁকার ডালনা, হৃদয়াকার এঁচোড়ের কাটলেটে সেজে উঠল কাবেরীর ইউ টিউব ভিডিও। দর্শক বাড়তে লাগল।
কাবেরীর দর্শকরা এবার দেখল বিয়েবাড়ি যাবার আগে কাবেরীর দই-বেসন-মধুর রূপটান। সাজগোজের শেষে বর শ্রীকান্ত নিমরাজি হয়ে দাঁড়ায় কাবেরীর পাশে। মুখে বোকাবোকা হাসি। পরনে ভুঁড়ি অবধি জবরদস্ত কাজ করা মেরুন পাঞ্জাবি।
মেয়ে টুকি কিছুতে আসতে চায়না তার ভিডিও তে। ঠোঁট উল্টে বলে, “আমার ভাল্লাগে না। তুমি যা খুশি করোগে যাও। আমাকে টানাটানি করছ কেন?”
পুরীর নীল সমুদ্রে কাবেরী ঢেউয়ের মাথায় নাচে। বরের কোমর জড়িয়ে লাফালাফি করে। বালিতে শুয়ে সানবাথ নেয়। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজে, ‘আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন। যেন ঐ চোখে সাগরের নীল।’
মেয়ে টুকি কিছুতেই ওদের সঙ্গে ছবি তুলল না। ‘মাই ফ্যামিলি, মাই লাইফ’ ক্যাপশন দিয়ে ছবি এখনো পোস্টানো হল না কাবেরীর।
টুকিটা কাবেরীর মাথা ছাড়িয়ে লম্বা হয়েছে অনেকদিন। সেই নিজের লম্বা মেয়েটার মাথায় আজকাল কি যে চলে, সে কথা মায়ের বোধের অগম্য। দিন দিন কিরকম জেদী হয়ে যাচ্ছে। কথায় কথায় তর্ক করে। পেটের মেয়েটাও যেন আর নিজের রইল না। আজকাল চারপাশটা বড্ড ফাঁকা লাগে কাবেরীর। সেই ফাঁকা জায়গা থেকেই রীল ভরে নিচ্ছে তার এলোমেলো ইচ্ছেগুলো।
দর্শকের মনও অবশ্য বোঝা ভার। রান্নাবান্না, সাজগোজ, বেড়ানোর ছবি দেখতে দেখতে দু’দিনেই মুখ ফিরিয়ে নিল ভিউয়াররা। কাবেরীর রীলের রীচ কমতে লাগলো। আবার দ্বারস্থ কাজরীর।
— এবার একটু নাটক কর।
— সে আবার কি?
— এই যেমন মন খারাপের নাটক করে অন্ধকারে শুয়ে থাক। তারপর আস্তে আস্তে উঠে জানলার পর্দা সরাবি। এলোমেলো চুল। লুটোনো আঁচল। উদাস হয়ে তাকিয়ে রইলি জানলার বাইরে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজবে, ‘এ মন আমার হারিয়ে যায় কোনখানে। কেউ জানেনা কেউ জানে না মন জানে ….।
লোকে বেশ নিল কাবেরীর নায়িকার ভূমিকা। নায়িকা এবার আরো সাহসী। বরের সঙ্গে মিছিমিছি ঝগড়ার নাটক। বুকের আঁচল সরিয়ে, বরের গলা জড়িয়ে আব্দার ভিউয়াররা বেশ খাচ্ছে। “বৌদি চালিয়ে যাও। কি প্রেম বাবা তোমাদের!” এইসব কমেন্টসে উৎফুল্ল কাবেরী ।
আশার পারদ চড়ছে চড়চড় করে। পাড়ার বিউটি পার্লার ক্রমাগত কাবেরী কে লোভ দেখায় সোনারুপোমুক্তো ফেসিয়ালের। ফোটোশপে তার নাক চোখ ধারালো হচ্ছে। ঠোঁটে ফুটে উঠছে লাস্য। ইউ টিউবের এক্সারসাইজ ভিডিও তার মেদ ঝরাচ্ছে। দই আর শসা এখন সর্বদা কাবেরীর ফ্রীজে মজুদ। রীল দেখিয়ে যে আমদানি হচ্ছে তাতেই ডিজাইনার ব্লাউজ, জাঙ্ক জুয়েলারী হয়ে যায়। বরের কাছে হাত পাততে হয় না।
এর মধ্যে ননদ রূপা ফোন করে কথা শোনাল, “কিসব শুরু করেছ বলতো আজকাল বৌদি। লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছ নাকি! তোমার জন্যে শ্বশুরবাড়িতে তো আমার মুখ দেখানো দায়!”
কাবেরীও ছেড়ে কথা বলল না, “তোমার ভারি হিংসে হচ্ছে না! কে আমার জ্ঞান দেবার গোঁসাই এলেন রে! তুমি চুপ থাকো। বিয়ের আগে তোমার কীর্তিকলাপের কথা কারোর তো আর জানতে বাকি নেই!”
এইসব মনখারাপ, অশান্তি কাটাতেই তো রীল বানানো। নিজেকে নতুন রূপে আবিষ্কার করা!
মেয়ে আর বরের জন্যে সামান্য রান্নাবান্না সেরে আয়নার সামনে দাঁড়ালেই ভুলে যাওয়া নাচ আজকাল কাবেরীর আবার বেশ মনে পড়ে যায়।
ওদিকে কাবেরীর ছাদের সাজানো বাগান শুকিয়ে যাচ্ছে। ফুলেরা অযত্নে ম্রিয়মাণ। সংসারের আনাচেকানাচে ধুলো। ঘরের কোণে মাকড়সার ঝুল।
টুকি অবশ্য নিয়ম করে ছাদের গাছে জল দিয়ে আসে। এর থেকে বেশি আর সময় পায় না। ওর জন্যেই কাবেরীর পরিত্যক্ত গাছগুলো এখনো মরেও বেঁচে আছে।
কাবেরী মাথায় এখন নাচের রীল। অনেকবার ট্রায়াল এন্ড এরর হোলো। কোন গানের সঙ্গে যে নাচা যায়!
আরে মেয়েও একটা নাচের ভিডিও ছেড়েছে যে! এই গানটা এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব পপুলার। টুকিটাও বেশ নাচে। তবে ছোটো তো এখনো। এক্সপ্রেশন অতটা ভালো দিতে পারে নি। আমি ওর থেকে আরো ভালো নাচব।
আলমারি থেকে গতবছর পুজোয় কেনা নীল হ্যান্ডলুমের নরম শাড়িটা বে’র করে একবার শুঁকল কাবেরী। মেকআপের ভিডিও শিখিয়েছে নীলের সঙ্গে গোলাপী লিপস্টিক বেশ যায়। হালকা নীল আইশ্যাডো আর পার্লসেটে নিজেকে সাজিয়ে আয়না থেকে আর চোখ ফেরাতে পারে না কাবেরী। চুলটা খোলা রাখে। বন্ধুরা বলে খোলা চুলেই তাকে ভালো মানায়।
মোবাইলটা ঠিকঠাক অ্যাঙ্গেলে রেখে রাধার লাস্য ফুটিয়ে তুলল কাবেরী।
“যদি দেখার ইচ্ছা হয়
তোমার নিঠুর মনে লয়
কালিন্দীর ঘাটে আইসো দুপুরের সময়।
আমি জল ভরিবার ছল করিয়া
দেখব নয়ন ভরিয়া….”।
“কি করেছেন বৌদি! মা আর মেয়ে যে একবারে ফাটিয়ে দিয়েছেন! কাকে ছেড়ে কাকে দেখি! তবে আপনার পাল্লাই কিন্তু ভারি যাবে বলে দিলাম। হেভি সেক্সী লাগছেন”,
চোখ কুঁচকে অশ্লীল ইঙ্গিত করল চায়ের দোকানের বালু।
বালুর কথা একেবারে ফেলনা নয়! আমি তাহলে ভালো নেচেছি টুকির চেয়ে! টুকি কি ভাবে আমাকে! মা’ টা ফ্যালনা। ওই সব পারে!
অতসী বৌদি একগাল হেসে বললো,
— তোমাদের দুজনের নাচ খুব ভালো হয়েছে। তোমারটা অবিশ্যি বেশি ভালো। একসঙ্গে প্রাকটিস করেছ নাকি!
— না বৌদি, ও ওর মত করেছে। আমি আমার মত।
— আচ্ছা, তুমি কিন্তু আরো ভালো নাচো। কি সুন্দর এক্সপ্রেশন, ইশারা! মেয়েকেও একটু শিখিয়ে দিও।
একগাল হাসল কাবেরী। বিজয়িনীর হাসি। প্রশংসা এল তার রীলগুরু কাজরীর কাছ থেকেও।
— তোকে বলেছিলাম না, নাচটা তুই ভালোই পারিস। তুই তো সেলিব্রেটি রে এখন। চালিয়ে যাও বস্।
— তোকে চুমু রে! তুইই তো সাহস যোগালি!
লাভ, লাইক আর কমেন্টের ঝড় বইতে লাগল কাবেরীর নাচের রীল জুড়ে।
“একেবারে শ্রীরাধা লাগছ।” “বৌদি যে একেবারে দুপুরে-রাধিকা হয়ে গেলে। তা কেষ্ট ঠাকুরটি কোথায়?”। “এত প্রেম বুকের মধ্যে জমা ছিল”, “সিনেমা-সীরিয়ালে এবার ট্রাই করুন”…..এইসব মন্তব্যে ছয়লাপ কাবেরীর মুঠোফোন।
দেখি মেয়েটার ভিডিও কেমন রেসপন্স পেল! আসলে তো এই নাচের ইন্সপিরেশেন ওইই।
ওমা, ফেসবুক-ইন্সট্রাতে টুকিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন! তবে কি…, ব্লক করেছে বোধহয়। যাক গে। মেয়ের মনের তো তল পাওয়া ভার। তবে আমি যে বেটার নেচেছি, সেটা তো প্রমাণ হয়ে গেছে!
বিজয়ী কাবেরী এখন আনন্দে আত্মহারা। হাতের মোবাইলটাকে একটা চুমু খেল। তারপর আবার মোবাইলে নিজের নাচ, কমেন্টস্ গুলো বারবার দেখতে দেখতে কখন যে সুখনিদ্রায় চলে গেছে জানেনা। ঘুম ভাঙল যখন, ঘড়িতে তখন বিকেল পাঁচটা। শীতের বিকেল তখনই ঘর অন্ধকার করে দিয়েছে।
আরে, এত দেরী হয়ে গেল টুকি এখনো ইস্কুল থেকে ফিরল না কেন! আজ তো ওর কোনো টিউশন নেই! কোথায় গেল তবে!
— হ্যালো হ্যালো রিক্তা, টুকি মানে পৌষালীর মা বলছি। হ্যাঁ রে পৌষালী আজ তোদের সঙ্গে ইস্কুল থেকে ফেরেনি!
— না আন্টি। পৌষালী বাড়ি আসেনি এখনো? স্কুলবাসে ওকে তো আমি দেখিনি।
রিক্তা এবার একটু চুপ করে রইলো। তারপর যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলল,
— একটা কথা বলব আন্টি! ওর দিনটা কিন্তু আজ একদম ভালো যায় নি। ক্লাসে সবাই বেচারীকে খেপাচ্ছিল। ও রেগে যাচ্ছিল। কাঁদছিল।
— কেন রে!
— তোমরা যে একই গানে নাচের রীল বানিয়েছ আন্টি। সে নিয়ে খুব মজা করছিল মেয়েরা। ঠাট্টা করছিল।
কাবেরী ধপ করে বসে পড়ল। মাথা ঘুরছে। চোখে অন্ধকার। কোথায় খুঁজবে রাগী-জেদী মেয়েটাকে! কার কাছে যাবে! পাগল পাগল লাগছে কাবেরীর। শীত রাতের ঠান্ডা জমাট বাঁধছে ঘরে-বাইরে। বুকের মধ্যে কে যেন হাতুড়ি পিটিয়ে পিটিয়ে বলছে,
— এটা কি করলি তুই! শেষে মেয়ের সঙ্গে কম্পিটিশনে নামলি!
— না না, আমি তো রীল বানিয়ে নিজের আনন্দ খুঁজে নিতে চেয়েছিলাম শুধু।
— মিথ্যে কথা। মিথ্যে কথা। নিজেকে প্রশ্ন কর। মেয়েকে দেখাতে চেয়েছিলিস তুই, দ্যাখ আমিও পারি। এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামলি তুই।
— না মানে আমি বুঝতে পারিনি।
— হ্যাঁ তুই বোকা। হদ্দ বোকা। শস্তা মোহের লোভে তুই সব হারালি। সব। ভালোবাসা, মানসম্মান, সংসার, পরিজন তোর নিজের বলে আর কিচ্ছু রইল না…
আর সহ্য হল না কাবেরীর। দরজা খুলে উদভ্রান্তের মত বাড়ির বাইরে সে বেরিয়ে গেল। কোথায় যাবে সে! কোন দিকে! আবার কবে সে ফিরিয়ে আনতে পারবে তার হারিয়ে যাওয়া সব কিছু!
বাহ্ খুব ভাল লিখেছ