ব্রিটিশরা এদেশে ১৮৮১ সালে প্রথম জনগণনা করে। তারা ভেবেছিল, যদি দেশের জনগণের তথ্য জানা যায়, তা হলে শাসন প্রক্রিয়া অনেক সুবিধাজনক হতে পারে। উল্লেখ্য, ভারতীয় সমাজকে বোঝার জন্য ব্রিটিশ শাসক ১৮৭১-৭২ সালে জনসংখ্যা জরিপের সময় জাতি বা বর্ণ গণনার পদ্ধতি শুরু করে। ১৯৩১ সালের আদমশুমারিতে সর্বশেষ প্রকাশিত বর্ণ গণনায় ৪, ১৪৭টি বর্ণ রেকর্ড করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪১ সালের আদমশুমারিতেও বর্ণের তথ্য ছিল কিন্তু তা কখনও প্রকাশ করা হয়নি। স্বাধীন ভারতে ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে জওহরলাল নেহেরু সরকার ভারত একটি ঐক্যবদ্ধ দেশ এবং একটি বর্ণহীন সমাজ বলে বর্ণ গণনা স্থগিত করে। সেই ধারাতেই ২০১১ সাল পর্যন্ত জনগণনা হয়, তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সংখ্যাও গণনা হয়। তবে তফসিলি জাতি ও উপজাতি ছাড়া অন্য কোনও বর্ণ গোষ্ঠীর গণনা করা হয়নি।
বিহার বিধানসভা নির্বাচনের মাত্র ছ’মাস আগে আগামী জনগণনা জাতি-বর্ণভিত্তিক — নরেন্দ্র মোদী সরকারের এই ঘোষণা কেবল আকস্মিক নয় বলা যায় সম্পূর্ণ ইউ-টার্ন। যে এনডিএ সরকার দীর্ঘদিন ধরে বর্ণভিত্তিক জনগণনা দাবির বিরোধিতা করে আসছিল, সেই বিজেপি সরকার পহেলগাম ঘটনা পরবর্তী ভারত ও পাকিস্তানের চরম উত্তেজনার মধ্যে অবাক করেছে আদমশুমারিতে বর্ণ গণনার ঘোষণায়। যে নরেন্দ্র মোদী তাঁর নির্বাচনী সভায় বলতেন, কংগ্রেস জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবি তুলে সমাজকে বিভাজিত করতে চাইছে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ স্লোগান দিতেন, ‘বাটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে’, সেই তারা কেন বর্ণগত আদমশুমারি ঘোষণা করলো।
আসলে বিজেপিকে জাতিভিত্তিক জনগণনা নিয়ে ফিরে ভাবতে বাধ্য হয়েছে ২০২৪-এর লোকসভা ফলাফলে কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া ব্লকে তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর (OBC) ভোট একত্রিত হওয়ায় বিজেপির ভোট ভাগাভাগি কমে যাওয়ায় মাত্র ২৪০-এ থামতে বাধ্য হয়েছে। হয়ত তারা এটাও মনে করছে, জাতি-বর্ণের তথ্য তাদের হিন্দুত্বের ইস্যুটাকেই আরও ভালো ভাবে তুলে ধরতে সহায়ক হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, যারা সংরক্ষণ বিরোধী, তারা যুক্তি দেয় যে, যত বেশি করে বিভিন্ন জাতিকে সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা যাবে, বিভিন্ন জাতির মধ্যে সংরক্ষণের সুযোগ পাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। মহারাষ্ট্রের একনাথ শিন্ডের সরকার ওবিসি-দের মধ্যে ‘ক্রিমি লেয়ার’ সংক্রান্ত একটি আইন পাশ করেছে, ছত্তিসগড় সরকার পঞ্চায়েতে ওবিসি-দের মধ্যে ৫০ শতাংশের জন্য প্রতিনিধি সংরক্ষণ নিয়ে আইন করেছে। বিজেপিও এই জাতভিত্তিক জনগণনাতে তারা কতটা রাজনৈতিক ভাবে লাভ পাবে সেটা দেখতে চাইছে।
জনগণনার পর তারা সংসদের আসনের পুনর্বিন্যাস করবে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, উত্তর ভারতের কিছু রাজ্যের আসনসংখ্যা বাড়বে আর পূর্ব এবং দক্ষিণ ভারতের আসনসংখ্যা কমবে। উত্তর ভারতে হিন্দুত্বেরী প্রভাব ফলে এখানে সংসদের সংখ্যা বাড়া মানে বিজেপির আসনসংখ্যা বাড়া। বিজেপির পক্ষে নিরাপদ নয় দক্ষিণ ভারত, সেখানে সাংসদ কমলে বিজেপি-র খুব একটা রাজনৈতিক ক্ষতি হবে না। পূর্ব ভারতের বাংলাতেও তারা বহু চেষ্টা করেছে, কিন্তু দাঁত ফোটাতে পারেনি অতএব এখানেও তাদের আসন কমলে তেমন ক্ষতি নেই। তাছাড়া এটাও মনে হয় তারা বুঝতে পেরেছে যে সাফল্য পেলেও কেবলমাত্র ঘৃণা আর বিদ্বেষের রাজনৈতিক খেলা খেলে তারা আর তাদের জয়রথ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না, তাই তাদের এ বার অন্য কৌশলের আশ্রয় নিতেই হবে। জাতি ভিত্তিক জনগণনা হয়ত এক্ষেত্রে তাদের সুবিধা করে দিতে পারে।
তাই জাতিভিত্তিক জনগণনা বিরোধী বিজেপি এতদিন প্রত্যাখ্যান করার পর শেষপর্যন্ত তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কারণেই। প্রথমত, গত লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে তাদের ভরাডুবি ভাবিয়েছে। রামমন্দির ইস্যুকে তারা যতবড় করে ভেবেছিল তা থুবড়ে পড়ে বিরোধীদের জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবি জোরালো হয়ে ওঠে পাশাপাশি সংরক্ষণের অধিকার রক্ষার প্রচার আরও জনপ্রিয়তা পায়। দেখাই যাচ্ছে বিহারে নিতীশকুমারের জনপ্রিয়তা অনেকটাই কমেছে, আগামী বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি তার উপর খুব একটা ভরসা রাখতে পারছে না, সেখানে বরং যে রাজ্যে জাতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেখানে ধ্যান জাতি-বর্ণে রাখাই ভাল। ওদিকে কংগ্রেস পরিচালিত কর্ণাটক ও তেলেঙ্গানা রাজ্যে জাতিভিত্তিক জনগণনা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনে তফসিলি জাতি উপজাতি মানুষের একটা বড় অংশ যে মোদীর তোলা ‘চারশো পার’ থেকে যে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল বিজেপির মধ্যে তা আশঙ্কা তৈরি করেছে। বাধ্য হয়েই মোদী সরকার নিজেদের আদর্শগত অহং ত্যাগ করে জাতিভিত্তিক জনগণনায় সম্মত হতে বাধ্য হয়েছে। একে সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক বা আদর্শগত পরাজয় ভাবার কারণ নেই। এতে প্রমাণ হয়, জনগণের চাপ এবং নির্বাচনী প্রয়োজন আদর্শগত গোঁড়ামিরও প্রতিষেধক হতে পারে। আর যদি জাতিগত জনগণনাতে বিজেপির কোনো ক্ষতিও হয়, মহিলা ভোটার এবং আসন পুনর্বিন্যাস করার প্রক্রিয়া তারা হাতে নেবেই, পাশাপাশি যদি ‘এক দেশ এক নির্বাচন’-কে ২০২৯ সাল থেকেই চালু করতে পারে, তা হলে তাদের জয়রথ কে আটকাবে কে?