‘পরশু রাতে পষ্ট চোখে দেখনু বিনা চশমাতে,/ পান্ত ভূতের জ্যান্ত ছানা করছে খেলা জোছনাতে।’
ভূত ছিল, আছে, থাকবে।
এই কথাটা শুনেই অনেকে হাঁ হাঁ, রে রে করে উঠবেন, জানি। কিন্তু ভূত ছিল, আছে, থাকবে।
ভেবে দেখুন ভূত না থাকলে বর্তমান কীভাবে থাকতে পারে, আর ভবিষ্যতই বা কীভাবে থাকবে? ভূত কথাটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অতীত। যার জন্যে কথায় বলে ‘ভূত-ভবিষ্যৎ’। সাধারণত চলতি কথায় ‘ভূত’ বলতে যা বোঝায় অর্থাৎ ‘ভূতপ্রেত’ , তারও উৎপত্তি কী অতীতে নয়? যা ছিল বা যে ছিল, এখন নেই, তাই ভূত।
যে গেছে তার প্রতি একটা টান তো থেকেই যায়। সেই টান থেকেই ধূসর অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সেতুবন্ধনের প্রয়াস আর সেই টান থেকেই মানুষের ভূতচর্চা। ভূত আছে কি নেই, তা নিয়ে বিস্তর বাদ বিবাদ বহুকাল ধরেই বর্তমান। ভূতে বিশ্বাসী আর ভূতে অবিশ্বাসী দুই দলই বেজায় ভারী।
তবে বিশ্বাস অবিশ্বাসের তোয়াক্কা না করে ভূতের অশরীরি ছায়া পড়েছে আমাদের জীবনযাপনের প্রথায়, সংস্কৃতিতে, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে, প্রবাদে, গাল গল্পে।
ভূতমাত্রই একইরকম নয়। ভুত জগতে সেলিব্রিটিদের মধ্যে আছেন ব্রহ্মদৈত্য, পেতনি, শাঁখচুন্নি, মামদো। ব্রাহ্মণের ভূতের নাম ব্রহ্মদৈত্য, স্বভাবে সাধারণত সদাশয়, নিবাস বেলগাছে। অবিবাহিত বা বিধবা নারীর ভূত হলো পেতনি, স্বভাবে বেশ হিংসুটে। বিবাহিতা নারীর ভূতের নাম শাঁখচুন্নি। এনারাও খুব রাগী। মামদো হলেন মুসলমান ভূত, কবরস্থানের আশেপাশে ইনি বাস করেন।
এছাড়া আরো কত রকমের কত গোত্রের ভূত আছে, কে জানে! এক বিশেষ শ্রেণীর ভূত হলো নিশি। রাতের বেলা চেনা মানুষের গলায় ডাকে ঘুমন্ত মানুষকে। ভুল করে তার ডাকে সাড়া দিয়ে ঘর থেকে বেরোলেই সর্বনাশ! আলেয়া আরেক শ্রেণীর ভূত। খোলা প্রান্তরে বা জলাভূমিতে এদের বসবাস। এছাড়া কন্দকাটা (বা স্কন্ধকাটা), গেছোভূত, মেছোভূত, একানড়ে, গোভূত, ঘোড়াভূত-অগণিত ভূত। ‘আরো হাজার ভূতের’ বেশ কয়েকটির উল্লেখ আছে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছায়াছবির ‘ভূতের রাজা দিল বর’ গানটিতে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূতুড়ে গল্পে দুটি ভূতের নাম আছে। দুই বোন কুনি আর বুনি- কুনি ঘরের কোণে থাকে, আর বুনি বনে থাকে।
বিশ্বসাহিত্যের কথা বাদ দিন, বাংলা গল্পেই কত রকমের ভূত আছে তার ইয়ত্তা নেই। কেবল শিশুভোলানো শিশুসাহিত্যে নয়, রীতিমতো প্রাপ্তবয়স্কদের সাহিত্যেও সগৌরবে বিরাজ করেন ভূতের দল। ভূতের গল্প লিখতে বা পড়তে যে ভূতে বিশ্বাস করতেই হবে, এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। অন্তত ভূতেদের তরফ থেকে এ নিয়ে কোন ঘাড় মটকানোর হুমকি নেই। তাই ভূতে অবিশ্বাসী লেখকও সরেস ভূতের কাহিনী লেখেন , ভূতে অবিশ্বাসী পাঠকও দিব্যি সে কাহিনী উপভোগ করেন।
বাংলা সাহিত্যে ভূত নিয়ে লেখেন নি, এমন লেখক বিরলপ্রায়।
‘চলে ভৈরব ভৈরবী নন্দী ভৃঙ্গী/ মহাকাল বেতাল তাল ত্রিশৃঙ্গী।/ চলে ডাকিনী যোগিনী ঘোর বেশে/ চলে শাঁকিনী পেতিনী মুক্তকেশে।’
ভারতচন্দ্রের দক্ষযজ্ঞ বর্ণনায় সাড়ম্বরে আছে যজ্ঞ নষ্ট করতে ভূতপ্রেতরা কী কান্ড সব করেছিল! মজলিশী সাহিত্যিক, লুল্লু ভূতের স্রষ্টা ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘যেমন জল জমিয়া বরফ হয়, অন্ধকার জমিয়া তেমনই ভূত হয়।’ হয়তো মনের কোণে জমে থাকা অজ্ঞানতার অন্ধকারে ভূতের বাসা, এই ঈশারাই তিনি করেছিলেন। যাই হোক, ভূতের গল্প বলতেই মনে আসে রবীন্দ্রনাথের মণিহারা আর ক্ষুধিত পাষাণ। পরশুরামের ‘ভূষণ্ডীর মাঠে’ গল্পটি মনে পড়ে? সেখানে শিবুর তিন জন্মের তিন স্ত্রী আর নৃত্যকালীর তিন জন্মের তিন স্বামী মিলে কী ভৌতিক জট পাকিয়েছিল!
কলকাতায় বিশেষত উত্তর কলকাতায় বেশ কিছু পুরোন বাড়ি খ্যাতি লাভ করেছিল ভৌতিক কারণে। কোন কোনটা পুরোদস্তুর হানাবাড়ি, কোথাও আবার ভূতে মানুষের সহাবস্থান। হেয়ার স্ট্রীটের কাছে গার্স্টিন প্লেসের ১ নং বাড়িটির এরকমই সুনাম ছিল। আকাশবাণীর পূর্বসুরী ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানীর ওই বাড়িটির অফিসে নাকি অনেকেই অশরীরি অস্তিত্ব অনুভব করতেন। ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের আলিপুরের অস্টাদশ শতাব্দীর বাসস্থান ‘হেস্টিংস হাউস’ এরও ভুতুড়ে খ্যাতি আছে। এখন ঐ বাড়িটিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শিক্ষিকা শিক্ষণ কলেজ হলেও সেখানে নাকি এখনো ‘অন্যরকম কিছু’র উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।
কলকাতার রাত আগে এত আলোয় আলোকময় ছিল না। সেই আলো আঁধারি ভরা রাতগুলিতে বহুকাল ধরে বহু মানুষের জীবন কাটানো পুরোন নির্জন বাড়িগুলিতে নাকি ভূতের অস্তিত্ব টের পাওয়া যেত। একের পর এক পুরোন বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি তৈরী হওয়ার ফলে পুরোন বাড়ির অধিবাসী ভূতগুলোর সব কি দুর্দশা হয়েছে, তা নিয়ে ভূতেরা সব সরব হয়েছে অনীক দত্তের ‘ভূতের ভবিষ্যত’ ‘ছায়া’ ছবিতে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘অক্ষয়বটোপাখ্যানম্’ গল্পেও ভূতেদের সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা করেছেন। বাংলা চলচ্চিত্রে
১৯৫০ সালে তৈরী হওয়া নরেশ মিত্রের পরিচালিত ‘কঙ্কাল’ সম্ভবত প্রথম ভূতের ছবি। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ভূতশিকারী মেজোকর্তা আর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বরদা— এই দুজনেই বিশিষ্ট ভূত বিশেষজ্ঞ।
ভূত আছে আমাদের মুখের কথায়, প্রবাদে, বাক্যালাপে। কোন কাজকে হেয় করে বলা হয় ‘ভূতের কীর্তন’। লালন ফকির তাঁর গানে বলেছেন, ‘ভবের পিরীত ভূতের কীর্তন, ক্ষণেক বিচ্ছেদ ক্ষণেক মিলন’।
রামপ্রসাদী গানে আছে— ‘মরলাম ভূতের বেগার খেটে’, অর্থাৎ বৃথা কর্ম করে। কোন ফল নেই এমন কাজ করাকে বলা হয় ‘ভূতের বোঝা বহা’। কারো মুখে তার স্বভাব বিরোধী কথা শুনলে বলি ‘ভূতের মুখে রামনাম’।
শেষ করি অবনীন্দ্রনাথের এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা দিয়ে। লিভারের প্রচন্ড যন্ত্রণায় ভুগছেন। তিন চারজন ডাক্তার চিকিৎসা করছেন, কিন্তু কিছু হচ্ছে না। রাতে ব্যথা শুরু হয়, শেষে যন্ত্রণায় বেহুঁশ হয়ে পড়েন। আর বুঝি বাঁচেন না, এমন অবস্থা। এক ভোর রাতে তিনি দেখলেন। কী দেখলেন? তাঁর নিজের ভাষায় —
‘হঠাৎ দেখি, একখানি হাত, মার হাতখানি মশারির ওপর থেকে নেমে এল। দেখেই চিনেছি, অসাড় হয়ে পড়ে আছি। মনে হল মা যেন বলছেন, ‘কোথায় ব্যথা? এইখানে?’ বলে হাতটি এসে টক করে লাগল ঠিক বুকের সেইখানটিতে। সমস্ত শরীরটা যেন চমকে উঠল। ভালো করে চারদিকে তাকালুম, কেউ কোথাও নেই। ব্যথা? নড়েচড়ে দেখি তাও নেই। অসাড় হয়ে শুয়েছিলুম, নড়বার শক্তিটুকুও ছিল না একটু আগে। সেই আমি বিছানায় উঠে বসলুম। …. সেই যে ব্যথা অদৃশ্য হলো, একেবারেই হলো। চলে যাবার পর একটু রেশ থাকে, তাও রইলো না।’ সেরে উঠলেন অবনীন্দ্রনাথ। বলাই বাহুল্য তাঁর মা তখন গত হয়েছেন।
আজ বাংলায় ভূত চতুর্দশী, ভারতের অন্যত্র নরক চতুর্দশী। মূল ভাবনায় পাশ্চাত্যের হ্যালোউইন আর আমাদের ভূত চতুর্দশী অনেকটাই এক, যদিও আলাদা দিনে পালিত হয়। এই উপলক্ষ্যে সকলের জন্য রইলো ভৌতিক শুভেচ্ছা।