মঙ্গলবার | ২০শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | সকাল ৯:৪৯
Logo
এই মুহূর্তে ::
রোনাল্ড রসের কাছে জব্দ ম্যালেরিয়া : রিঙ্কি সামন্ত রাজ্যে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ছে, কমবে অন্য রাজ্যের উপর নির্ভরতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় উনিশের উত্তরাধিকার : শ্যামলী কর কেট উইন্সলেটের অভিনয় দক্ষতা ও চ্যালেঞ্জিং ভূমিকার ৩টি চলচ্চিত্র : কল্পনা পান্ডে হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলা — আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংকট : সুব্রত কুমার দাস সিন্ধুসভ্যতার ভাষা যে ছিল প্রোটোদ্রাবিড়ীয়, তার প্রমাণ মেলুহা তথা শস্যভাণ্ডার : অসিত দাস চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (শেষ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস জাতিভিত্তিক জনগণনার বিজেপি রাজনীতি : তপন মল্লিক চৌধুরী গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তালশাঁসের চাহিদা : রিঙ্কি সামন্ত চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (ষষ্ঠ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস ভারতের সংবিধান রচনার নেপথ্য কারিগর ও শিল্পীরা : দিলীপ মজুমদার চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (পঞ্চম পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস আলোর পথযাত্রী : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (চতুর্থ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস কন্নড় মেল্ল থেকেই সিন্ধুসভ্যতার ভূখণ্ডের প্রাচীন নাম মেলুহা : অসিত দাস রবীন্দ্রনাথের চার্লি — প্রতীচীর তীর্থ হতে (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (তৃতীয় পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস লোকভুবন থেকে রাজনীতিভুবন : পুরুষোত্তম সিংহ চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (দ্বিতীয় পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস রবীন্দ্রনাথের চার্লি — প্রতীচীর তীর্থ হতে (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত রবীন্দ্রনাথের ইরান যাত্রা : অভিজিৎ ব্যানার্জি ঠাকুরকে ঠাকুর না বানিয়ে আসুন একটু চেনার চেষ্টা করি : দিলীপ মজুমদার যুদ্ধ দারিদ্র কিংবা বেকারত্বের বিরুদ্ধে নয় তাই অশ্লীল উন্মত্ত উল্লাস : তপন মল্লিক চৌধুরী রবীন্দ্রনাথ, পঁচিশে বৈশাখ ও জয়ঢাক : অসিত দাস রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী ও শান্তিনিকেতন : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বাঙালী রবীন্দ্রনাথ : সৈয়দ মুজতবা আলী অনেক দূর পর্যন্ত ভেবেছিলেন আমাদের ঠাকুর : দিলীপ মজুমদার রবীন্দ্রনাথের প্রথম ইংরেজি জীবনী : সুব্রত কুমার দাস চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (প্রথম পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস শুক্লাম্বর দিঘী, বিশ্বাস করে দিঘীর কাছে কিছু চাইলে পাওয়া যায় : মুন দাশ
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা (গুরু পূর্ণিমা) আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

ইচ্ছামৃত্যু : ডা. ইন্দ্রনীল আইচ

ডা. ইন্দ্রনীল আইচ / ৭৭১ জন পড়েছেন
আপডেট সোমবার, ১৬ মে, ২০২২

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের নবম দিনের সন্ধ্যায় যুদ্ধক্ষেত্রে পায়চারি করছেন ভীষ্ম। মন বিষণ্ন। গত ন’দিন ধরে প্রতিদিন তিনি দশহাজার করে পাণ্ডবসৈন্য হত্যা করেছেন। তাঁর হাতে প্রাণ হারিয়েছে পাণ্ডবপক্ষের অসংখ্য রথী মহারথী। তথাকথিত শত্রুর রক্তে হাত রাঙাতে রাঙাতে তিনি আজ ক্লান্ত। কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য মৃতদেহ… ভালো করে হাঁটাও যায় না। অন্ধকারে হাঁটার সময় অসাবধানতায় পায়ে ঠেকছে মৃতদেহগুলি। প্রতিবার তিনি তাকিয়ে দেখছেন… চেনা চেনা লাগছে কি? মনে মনে ভাবছেন, কবে তাঁর শব মাটিতে পড়ে থাকবে এইভাবে। কবে আসবে সেই বহুকাঙ্খিত দিন? কবে মিলবে মুক্তি?

একটু আগে যুধিষ্ঠির এসেছিল তাঁর কাছে। পা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করেছিল, “পিতামহ, আপনি বেঁচে থাকতে আমি এই যুদ্ধ জিততে পারবো না। কৃপা করে আপনাকে বধ করবার উপায় বলে দিন”। মনে মনে হেসেছিলেন তিনি। তিনি জ্যেষ্ঠ কুরুপুত্র, তিনি ভার্গবশিষ্য, তিনি পরশুরামশিষ্য, তিনি পৃথিবীশ্ৰেষ্ঠ ধনুর্ধ্বর, তিনি ক্ষত্রিয়কুলের ত্রাস পরশুরামকে পরাজিত করেছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে রয়েছে পিতা শান্তনুর দেওয়া ইচ্ছামৃত্যুর বর। তাঁকে কে পরাজিত করবে? তিনি যুধিষ্ঠিরকে উত্তর দিয়েছিলেন, “এই পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে সশস্ত্র অবস্থায় আমাকে পরাজিত করতে পারে। কিন্তু এটা জেনে রাখ যে নিরস্ত্র, ভূপতিত, বর্ম ও ধ্বজবিহীন, পলায়মান, ভীত, শরণাপন্ন, স্ত্রী, স্ত্রী নামধারী, বিকলেন্দ্রিয়, একপুত্রের পিতা ও নীচজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আমার প্রবৃত্তি হয় না। দ্রুপদপুত্র শিখণ্ডী পূর্বে স্ত্রী ছিলেন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে যদি আমার সামনে আসেন তবে আমি অস্ত্রত্যাগ করবো”।

হাঁটছেন ভীষ্ম। মনে অনেক জিজ্ঞাসা। শিখণ্ডীর ছদ্মবেশে অম্বাকে তিনি অনেক আগেই চিনতে পেরেছিলেন। কিন্তু শিখণ্ডীর বাণে কি তাঁর বর্ম ভেদ করবার ক্ষমতা আছে? শিখণ্ডীর পিছনে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে গাণ্ডীব তুলে ধরার মতো কাপুরুষতা কি অর্জুন আদৌ দেখাতে পারবে? তাঁর পতনের পর কৌরবসেনার দায়িত্ব কে নেবে? পিতা শান্তনু’র থেকে হস্তিনাপুরের সুরক্ষার দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন তিনি। কি হবে হস্তিনাপুরের? হাঁটছেন ভীষ্ম। মনে অনেক জিজ্ঞাসা।

হঠাৎ ভীষ্ম দেখলেন, একটু দূরে অন্ধকারের মধ্যে সাদা শাড়ি পরিহিত একজন স্ত্রীলোক মাটির উপর বসে কি যেন করছেন। অবাক হয়ে আরও একটু এগিয়ে গেলেন তিনি। বুঝতে পারলেন, স্ত্রীলোকটি মাটিতে পড়ে থাকা নুড়িপাথরগুলি তুলে নিজের আঁচলে ভরছেন। কে ইনি? রাতের অন্ধকারে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে পাথর কুড়োচ্ছেন কেন? এবারে স্ত্রীলোকটিকে চিনতে পারলেন ভীষ্ম। স্ত্রীলোকটি আর কেউ নন… তাঁর মা… গঙ্গা!

এগিয়ে গেলেন ভীষ্ম। প্রণাম করে গঙ্গাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি এতো রাতে এখানে কি করছেন?” অপ্রস্তুত গঙ্গা উত্তর না দিয়ে প্রতিজিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি এতো রাতে এখানে কি করছো?” ভীষ্ম বললেন, “আমি আগামীকালের যুদ্ধের পরিণাম নিয়ে চিন্তিত আছি। বুঝতে পারছি না যে কাল কি ঘটতে চলেছে। আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে এতো দূর চলে এসেছি। কিন্তু আপনি এখানে কি করছেন?”

বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে গঙ্গা উত্তর দিলেন, “আমি প্রান্তরের এইটুকু অংশ পরিস্কার করছি”। ভ্রু কুঁচকে গেলো ভীষ্মের, জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন? এইটুকু অংশ এতো রাতে পরিস্কার করছেন কেন?” ভীষ্মের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলেন গঙ্গা, “আগামীকাল এই জায়গাতেই তোমার শয্যা পাতা হবে। সারাজীবন ধরে দায়িত্ব পালন করতে করতে তুমি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছো…এবার তোমার বিশ্রামের সময়”।

কুরুক্ষেত্রের প্রান্তর থেকে আমি এইবার ফিরে যাবো দাসরাজার দরবারে। সত্যবতীর পিতা দাসরাজা। বৃদ্ধ শান্তনুকে নিজের কন্যা সম্প্রদান করবার পূর্বে অদ্ভুত ধরণের জেদ ধরে বসলেন। তাঁর নাতি যেন হস্তিনাপুরের রাজা হয়…এই তাঁর প্রাণের ইচ্ছা। ভীষ্ম তখন দেবব্রত। বললেন, “বেশ…তাই হবে। কুরু সিংহাসনের অধিকার আমি এই মুহূর্তে ত্যাগ করলাম”। একটু থমকালেন দাসরাজা। তারপর কুটিল হাসি হেসে বললেন, “ভয় তো তোমাকে নয় দেবব্রত। কিন্তু তোমার সন্তানরা যদি আমার নাতিকে হত্যার পরিকল্পনা করে, তাহলে তুমি তাদের আটকাবে কি করে?”

কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে উত্তর দিলেন দেবব্রত…”বিবাহ করলে তবেই না সন্তান হবে দাসরাজ। এই মুহূর্তে প্রতিজ্ঞা করছি, কোনোদিন আমি বিবাহ করবো না, আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করবো। অপুত্রক বাঁচবো… অপুত্রক মরবো… এই আমার অখন্ড প্রতিজ্ঞা”। ভীষণ প্রতিজ্ঞা…দেবব্রতের নামকরণ হলো “ভীষ্ম”।

সত্যবতীকে নিয়ে হস্তিনাপুর ফিরলেন ভীষ্ম। বৃদ্ধ শান্তনু হতবাক। বললেন, “কেন করলি এই কাজ? কেন নিজের অধিকার ছেড়ে দিলি? এতো বড় আত্মত্যাগের পরিণামস্বরূপ তোকে ইচ্ছামৃত্যুর বর দিলাম। মৃত্যু তোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোকে কোনোদিন স্পর্শ করতে পারবে না”।

হিন্দু পুরাণ এবং মহাকাব্যে সর্বমোট আটজন “অমর” বা “চিরঞ্জীবী”র উল্লেখ আছে। এই আটজন হলেন মার্কণ্ডেয়, বলী, বিভীষণ, ব্যাস, পরশুরাম, কৃপাচাৰ্য, হনুমান এবং অশ্বত্থামা। শাস্ত্রমতে এনারা অমর… কলিযুগের শেষ অবধি মৃত্যু এঁদের স্পর্শ করতে পারবে না। এই আটজনের মধ্যে হনুমান, ব্যাস, কৃপ, পরশুরাম এবং অশ্বত্থামার উল্লেখ মহাভারতে আছে। সম্ভবত মহাভারতই একমাত্র গ্রন্থ যেখানে পাঁচজন চিরঞ্জীবীর একত্র সমন্বয় ঘটেছে। ভীষ্ম কিন্তু অমর নন। তিনি ইচ্ছামৃত্যুর অধিকারী। অর্থাৎ নিজের মৃত্যুর সময় তিনি নিজেই নির্ধারণ করতে পারবেন। প্রশ্ন হলো এই যে “অমরত্ব” এবং “ইচ্ছামৃত্যু” এই দুটো শব্দ কি সমার্থক?

শুনতে কাছাকাছি হলেও “অমরত্ব” এবং “ইচ্ছামৃত্যু”, দুটো শব্দ সমার্থক নয়। অমরত্বের ক্ষেত্রে মৃত্যু কখনোই আসবে না…অমর ব্যক্তি চাইলেও নয়। ইচ্ছামৃত্যুর ক্ষেত্রে মৃত্যু আসবে, কিন্তু যতক্ষণ না সেই ব্যক্তি নিজে চাইছেন ততক্ষণ মৃত্যু তাঁকে স্পর্শ করতে পারবে না। ইচ্ছামৃত্যুর অধিকারী যদি নিজের তরুণ বয়সে মৃত্যুকে আহ্বান করেন, মৃত্যু তৎক্ষণাত আসবে। আবার যদি অতিবৃদ্ধ বয়সে তিনি মৃত্যুকে আহ্বান করেন, স্বাভাবিক মৃত্যুর সময় পেরিয়ে গেলেও আহ্বান মাত্রই মৃত্যু তাঁর কাছে আসবে। পিতা শান্তনুর থেকে ভীষ্ম এই বরই পেয়েছিলেন।

আমাদের একটু ভেবে দেখা দরকার, যে মুহূর্তে শান্তনু ভীষ্মকে ইচ্ছামৃত্যুর বর দিয়েছিলেন, সেই মুহূর্তে ক্ষত্রিয়কূলে ভীষ্মের ‘সি ভি’ কেমন ছিল। তিনি অষ্টবসুর প্রধান বসু “দ্যু” অবতার। তিনি তৎকালীন ভারতের শ্রেষ্ঠ রাজ্য কুরু’র জ্যেষ্ঠ রাজকুমার দেবব্রত। তিনি গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম। তিনি ভাৰ্গবশিষ্য ভীষ্ম। তিনি পরশুরামশিষ্য ভীষ্ম। তিনি পৃথিবীশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধ্বর ভীষ্ম…ব্রহ্মাস্ত্র, পাশুপত ইত্যাদি সেরা দৈবাস্ত্রে পরিপূর্ণ তাঁর তূণীর। তাঁর বীরত্ব এতটাই যে তাঁর নিজের গুরু, ক্ষত্রিয়ত্রাস পরশুরাম অবধি তাঁর কাছে পরাজয় স্বীকার করেছিলেন। তাঁর শৌর্য এতটাই যে অম্বা, অম্বিকা, অম্বালিকা হরণের সময় স্বয়ম্বর সভায় উপস্থিত রথী মহারথীরা টু শব্দ করতে পারেননি। ক্ষত্রিয়কূলে তাঁর প্রভাব এতটাই ছিল যে গান্ধাররাজ সুবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিজের পরমাসুন্দরী কন্যা গান্ধারীকে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্রের মাঠে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে কৌরবসেনার প্রধান সেনাপতির পদে যেদিন দুর্যোধন ভীষ্মকে অভিষিক্ত করেছিলেন সেদিন তাঁর বয়স ছিল ১৪৮ বছর! ওই ১৪৮ বছর বয়সেও তাঁর সামনে পাত্তা পায়নি পঞ্চপাণ্ডবসহ সমগ্র পাণ্ডব সেনা। হেলায় প্রতিদিন দশ হাজার করে পাণ্ডবসৈন্য নিধন করতেন তিনি! দশ হাজার!! তাঁর আগ্রাসী বীরত্বের ঠেলায় অতিষ্ঠ হয়ে স্বয়ং ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণকেও প্রতিজ্ঞা ভেঙে হাতে তুলে নিতে হয়েছিল সুদর্শন চক্র। রণক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে খানিকটা যুঝতে পারতেন একমাত্র ভীম,অর্জুন এবং শ্রীকৃষ্ণ। বাকি সবাইকে তিনি পোকার মতো টিপে মারার ক্ষমতা রাখতেন। মারেননি…কারণ তিনি নিজেই মারতে চাননি। তিনিই মহাভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর…অর্জুন নন, কর্ণ নন, ভীম নন, দুর্যোধন নন।

তাই এহেন বীরের কোনো ইচ্ছামৃত্যুর কবচের প্রয়োজন হয় কি? না… হয় না। ভেবে দেখুন তো, নিজের জীবদ্দশায় অসংখ্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া ভীষ্ম কতবার এই ইচ্ছামৃত্যুর বরের সাহায্য নিয়ে নিজের জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন? উত্তরটা হল “মাত্র একবার”…নিজের জীবনের শেষ যুদ্ধে, অর্জুন এবং শিখণ্ডীর হাতে পিন কুশন হয়ে গিয়ে রথ থেকে পড়ে যাওয়ার পরে…”আমি এখনই দেহত্যাগ করবো না, সূর্যের উত্তরায়ণের জন্য অপেক্ষা করবো”।

আমার মনে হয়, মহারাজ শান্তনু দাসরাজ অধ্যায়ের সময়েই বুঝে গিয়েছিলেন যে ভীষ্মের মতো বীরের কোনো ইচ্ছামৃত্যুর বরের প্রয়োজন হবে না। ইচ্ছামৃত্যুর বর থাক কি না থাক, ভীষ্ম জীবনের সমস্ত যুদ্ধে জিতবেন। শান্তনু বুঝেছিলেন যে নিজের বৃদ্ধ বয়সের প্রেম এবং ভীষ্মের অপরিণামদর্শিতা কুরু রাজসিংহাসনকে আজ অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সেই অনিশ্চয়তাকে দূর করতে হলে নিজের প্রিয়তম এই আবেগপ্রবণ পুত্রটিকে দীর্ঘায়ু হতে হবে। একে হতে হবে কুরু রাজসিংহাসনের ‘সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড’, কুরু রাজসিংহাসনের দেহরক্ষী, কুরু রাজসিংহাসনের দাস। চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্যের অকালমৃত্যু, পান্ডুর অকালমৃত্যু, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সিংহাসনে আরোহন, দুর্যোধনের উচ্ছাকাঙ্খা, হস্তিনাপুরের বিভাজন এবং সর্বশেষে কুরুক্ষেত্র… অর্থাৎ সমগ্র মহাভারত জুড়ে কুরু সিংহাসনকে সিকিউরিটি দিয়ে গেছেন ভীষ্ম। যদি তিনি দীর্ঘায়ু না হতেন, মহাভারত কুরুক্ষেত্র অবধি গড়াতো না। শান্তনুর দেওয়া ইচ্ছামৃত্যুর বরের সার্থকতা সেখানেই।

প্রশ্ন হলো… ইচ্ছামৃত্যু ব্যাপারটা আসলে কি? ভীষ্ম ছাড়া আর কেউ কি ইচ্ছামৃত্যুর অধিকারী ছিলেন? আমি যতদূর জানি বা বুঝি, আমার মনে হয় মহাভারতের সময়ে ভীষ্ম ছাড়া আরও অন্তত তিনজন এবং আধুনিক যুগে অন্তত পাঁচজন ইচ্ছামৃত্যুর অধিকারী ছিলেন। তাঁরা কে? প্রথমে আসি আধুনিক যুগে।

১৯১১ সালের ১৭ই জুলাই। সময় মধ্যরাত্রি। তারাপীঠের ক্ষ্যাপা ঝোপড়ার মধ্যে সঙ্গী নগেনের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলেন বামাক্ষ্যাপা। বললেন, “নগেন…আমার ডাক এসেছে”। নগেন পীড়াপীড়ি করে ক্ষ্যাপাবাবাকে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। ভোর হতেই বামাক্ষ্যাপা আবার বললেন, “নগেন, আমাকে নদীতে নিয়ে চল…চান করবো”। আদেশ অমান্য করবার উপায় নেই। কাকভোরে উঠে দ্বারকা নদীতে গিয়ে “জয় তারা, জয় জয় তারা” চিৎকার করতে করতে স্নান সারলেন বামদেব। স্নান সেরে ঝোপড়ায় ফিরলেন, তারপরে গেলেন শ্মশানে। মন্দিরের মঙ্গল আরতির সঙ্গে বামদেবের “জয় তারা” নাদে শ্মশান কাঁপতে শুরু করলো। ফেরার সময় শিমুলতলায় একটি জায়গা দেখিয়ে ক্ষ্যাপাবাবা বললেন, “এই দেখ…এইখানে আমাকে সমাধি দিবি”। ঝোপড়ায় ফিরে সামান্য আহার সারলেন। সন্ধ্যায় তারা মা’র আরতির পরে সামান্য প্রসাদ গ্রহণ করলেন। এরপর উত্তর দিকে মুখ করে বসে শুরু করলেন তন্ত্রক্রিয়া। মুখে কেবল “জয় জয় তারা” রব…আর কিছু নয়। ১৮ই জুলাই, আনুমানিক রাত ১টা বেজে ৫ মিনিট…বামাক্ষ্যাপার ব্রহ্মতালু ফট করে ফেটে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে “জয় তারা” নাদ বন্ধ হয়ে গেলো…ব্রহ্মতালু থেকে সামান্য রক্ত গা বেয়ে মাটিতে পড়লো…বামাক্ষ্যাপা মনুষ্যকায়া ত্যাগ করে সূক্ষ শরীরে বিরাজমান হলেন। সজ্ঞানে, নিজের ইচ্ছায় দেহত্যাগ…ইচ্ছামৃত্যু!

১৯৫২ সালের ৭ই মার্চ…লস এঞ্জেলস এর বাল্টিমোর হোটেল। আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত শ্রী বিনয়রঞ্জন সেন এবং তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে রাতের খাওয়া সারলেন পরমহংস যোগানন্দ। এরপরে শ্রী সেনকে যোগানন্দ শোনালেন ক্রিয়াযোগের কিছু তত্ত্ব, আবৃতি করলেন নিজের লেখা কবিতা “My India”…”Where Ganges, woods, Himalayan caves, and men dream God—I am hallowed; my body touched that sod”. এই কথা উচ্চারণ করবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দৃষ্টি তৃতীয় নয়নের স্থানে নিবদ্ধ হলো…পরক্ষণেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো তাঁর প্রাণহীন দেহ। ধীর পায়ে প্রবেশ করলেন তাঁর শিষ্যরা। তাঁরা বললেন, “গুরুদেব মহাসমাধিতে প্রবেশ করেছেন…সজ্ঞানে দেহত্যাগ”। ৭ই মার্চ থেকে ২৭শে মার্চ, প্রায় কুড়ি দিন ধরে স্বামী যোগানন্দের দেহ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ভক্তবৃন্দের সামনে রাখা হয়। এই কুড়ি দিন তাঁর মৃতদেহে বিন্দুমাত্র পচন ধরেনি! লস এঞ্জেলস মর্গের তৎকালীন ডিরেক্টর হ্যারি টি রাওয়ের মতে, “The absence of any visual signs of decay in the dead body of Paramahansa Yogananda offers the most extraordinary case in our experience… No physical disintegration was visible in his body even twenty days after death… No indication of mold was visible on his skin, and no visible drying up took place in the bodily tissues. This state of perfect preservation of a body is, so far as we know from mortuary annals, an unparalleled one… No odour of decay emanated from his body at any time..”।

১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই… বেলুড় মঠ। ভোরে শয্যা ত্যাগ করলেন স্বামী বিবেকানন্দ। মঠের মূল মন্দিরে গিয়ে তিন ঘণ্টা ধ্যান করলেন তিনি। এরপরে শিষ্যদের সামনে শুক্লা যজুর্বেদ সম্পর্কে এবং সংস্কৃত ব্যাকরণ প্রসঙ্গে বক্তৃতা দিলেন। সন্ধ্যা ৭টা’র সময় নিজের ঘরে প্রবেশ করবার সময় শিষ্যদের বললেন, “কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে”। এরপর তিনি ধ্যানে বসলেন এবং আনুমানিক সাড়ে ন’টায় ধ্যানস্থ অবস্থায় দেহত্যাগ করলেন। মৃত্যুর কারণ হিসাবে লেখা হলো “সেরিব্রাল স্ট্রোক”, কিন্তু ভক্তবৃন্দরা বুঝলেন এটা আসলে মহাসমাধি…নিজের আত্মাকে ব্রহ্মরন্ধ্রের মাধ্যমে মহাশূন্যে বিলীন করে দেওয়া… ইচ্ছামৃত্যু।

১৮৯৫ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর। যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ীর বারাণসীর বসতবাটিতে ভক্তদের ভিড়। লাহিড়ী মহাশয় নিজেই তাঁদের ডেকে পাঠিয়েছেন। যথাসময়ে তিনি ভক্তদের সামনে এলেন। বললেন, “শোন, আমার এবার ঘরে ফেরার সময় হলো। তোরা দুঃখ করিস না। মনে রাখিস, ক্রিয়াবানদের সঙ্গে আমি সবসময় আছি”। এরপর তিনি যোগাবিষ্ট হলেন। খানিকক্ষণ পরেই মহাসমাধি… ইচ্ছামৃত্যু। মণিকর্ণিকার ঘাটে তাঁর নশ্বর দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেলো।

১৮৮৭ সালের ২৫শে ডিসেম্বর। কাশীর “সচল শিব” ত্রৈলঙ্গস্বামী ডেকে পাঠালেন তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত মঙ্গলদাসকে। বললেন, “শোন মঙ্গল, প্রায় ২৫০ বছর ধরে এই মর্তলোকটা দেখলাম। অন্যান্য লোকগুলোও তো দেখতে হবে। তাই ঠিক করেছি কাল দুপুরবেলা দেহত্যাগ করবো। তুই একটা বড় সিন্দুক তৈরী করা। কাল দুপুরে আমার দেহত্যাগের পরে আমার দেহটাকে সেই সিন্দুকের মধ্যে রেখে অসি ঘাট থেকে বরুণা অবধি ঘুরিয়ে গঙ্গায় ফেলে দিবি। আর কোনো ক্রিয়া কর্ম নিষ্প্রয়োজন”। ত্রৈলঙ্গস্বামী’র এই আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়েছিল।

কেবলমাত্র বামাক্ষ্যাপা, স্বামী যোগানন্দ, স্বামী বিবেকানন্দ, লাহিড়ী মহাশয় কিংবা ত্রৈলঙ্গস্বামীই নয়, ভারতের অধিকাংশ যোগী পুরুষ দেহত্যাগ করেছেন নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী। তাঁদের প্রত্যেকেরই “ইচ্ছামৃত্যু”।

ফিরে আসি মহাভারতে। মৌষলপর্বে নিজের চোখে যদু বংশের নাশ দেখার পরে শ্রীকৃষ্ণ গিয়েছিলেন নিজের দাদা বলরামের সঙ্গে দেখা করতে। বলরামের কাছে পৌঁছে শ্রীকৃষ্ণ দেখলেন তিনি যোগাবিষ্ট। একটি সহস্র ফণাযুক্ত সাপ বলরামের নাক থেকে বার হয়ে সমুদ্রের জলের দিকে চলে যাচ্ছে…বলরাম যোগবলে দেহত্যাগ করছেন…ইচ্ছামৃত্যু।

“অশ্বত্থামা হত ইতি গজ” শোনার পরে পুত্রশোকে কাতর আচার্য দ্রোণ প্রথমে অস্ত্রত্যাগ এবং তারপরেই যোগবলে দেহত্যাগ করেন। আরেকটা “ইচ্ছামৃত্যু”। দ্রোণের মৃতদেহের শিরচ্ছেদ করেন ধৃষ্টদ্যুম্ন।

কিন্তু কিভাবে ঘটে এই ইচ্ছামৃত্যু? কি এর টেকনিক? কি এর মেকানিজম? এর প্রকৃত উত্তর আমার অজানা। কেবলমাত্র এইটুকু আমি বুঝতে পেরেছি যে যোগী নিজের গুরুর কাছ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা এবং সেই শিক্ষার দীর্ঘকালীন অভ্যাসের মাধ্যমে নিজের স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রকে নিজের বশে এনে ওই স্নায়ুতন্ত্র বা ষটচক্রের মাধ্যমেই নিজের প্রাণশক্তিকে নিজের ইচ্ছায় নিজের শরীর থেকে নির্গত করে দিতে পারেন। সেটাই “মহাসমাধি” বা “ইচ্ছামৃত্যু”। ইচ্ছামৃত্যুর বর আসলে এই যৌগিক ক্রিয়ার জ্ঞান বা শিক্ষা যা শান্তনু নিজের প্রিয় পুত্রকে শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন…অন্তত আমার সেইরকমই মনে হয়। মেডিকেল সায়েন্স এই ব্যাপারে বিশেষ কিছু বলে না।

এখানে দুটি প্রশ্ন মনে আসে। প্রথম প্রশ্ন, ভীষ্ম কি এই যৌগিক ক্রিয়ার মাধ্যমেই দেহত্যাগ করেছিলেন, না কি তাঁর দেহত্যাগের পিছনে অন্য কোনো টেকনিক ছিল? এর উত্তর হিসাবে আমি শ্রী রাজশেখর বসু’র লেখা “কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারত সারানুবাদ” থেকে ভীষ্মের দেহত্যাগ সংক্রান্ত কয়েকটি লাইন হুবহু তুলে দিলাম।

“শান্তনুপুত্র ভীষ্ম সমবেত কুরুগণকে এইরূপ বলে নীরব হলেন, তারপর যথাক্রমে মূলাধারাদিতে তাঁর চিত্ত নিবেশিত করলেন। তাঁর প্রাণবায়ু নিরুদ্ধ হয়ে যেমন ঊর্ধ্বগামী হতে লাগলো সেই সঙ্গে তাঁর শরীর ক্রমশ বাণমুক্ত ও ব্যাথাহীন হল। তারপর তাঁর প্রাণ ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে মহা উল্কার ন্যায় আকাশে উঠে অন্তর্হিত হল। পুষ্পবৃষ্টি ও দেবদুন্দুভির ধ্বনি হতে লাগলো, সিদ্ধ ও মহর্ষিগণ সাধু সাধু বলতে লাগলেন”।

অর্থাৎ একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে আধুনিক যুগের বিভিন্ন যোগীপুরুষ ও ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যুর পদ্ধতি এক ও অভিন্ন।

মহাভারতে লেখা আছে, শরশয্যায় শায়িত হওয়ার আগে ভীষ্মের শরীরে এতো সংখ্যক তীর বিঁধেছিল যে “দুই আঙুল স্থান অবশিষ্ঠ ছিল না”। এমন সাংঘাতিকভাবে আহত হওয়ার পরেও কোন উপায়ে তিনি ৫৮ দিন ধরে মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন সেই ব্যাপারে মহাভারত নিরব। আমিও এই ব্যাপারে কিছুমাত্র আলোকপাত করতে অক্ষম। কেবলমাত্র এটাই বলতে পারি…হয়তো এটা একপ্রকার হঠযোগ।

দ্বিতীয় প্রশ্ন, ভীষ্মের মতো একজন যোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ এই যোগীসুলভ জ্ঞান শিখলেন কার থেকে। নিঃসন্দেহে শান্তনুর থেকে। আবার প্রশ্ন, শান্তনু এই জ্ঞান শিখলেন কার থেকে? এর উত্তর পেতে গেলে আমাদের কুরু বংশের শান্তনু-ভীষ্ম-পান্ডু-যুধিষ্ঠির লাইনেজ ছাড়া অন্য একটি প্যারালাল লাইনেজ সম্বন্ধে জানতে হবে।

আগেই বলেছি, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলাকালীন ভীষ্মের বয়স ছিল ১৪৮ বছর। ওই বয়সেও তিনি এতটাই ফিট ছিলেন যে যুদ্ধের প্রথম দশদিন পাণ্ডবদের নাস্তানাবুদ করে ছেড়ে ছিলেন। যোগাভ্যাস ছাড়া বৃদ্ধ বয়সে এতটা এফিসিয়েন্সি দেখানো হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু এটাও ঠিক যে কুরুক্ষেত্রের মাঠে কৌরব পক্ষেই ভীষ্মের চাইতেও বয়সে বড় আরেকজন যোদ্ধা ছিলেন এবং বীরত্বের দিক থেকে তিনিও মোটেই খুব একটা পিছিয়ে ছিলেন না। তিনি কে?

তাঁর নাম বাহ্লীক। বাহ্লীক ছিলেন বহ্লীক দেশের রাজা, শান্তনুর বড় দাদা ও ভীষ্মের জ্যাঠামশাই। যুদ্ধ শুরুর আগে ভীষ্ম এনাকে “অতিরথী” তকমা দিয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় বাহ্লীকের বয়স ছিল আনুমানিক প্রায় ২০০ বছর এবং তিনি যুদ্ধের ১৪তম দিনে ভীমের হাতে নিহত হন। বাহ্লীক এবং শান্তনুর আরেক দাদা ছিল, তাঁর নাম ছিল দেবাপি এবং তিনি যৌবনেই সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করেন।

ভীষ্মের ক্ষেত্রে ১৪৮ বছর বয়সেও টানা ১০ দিন চরম বীরত্ব দেখানো যদি যোগাভ্যাসের প্রভাব বলে ধরে নিই তবে এটাও স্বয়ংসিদ্ধ যে ২০০ বছর বয়সী বাহ্লীকও যোগাভ্যাসের ফলেই টানা ১৪ দিন লড়ে যেতে পেরেছিলেন। ভীষ্ম “ইচ্ছামৃত্যু”র টেকনিক যদি শান্তনুর থেকে পেয়ে থাকেন তবে এটা হতেও পারে যে শান্তনু সেই জ্ঞান বাহ্লীক বা দেবাপি’র থেকে পেয়েছিলেন। হয়তো সেই জ্ঞান বাহ্লীকের পিতা প্রতীপ বা তারও আগে কুরু বা ভরতের সময় থেকে গুরু শিষ্য পরম্পরায় চলে আসছে। হয়তো…।

কুরু বংশে যোগাভ্যাসের যে একটা চল ছিল সেটার আভাস মহর্ষি বেদব্যাস বারংবার দিয়েছেন। বাহ্লীকের নাতি ভূরিশ্রবার সঙ্গে সাত্যকির যুদ্ধ চলাকালীন অর্জুনের ছোঁড়া বানে ভূরিশ্রবার একটি হাত কাটা যায়। অর্জুনের সঙ্গে সামান্য বাকযুদ্ধের পরে যুদ্ধক্ষেত্রেই তীরের আসন সাজিয়ে যোগবলে প্রাণ বিসর্জনের চেষ্টা করেন ভূরিশ্রবা। এই টেকনিক তিনি শিখলেন কি ভাবে? ভীমের বিরুদ্ধে শেষ গদাযুদ্ধের আগে হ্রদের নীচে শ্বাসরোধ করে যোগাবিষ্ট হয়ে বিশ্রাম করছিলেন দুর্যোধন। এই প্রক্রিয়াকে হঠযোগ বলেই মনে হয় আমার। এমনকি অজ্ঞাতবাস চলাকালীন অর্জুনের এক বছরের ক্লীবত্ব দীর্ঘদিন যোগাভ্যাসের ফল বলেই আমার মনে হয়েছে। কিন্তু একথাও সত্যি যে সাচ্চা যোগীর মতোই কুরু বংশের কেউই এই যোগাভ্যাসের কথা কোথাও ফলাও করে বলেননি। এমনকি মহর্ষি বেদব্যাস অবধি এই ব্যাপারে সরাসরি একটি কথাও মহাভারতে লেখেন নি।

সামান্য মহাভারতীয় জ্ঞান আর নিজের চিন্তাভাবনাকে কাজে লাগিয়ে “ইচ্ছামৃত্যু” সম্পর্কে আমি যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, আপনাদের সামনে রাখলাম। সিদ্ধান্ত আপনাদের।

মা গঙ্গার সঙ্গে কথা বলে ভীষ্ম ফিরে এলেন শিবিরে। এসেই নিজের দু’জন সেবককে প্রচুর ধনসম্পদ দিয়ে বললেন, “আজ তোমাদের ছুটি দিয়ে দিলাম। আজ থেকে তোমরা আর দাস নও, তোমরা স্বাধীন নাগরিক। দাসত্বের চাইতে বড় শৃঙ্খল আর কিছুই নেই। আশীর্ব্বাদ করি, তোমাদের যেন আর কখনও দাসত্বের শৃঙ্খলে জড়িয়ে পড়তে না হয়”।

ভীষ্ম নিজে ছিলেন জ্যেষ্ঠ কুরুপুত্র…সেকালের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। কিন্তু দাসরাজার সামনে করা প্রতিজ্ঞার জেরে তিনি নিজেই নিজেকে বানিয়ে ছিলেন আজীবন দাসত্বের প্রতিনিধি। কুরু সিংহাসনের দাস। হয়তো এই দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিতেই মহারাজ শান্তনু তাঁকে দিয়েছিলেন ইচ্ছামৃত্যুর বর। হয়তো তিনি বলতে চেয়েছিলেন, “যেদিন নিজের এই দুঃসহ জীবনের বোঝা আর বইতে পারবি না…সেইদিন নিজেকে মুক্তি দেওয়ার রাস্তা তোকে বলে গেলাম”।

সত্যিই দুঃসহ জীবন। কুরুক্ষেত্রে বিপক্ষে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাঁর নিজের নাতিরা। প্রাণে ধরে তাঁদের হত্যা করতে পারছেন না বলে তাঁকেই ধমকাচ্ছে তাঁর আরেক নাতি দুর্যোধন… “পিতামহ, একটু মন দিয়ে যুদ্ধ করুন…ওদের আর কতো দয়া করবেন”? কি করবেন তিনি? কোনোমতে উত্তর দিয়েছিলেন, “হ্যাঁ দুর্যোধন… তোমার বেতনভুক যোদ্ধা আমি… চেষ্টা করছি”।

রাজসূয় যজ্ঞ চলছে যুধিষ্ঠিরের। শিশুপাল এসে বললো, “এই ভীষ্ম’র আজীবন ব্রহ্মচর্যের প্রতিজ্ঞা আসলে একটা ঢং। ও যদি এই প্রতিজ্ঞা নাও করতো তাহলেও ওকে সারাজীবন ক্লীবের জীবনযাপনই করতে হতো”। শিশুপালের এই অপরাধের শাস্তি তাঁর নাতিরা দেননি। তাঁরা কেবল গলা চড়িয়েই কর্তব্য সেরেছিলেন। শিশুপালকে শাস্তি দিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ… সুদর্শনকে আহ্বান করে।

আজীবন দাসত্ব ও অপমানের বোঝা বইতে বইতে একবারও কি মনে মনে পিতা শান্তনুকে দোষারোপ করেছিলেন ভীষ্ম? একবারও কি ভেবেছিলেন, “আমার সাতজন দাদাকে জলে ডুবিয়ে মারার সময় তো আপনি মা’কে আটকান নি। আমার বেলাতেই আটকালেন কেন? সেদিন যদি আপনি মা’কে না আটকাতেন, তবে তো আমাকে আজ এই দিন দেখতে হতো না”।

কুরু রাজসিংহাসনের দাস ছিলেন বলেই ভীষ্ম নিজের ক্ষোভ, উচ্চাকাঙ্খা, আবেগ সবকিছুই বিসর্জন দিয়েছিলেন। কেবলমাত্র একটা জিনিস বিসর্জন দিতে পারেননি। সেটা হলো ক্ষাত্রতেজ। অর্জুন আর শিখণ্ডী যখন তাঁকে একের পর এক তীরে ফুঁড়ে ফেলছেন, তখন ভীষ্ম পাশে দাঁড়ানো দুঃশাসনকে বলছেন, “এইসব তীর অর্জুনের, কেবলমাত্র অর্জুনের… আর কারও নয়”।

তিনি ভার্গবশিষ্য…পরশুরামশিষ্য… পরশুরামজয়ী। কোনো শিখণ্ডী তাঁকে ন্যায়যুদ্ধে মারতে পারে না।

পুনশ্চঃ : গঙ্গার সঙ্গে ভীষ্মের এই কথোপকথন মূল মহাভারতে নেই। যতদূর জানি ভি. এস. সুখতাঙ্করের ক্রিটিকাল এডিশনে এই কথোপকথনের উল্লেখ আছে। আসলে এই কথোপকথন এতটাই মর্মস্পর্শী যে লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না।

তথ্যসূত্র : ১) কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারত সারানুবাদ – রাজশেখর বসু, ২) ইন্টারনেট, ৩) তারাপীঠের সচল শিব বামাক্ষ্যাপা (গ্রন্থ), ৪) ত্রৈলঙ্গস্বামী (চলচ্চিত্র)


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন