মঙ্গলবার | ১৭ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | সকাল ১১:১৭
Logo
এই মুহূর্তে ::
স্মরণে মননে জন্মদিনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় : রিঙ্কি সামন্ত হুগলি জেলায় কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ছে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় খালিয়াজুরি মৌজার প্রাচীন ইমারত : ফারুকুর রহমান চৌধুরী দুর্দৈবপীড়িত রবীন্দ্রনাথ : দিলীপ মজুমদার শান্তি সভ্যতার গুণ, যুদ্ধ তার অপরাধ … ভিক্টর হুগো : অশোক মজুমদার হরপ্পার ব্যুৎপত্তি নিয়ে নতুন আলোকপাত : অসিত দাস বল পয়েন্ট কলমের জার্নির জার্নাল : রিঙ্কি সামন্ত মহেঞ্জোদারো নামের নতুন ব্যুৎপত্তি : অসিত দাস পরিসংখ্যানে দারিদ্রতা কমলেও পুষ্টি বা খাদ্য সংকট কি কমেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী অথ স্নান কথা : নন্দিনী অধিকারী তন্ত্র বিদ্যার বিশ্ববিদ্যালয় চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মেসোপটেমিয়া ও সিন্ধুসভ্যতার ভাষায় ও স্থাননামে দ্রাবিড়চিহ্ন : অসিত দাস ধরনীর ধুলি হোক চন্দন : শৌনক দত্ত সিন্ধুসভ্যতার ভাষা মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলনের রাজা হামুরাবির নামে : অসিত দাস বিস্মৃতপ্রায় জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় ভাষায় সিন্ধুসভ্যতার মেলুহার ভাষার প্রভাব : অসিত দাস বঙ্গতনয়াদের সাইক্লিস্ট হওয়ার ইতিহাস : রিঙ্কি সামন্ত নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘ঝড়ের পরে’ ভালো থাকার পাসওয়ার্ড (শেষ পর্ব) : বিদিশা বসু গাছে গাছে সিঁদুর ফলে : দিলীপ মজুমদার ভালো থাকার পাসওয়ার্ড : বিদিশা বসু সলিমুল্লাহ খানের — ঠাকুরের মাৎস্যন্যায় : ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা : মিল্টন বিশ্বাস নেহরুর অনুপস্থিতিতে প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদও ৩৭০ অনুমোদন করেছিলেন : তপন মল্লিক চৌধুরী সিঁদুরের ইতিকথা আর কোন এক গাঁয়ের বধূর দারুণ মর্মব্যথা : দিলীপ মজুমদার সাহিত্যিকদের সংস্কার বা বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষে শ্রীপাণ্ডবা বা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত দশহরার ব্যুৎপত্তি ও মনসাপূজা : অসিত দাস মেনকার জামাই ও জামাইষষ্ঠী : শৌনক ঠাকুর বিদেশী সাহিত্যিকদের সংস্কার ও বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভক্তের ভগবান যখন জামাই (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই প্রভু জগন্নাথদেবের শুভ স্নানযাত্রার আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কমেডিয়ান নন, একজন পূর্ণাঙ্গ অভিনেতা : মনোজিৎকুমার দাস

মনোজিৎকুমার দাস / ৩১০ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ২৭ আগস্ট, ২০২২

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা হাস্যকৌতুকের বিরল প্রতিভার অধিকারী অভিনেতা। মানুষকে আনন্দ দেওয়ার যে উপাদান, তিনি যেন তা নিয়েই জন্মেছিলেন এই বঙ্গে। তাকে যারা কমেডিয়ান বলতেন, তাদের কাছে হয়ত অন্য শব্দ ছিল না। তিনি শুধুই কমেডিয়ান নন, একজন পূর্ণাঙ্গ অভিনেতা। অভিনয়ের সব উপাদান গুলো শাণিত করেই জন্মেছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।

একালের মানুষ ভানুকে সিনেমার অভিনেতা হিসেবে যতটা চেনে তার থেকে কৌতুক অভিনেতা হিসাবে বেশি জানে। এখনকার মানুষের কোন কৌতুক শুনে বলে এ যেন ভানুর কৌতুক।

আমরা প্রথমে ভানুর জনপ্রিয় কয়েকটি কৌতুকের উদাহরণ দেব।

‘ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়’ সে-বার যেন ঘোর বিপদে পড়েছেন। তিনি তখন পেশায় ‘জেনারেল কনসালট্যান্ট’। তাঁর ভাষায়, ‘‘লোকেরে সব বিষয়ে জ্ঞান দেই।’’ ফি ১২ টাকা (নিজে ন’টাকা, দালালের তিন)। বাড়ির বাইরে বিরাট সাইনবোর্ড ‘লর্ড ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়’।

খামোখা লর্ড কেন লিখতে গেলেন? ‘এটা কী করলে? মামলায় পড়ব তো!’ ভানুকে সাবধান করতে এগিয়ে এলেন জনৈক হিতৈষী। ভানু তাঁকে জলের মতো সহজে লর্ড-রহস্য বুঝিয়ে দিলেন।

‘‘ব্যাপার হইল কী জানেন, দ্যাশে তো কিসু জমিজমা আমার আছিল, জমি থাকা মানেই ল্যান্ডলর্ড। দ্যাশ বিভাগের পর ল্যান্ড তো গ্যাল, পইড়া রইল লর্ড। লর্ডেরে রাখি কই! নামের গোড়ায় লাগাইয়া দিসি।’’

ভানু গেছে তার গুরুদেবের বাসায়। লক্ষ্য কর্নেল চ্যাটার্জীর সাথে দেখা করে একটি চাকরি যোগার করা।

কর্নেল চ্যাটার্জী: কে?

ভানু: আজ্ঞে, আমি ঢাকার ভানু।পেন্নাম হই।

কর্নেল চ্যাটার্জী: পেন্নাম নয়, কথাটা প্রণাম।

ভানু: ভ্যেম হইয়া গেছে।

কর্নেল চ্যাটার্জী: ভ্যেম নয়, কথাটা ভ্রম।

ভানু: বাহ!! প্যেত্যেক কথার র ফলা দিতে হবে?

কর্নেল চ্যাটার্জী: প্যেত্যেক নয়, প্রত্যেক।এটাতেও র ফলা দিতে হবে।

ভানু: ব্রেশ ব্রেশ।

কর্নেল চ্যাটার্জী: ঐটাতে আর দিয়ো না।

ভানু: ন্রা। দ্রিমু য্রখন ত্রখন সবট্রাতেই দ্রিমু।

এই ‘কৌতুক নকশা’ তখন মুখে মুখে ঘুরছে। অনেকেই তা সত্যি বলেও বিশ্বাস করতেন। ভানুই পারতেন, হাসির মোড়কে ‘রিফিউজি বাঙাল’ বলে লাঞ্ছিত অজস্র ঘা-খাওয়া মানুষের কপালে লর্ড-টিকা পরিয়ে দিতে। দেশভাগের মতো একটা ইতিহাসের ট্র্যাজেডিকেও এ ভাবে গভীর মমতা কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতার আতসকাচে পাল্টে ফেলা যায়! ঠাট্টার ছুরিতে বঙ্গসমাজের চিরকেলে বনেদি শ্রেণি-চেতনাও তাতে ফুটিফাটা। তখন বাঙালির বিনোদন জগৎও ঘটি-বাঙালের তরজায় ভরপুর। উত্তমকুমার-শ্যামল মিত্তির সব মোহনবাগান। ‘ট্রেডমার্ক বাঙাল’ ভানুর চোখে ব্যাকরণসম্মত গালাগালিতে তুখোড় দুই ঘটি ব্যারিটোন স্বর কমল মিত্তির আর কালোদাও (অসিতবরণ)। হতেই পারে তাঁদের সঙ্গে তক্কাতক্কিতেও ভানুর তুণে এ সব রসিকতার তির মজুত হয়েছে।

বাংলার চলচ্চিত্র ও মঞ্চজগতে কৌতুক ও রসাভিনয়ে একটি সর্বাগ্র গণ্য নাম ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন ঢাকার সন্তান। গর্বভরে নিজেই বলেছেন, ‘আমি ঢাকার ভানু।’

বাঙাল’ ভাষা ব্যবহার করে তিনি হাস্যরসের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। একটা উদহারণ দেওয়া যাক:

ভানু: আমি তো বাঙাল। আপনে কী?

চরিত্র: আমি আবার কী? বাঙালি।

ভানু: তাইলে কী খাড়াইল?

চরিত্র: কী আবার খাড়াইল?

ভানু: কথাডারে ব্যাকরণে ফেলান। আমি হইলাম বাঙাল আর আপনে হইলেন বাঙালি। তার মানে আমি হইলাম পুং লিঙ্গ আর আপনে হইলেন স্ত্রী লিঙ্গ।

তিনি অসংখ্য কৌতুক নকশায় অভিনয় করেছিলেন। সেগুলোর মধ্যে স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া, বাবা পাকিস্তান ইত্যাদিতে ঢাকাইয়া ভাষায় কথোপকথনের মধ্যে হাস্যরসে ভানুর কৌতুক রসবোধের পরিচায়ক।

এই বাংলায় জন্ম হয়েছিল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়’র- ১৯২০ সালের ২৬ আগস্ট মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে। পুরো শিক্ষাকাল কেটেছে ঢাকায়। ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি’স হাই স্কুল এবং জগন্নাথ কলেজে শিক্ষা শেষ করে ১৯৪১ সালে কলকাতায় চলে যান ভানু। সেখানে তিনি আয়রন অ্যান্ড স্টীল কম্পানি নামে একটি সরকারি অফিসে যোগ দেন এবং বালীগঞ্জের অশ্বিনী দত্ত রোডে তার বোনের কাছে দু’বছর থাকার পর টালিগঞ্জের চারু অ্যাভিনিউতে বসবাস শুরু করেন।

১৯৪৭ সালে ‘জাগরণ’ সিনেমার মাধ্যমে অভিনয় জীবন শুরু হয় ভানু বন্দোপাধ্যায়ের। একই বছর ‘অভিযোগ’ নামে আরেকটি সিনেমা মুক্তি পায় তার। এরপর ধীরে ধীরে সিনেমার সংখ্যা বাড়তে থাকে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৯৪৯ সালে ‘মন্ত্রমুগ্ধ’, ১৯৫১ সালে ‘বরযাত্রী’, এবং ১৯৫২ সালে ‘পাশের বাড়ি’।

১৯৫৩ সালে মুক্তি পায় ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমাটি। বলা যায় এই সিনেমার মাধ্যমেই ভানু দর্শকদের নিজের অভিনয়ের গুণে আকৃষ্ট করা শুরু করেন। এর পরের বছর মুক্তি পায় ‘ওরা থাকে ওধারে’। ১৯৫৮ সালটিতে মুক্তি পাওয়া অনেক সিনেমার মধ্যে দু’টি ছিল ‘ভানু পেল লটারি’ এবং ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’। ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’- এই সিনেমাতে ভানু নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন, বিপরীতে ছিলেন রুমা গুহঠাকুরতা।

১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘৮০তে আসিও না’ সিনেমাটিতেও ভানু নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন এবং এখানেও তার বিপরীতে ছিলেন রুমা গুহঠাকুরতা। ১৯৬৭ সালে ভানুর আরো একটি সিনেমা মুক্তি পায় ‘মিস প্রিয়ংবদা’, যে সিনেমাটিতে উনি চরিত্রের প্রয়োজনে মহিলা সেজে অভিনয় করেন। ভানুর ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’ সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৭১ সালে। ১৯৮৪ সালে ‘শোরগোল’ সিনেমাটিই তার সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা।

অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় চরিত্রাভিনেতা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই স্মৃতিচারণ করে ভারতীয় একটি গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘কখনও আফসোস করতে দেখিনি ভানুদাকে। অনেক ঝড় এসেছে জীবনে। তবে সমবেদনা চাননি। কারও কাছে হাতজোড় করে সাহায্য প্রার্থনা করেননি। লড়াকু মানুষ ছিলেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে আসলে নকল করা যায় না। তার থেকে উত্তাপ নেওয়া যায়।’

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বলেছিলেন, ‘উনি কমেডিয়ান নন। একজন পূর্ণাঙ্গ অভিনেতা। তবে দর্শক ভালোবেসেই কমেডিয়ান বলতেন। আসলে কমেডিয়ান হতে গেলে সব দিক পরিক্রমা করে আসতে হয়। যিনি হাসাতে পারেন, তিনি দর্শকের চোখে জলও আনতে পারেন। যেমন চার্লি চ্যাপলিন। দেখে হাসছেন, কিন্তু কখন যে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়বে, বুঝতে পারবেন না। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও তেমন।’

১৯৮০ সালের ২৬ আগস্ট ৬০তম জন্মদিনে এক আড্ডায় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘একদিন আমাকে এক ভদ্রলোক কমিউনিজম সম্বন্ধে বোঝাতে এসেছিল। তাকে বলেছিলাম, আজ থেকে ৫৯ বছর আগে আমার মায়ের বাবা আমার নাম রেখেছিলেন সাম্যময়! বুঝতে পারছেন, আমি কোন পরিবার থেকে এসেছি? দ্যাট আই অ্যাম আ কমিউনিস্ট, আই বিয়ার ইট ইন মাই নেম। আপনি আমার চেয়ে ভালো কমিউনিস্ট কী করে হবেন?’

১৯৮৩ সালের ৪ মার্চ কলকাতার উডল্যান্ডস হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন আপামর বাঙালির প্রিয় অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। আজীবন যিনি বাঙালিকে হাসিয়েছেন, সেই তিনিই নিজের শেষযাত্রায় সবাইকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নেন। বাংলা চলচ্চিত্র যতদিন থাকবে, ততদিন স্বমহিমায় বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।

কৈশোরে বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের পার্শ্বচর হিসেবে তাঁর নির্দেশমাফিক টিফিনবক্সে রিভলবার আর ‘নিষিদ্ধ’ বই পাচার করতেন তিনি। তৎকালীন পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকার সদরঘাট দিয়ে পুলিশ ও সরকারি কর্মচারীদের আসা-যাওয়ার ওপর রাখতেন তীক্ষ্ণ নজর। এক কথায়, তিনি ছিলেন খুদে গুপ্তচর। পরে ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন, অনন্ত সিং—এঁদের সঙ্গে পরিচয় ও জানাশোনা হয় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

হ্যাঁ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। সরস রঙ্গ ও কৌতুকের জন্য যে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের খ্যাতি দুই বাংলাজুড়ে, তিনি ঢাকার সন্তান। তাই হয়তো সব জায়গাতেই ‘ঢাকার ভানু’ হিসেবে নিজেকে পরিচিত করতে ভালোবাসতেন তিনি। আজ সেই ঢাকার ভানুর জন্মশতবর্ষ।

১৯২০ সালের ২৬ আগস্ট ঢাকার দক্ষিণ মৈসুণ্ডি গ্রামে (সেই সময়ের বিক্রমপুর) জিতেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুনীতি বন্দ্যোপাধ্যায় দম্পতির ঘরে জন্ম নেয় এক শিশু। নাম রাখা হয় সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে মা–বাবার কাছে তিনি ছিলেন আদরের ভানু। ফলে ভানু নামের আড়ালে ঢাকা পড়ে তাঁর সাম্যময় নামটি। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ভানু ছিলেন ছোটর ওপরের জন। তাঁর দুই ভাইয়েরই অকালমৃত্যু হয়—একজন মারা যান ছোটবেলায় এবং অন্যজন পুলিশে চাকরিরত অবস্থায় মাত্র ২৬ বছর বয়সে। তাই ভানু ছিলেন তিন বোনের সবেধন নীলমণি একমাত্র ভাই।

ভানুর বাবা জিতেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে ঠাকুরবাড়িতে গৃহশিক্ষক ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রের। পরে অবশ্য ঢাকার নবাব এস্টেটের সদর মোক্তার হিসেবে চাকরি নেন। আর মা সুনীতি দেবী কর্মরত ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষা দপ্তরে। বাবা-মা সরকারি কর্মচারী, ফলে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধাচরণ বা ব্রিটিশবিরোধী মত প্রচার ও প্রকাশ করা ভানুদের বাড়িতে ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তা সত্ত্বেও ১২ বছরের ভানু লুকিয়ে যোগ দেন স্বদেশি আন্দোলনে।

ঢাকার পোগোজ স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা এবং সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাসের পর ভানু ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজ। এরপর স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে তাঁর সতীর্থ ছিলেন সাংবাদিক নির্মল সেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সত্যেন বসু, ড. জ্ঞান ঘোষ ও মোহিতলাল মজুমদারের প্রিয় ছাত্র ছিলেন ভানু।

তবে স্বদেশি আন্দোলনের কর্মী সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরস কৌতুকপ্রতিভার সূচনা ঘটল কীভাবে?

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়ানোর পর জনমানুষের সঙ্গে অবাধে মেশার সুযোগ পান ভানু। এ সূত্রেই মানুষকে তীক্ষ্ণ পর্যালোচনা ও অনুধাবন করার ক্ষমতা গড়ে ওঠে তাঁর। ঢাকায় তিনি মিশতেন ঘোড়ার গাড়ির চালক ‘ঢাকাই কুট্টি’দের সঙ্গে। কুট্টিদের প্রবল তীক্ষ্ণ রসবোধ ভানুর কৌতুকপ্রতিভা বিকশিত করতে সাহায্য করেছিল। এর প্রভাব দেখা যায় তাঁর পরবর্তী জীবনে। ১৯৪৩ সালে তাঁর প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড শ্রুতিনাট্যের কৌতুক নকশা বের হয়। তিনি এই কৌতুক নকশার নাম রাখেন ‘ঢাকার গাড়োয়ান’। এটা ছিল ঢাকার গাড়োয়ানদের নিয়ে ১৫ মিনিটের কমিক স্কেচ। পরের বছর অবশ্য এটি কেটেছেঁটে ৬ মিনিট করা হয়।

গত শতকের তিরিশের দশকে ভানু যে সময়ে বেড়ে উঠেছেন, তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জোয়ার চলছে ভারতবর্ষজুড়ে। তার ঢেউ আছড়ে পড়েছে ঢাকা শহরেও। ত্রিশ দশকের শেষ দিকে বাংলার রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন ভানু। ছাত্রজীবনে প্রথমে তিনি ছিলেন অনুশীলন সমিতিতে। পরে ১৯৪০ সালে যোগদান করেন আরএসপি নামের এক বামপন্থী সংগঠনে।

কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর এক অভিযান চালান ঢাকার বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত। তিনি ভানুকে খুব স্নেহ করতেন। বিভিন্নজনের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, দীনেশ গুপ্তের একটা সাইকেল ছিল। আর ওই সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারটা যেন ছিল ভানুরই। কেননা, তখনকার ঢাকায় দীনেশ গুপ্ত সাইকেলে যাচ্ছেন, অথচ সেই বাহনের পেছনের ক্যারিয়ারে ভানু বসে নেই—এমন দৃশ্য কল্পনা করাও ছিল কষ্টকর। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই দীনেশ গুপ্ত যখন ফাঁসিমঞ্চে প্রাণ দেন, ভানু তখন নিচ্ছেন দেশমাতৃকা মুক্ত করার বলিষ্ঠ শপথ।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, ঢাকার ভানু আদতে কেমন ছিলেন? জানা যাবে অনন্ত সিংয়ের কথা থেকে, ‘বিপ্লবীরা কি কখনো হাসতে জানে? বিপ্লবীদের হৃদয়ে দয়া নেই, মায়া নেই, নিষ্করুণ, নির্দয় ও নিষ্ঠুর পদার্থে গড়া বিপ্লবীর হৃদয়। নিজের সম্বন্ধে আমার এরূপ ধারণাই ছিল। তার একমাত্র কারণ আমার চারিপাশে বন্ধুরা আমাকে এই বলে সম্মোহিত করে রেখেছিল যে, আমি অতি নিষ্ঠুর, নির্দয় ও নিষ্করুণ—আমার হৃদয়ে কখনো কখনো করুণা, প্রেম, ভালোবাসা কোনো দিন কোনো স্থান পাবে না। তাদের এ রকম মন্তব্য শুনে শুনে আমি অভ্যস্ত ছিলাম। কোনো রকম প্রতিবাদ করতাম না।

‘আমার ভুল ভাঙল সেই দিন, যখন আমার প্রিয় যুবকবন্ধু কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সান্নিধ্য লাভ করলাম। “যমালয়ে জীবন্ত মানুষ” প্রথম একটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের সিনেমার ছবি আমি প্রযোজনা করি। শিল্পীদের সহযোগিতায় এই ছবিটি আমি সম্পূর্ণ করতে পেরেছিলাম।

‘এই সময়ে ভানুবাবুর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়। তখন বুঝেছিলাম যে তিনি কেবল কৌতুক অভিনেতা নন, তিনি বাংলাদেশের সিনেমার পর্দায়, থিয়েটারের মঞ্চে, যাত্রার আসরের একজন সার্থক হাসির রাজা।

‘ভানুবাবুকে আমি কেবল কৌতুক অভিনেতা হিসেবে দেখছি তা নয়, তাঁকে আমি একজন বলিষ্ঠ দেশপ্রেমিক বলে মনে করি।’

এই দেশপ্রেমিক মানুষটি, পরবর্তীকালে যিনি খ্যাতিমান অভিনেতা হয়ে গোমড়ামুখের বাঙালিকে রসসাগরে ভাসিয়ে দেবেন, সেই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মানস গঠন হয়েছিল ঢাকায়। কেবল মানস গঠন নয়, ঢাকাতেই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন তিনি।

এক সাক্ষাৎকারে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ঢাকার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমি যখন ঢাকায় অভিনয় করতাম, তখন আমার প্রথম সারির দর্শক ছিলেন অধ্যাপক সত্যেন বসু, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌, ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, কবি মোহিতলাল মজুমদার, কবি জসীমউদ্‌দীন, অর্থনীতিবিদ এইচ এল দে, ড. এস কে দে প্রমুখ। তাঁরা আমার অভিনয় দেখে বলেছিলেন, তোর হবে।’

ভানুর হয়েছিলও বটে। চলচ্চিত্র ও মঞ্চজগতে কৌতুকরসের অভিনয়ে একটি সর্বাগ্রগণ্য নাম ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। ঢাকার ভানু কলকাতায় গিয়ে সিনেমায় অভিনয় শুরু করেন ১৯৪৬ সালে। সে বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি সুশীল মজুমদার পরিচালিত ‘জাগরণ’-এ অভিনয় শুরু করার মাধ্যমে চলচ্চিত্রের অঙ্গনে তাঁর পা পড়ে। একই বছর সংগীতশিল্পী নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন তিনি।

১৯৪৬ সাল থেকে ভানুর চলচ্চিত্রাভিনয়ের যে যাত্রা, সেখানে দিনে দিনে যুক্ত হয়েছে অজস্র পালক। ১৯৪৯ সালে বিমল রায় পরিচালিত ‘মন্ত্রমুগ্ধ’, প্রেমেন্দ্র মিত্র পরিচালিত ‘সেতু’ প্রভৃতি ছবিতে কাজ করার পর থেকে আর তাঁকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের লেখা গল্প থেকে ‘কাঞ্চন মূল্য’ নামে একটি চলচ্চিত্রও পরিচালনা করেন ভানু। তা ছাড়া বাংলা সিনেমা ছাড়াও কয়েকটি হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। সত্যেন বোস পরিচালিত ‘বন্দিশ’ ও দুলাল গুহ পরিচালিত ‘এক গাঁও কি কাহানি’ ভানু অভিনীত অন্যতম হিন্দি চলচ্চিত্র। অন্যদিকে, এই অভিনেতার বিখ্যাত শ্রুতিনাটকের সংখ্যাও অনেক।

বস্তুত, প্রবল রসবোধের কারণে ভানুর ছবিগুলো ফ্লপ হওয়া একটু কঠিনই ছিল। ২৫০টির মতো চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। এসব চলচ্চিত্রের সংলাপ উচ্চারণ ও ডেলিভারিতে তিনি ব্যবহার করেছেন ঢাকাইয়া উচ্চারণ ও ভাষাভঙ্গী, যা একই সঙ্গে তাঁর অভিনয়কে জীবন্ত ও স্বতন্ত্রও করে তুলেছে। ‘সিরিয়াস অভিনয়ে একটু বেশি কাঁদলে ক্ষতি নেই, কম কাঁদলেও চলবে। কিন্তু কমিক চরিত্রের অভিনয়ে প্রপরশন জ্ঞানটা ভীষণ প্রয়োজন। খুব ভালো অভিনেতা না হলে ভালো কমেডিয়ান বা কৌতুক অভিনেতা হওয়া সম্ভব নয়।’ এ কথাগুলো বোধ করি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা স্মরণ রেখেই বলা হয়েছে।

আর অভিনয় প্রসঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য ছিল এমন, ‘অ্যান আর্টিস্ট মাস্ট ডিক্লাস হিমসেলফ। অভিনেতা যদি চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হতে না পারেন, তবে তার পক্ষে কোনো শিল্প সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। কেউ কেউ অবশ্য সহজাত শিল্পপ্রতিভা নিয়েই আসেন, আর অন্যদের কঠোর চেষ্টার দ্বারা শিল্পী পর্যায়ে উন্নীত হতে হয়।’

আমাদের ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সহজাত শিল্পপ্রতিভা নিয়েই এসেছিলেন। ১৯৪১ সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়। এ কারণে সে বছরের ১৪ অক্টোবর ঢাকা থেকে এক বস্ত্রে এক পরিচিতজনের গাড়ির পেছনের সিটের পাদানিতে শুয়ে কলকাতায় যান ঢাকার ভানু। কলকাতায় তিনি চলে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু বুকের ভেতর নিয়ে গিয়েছিলেন একখণ্ড ঢাকা। আর স্মৃতিময় সেই ঢাকার গন্ধ বুকে নিয়েই ১৯৮৩ সালের ৪ মার্চ তিনি চলে যান পৃথিবী ছেড়ে।

কালজয়ী জুটি উত্তম-সুচিত্রার সঙ্গে একটি সিনেমা আছে ভানুর। সেই চলচ্চিত্রের স্মৃতি উল্লেখ করে এক লেখায় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে একটা মন্তব্য করেছিলেন সুচিত্রা সেন। সেটুকু তুলে ধরে এ লেখার ইতি টানব, ‘শুরু হয়েছিল সেই “সাড়ে চুয়াত্তর” দিয়ে। পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিক সেটা। তাঁর সেই বিখ্যাত সংলাপ তখন—এমনকি এখনো মানুষের মুখে মুখে ফিরে চলছে—“মাসিমা, মালপোয়া খামু”। এরপর দিন, মাস, বছর কাটছে, ভানুবাবু মানুষকে হাসিয়েই চলেছেন—অনাবিল মুক্ত হাসি। দুঃখে যারা বিহ্বল, বেদনায় যারা বিধুর, ভানুবাবু তাদের মুখেও হাসি জুগিয়ে চলেছেন।’

ভানু  ছবিতে অভিনয় করেছেন এবং যেখানে বিশেষ কিছু করার নেই, সেখানেও করেছেন। আশ্চর্য এই যে যা-ই করেছেন, তা বহরে ছোট হোক বা বড়ই হোক, তার মধ্যে তাঁর সাবলীলতার পরিচয় রেখে গেছেন। সর্বজনপ্রশংসিত বিরল অভিনেতাদের মধ্যে ভানুবাবু একজন।

সত্যজিৎ রায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ভানু সম্বন্ধে কী বলেছিলেন আসুন দেখি—”ভানু অজস্র ছবিতে অভিনয় করেছেন এবং যেখানে বিশেষ কিছু করার নেই, সেখানেও করেছেন। আশ্চর্য এই যে যা-ই করেছেন, তা বহরে ছোট হোক বা বড়ই হোক, তার মধ্যে তাঁর সাবলীলতার পরিচয় রেখে গেছেন। সর্বজনপ্রশংসিত বিরল অভিনেতাদের মধ্যে ভানুবাবু একজন।”—সত্যজিৎ রায়

“ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় বললে শুধুই একটা হাসানোর যন্ত্র মনে পড়ে না; একটা জীবনধারণা, জীবন সম্পর্কে একটা মন্তব্য যেন মনকে ছুঁয়ে যায়। বাংলা চলচ্চিত্রে যেমন উত্তম-সুচিত্রা ছাড়া চলত না, তেমন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তীর গুরুত্বও অপরিসীম। উত্তম-সুচিত্রার মতো তাঁরাও জনপ্রিয় ছিলেন দর্শকদের কাছে। তাঁদের চাহিদাও ছিল সমান।”—সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

রসবোধক সম্পন্ন কৌতুক নকশায় ও সিনেমায় কৌতুকধর্মী হাস্যরসাত্মক অভিনয়ের কারণে বাঙালি কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই একটা ইনস্টিটিউট হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকবেন চিরকালের জন্য।

মনোজিৎকুমার দাস, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অনুবাদক ও কবি, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা বাংলাদেশ।


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন