বুধবার | ২৮শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | সকাল ১১:৪৪
Logo
এই মুহূর্তে ::
মনোজ বসু-র ছোটগল্প ‘বাঁশের কেল্লা’ গ্রেস কটেজ বুলেটিন প্রকাশ : দীপাঞ্জন দে অথ ওয়াইন কথা : রিঙ্কি সামন্ত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিকিৎসাবিভ্রাট : অসিত দাস বাংলা ইসলামি গান ও কাজী নজরুল ইসলাম : আবু বকর সিদ্দিকি পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের অনবদ্য সৃষ্টি ‘কবর’ কবিতার শতবর্ষ পূর্তি : মনোজিৎকুমার দাস কঠোর শাস্তি হতে চলেছে নেহা সিং রাঠোরের : দিলীপ মজুমদার রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন : শান্তা দেবী বাঙালি মুসলমান সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা : ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সিন্ধু সভ্যতার ভূখণ্ড মেলুহা-র সঙ্গে বাণিজ্যে মাগান দেশ : অসিত দাস তদন্তমূলক সাংবাদিকতা — প্রধান বিচারপতির কাছে খোলা চিঠি : দিলীপ মজুমদার হেমন্তকুমার সরকার ও নজরুল-স্মৃতিধন্য মদনমোহন কুটির : ড. দীপাঞ্জন দে রামমোহন — পুবের সূর্য পশ্চিমে অস্তাচলে গেলেও শেষ জীবনে পিছু ছাড়েনি বিতর্ক : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় মাওবাদী দমন না আদিবাসীদের জমি জঙ্গল কর্পোরেট হস্তান্তর : তপন মল্লিক চৌধুরী জৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণপক্ষে শ্রী অপরা একাদশী মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত পর্যটন মানচিত্রে রামমোহনের জন্মভূমিতে উন্নয়ন না হওয়ায় জনমানসে ক্ষোভ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সংগীতে রবীন্দ্রনাথ : সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর গোয়ার সংস্কৃতিতে সুপারি ও কুলাগার কৃষিব্যবস্থা : অসিত দাস পুলওয়ামা থেকে পহেলগাঁও, চিয়ার লিডার এবং ফানুসের শব : দিলীপ মজুমদার ক্যের-সাংরী কথা : নন্দিনী অধিকারী সুপারি তথা গুবাক থেকেই এসেছে গোয়ার নাম : অসিত দাস রোনাল্ড রসের কাছে জব্দ ম্যালেরিয়া : রিঙ্কি সামন্ত রাজ্যে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ছে, কমবে অন্য রাজ্যের উপর নির্ভরতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় উনিশের উত্তরাধিকার : শ্যামলী কর কেট উইন্সলেটের অভিনয় দক্ষতা ও চ্যালেঞ্জিং ভূমিকার ৩টি চলচ্চিত্র : কল্পনা পান্ডে হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলা — আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংকট : সুব্রত কুমার দাস সিন্ধুসভ্যতার ভাষা যে ছিল প্রোটোদ্রাবিড়ীয়, তার প্রমাণ মেলুহা তথা শস্যভাণ্ডার : অসিত দাস চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (শেষ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস জাতিভিত্তিক জনগণনার বিজেপি রাজনীতি : তপন মল্লিক চৌধুরী গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তালশাঁসের চাহিদা : রিঙ্কি সামন্ত
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা (গুরু পূর্ণিমা) আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

মনোজ বসু-র ছোটগল্প ‘বাঁশের কেল্লা’

মনোজ বসু / ৫০ জন পড়েছেন
আপডেট মঙ্গলবার, ২৭ মে, ২০২৫

বাঃ, খাসা সাজিয়েছ তোমরা নিশিবাবু। বেছে বেছে বাঁশতলায় সভার জায়গা করেছ, ভারি ঠাণ্ডা জায়গা, রোদ লাগবে না মানুষজনের গায়ে শেয়াকুল আর ন্যাড়াসেজির ঝাড় সাফসাফাই হয়ে গেছে, তেরঙা নিশান উড়িয়েছ দীঘির পাড়ে পোড়া দালানের সামনে। আমরাও একটা নিশান বেঁধে দিয়েছিলাম ঐ দালানের ছাতে। সেটা অত বড় নয়— আর উড়েছিল বড় জোর পাচটা কি ছ-টা দিন।

যা ভাবছ, তা নয়। মাথা খারাপ হয়েছিল সত্যি জেলের মধ্যে, এখন সেরে গেছে। এখন ভালমানুষ আমি। বত্রিশ টাকা ভিজিটের বিলাতি খেতাব-ওয়ালা ডাক্তার ওষুধ দিয়েছিল, পাগলামি কদিন থাকে? এমনি আমি মাঝে মাঝে বাঁশবনের ধারে এসে বসি, দীঘির পাড় পোড়া-দালান আর পোড়ো ভিটেগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। চুপচাপ বসে থাকি নিশিবাবু, আজকেই তোমায় পেয়ে মীটিঙের খবরাখবর নিচ্ছি।

লক্ষ্মণ মাইতি মশায়ের জায়গা বুঝি দীঘির পাড়ে ঐ ঢিবির উপর? না— উঁচুতে আলাদা হয়ে কেউ বসবে না তোমাদের সভায়। সপ পেতে দেওয়া হবে একসঙ্গে সকলের জন্য। কিন্তু সপই বা কেন? বাঁশপাতা ঝরে ঝরে স্তূপাকার হয়ে আছে, ও-ই কতক এনে ছড়িয়ে দাও— গদির মতো হবে, দিব্যি আরাম করে বসা চলবে। কতদিন নিশিবাবু বাঁশপাতার বিছানায় ঘুমিয়েছি আমরা! বেশ লাগত। প্রভাসটা বাইরে থেকে এমন কাটখোট্টা— কদম-ছাটা চুল, গেরুয়া পরত না বটে কিন্তু হাটুর নীচে কাপড় নামতে দেখিনি, বছর পনের নিরামিষ ধরেছে— তার মধ্যে শুন ছোয় না বছর পাঁচেক— প্রভাস-বহারাজ বলে ক্ষেপাতাম আমরা, স্ফূর্তির জোয়ার খেলতে লাগল ঐ সময়টা যেন তারও মনে। এক টুকরো বাঁশের গোঁড়া পাতার ছোটা দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে দোলনার মতো করে নিয়েছিল। যেদিন পেটে ভাত পড়ত না দোল খাওয়ার শখ বেড়ে যেত তার সেইদিন।

ফুল নিয়ে নিয়ে আসছে— ঢিবির উপর ঢালবে? কিন্তু কতক্ষণ থাকবে বলো নিশিবাবু? বাতাস এলে ঝুর-ঝুর করে বাঁশপাতা ঝরে পাতার নীচে তোমাদের ফুলসজ্জা গুলিয়ে দেবে। এই তো ক বছর আগে রক্তের ছোপে রাঙা হয়ে গিয়েছিল পোড়া দালানের সামনে দীঘির পাড়ের ঐধানটা। বাপপাতা সরিয়ে দেখ দিকিতার কোন দাগ আছে কিনা? লোকের মনে একটু-আধটু হয়তো আছে, তা-ও মিলিয়ে যাবে আর ক-বছর পরে।

মীটিং সন্ধ্যাবেলা— কত মানুষ আসতে শুরু করেছে এখনই এই সকাল থেকে। একজন দু-জন করে আসছে, আবার এক একটা মিছিল জমিয়ে আসছে। দূর-দূরান্তর থেকে খেয়া পার হয়ে আসছে। অনেকগুলো চাষী মেয়ে-বউ ফুলঝুরি ষ্টেশনে এসে নেমেছে, সেখান থেকে গরুর গাড়িতে চাকার ধূলোয় ধূসর হয়ে আসছে— ঐ দেখ। পোড়া দালানে অনেকদিন পরে মানুষের সোরগোল। দরজা-জানলা পুড়ে গিয়ে ঘরগুলো হা-হা করছে— তারই একটায় বিজলী ডাক্তার খাবার জল আর তূলো-আইডিন নিয়ে অফিস সাজিয়ে বসেছে। ঐ ঘরেরই একপাশে একটুখানি বিছানা করা আছে, যদি বিশ্রামের দরকার মনে করেন লক্ষ্মণ মাইতি মশায় এসে পৌঁছবার পর। বুড়ো মানুষ, তার উপর শরীরের ঐ হাল-মানুষগুলো নেহাৎ নাছোড়বান্দা বলেই তাঁকে সভা করে বেড়াতে হয় এগ্রামে সেগ্রামে। তিনি আসছেন শুনে পাঁচ ক্রোশ সাত ক্রোশ দূর থেকেও ভোরবেলা চাল-চিঁড়ে নিয়ে সব বেরিয়েছে। বক্তৃতা করতে পারেন না মাইতি মশায়— দুটো কথা একসঙ্গে গুছিয়ে বলতে কালঘাম ছুটে যায়, অ্যা-অ্যা করেন— সেই সময় পাশ থেকে কথা জুগিয়ে দিতে হয়। তবু তাঁর নাম শুনে, তিনি হাতে করে শহীদ-পদক পরিয়ে দেবেন সেই অনুষ্ঠান চোখে দেখবে বলে পিঁপড়ের সারির মতো মানুষ আসছে দেখ। মাইতি মশায়ের সঙ্গে একই দিনে জেল থেকে বেরুই আমি-গ্রামে এসে এদিক-ওদিক তিনি তাকাচ্ছেন, কোন জায়গায় ঘরবাড়ি ছিল চিনতে পারেন না। আর আমার কিন্তু ঠিক উল্টো অবস্থা, কিছু নেই— তবু সমস্ত জীবন্ত দেখতে পাই চোখের সামনে; সব কেমন চলে ফিরে বেড়ায়। পাগল হয়েছিলাম, আমি নিজে যা একবিন্দু টের পাই নি। সেই তারা সব রাতদিন যেন ঘিরে বসে থাকত আমায়, বড় আরামে ছিলাম। বরং মনে হয়, পাগল বুড়ো মাইতি মশায়ই। হাসতে লাগলে মনে হবে অমন সুখী লোক ভূ-ভারতে নেই। জেল থেকে বেরিয়ে ঘর উনি আর নূতন করে বাঁধলেন না। বললে হাসতে থাকেন, দরকার কি ভাই? কথা মিথ্যা নয়, ঘরের আর ওঁর কি দরকার? নিজে তো আজ এখানে কাল সেখানে এই করে বেড়াচ্ছেন। বউ জলে ডুবে মরেছে। তিন ছেলের মধ্যে প্রভাস ফাঁসিতে গেছে, আর দুটি ছেলে— একটির নাকি এখন-তখন অবস্থা। কেন মিছে ঘর বাঁধার হাঙ্গামা করতে যাবেন বলো?

বাঁশবনের ভিতরে কোনদিন ঢুকেছ নিশিবাবু, ঢুকে কতদূর গিয়েছ? ইচ্ছে হলে ফুলঝুরি ষ্টেশনের লেভেল-ক্রসিং অবধি চলে যেতে পার বাঁশঝাড়ের ছায়ায় ছায়ায়। মাঝে মাঝে খানিকটা করে ফাঁকা, লম্বা উলুঘাস জন্মে আছে সেখানে আর অজস্র কাশফুল। খুব তাড়াতাড়ি যাওয়া যায় এই দিক দিয়ে ষ্টেশনে, পথ অনেক কম— কিন্তু গ্রামের মানুষ নিতান্ত দায়ে না পড়লে বাঁশবনে ঢোকে না, সহজে মাড়াতে চায় না এদিককার পথ।

একটা দিনের কথা বলি, বারো-তোরো বছর বয়স হবে তখন আমার। ঘোর হয়ে গেছে, গরু আসেনি গোয়ালে। দুধাল গরু-ঠাকুরমা উতলা হয়ে ঘর-বার করছেন। তখন বাড়িতে পুরুষমানুষ কেউ নেই গরু খুঁজে আনবার মতো। আমি বললাম, ব্যস্ত হয়ো না ঠাকুরমা, পাড়ার মধ্যেই আছে কোনখানে। ননীদের খামার বাড়ি হয়তো ঢুকে পড়েছে তাদের গরু-বাছুরের সঙ্গে, দেখে আসছি। ঐ যে ফাঁকা জায়গাটা নিশিবাবু, কটা ছেলে নুন-দাড়ি খেলা করছে— ঐখানে ছিল ননীদের খামার বাড়ি। গিয়ে শুনলাম, শুঁটকি আমাদের সত্যিই খামারে ঢুকে পোয়াল-গাদা থেকে পোয়াল টেনে টেনে খাচ্ছিল। ওরা দেখতে পেয়ে বেহদ্দ পিটুনি দিয়ে দিয়েছে। তারপর বাঁশতলার এদিক দিয়ে ফিরে যাচ্ছি, মনে হল— ঐতো সাদা মতো… শুঁটকিই। বড্ড রাগ হল, শিঙে একবার দড়ি পরাতে পারলে হয়। ঘুরে ঘুরে আমরা হয়রান হচ্ছি, আর হতভাগা গরু শুয়ে পড়ে দিব্যি জাবর কাটছে ওখানে!

জায়গাটায় এসে দেখি, কিছু নয়— ঝাড়ের ফাঁকে জ্যোৎস্না পড়েছে, সেইটে গরুর মতো মনে হচ্ছে দূর থেকে। ডাকছি, শুঁটকি-ই-ই! সামনের দিকে কি-একটা নড়ে উঠল— শুঁটকি না হয়ে যায় না… ছায়া দেখে দেখে এমনি অনেকটা এগিয়ে গেছি নিশিবাবু, হঠাৎ জোরে বাতাস এল, ক্যাচ কোচ কটর-কট আওয়াজ উঠল বাঁশঝাড়ে। সর্বাঙ্গ শির-শির করে উঠল। ছেলেমানুষ পেয়ে যেন আমাকে ভয় দেখাচ্ছে অশরীরী বহুজন, চেপে ধরবে বুঝি বাঁশের আগা দিয়ে। রাস্তার দিকে দৌড় দিই। ঝাড়ে ঝাড়ে যেন ষড়যন্ত্র হয়ে গেছে, বাঁশ নুয়ে নুয়ে পড়ছে আমার পথ আটকে এই একবার মাটি ছোঁবার উপক্রম, পরক্ষণে আবার সটান উপরে উঠে যাচ্ছে। চাবুকের মতো সপাৎ করে কঞ্চির বাড়ি লাগল মুখের উপর। বাঁশপাতা ঝরছে, মুঠো মুঠো বাঁশপাতা যেন আমার গায়ে ছুঁড়ে মারছে।

রাস্তায় পড়েও ছুটছি। বাঁশবনের আওয়াজ কানে আসছে। এক ঠাকুর ও তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্যের গল্প শুনছিলাম, তারাই শাসাচ্ছে যেন আমায়। ঠাকুরমাকে দেখতে পেয়ে সুস্থির হলাম, লণ্ঠন নিয়ে আমার খোঁজে আসছিলেন। বললেন, শুঁটকি এসে গেছেরে। হুড়কোর ধারে এসে শিং নাড়ছিল, তাকে গোয়ালে তুলে তোকে ডাকতে বেরিয়েছি।

রাতে শুয়ে পরে ঠাকুরমাকে জিজ্ঞাসা করলাম, পীতাম্বর ঠাকুরকে দেখেছ তুমি— সেই যিনি বাঁশের কেল্লা বানিয়েছিলেন?

কিন্তু ঠাকুরমা কেন— তাঁর শ্বশুর অর্থাৎ আমার প্রপিতামহ শণিকান্ত নাকি হামাগুড়ি দিতেন সেই সময়। অথচ গল্পটা ঠাকুরমা এমন গড়গড় করে বলে যান যেন আগাগোড়া চোখের সামনে ঘটতে দেখেছেন তিনি।

পায়ে পায়ে নিশিবাবু চলো না এগিয়ে, পীতাম্বর ঠাকুরের আসন দেখিয়ে দেব। পাকুড়তলা— ভারি জাগ্রত স্থান ছিল ওটা, দেশ-দেশান্তরের মানুষ আসত-আজকে যেমন আসছে লক্ষ্মণ মাইতি মহাশয়ের মীটিঙে। বাঁশঝাড় চারিদিকে চেপে ধরেছে পাকুড়গাছটাকে— আসল গাছ অনেকদিন মরে গেছে, খান দুই ডাল বেঁচে রয়েছে কোন প্রকারে, আর ক’বছর পরে চিহ্ন থাকবে না এ গাছের। ঠাকুরমার গল্প শুনেছি, পীতাম্বর ঠাকুর স্নান-আহ্নিক সেরে দেড় প্রহর রাত্রে এই গাছতলায় এসে বসতেন, শিষ্য-সেবকেরা সেই সময় চারিদিকে ঘিরে এসে বসত।

কোম্পানির তখন প্রথম আমল। ঠাকুর তো আস্তানা গড়ে নিশ্চিষ্ট আছেন। বাঁশবন নয় এটা তখন— নদীর প্রান্ত জুড়ে বিস্তীর্ণ মাঠ। দো-চালা খোড়ো-ঘর বেঁধে সর্বমঙ্গলা ভুবনেশ্বরীর মন্দির প্রতিষ্ঠা হল সকলের আগে। তার চারিদিকে সংখ্যাতীত কুঁড়ে উঠল আশ্রমবাসী ও অতিথ-অভ্যাগত সাধুসজ্জনের থাকবার জন্য। মাঠের মাঝখানে গ্রাম গড়ে উঠল দেখতে দেখতে। তালুকদার এল একটা নিরিখ সাব্যস্ত করে বন্দোবস্ত দিতে, পঞ্চায়েত চৌকিদারি ট্যাক্সর ভাগাদায় এল। ঠাকুর বলে দিলেন, রাজার প্রজা নই, সাধুরও খাতক নই। দেবীর কিঙ্কর— খসে পড়ো বাপধনেরা।

গ্রাম আরও জেঁকে উঠছে, নানা অঞ্চল থেকে মানুষ এসে ঘর বাঁধছে। ঢেঁকি-ঢেঁকিশাল তাঁত-চরকা হাপর-নেহাই যা কিছু মানুষের দরকারে পড়ে। বিলের মধ্যে বিস্তীর্ণ ঐ যে ধানবন দেখতে পাচ্ছ নিশিবাবু, ওর বেশির ভাগই সে আমলে কারকিত করত ঠাকুরের লোকজন! এক খোলাটে ধান এনে তুলত, ঝেড়ে উড়িয়ে তুলে দিত ধর্মগোলায়। ট্যাক্স-খাজনার ধার ধারত না, দিব্যি ছিল।

বাঁধাঘাটে সবে তখন চৌকি বসেছে। সে এখান থেকে আট-দশ ক্রোশ দূর, দুর্গম পথ ঘাট। এক বিকালে ঘোড়ায় চেপে দারোগা এল। ছোট রেল না হওয়া অবধি ও অঞ্চল থেকে আসা-যাওয়া বড্ড মুশকিল ছিল নিশিবাবু। রাত থাকতে বেরিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছে, তা-ও প্রায় সন্ধ্যা লেগে গেল পৌঁছতে। গাঙে-খালে তিনটে পারাপার ঘাটে এসে হা-পিত্যেশ বসে থাকতে হয়। মানুষ পার হলেও ঘোড়া পার করে আনা বেশ মুশকিল হয়ে পড়ে৷

দারোগা এসে গড় হয়ে প্রণাম করল ঠাকুরকে। ঠাকুর পূজার নির্মাল্য জবাফুল দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। পাথরের বাটিতে ঘোল আর রেকাবিতে করে খানকয়েক বাতাসা দিয়ে গেল একজন। খেয়ে দারোগা ঠাণ্ডা হল। তারপর বলে, ট্যাক্স চাইতে এসেছিল— হাকিয়ে দিয়েছেন। কোম্পানির রাজ্য জানেন এটা?

না বাবা, সর্বমঙ্গলা ভুবনেশ্বরীর রাজ্য। কারো তিনি ইজারা দিয়ে দেন নি পৃথিবীর জায়গা-জমি। বাজে কথা রাখো, অতিথ এসেছ- খাও-দাও থাকো ছু-চার দিন মায়ের নাম করো, আরাম পাবে। আমরা কারো তোয়াক্কা রাখিনে, কারো সঙ্গে গোলমাল করতে যাইনে। আমাদের কেন এসে জ্বালাতন করছ বাবা?

দারোগা দিন পাঁচ ছয় রইল সেখানে! ঠাকুরমা বলেন, চর্বচোষ্য খেয়ে দিব্যি মজায় ছিল। গিয়ে কিন্তু সদরে রিপোর্ট পাঠাল, জবরদণ্ডি করে আটকে রেখেছিল তাকে। গ্রামে সোরগোল পড়েছে, চওড়া পরিখা কাটা হচ্ছে চারিদিক ঘিরে। আস্ত বাঁশ পুঁতে পুঁতে প্রাচীর তৈরি হল— পর পর তিনটে প্রাচীর-দস্তুরমতো এক কেল্লা। আর ওদিকে অনিবার্য ভাবে যা ঘটবার কথা— একদল গোরা সৈন্য এসে পড়ল।

লম্বা চওড়া ইয়া দশাসই জোয়ান, রক্তাম্বর-পরা— এই নাকি ছিল ঠাকুরের চেহারা। বুক ফুলিয়ে খালি গায়ে সৈনদের বন্দুকের সামনে গিয়ে তিনি দাঁড়ালেন। তারা অবাক হল। ঠাকুর বলেন, কেন গণ্ডগোল করতে এসেছিস? ঘরের ছেলেরা ঘরে চলে যা। আমরা তো বাছা খুতু ফেলতেও যাইনে তোদের দেশে ঘরে।

কিন্তু ফিরে যেতে আসে নি তারা। বন্দুক ছোঁড়ে— ফাঁকা আওয়াজ, ভয় দেখাবার জন্য। ফলে উল্টা উৎপত্তি হল। প্রথমটা সকলের ভয় হয়েছিল— ভেবেছিল, ঠাকুর মরে পড়ে আছেন বুঝি নূতন-কাটা পরিখার ভিতর। কিন্তু হাসতে হাসতে ঠাকুর কেল্লায় এসে ঢুকলেন। লোহার গুলিও তাঁর গায়ে লেগে ধোয়া হয়ে উড়ে গেল। হবে না কেন— ধর্ম সহায়, কারও উপর অন্যায় করতে যান না তো তাঁরা— নিজের জায়গায় চুপচাপ নিজেদের কাজকর্ম নিয়ে থাকেন।

বাঁশের কেল্লা দেখে খুব হাসছে গোরা সৈন্যরা। এগিয়ে এসে ধাক্কাধাক্কি করে তারা প্রাচীরের খানকয়েক বাঁশ খুলে ফেলল। সেই সময় এক কাও— পাকা মন্দির হবে, তার জন্য পাত্র। ভেঙে ইট স্তূপীকৃত করে রেখেছে, ঠাকুরের লোক আক্রোশে দমাদম সেই ইটবৃষ্টি করতে লাগল সৈন্যদের উপর। মাথায় লেগে মুখ থুবড়ে পড়ল একটা, ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল।

পরবর্তী ঘটনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। ঠাকুর মরলেন বন্দুকের গুলিতে, আরও ষাট-সত্তর জন মারা গেল। কেল্লায় আগুন দিল, দাউ-দাউ করে সারা দিনরাত জ্বলল, ফট-ফট করে বাঁশের গিরা ফুটতে লাগল। বিয়াল্লিশ সনে দীঘির পাড়ের ঘরবাড়ি জ্বলতে দেখেছ নিশিবাবু? ওই থেকে সেকালের ছবি আন্দাজ করে নিই। ঠাকুরের অতদিনের অত আয়োজন নিশ্চিহ্ন হল দেখতে দেখতে। একটুখানি কেবল স্মৃতি আছে— এই বাঁশবন। প্রাচীরে কতকগুলো যে গোড়ার বাঁশ পোঁতা ছিল তাই থেকে নূতন নূতন বাঁশ জন্মেছে শতাব্দী কাল ধরে। কসাড় বাঁশঝাড় হয়ে পড়েছে এখন এই জায়গায়৷

এত সব ব্যাপারের একটুখানি ইঙ্গিতও কিন্তু কোন ইতিহাসে নেই৷ ঠাকুরের অসমাপ্ত মন্দির কিম্বা সাত সাতটা যে পাঁজা সাজানো হয়েছিল, তার একটুকরা ইট দেখতে পাওয়া যায় না গ্রামের কোনখানে। পণ্ডিত জনেরা ঘাড় নেড়ে বলেন, গাঁজাখুরি গল্প— সামান্য একটু গ্রাম্যঘটনা লোকে মুখে মুখে রঙ চড়িয়ে এই রকমটা দাঁড় করেছে। সে যাই হোক, ছোট-বেলায় ঠাকুরমার মুখে শোনা প্রতিটি কথা কিন্তু মনে গেঁথে গিয়েছিল আমাদের। ইঁট রয়েছে নিশ্চয়ই মাটির নিচে কোনখানে চাপা পড়ে, সেইসব মড়ার হাড় পাঁজরা ধূলো হয়ে বাতাসে উড়ে মিশে আছে মাটির সঙ্গে। অহরহ বাঁশবনে কটর-কট আওয়াজ ওঠে— ছেলেবেলায় আমার মনে হত, সেকালের সেই রক্তাক্ত শিষ্য-প্রশিষ্যরা বাঁশের আগায় আগায় পা ফেলে শূন্য মার্গে চলাচল করছে। ছেলেমানুষ বলে নয়— বুড়োরাও নিতান্ত দরকার ছাড়া ঢুকতে চায় না এখানে। কেউ আসে না নিশিবাবু। দিনদুপুরে শিয়াল চরে বেড়ায়। খরগোস ছোটে দু-কান উঁচু করে, বাদুড় ঘুমোয় নিচেমুখো মাথা ঝুলিয়ে। তলায় ন্যাড়াসেঁজি ও শেয়াকুলের ঝোপ। কে আসতে যাচ্ছে বলো এদিকে, কার কি দায় পড়েছে?

দায় পড়েছিল আমাদের খুব মুশকিলে পড়েছিলাম সেবার ঐ বিয়াল্লিশ সনের শেষাশেষি সময়টায়। আজকে নিশিবাবু ঘুরে ঘুরে দেখিয়ে বেড়াচ্ছি— সেদিন ঝোপের আড়ালে পাকা বাঁশপাতার উপর আমাদের দিনরাতের কায়েমি বিছানা হয়েছিল। শাস্তিবউদি তাকিয়া দিচ্ছিল মাথায় দেবার জন্য। তাকিয়ার বদলে একটা পাশবালিশ নিয়ে এলাম- ঐ এক পাশবালিশে এদিক-ওদিক মাথা রেখে অনেক লোকের শোওয়া চলে। ছিলাম অবশ্য মন্দ নয় নিশিবাবু। রাতদুপুরে শিয়াল ডেকে ডেকে চুপ করত, তখনই উৎসব পড়ে যেতে গ্রামের ঘরে ঘরে। আলো নিভিয়ে দিয়ে উৎসব। ছায়ার মতো এক একজন আমরা ছাঁচতলায় গিয়ে দাড়াচ্ছি, দুয়োর খুলে তাড়াতাড়ি আপনজনেরা বেরিয়ে আসছে। ফিসফিস কথাবার্তা, খাওয়া-দাওয়া— আমার দু-বছরের খুকি দেড়টা মাসের মধ্যে কোনদিন আমায় দেখতে পায়নি নিশিবাবু, আমিই তার ঘুমন্ত দু’চোখের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে আদর করে যেতাম। সকাল হবার অনেক আগেই ঢুকতাম গিয়ে আবার বাঁশবনে। দেড়মাস বরাবরই যে এখানে ছিলাম তা নয়। সময় সময় ছোটলাইন ধরে দূরের কোন ষ্টেশনে গিয়ে গাড়ি চাপতাম, আবার ফিরে আসতাম। এদিককার কাজের ভার আমাদের উপর, অঞ্চল ছেড়ে পালাবার জো ছিল না। রোজই যে ঘরে এসে খেয়ে যেতে পারতাম তা নয়। এক একদিন অচেনা মানুষ দেখা যেত গ্রামে— শাঁক বেজে উঠত এবাড়ি ওবাড়ি। সে রাতে নিরম্বু উপোস যেত। কাছাকাছি খেজুর-বনে ভাঁড় পেতে দিয়েছে, কিন্তু বেরিয়ে এসে খেজুর-রস নিয়ে যাবে তাতেও বড্ড কড়া রকমের মানা ছিল।

গোড়া থেকেই বলি শোন। বারটা মনে আছে— বিষ্যুৎবার। হাট বসেছিল সেদিন, হাটবার ছিল, তাই মনে আছে বারটা। সকালবেলা টিপ-টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল। প্রভাসকে ধরল, হাত বেঁধে নিয়ে চলল। হাঁটু অবধি খদ্দর-পরা, মুখে প্রশান্ত হাসি আমাদের প্রভাস মহারাজ— তার হাতে দড়ি না দিলেও চলত নিশিবাবু। থানা এখন আর তো বাঁধাঘাটে নয়— আসামি পালিয়ে যাবে তার কোন সম্ভাবনা ছিল না। পালাবার হলে অপেক্ষা করত কি সে বাড়ি বসে? কত জনে সে বুদ্ধি দিয়েছিল, সে যায় নি। ওরা এলে প্রভাস বেরিয়ে এসে হাত দু-খানা এগিয়েই দিল একরকম। হাতে হাতকড়ি পরাল, কোমরেও এই মোটা এক দড়ি বেঁধে হিড়-হিড় করে তাকে টেনে নিয়ে চলল। ঐ পোড়া দালানটা তখন ছিল থানা— এখন ফুলঝুরির গঞ্জে নূতন দালানে থানা উঠে গিয়েছে। কিন্তু সোজাপথে না নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, গ্রামের বাইরে হাটখোলা অবধি তাকে ঘুরিয়ে বেড়াল। তার মানে, সারা অঞ্চলের মানুষ দেখে নিক ওদের প্রতাপ। কাল হল এই প্রতাপ দেখাতে গিয়েই। বেলা হবার সঙ্গে সঙ্গে হাটুরে মানুষ জমতে লাগল, সকলের মুখে ঐ এক কথা। ভোরবেলা এরা যে যার ঘরের মধ্যে ছিল, থানার লোক যেন ফাঁক বুঝে সেইসময় জুতো মেরেছে একা প্রভাসকে নয় অঞ্চল সুদ্ধ মানুষের মুখে। প্রভাসকে এমনি ভালবাসত সবাই। বাসবে না কেন নিশিবাবু, অত কে করেছে গ্রামের মানুষের জন্য? ফুলঝুরির চালের কলে হাজার দেড় হাজার মানুষ গিয়ে পড়ল বাইরের চালান বন্ধ করবার জন্য— তখন প্রভাসই ছিল সকলের আগে। বারাণ্ডায় ঐ যে আধ-পোড়া শাল-খুঁটি, ঐখানে ঠিক দুপুরে প্রভাসকে বসিয়ে রেখেছিল। মালসায় করে গুড়-মুড়ি খেতে দিয়েছে, তা সে খায় নি। প্রহরখানেক একটানা জেরা করে ক্লান্ত অশোকবাবু সবে মাত্র খেতে গেছেন, খেয়ে দেয়ে এসে নব উদ্যমে আবার এক দফা চেষ্টা চলবে, তারপর পাঁচটার গাড়ীতে সবশুদ্ধ মহকুমা শহরে রওনা হয়ে যাবেন, এই সাব্যস্ত হয়ে আছে। কাণ্ডটা ঘটল এই সময়। আশপাশ আট-দশখানা গ্রামের বিস্তর লোক দলে দলে মিছিল করে এসে পড়ল। শঙ্খ বাজছে, শত শত নিশান উড়ছে, ভাবতে গেলে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে নিশিবাবু। খাওয়া হল না অশোকবাবুর, এঁটো হাতে বন্দুক নিয়ে ছুটলেন। হাটুরে মানুষও যে যা পেয়েছে হাতে নিয়ে হৈ-হৈ করে এগিয়ে এল। তিনজন মারা পড়ল ঐ জায়গায় আর একজন পরে হাসপাতালে। প্রভাসের হাতকড়ি ভেঙে কোমরের দড়ি কেটে কাঁধে তুলে লাফাতে লাফাতে নিয়ে গেল। ভাগ্য ভাল অশোকবাবুর— জনতার নজর এড়িয়ে এঁদোপুকুরে কচুবনের ভিতর গিয়ে বসেছিলেন, চাঁদ ডুবে না যাওয়া পর্য্যন্ত এই অবস্থায় থাকতে হয়েছিল নাকি তাঁকে। সত্যি, তাজ্জব ঘটে গেল নিশিবাবু— এক মুহূৰ্ত্ত আগে যা আমরা স্বপ্নেও ভাবি নি। প্রভাসকে শুধু ছাড়িয়ে নিয়ে আসা নয়— জমাদার কনেষ্টবল উর্দি-চাপরাস ফেলে ‘বাপ’ ‘বাপ’ বলে পালিয়েছে, তাদেরই কজনকে তালাবন্ধ করে রেখেছে গারদঘরে। তে-রঙা নিশান পতপত করে উড়ছে থানার মাথায়। পাঁচ রাত চার দিন উড়েছিল ঐ ভাবে।

রাত্রি প্রহরখানেক অবধি এই সমস্ত চলল তো নিশিবাবু, তারপর চারিদিক স্তব্ধ হলে মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবছি, এ কি হয়ে গেল—ঠিক এমনটা চাই নি। আশাও করি নি এত সহজে এমন দখলে এসে যাবে এসমস্ত। কাগজে লড়াইয়ের খবর পড়ি সে ব্যাপারও এই রকমটা নাকি? হঠাৎ বিজয় হয়ে যায়, যত মানুষ মরবে আর যত গোলাগুলি চলবে বলে আস্ফালন করা হয় আসলে তার সিকির সিকিও লাগে না। এর পরবর্ত্তী অধ্যায়ে আঁচ করছি এ ব্যাপার অবশ্য এখানেই চুকবে না। আমরা— বয়স যাদের বেশি— সাব্যস্ত করতে পারিনে, কি করতে হবে অতঃপর আমাদের। কিন্তু জোয়ান ছেলেগুলো বেপরোয়া, তাদের রক্ত টগবগ করে ফুটছে, হাসি-স্ফূর্তির অবধি নেই, খবর নিয়ে আসে শুধু এই একটা জায়গা নয় সর্বত্র প্রায় এক অবস্থা। সাম্রাজ্যের হাজার ছিদ্র, সামলাবে ওরা আর কদিকে? কত মানুষ আছে শুনি, কত হাতিয়ার? আর হাতিয়ার হাতে পেয়ে কে কোনদিকে তাক করবে তারই বা ঠিক কি? ওদের নিজের ঘরের ছেলেরাই বিরক্ত হয়ে বেঁকে বসেছে ক্ৰমে। সদর থেকে ফিরে এসে একজন গল্প করছে, সাদাসৈন্যের ব্যারাকের সামনে কয়লা দিয়ে লিখে রেখেছিল, কুইট ইণ্ডিয়া— ভারত ছাড়ো। সৈন্যদেরই একজন নাকি তার পাশে বড় বড় অক্ষরে জবাব দিয়েছে, ফর গডস্ সেক— ঈশ্বরের দোহাই, ভারত ছেড়ে দেশে ফিরতে দাও তাদের। ছেলেগুলো মুখ নেড়ে নেড়ে আমাদেরই উপদেশ দিতে আসে, অত ভাবছেন কি দাদা? চালাও হুকুম এবার, নেতার মুখ চেয়ে থাকতে হবে না, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। পোষ্ট-অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে, খবরের কাগজ বন্ধ। ছেলেরা বলে ভাল হয়েছে— বানানো গল্প আর সুকৌশলে পিছু হঠার বাহাদুরি পড়তে হবে না এখন আর। কাগজ আসছে না, তা বলে খবরের প্রচার কিন্তু বন্ধ নেই। গাছে গাছে অলক্ষ্যে এঁটে দিয়ে যাচ্ছে সাইক্লোষ্টাইল করা খবর। হুলস্থুল কাণ্ড। বিদেশে ফৌজ গড়েছে আমাদের। আসছে, তারা এসে গেল বলে। পথ তৈরী করো তাদের জন্য।

রাস্তায় বড় বড় গাছ কেটে ফেলেছে, পগার কেটেছে দশ-বিশ হাত অন্তর। খেয়া-নৌকো ডুবিয়ে দিয়েছে। ছোট রেললাইনও একেবারে বেমালুম মাঠের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে পাঁচ-সাত জায়গায়। সদর থেকে সৈন্য নিয়ে আসা সহজ হবে না আর এখন। রোজই নূতন নূতন বাধা তৈরী করছে। আর দিন গুণছি নিশিবাবু, খবর নিচ্ছি সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়েছে কি আগুন? আগা-পাস্তলায় আগুন লেগে গেলে জল ঢালবে তখন কোন দিকে?

কিন্তু আটকানো গেল না নিশিবাবু। রাস্তায় নূতন মাটি ফেলে গাছ সরিয়ে মেটে রঙের সারবন্দি ট্রাক হিংস্র জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল, আর কোন উপায় নেই। সমস্ত রাত্রি হেঁটে জন চারেক আমরা একবার রাণায়ের মোহনা অবধি গিয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু দূরের জায়গায় বেশি বিপদ। সবদিকে ডামাডোল চলছে, অচেনা লোক দেখলে সবাই কেমন এক ভাবে তাকায়। মুশকিলের কথা বলব কি সারাদিনের মধ্যে একমুঠো ভাত কি চিঁড়ে জোটাতে পারলাম না, সকলে চোখ কটমট করে চায়, নূতন মানুষ দেখে সন্দেহ করেছে পুলিশের চর আমরা। অবস্থা দেখে আতঙ্ক হল, দিনের বেলা এই রকম— রাত্রে নিশ্চয় এরা ধরে পিটুনি দেবে। অথচ আত্মপরিচয় দেবার উপায় নেই— যত ঢাকাঢাকি করছি, সন্দেহ ততই বেড়ে যাচ্ছে সকলের।

চুপি-চুপি বলি তাহলে নিশিবাবু, জেলে গিয়ে যেন সোয়ান্তির শ্বাস ফেলেছিলাম ছ-সাতমাসের পর। নিশ্চিন্ত। মাথা খারাপ হল, শুনে তোমরা হায়-হায় করতে, আমার তার জন্য এতটুকু কষ্ট ছিল না। এক বিচিত্র অনুভূতি— স্বপ্নের মতো এখনো আবছা আবছা মনে পড়ে। মোটা মোটা গরাদে আর উঁচু পাঁচিলে যেন লোহার কেল্লা গড়ে রাজাধিরাজ হয়ে নিঃশঙ্কে ছিলাম; পথের কুকুরের মতো তাড়া খেয়ে আর ঘুরতে হবে না। রাতে ঘুম হত না, তারাই সব ভিড় করে আসত। কত আনন্দ জানাত, কত দুঃখ করত?

এখন সুস্থ হয়েছি, একটা ছেলের চেহারা বড্ড মনে পড়ে, এসে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত। ফুটফুটে ছেলে, কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, বছর পাঁচেক বয়স, কথা সুস্পষ্ট হয়নি এখনো। শান্তি-বউদির ছেলে কাজলের মতো অনেকটা। মরবার সময় আমি কাজলের কাছে ছিলাম, গলার ঘড়ঘড়ানি আর অসহায়। এত বাতাস পৃথিবীতে, একটুখানি বাতাসের জন্য বার বার হাঁ করছিল অবোধ শিশু। সেই কাজলই যেন গিয়ে কাঁদত, আমার কাছে।

শোন খোকা, কাছে এসো—

না—

আরও সে সরে গিয়ে বসত।

এসো মাণিক আমার। সন্দেশ পাঠিয়ে দিয়েছে আজকে। খাবে? খাই কেমন করে? দেখ, দেখ তো—

কান্নায় ভেঙে পড়ত। গলায় সিল্কের রুমাল জড়ানো। রুমাল খুলে দেখাত। গলা দিয়ে রক্তের ধারা ছুটল আবার, গলা ছেঁদা করে বুলেট বেরিয়ে গেছে।

খোকা বলে আমি কত চেঁচিয়েছিলাম। শুনতে পাওনি?

না ভাই, পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম আমরা। মানুষের মুখে তাকিয়ে দেখবার ফুরসৎ থাকে কি লড়ায়ের মধ্যে?

খোকা বলত, চেঁচামেচি শুনে রাস্তায় গিয়েছিলাম। সবাই ইট মারছে দেখলাম লরীতে! আমি ও মারলাম। এই এতটুকু একখানা বড় ইট তুলতে পারি কি আমি? আমার ইট পৌঁছয় নি লরী অবধি। সত্যি বলছি, আমি বুঝতে পারিনি। সবাই মারছে, আমিও তাই মারলাম। আর অমনি খটাখট আওয়াজ করে তেড়ে এল।

কে?

ফিরে দেখেছি নাকি? কাঁদতে কাঁদতে বাড়ী ছুটলাম। রোয়াকে উঠেছি, দরজায় ঘা দিচ্ছি, ও মাগো— বলে ডাকছি মাকে! ফটফট আওয়াজ হল, গলা আমার ফাঁক হয়ে গেল। পড়ে গেলাম, মনে হল! বলো তো, বলো— গলার এ ছেঁদা কি কোন দিন?

আচ্ছা নিশিবাবু, সত্যি সত্যি ঘটেছিল এ রকম! শুনেছ তোমরা কেউ? না নির্জন সেলে বসে পাগলের উদ্ভট কল্পনা?

এমনি যে কত লোক আসত। মনেও নেই সমস্ত আর বলতে গেলে তুমি এখন মীটিঙের ব্যাপারে।

কত লোকের কত রকম কাহিনী।

তোমার ধৈর্য্য থাকবে না। ব্যস্ত প্রভাসকে শেষ দেখেছিলাম গরাদের ফাঁক দিয়ে। সে দেখেনি, অঘোরে ঘুমুচ্ছিল সে তখন। উজ্জ্বল আলো প্রতিফলিত হয়ে সেলের ভিতরটা অবারিত। ওয়ার্ডার পাহারা দিচ্ছে দরজার সামনে। ফাঁসি কাঠে কালো বার্ণিশ লাগিয়েছে, চর্বি দিয়ে মেজেছে দড়ি। প্রভাসেরই ওজনের বালির বস্তা ঝুলিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছে সকালবেলা। তারা তৈরি।

ঘুমুচ্ছিল, রাতের স্তব্ধতা চুর্ণিত করে ঘণ্টার আওয়াজ এল। শোনা কথা অবশ্য— ধড়মড়িয়ে উঠে বসে সে বলেছিল, দশটা মিনিট সময় চাই যে ভাই। একটু গীতা পড়ে নেব, প্রার্থনা করব একটুখানি।

উদাত্ত কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, শেষ রাত্রের নির্মল আকাশে অজস্র হীরার কুচির মতো তারা দপদপ করছে— সেই সময় ঘুম ভেঙে উঠে বসে শুনতে পাচ্ছি, যার কাছে যে দোষ করেছি, মাপ চেয়ে যাচ্ছি ভাই। শুনতে পাও বা না পাও আমায় মাপ কোরো তোমরা —

চোখে দেখিনি কিন্তু ছবিটা আন্দাজ করতে পারি নিশিবাবু। পবিত্ৰ আগুনের মতো প্রদীপ্ত মুখ, ফাঁসির মঞ্চে অচঞ্চল উঠে দাঁড়াল তেত্রিশ বছর বয়সের আমাদের প্রভাস মহারাজ।

যে সময় বিচার চলছিল, একদিন তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, মানুষ মারতে পার তুমি? সত্যি কি মেরেছিলে?

খানিক হাসিমুখে তাকিয়ে থেকে বলেছিল, মানুষ কি মারা যায়? জানোয়ার মরেছিল কিনা খবর রাখিনে। তারপর একটু স্তব্ধ থেকে বলল, একটা কাজ কোরো ভাই দয়া করে, মহাত্মাজি বেরিয়ে এলে তাঁকে আমার প্রণাম জানিও।

প্রশান্ত হাসি হেসে আবার বলল, কি অত ভাবনা করছ? জন্মেছি যখন, মরবই। যিনি জীবন দিয়েছেন, ফিরিয়ে নিচ্ছেন তো তিনিই।

প্রভাসের পদকটা মীটিঙের মধ্যে কে নিচ্ছে হাত পেতে? লক্ষ্মণ মাইতি মশায় নিজেই হয়তো কম্পমান হাতে বুকের উপর ঝুলাতে যাবেন। আর ভাল এক বক্তৃতা ফেঁদে বসবেন, রাজপুত ও শিখের ইতিহাস থেকে নজীর তুলে তুলে তুলনা করবেন। সামলে থেকে। কিন্তু নিশিবাবু, পাশ থেকে সেই সময় কথা জুগিয়ে জুগিয়ে দিও নইলে মাঝখানে হঠাৎ থেমে গিয়ে তিনি অ্যাঁ-অ্যাঁ করবেন, কোটরগত চোখ বেয়ে জলের ধারা বইবে, যজ্ঞ পণ্ড হবে তোমাদের।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন