শনিবার | ১৭ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | সকাল ১০:৫৭
Logo
এই মুহূর্তে ::
হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলা — আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংকট : সুব্রত কুমার দাস সিন্ধুসভ্যতার ভাষা যে ছিল প্রোটোদ্রাবিড়ীয়, তার প্রমাণ মেলুহা তথা শস্যভাণ্ডার : অসিত দাস চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (শেষ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস জাতিভিত্তিক জনগণনার বিজেপি রাজনীতি : তপন মল্লিক চৌধুরী গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তালশাঁসের চাহিদা : রিঙ্কি সামন্ত চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (ষষ্ঠ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস ভারতের সংবিধান রচনার নেপথ্য কারিগর ও শিল্পীরা : দিলীপ মজুমদার চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (পঞ্চম পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস আলোর পথযাত্রী : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (চতুর্থ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস কন্নড় মেল্ল থেকেই সিন্ধুসভ্যতার ভূখণ্ডের প্রাচীন নাম মেলুহা : অসিত দাস রবীন্দ্রনাথের চার্লি — প্রতীচীর তীর্থ হতে (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (তৃতীয় পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস লোকভুবন থেকে রাজনীতিভুবন : পুরুষোত্তম সিংহ চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (দ্বিতীয় পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস রবীন্দ্রনাথের চার্লি — প্রতীচীর তীর্থ হতে (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত রবীন্দ্রনাথের ইরান যাত্রা : অভিজিৎ ব্যানার্জি ঠাকুরকে ঠাকুর না বানিয়ে আসুন একটু চেনার চেষ্টা করি : দিলীপ মজুমদার যুদ্ধ দারিদ্র কিংবা বেকারত্বের বিরুদ্ধে নয় তাই অশ্লীল উন্মত্ত উল্লাস : তপন মল্লিক চৌধুরী রবীন্দ্রনাথ, পঁচিশে বৈশাখ ও জয়ঢাক : অসিত দাস রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী ও শান্তিনিকেতন : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বাঙালী রবীন্দ্রনাথ : সৈয়দ মুজতবা আলী অনেক দূর পর্যন্ত ভেবেছিলেন আমাদের ঠাকুর : দিলীপ মজুমদার রবীন্দ্রনাথের প্রথম ইংরেজি জীবনী : সুব্রত কুমার দাস চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (প্রথম পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস শুক্লাম্বর দিঘী, বিশ্বাস করে দিঘীর কাছে কিছু চাইলে পাওয়া যায় : মুন দাশ মোহিনী একাদশীর ব্রতকথা ও মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত নিজের আংশিক বর্ণান্ধতা নিয়ে কবিগুরুর স্বীকারোক্তি : অসিত দাস ঝকঝকে ও মজবুত দাঁতের জন্য ভিটামিন : ডাঃ পিয়ালী চ্যাটার্জী (ব্যানার্জী) সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা : লুৎফর রহমান রিটন
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা (গুরু পূর্ণিমা) আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

রথযাত্রা ছোট গল্প লিখছেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় / ৫২৯ জন পড়েছেন
আপডেট সোমবার, ১২ জুলাই, ২০২১

রথযাত্রা উৎসবটির সঙ্গে নানা স্মৃতি জড়িত, নদী-নালা-খাল-বিলের দৃশ্য আমার চোখে আজও ভেসে ওঠে। তরুর কথা মনে হয়। জলা দেশের মানুষের কাছে বর্ষাকাল বড়ো প্রিয়। উজানি নদীতে নৌকা ভাসিয়ে রথের মেলায় যাওয়ার দৃশ্যটিও মনোরম। সারা গ্রাম, মাঠ জলে ডুবে থাকে। যত দূর চোখ যায়, শুধু জল থইথই। ঘাটে-ঘাটে নৌকা বাঁধা, এ-বাড়ি সে-বাড়ি যেতে গেলেও নৌকায়। বাড়ির উঠোনেও জল উঠে আসে। পুঁটিমাছ, ডারকিনা মাছের ছড়াছড়ি। ঘর থেকে বের হয়ে দু-লাফে ভাইবোনেরা উঠোনে নেমে যাই, গামছায় কিংবা পাতা জালে মাছ ধরায় আনন্দের তখন সঙ্গী হয় তরু। আমরা সমবয়সি, নদীতে সাঁতার কাটি, পুকুর সাঁতরে পার হয়ে যাই, সামনে যত দূর চোখ যায়, ধানের জমি, পাটের জমি, কত পাখি উড়ে আসে— কোড়াপাখি ডিম পাড়ে ধানগাছের গুচ্ছ অন্ধকারে আর কুবকুব করে ডাকে। জ্যাঠা বাবা কাকারা এবং ঠাকুমা-সহ আমাদের বিশাল একান্নবর্তী সংসারে তখন মেলা পরিবার-পরিজন।

রথের মেলায় যাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়— আষাঢ় মাস, নদীর জলে কদম গাছের ছায়া আর তার থোকা থোকা নরম উলের মতো সাদা-হলুদে মেশানো গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের কীই-বা তখন বাহার! তরু নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকে। অভাবী পিতার সে কন্যে, তারা সাত ভাইবোন, মা নেই। ভাইবোনেরা অভাবের তাড়নায় এ-বাড়ি সে-বাড়ি ঘোরে। তরু, বলতে গেলে, আমাদের বাড়িতেই থাকে, খায়। ঠাকুমার ফুট-ফরমাশ খাটে, আর বাড়ির সব গাছপালা, বাগান পাহারা দেয়। বাড়িতে থাকতে থাকতে সে আমাদের গাছপালা নদীকে কখন ভালবেসে ফেলেছে। কেউ তার চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না, কেউ ফল ফুল কিছুই চুরি করতে পারে না। এমনকী, গাছের ডাল কাটলেও সে ক্ষেপে যায়। সেবারে ডাংগুলির জন্য ডাল কাটতে গিয়ে আমার কী বিড়ম্বনা! দেখছি, তরু ফ্রক গায়ে পুকুর পাড় ধরে দৌড়ে আসছে, চিৎকার, ভালো হবে না গোলা, ডাল কাটবি না— চেঁচাচ্ছে, ছোটোকাকা, দ্যাখো, গোলা পেয়ারা গাছটার ডাল কাটছে। অগত্যা লাফ দিয়ে নামতেই তরু দা কেড়ে নিতে গিয়ে ঠেলাঠেলিতে চিত হয়ে পড়ে যায়। তরু নীচে কিছুই পরেনি, উদোম। বাইরে ফ্রক, নীচে উদোম, গরিব মানুষের যা হয়। অথবা ওর প্যান্টি ভিজে, কোথাও মেলে দিয়েছে— সে যাই হোক, ফ্রক ওপরে উঠে গেছে, সব দেখা যায়।

তরু ক্ষেপে গিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। গোলা, তুই আমার সব দেখে ফেললি! কান্না কিছুতেই থামে না। হতভম্ব আমি। আমার কী দোষ, তা-ও বুঝছি না। বিপাকে পড়ে খুবই ঘাবড়ে গেছি— আমার মুখ দেখে তরুর মায়া হতে পারে, কিংবা তরু আমাকে যেন বিষাদ থেকে উদ্ধার করার জন্যই শর্ত জুড়ে দিয়েছিল, ঠিক আছে, কাউকে বলব না। তোরা তো মনোহরদির রথের মেলায় যাবি, মেলা থেকে আমার জন্য একটা রথ আনবি, কথা দে। রথের রশি ধরে টানলে কোনও পাপ থাকে না। কী পাপে-তাপে যে আমার মা মরে গেল, বাবা উদাসীন হয়ে গেল— কী রে, আনবি তো? রথে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার মূর্তি দেখে কিনবি। আমার জন্য তোর কষ্ট হয় না? তরু গরিবের মেয়ে হতে পারে, তবে ভারী সুন্দর দেখতে। নাকে বেশর, কানে পেতলের মাকড়ি, সে বড়ো হয়ে উঠছে।

বাড়ি থেকে নৌকায় নদীর উজানে যাওয়া, পালে বাতাস লেগে যাওয়ায় বেলাবেলিতে মনোহরদির রথের মেলায় নেমে যেতে দেরি হয়নি। আমার সঙ্গে দাদারা আছে, দুই বিধবা পিসি এবং বড়ো জেঠি। ঠাকুমা সব তীর্থেই গেছেন, সব নদীতে পুণ্যস্নান করেছেন। পুরীর রথযাত্রায় রথের রশি ছুঁয়েছেন, তিনি আমাদের সঙ্গে আসেননি। তরুও আসতে পারেনি। ঠাকুমাকে কে দেখবে!

তরুর সব দেখে ফেলায় আমার যে খুবই অপরাধ হয়েছে, তা-ও বুঝি। তরুকে বলেছিলাম, বড়ো হয়ে তোকে ঠিক মাহেশের রথে নিয়ে যাব। কোথায় মাহেশের রথ, কত দূর যেতে হয়, কিছুই জানি না। জিলিপিভাজা খাব, একসঙ্গে রথের রশি টানব।

নৌকা ছাড়া রথের মেলায় যাওয়া যায় না, হেঁটে যেতে পারলে তরুকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ায় সুবিধে ছিল। সে-সুবিধেটুকুও আমার নেই!

মেলা উপলক্ষে রথতলা জায়গাটি সপ্তাহখানেক পুণ্যতীর্থের মর্যাদা পায়। বিশাল কাঠের রথটিকে নানা বর্ণের কাগজ দিয়ে সাজানো হয়। এটা যে আমার মামাবাড়ির দেশ, ভাবতে তখন খুবই গর্ব হয়।

কুলদা সাহা ধনাঢ্য ব্যক্তি—বড়ো বড়ো তাঁবুতে সব মহান্তরা উঠে এসেছেন, নদীর পাড়ে একটি প্রাচীন মঠও আছে, তার গর্ভগৃহে সাজানো সব দেবদেবীর পুতুল, সিঁদুরে মাখামাখি হয়ে আছে। কুলদা সাহার লোকজন মেলায় মাতব্বরি করে বেড়াচ্ছে। কোথাও কোনও বিশৃঙ্খলা দেখলে তেড়ে যাচ্ছে, কারণ, রশি টানার সময় এত ভিড় হয় যে, পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুরও আশঙ্কা থাকে।

বড়ো মামা ঘাটে হাজির। তাঁর সঙ্গেই ঘুরছি। তিনি সঙ্গে থাকায় সবাই আমাদের সমীহ করছে, সবাই সরে গিয়ে পথ করে দিচ্ছে। দেবদেবীদের তখন অঙ্গদান, চক্ষুদান চলছে— বড়োমামাই তীর্থমাহাত্ম্য বোঝাচ্ছেন: আষাঢ়ের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়াতে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা হয়ে থাকে। এ জন্য এ দিনে যাত্রা, মহোৎসব এবং বহু ব্রাহ্মণভোজনের ব্যবস্থা হয়েছে। নদীর পাড়ে সারি সারি পেট্রোম্যাক্স জ্বলবে, পুণ্যার্থীরা পদ্মপাতায় খিচুড়ি প্রসাদ গ্রহণ করবেন। এ সময়ে খুব হুড়োহুড়ি হয়, প্রসাদ পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে ওঠে সবাই। তার পর বললেন, শুক্লপক্ষ হলেই শুধু হবে না, পুষ্যা নক্ষত্রযুক্ত হতে হবে। যদ্যপি দ্বিতীয়া পুষ্যা নক্ষত্রযুক্ত না হয়, তিথি-মাহাত্ম্য গুণে উক্ত কর্ম কর্তব্য নহে। বড়ো মামা বড়ো বেশি সংস্কৃত-ঘেঁষা শব্দ উচ্চারণ করায় আমি মাত্রাতিরিক্ত গর্ব বোধ করতে থাকি। মামার কত পাণ্ডিত্য, কত তিনি জানেন! তার পর বললেন, এতে ভগবান অত্যন্ত প্রীত হন, ইতি ব্রহ্মপুরাণম্‌। আসলে আমার ছোটো পিসি সম্প্রতি বিধবা হয়েছেন। পুণ্যতীর্থের পুণ্য কথা পিসিকে শুনিয়ে মামা কিছুটা বাহবা নিতে চান, বুঝি।

প্রতি বছর এই মেলায় আসা হয় না ঠিকই, তবে মাঝে মাঝে আসা হয়। রথের পাটাতনে জোর সংকীর্তন শুরু হয়েছে, ‘জয় জয় ভগবান’ উচ্চারিত হচ্ছে। আমি প্রতি বারই এই সময়টায় ভ্যাবলু বনে যাই। ইস! তরুকে নিয়ে এলে কী যে ভালো হতো! তরু কী যে খুশি হতো! সাহসেই কুলোয়নি, ছোটোকাকা, তরু আমাদের সঙ্গে যাবে বলছে। কারণ, তরু নিজেই বলতে পারে, না, না, ছোটোকাকা, গোলা মিছে কথা বলছে। ঠাকুমাকে দেখার চেয়ে তরুর মেলা দেখা বেশি হয়ে গেল! তরুই বা কোন সাহসে স্বীকার করবে, সে বলেছে মেলা দেখতে যাবে।

জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ি থেকে ঘরে না ফিরে আসা পর্যন্ত মামাবাড়িতে থাকি, খাই। মেলায় ঘুরে বেড়াই। তরুর জন্য কাঠের একটি রথও কেনা হয়ে গেল। পিসিরা নানা দেবদেবীর পুতুল কিনে নৌকায় পাঠিয়ে দিলেন। গয়না নৌকার মাঝি মোজাম্মেলেরও আহ্লাদ কম না। টানা দশ দিনের বিশ্রাম। দশ দিন ধরে দু-বেলা ভোগ আসছে নৌকায়, রথের মেলা উপলক্ষে তারও ভালোমন্দ ভোজের আয়োজন— এত সব আয়োজনের মধ্যে তরুর জন্য রথ নিয়ে যাওয়া যে কত জরুরি— রথযাত্রা শুরু এবং শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তরুর কাছে এই রথের মাহাত্ম্য বিন্দুমাত্র কমে না। রথের রশি টানা নিয়ে কথা।

আর, রথটিকে তরুর হাতে দিয়ে আমার অপরাধ লাঘব হয়েছে। তরু আর কখনও ‘গোলা আমার সব দেখে ফেলেছে’— এই শোকে যেখানে-সেখানে কাঁদতে বসবে না। তরু রথটি পেয়ে মহাখুশি। সারা দিন রথ নিয়েই পড়ে থাকে। ফুল দিয়ে সাজায়, বাইরের উঠোনে রথের চাকা ঘোরে, চাকা খুলে গেলে মেরামত করতে বসে যায়। তার পর সে তার বাড়ি নিয়ে যায় এবং ঘরের এক কোনায় অতি যত্নে তুলে রাখে রথটি। রথের ঘোর সবারই কিছু দিন থাকে, তার পর যা হয়, রথের চাকা সারথি এবং দেবতাগণ ছিটকে কোথায় কোনটা গিয়ে পড়ে থাকে, কেউ টেরই পায় না। হালকা শোলার মতো পাতলা কাঠ বেশি দিন টেকারও কথা না। এই যখন অবস্থা, তখনই এক সকালে স্নানের সময় পুকুরঘাটে তরু জলে লাফিয়ে পড়ার আগে বলল, জানিস গোলা, স্বপ্নে বলরাম, জগন্নাথ, সুভদ্রা তিন জনেই হাজির। স্বপ্নে আমাকে বর দিলেন, তুই রাজরানি হবি, তরু। তোর আর এঁটোকাঁটা ঘাঁটতে হবে না। কাউকে বলিস না ভাই। বর না দিলে রথের রশি টানায় মাহাত্ম্য থাকে কোথায়!

না, না, আমি বলি, বললেই যে তুই কাঁদতে বসবি— আমি জানি না? আমি তো কেবল কাঁদি!

রাগ করিস না তরু। তুই সব পারিস। বলেই সাঁতরে কিছুটা যেতেই, তরু বলল, শীতের সময় কাকিমার সঙ্গে তোর মামাবাড়ি যাব। তুই যাবি?

কেন? আমি যাব কেন?

আমরা দুজনে রথের ওপর উঠে যাব। তুই আর আমি। শীতের বাতাস, বকুল ফুল ঝরে পড়বে।

রথতলায় অবশ্য একটি বিশাল বকুল গাছ আছে। মা-র কাছ থেকে বকুল ফুলের খবর পেতেই পারে। তবে আমি যাচ্ছি না।

তুই যাবি না!

আরে, তুই রাজরানি হতে যাচ্ছিস। তোর কি আমার সঙ্গে বনেজঙ্গলে ঘোরা ঠিক হবে!

মা কী করে যে রাজি হলো, বুঝি না। সারা দিন মেয়েটার জলে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো স্বভাব। কাকাকে ছাড়া কাউকে ভয় পায় না। ঠাকুমার আশকারাতে তার এত সাহস। সে যে একটা বেজির বাচ্চাও পুষেছিল, বেজিটা এখন বড়ো হয়ে গেছে, বেজিটাকে দিয়ে একটা গোখরো সাপকে গর্ত থেকে টেনে বের করে এনেছিল এক দুপুরে, মহামারী কাণ্ড!

পোষ্য বেজি হলে যা হয়, তরু বেজিটাকে নাম ধরে ডাকলেই জঙ্গল থেকে বের হয়ে আসে। এক সময় শেকলে বাঁধা থাকত। কারণ, বাচ্চা বেজি কাক-চিলে ছোঁ মেরে তুলে নিতেও পারে। বেজিটার জন্য জলে ডুবে আমরা ভাইবোনেরা মাছ ধরেও আনতাম। বেজিটার নাম আমার বড়দা উমাশঙ্করই দিয়েছিল— বনমালা।

বড়ো হলে দেখা গেল, অকারণে বেজিটা ক্ষুব্ধ হয়। কামড়ে-খামচে দেয়। তরু ছাড়া বাড়ির এমন কেউ নেই, যাকে বনমালার উৎপাত সহ্য করতে হয়নি। কাকা এক দিন রেগেমেগে বেজিটার শেকল খুলে দিলেন। বেজিটা চলেও গেল জঙ্গলে। তরুর যা হয়, সারা দিন বেজিটার জন্য কাঁদে। এবং আশ্চর্য, রাতের দিকে বেজিটা ফিরেও এল। তরু কোথা থেকে দুটো পুঁটি মাছ এনে খেতে দিলে, খেলেও। তার পর জঙ্গলে চলে গেল। খিদে পায়, খিদে যে কী ভয়ংকর কষ্ট, তরু ভালোই বোঝে। সে মরা ইঁদুর, মাছ যা পায়, বেজিটার জন্য সংগ্রহ করে রাখে। এই করে সে যে একটি বণ্যপ্রাণীকে পোষ মানিয়ে ফেলেছে কখন, আমরা কেউ টেরই পাইনি। তরু নাম ধরে ডাকলেই বনমালা খাবার লোভেই হোক, কিংবা মায়াতেই হোক জঙ্গল থেকে উঠে আসে।

শীতের সময় মা আমাদের ভাইবোনদের নিয়ে প্রতি বারই যান বাপের বাড়ির শীতের পিঠে-পায়েস খেতে। পৌষসংক্রান্তিতে আমাদের যেতেই হয়। এ বারে তরুও গেল। সঙ্গে বাড়ির আশ্রিত ভুবনজ্যাঠা। এবং বনমালাও যে রওনা হয়েছে, সিংবাড়ির শিমুলবাগানেই টের পাওয়া গেল। তরুই চেঁচিয়ে বলল, গোলা, শিগগির আয়, দ্যাখ দ্যাখ। ঘাসের ভিতর বনমালার লাল ছুঁচলো মুখ। মুহূর্তে দেখা দিয়ে বেজিটা তিলের জমির ভিতর হারিয়েও গেল।

সামনে যত দূর দেখা যায়, তিলের চাষ, কোথাও আখের জমি। আখ মাড়িয়ে বড়ো বড়ো কড়াইয়ে রস জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। এভাবে মামাবাড়ি সাঁঝ লাগতেই পৌঁছে গেলাম। পর দিন বিকেল বেলায় তরুকে নিয়ে রথতলায় গিয়ে দেখছি, সেই রথ নেই। ভাঙাচোরা রথ, রং চটে গেলে যা হয়। ঘোড়ার মুণ্ড হেলে গেছে, একটা কাক রথের ধ্বজা হয়ে কা কা করছে। নদীতে জল নেই। বর্ষার দু-কূল প্লাবিত সেই ভরা জোয়ারের নদী কচুরিপানায় ঢেকে গেছে। বাঁশের সাঁকোতে মানুষ এ-পার ও-পার হচ্ছে।

কথা নেই, বার্তা নেই, তরু রথটাকে পাক খেতে গিয়ে আমাকে ডাকল, এই গোলা, উঠে আয়। উঠতেই হল, না উঠেও উপায় নেই, সে যে কোনও ছুতোয় আমাকে ফাঁসিয়ে দিতে পারে। এবং কেন যে মেয়েটা সপ্তধা প্রদক্ষিণ করে রথের উপর উঠে এসে বসল! তার কী অভিলাষ, তা-ও জানি না। কেমন ব্যাজার মুখ, কিছুই বলছে না। চুপচাপ রথটির কারুকার্য দেখছে। সে আমাকে কিছু বলার জন্যেই যে ডেকে এনেছে, তা-ও বুঝি। কুলদা সাহার সঙ্গে আমার দাদুর হয়তো এমন কিছু কথা হয়েছে, যা শুনে তার মাথা খারাপ। সে হঠাৎ লাফ দিয়ে নেমে দৌড়োতে থাকল। বিকেল বেলায় রথতলায় মানুষের যথেষ্ট যাতায়াত থাকে, গোপনে কিছু বলার মতো সুযোগ থাকে না, তরু সাঁকোতে উঠে নদী পারাপার করতে গিয়ে এক বার জলেও পড়ে গেল।

সেই কখন থেকে বলছি, চল, তরু, বাড়ি চল। সে যাবে না। কিছুতেই যাবে না। আমার কানে কানে বলল, সে কোথাও চলে যাবে। সে জলে ডুবে মরে যাবে। তার পর কুলদা সাহার অভিলাষের কথাও বলল, মেয়েটি তো বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছে মতিলালের। দেখতেও ঊর্বশী, এবং তাঁর যে তৃতীয় পক্ষের এক জন স্ত্রী থাকা দরকার, কারণ বয়স হয়েছে, পেল্লায় প্রাসাদের মতো বাড়িতে তিনি খুবই একা। প্রথম পক্ষের স্ত্রী বড়ো ছেলের সঙ্গে থাকেন। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী খুবই অসুস্থ। পুত্ররা সব আলাদা। কেউ মাধবদির আড়তে থাকেন, কেউ নারায়ণগঞ্জের তেজারতি কারবার দেখেন। বাড়িতে নায়েব-গোমস্তাদেরই ভিড় বেশি। ঝি-চাকর ছাড়া তাঁকে এক গ্লাস জল দেবার মতো কেউ নেই। মতিলাল যদি রাজি হয়।

মতিলাল তাঁর স্বজাতি, এবং তরু জানে তার বাবা এককথায় রাজি হয়ে যাবেন। তরুকে স্ত্রীরূপে পাবার কুলদা সাহার খুব ইচ্ছে হয়েছে—এই শুভ খবরে প্রতিবেশীরাও খুশি। গরিব পরিবারটি রক্ষা পেয়ে যাবে। কুলদা সাহা বড়ো মহাজনই নন, বড়ো মাপের মানুষও। কথা থাকল, মতিলালাকে দুপতারার বাজারে দোকান করে দেবেন এবং তরুর জন্য কুলদা সাহা তাঁর বাড়ির একটা অংশও মতিলালকে ছেড়ে দিতে রাজি। তরু জানে, দু-এক দিনের মধ্যেই তার বাবা এসে হাজির হবেন। এখন সে কী করে!

আমার যা স্বভাব, কোনও সংকটে পড়লেই ভাবালু বনে যাওয়া। তরুর বয়স বেশি না, প্রায় নাবালিকাই বলা যায়। কুলদা সাহার এই ভীমরতিতে আমার শুধু মনোকষ্টে ভোগা ছাড়া উপায় থাকে না। শুধু বললাম, তুই এক কাজ কর। রথের জগন্নাথ ছাড়া তোকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। রাজরানি হওয়ার কথা আছে ঠিক, স্বপ্নে জগন্নাথ দেব তোকে দেখা দিয়েছেন। আবার তিনি দেখা দেবেন। দেখা দিলে বিবাহের বিষয়টি এক বার তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া দরকার।

তাঁর সঙ্গে মানে?

আরে, তোর তো ঠাকুর দেবতার সঙ্গে কথা হয়, সোজা ব্যাপার। কুলদা সাহা ধর্মভীরু মানুষ, ঘাবড়ে যেতে পারে। জগন্নাথ দেবের কৃপাতেই তার এই জয়ময়।

তরু বলল, ধুস! আসলে রথ দেখা, কলা বেচা। রথের মেলায় কত মুনাফা তাঁর, বুঝিস না? লোকটা শুধু বাণিজ্য বোঝে।

যাই হোক, আমাদের ইচ্ছের যে কোনও দাম নেই, তরুর ওপরে যখন নজর পড়েছে মহাজনের, তারও রক্ষা নেই।

মতিলাল তো সব শুনে থ! বলে কী মহাজন! সে সটান গড় হয়ে বলেছিল, দোহাই আপনার জগন্নাথ দেবের, মেয়ের পাণিপ্রার্থী হয়েছেন। আমার গৌরবের শেষ নেই।

আমার দাদু এবং বৈঠকখানায় আর যাঁরা উপস্থিত, সবাই একবাক্যে মহাজনকে খুবই বিবেচক পুরুষ বলে সাব্যস্ত করে ফেললেন। এমনকী, আমার জ্যাঠা-কাকারা শুনেও খুব প্রসন্ন হয়ে উঠলেন, পরিবারটি বেঁচে গেল।

তবে, তরুকে আমি জানি, সে যদি মাথা না পাতে, কারও ক্ষমতাই নেই, তাকে ছাদনাতলায় নিয়ে যায়। কারণ, তরু যে একা নয়। তার বনমালা আছে। বনমালাকে দিয়ে সে গর্ত থেকে একটা গোখরো সাপকে টেনে বের করেছিল— দৃশ্যটি ভাবতেই কিছুটা আহ্লাদিত হওয়া গেল— তরুর আর কেউ না থাকুক, বনমালা আছে।

তবে, কিছুতেই কিছু আটকানো যায়নি। জ্যৈষ্ঠে তরুর বিয়ে হয়ে গেল। সব সময় আশঙ্কা— এই বুঝি কোনও অঘটনের খবর এল! শেষ পর্যন্ত আমার ঠাকুমা তরুর জন্য চোখের জলে ভেসে গেলেন। তিনি কিছু খেতে চাইতেন না, খেতে ইচ্ছে হতো না। পথ চেয়ে বসে থাকতেন, তরু কবে আসবে। আশায় আশায় এক দিন ঠাকুমাও বর্ষাকালে রথযাত্রার দিনে দেহরক্ষা করলেন। ঠাকুমার শ্রাদ্ধে গোটা পরগনার বিশিষ্ট জনেরা নিমন্ত্রিত। কুলদা সাহাও তরুকে নিয়ে আসছেন নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। বড়ো পানসি নৌকা থেকে দাসদাসী-সহ তরু নেমে এলে তাকে চেনাই গেল না— রোগা মেয়েটা নানা অলংকারে ঝলমল করছে। ঠাকুমার ঘরে ঢুকে তার শোকতাপ উথলে উঠল। সে প্রাণ ভরে কাঁদল। জেঠিমা-কাকিমারা নানা প্রবোধ দিতে দিতে ঘরের বাইরে নিয়ে এলেন। সে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। দাসদাসী পরিবৃত হয়ে সে বসে আছে। এক জন দাসীকে দিয়ে কুলদা সাহাকে তলব করতেই তিনি পড়িমরি করে হাজির। তরুর তখন কী হাসি! তরু হাসতেও জানে, কাঁদতেও জানে, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

শ্রাদ্ধবাড়িতে যা হয়ে থাকে, সকাল থেকেই নদীর ঘাটে সারি সারি কোষা নৌকা, গয়না নৌকা কিংবা বজরা থেকে নিমন্ত্রিতরা নামছেন, বস্তা বোঝাই চিড়া মুড়ি খই গুড় বড়ো ঘাসি নৌকায় বোঝাই হয়ে আসছে। চিৎকার চেঁচামেচি, দই ক্ষীরের পাতিল সারি সারি নামানো হচ্ছে। বাইরের উঠোনে বিশাল সামিয়ানা। তার নীচে বিশাল বিশাল সতরঞ্জি পাতা। এই বিশাল শ্রাদ্ধকাণ্ডে একা নিঃসঙ্গ বিষবৃক্ষ এবং তার খুঁটিতে বাঁধা একটি গো-বৎস ফ্যালফ্যাল করে সব দেখছে। এত সবের মধ্যে তরুর মাথা ঠিক না-ই থাকতে পারে। সে তার স্বামী কুলদা সাহাকে বলছে, আমাকে মণ্ডপে নিয়ে চলো। সঙ্গে সঙ্গে কুলদা সাহা নিজে একটি চেয়ার টেনে নিয়ে গেলেন। কে বলবে, এই রেশমবস্ত্র পরিহিত মানুষটির দোর্দণ্ড প্রতাপে মানুষজন ত্রস্ত থাকে। তরু চেয়ারে বসার পরই ফের ডাকল। তিনি ফের ছুটে গেলেন। আমন্ত্রিতদের আপ্যায়ন করার ভার তাঁর উপর, তবু তিনি ছুটে যাচ্ছেন অহরহ, আর তরুর আবদার রক্ষা করছেন। আর, তখনই গোলা গোলা বলে কে চেঁচাচ্ছে। ছুটে যেতেই বলল, তরু ডাকছে।

কাছে গেলে বলল, গোলা চল, নদীর ঘাটে। গেলাম। দাসীবাঁদিরা এক ধমকে পালিয়েছে— তোদের এখানে কী? যা। সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া।

তরু নদীর জল দেখছিল। চার পাশে সেই ভরা বর্ষা। নদী দু-কূল প্লাবিত। বজরায় নিয়ে গেল। তার পর বলল, চল পুকুর ঘাটে। একেবারে মতিস্থির নেই। কখন কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। সে যে বলেছিল, দেখবি ওই রাক্ষসটার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হলে আমি জলে ডুবে মরব! আমার ভিতরে আতঙ্ক— নদীর জলে কি সে ভেসে যাবে ঠিক করেছে!

এই তরু, চল। সে সাড়া দিলো না। সে বৃষকাষ্ঠের গো-বৎসটির মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। নদী দেখছে, শাপলা-শালুক ফোটা বর্ষা দেখছে। বনমালার কী খবর, বলতেই সে চোখের জলে ভেসে গেল। বাড়ির বাঘা ঘাড় কামড়ে… আর বলতে পারল না। তার পরই হাহাকার হাসি, জানিস গোলা, কর্তাকে বলেছি আকাশ সমান নতুন রথ চাই। পুরনো রথ চলবে না। আগামী বার গেলে দেখতে পাবি। যাবি তো?

ঠিক আছে, বলেই পালালাম। অবশ্য দেশভাগ হয়ে যাওয়ায় রথের মেলায় আর যাওয়া হয়নি। এ দেশে এসেও রথযাত্রা সম্পর্কে আমার কোনও আর আগ্রহ ছিল না। সংগ্রামী মা মাটি মানুষ পত্রিকা ২০১৮ পূজাসংখ্যায় প্রকাশিত


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন