যে কোন মন্দির নির্মাণেরই একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে, যাকে আমরা বর্তমানে মিশন বলি। অর্থাৎ একটি বিশেষ বার্তা যা আমরা এই নির্মাণের মধ্য দিয়ে সকলের কাছে তুলে ধরতে চাই। সেইরকমই দক্ষিন চব্বিশ পরগনার তিন বিখ্যাত মন্দির হাউড়ি হাটের জোড়া শিব আর কাছেই বানচাবড়ার কেশবেশ্বর মন্দির নিয়ে আজকের প্রতিবেদন। প্রাচীনতার নিরিখে অবশ্য হাউড়ি হাটের জোড়া শিব মন্দির এগিয়ে। সেই সঙ্গে এর ব্যতিক্রমী স্থাপত্যও। তবে সব মিলিয়ে সমসাময়িক বা কিছু আগে ও পরে যে সব আটচালা মন্দির তৈরী হয়েছিল সেগুলির মধ্যে কেশবেশ্বর মন্দিরকেই সবদিক থেকে উৎকৃষ্ট বলা চলে। আসছি সেই কথায়। এই মন্দির গুচ্ছের কারনে এই জায়গার নাম মন্দিরবাজার হয়েছে বলেও অনেকের ধারণা আবার অনেকের মতে মন্দিরকে কেন্দ্র করে এর অদূরেই গড়ে উঠেছে স্থায়ী বাজার, সেই থেকেই এই জায়গার নাম। অবশ্য এর কোন প্রামাণ্য নথি নেই। তবে দক্ষিণ ২৪ পরগণা-সহ সুন্দরবনের আধ্যাত্মিক ভাবধারা বিস্তারে এই মন্দির গুচ্ছের প্রভাব ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়।
হাউড়ি হাটের জোড়া শিব মন্দির
সারা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য শিব মন্দির। সেইরকমই আজ থেকে প্রায় ৪০০ বৎসর আগে প্রাচীন হাতিয়াগড় পরগণায় বর্তমান মন্দিরবাজার থানার পুর্ব দিকে জগদীশপুর গ্রামে ১০৪০ বঙ্গাব্দে দুইটি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। ডায়মন্ডহারবার থেকে রায়দীঘিগামী বাসে বা যে কোন গাড়ীতে গেলে মন্দিরবাজারের পরেই রাস্তার প্রায় পাশে এই দুই মন্দিরের সুউচ্চ চূড়া দেখা যায়। অনেকে এই দুই মন্দিরকে ‘দুই সতীনের মন্দির’ বলেও ডাকেন। মন্দিরের কাছেই বিখ্যাত নস্কর পরিবারের অকাল বিধবা পুত্রহীনা ধর্মপ্রাণা হাউড়ি নামের এক গৃহবধূ এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। তিনি আবার এ মন্দির নির্মাণের পর কলকাতার হাটখোলা নিবাসী দত্ত পরিবররের কুলগুরু আহিরীটোলার ভট্টাচার্য্যদের এটি দান করেন। সে সময় এরকম তৈরী করে দান করে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। আবার অনেকের মতে এটি উত্তর কোলকাতার হাটখোলা দত্ত পরিবারেরই তৈরী। যাই হোক মন্দির ও হাট সবই এখন নস্করদের তত্ত্বাবধানে। এর মধ্যে পূর্বেরটি যজ্ঞেশ্বর শিব ও পশ্চিমেরটি ভুবনেশ্বর শিব নামে খ্যাত। মন্দিরের পাশেই বড় পুকুর। সপ্তাহে দুই দিন এখানেও হাট বসে। হাউড়ির হাট সম্বন্ধে একটা পুরোনো প্রবাদ চালু আছে “হাউড়ি হাটের পরদিন বে।” অর্থাৎ সেই সময় এত পাজী পুঁথির চল ছিল না। লোকে হাট থেকে অনুষ্টানের সব বাজার করতো আর সেই বাজার যাতে নষ্ট না হয় তার জন্য পরদিন শুভ অনুষ্ঠান সেরে ফেলতো। সেই জন্য হাউড়ি হাটের পরের দিন বিবাহ ইত্যাদি অনুষ্ঠানের কাজ হত। বর্তমানে মন্দির বাজারের কেশবেশ্ববের মন্দিরের জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় এটির গুরুত্ব কিছুটা কমে গিয়েছে।
বানচাবড়ার কেশবেশ্বর মন্দির
দক্ষিণ বাংলার অধিকাংশ শিবমন্দিরের মত বাণচাপড়ার কেশবেশ্বর শিব মন্দিরও একটি আটচালা বৈশিষ্ট্যের বিখ্যাত মন্দির। নির্মাণ কাল ১৭৪৮ খৃষ্টাব্দ হলেও (বাংলা ১১৫৫) তিনটি ফলক থেকে জানা যায় যে মন্দির ১৩৫৬ বঙ্গাব্দে এবং ১৪০২ বঙ্গাব্দে দুবার সংস্কার ও পুনঃসংস্কার হয়েছিল। মূল প্রতিষ্ঠালিপিটি সংস্কৃতে লেখা। আর একটি ফলক থেকে জানা যায় ১৬৭০ শকাব্দে (বা ১৭৪৮ খৃষ্টাব্দে) রাজা কেশবের আদেশে শিল্পী বাসুদেব কর্তৃক এই মন্দির নির্মিত হইল। বিশাল আয়তনের এই মন্দিরটি আয়তকার। আয়তন ৪১ ফুট ৪ ইঞ্চি x ৩৩ ফুট ১ ইঞ্চি। মাটির উপর থেকে চাতাল বা প্লিন্থ লেভেল ছয়ফুট এবং মাটির ভিতরের ভিত প্রায় ৮-১০ ফুট উঁচু করে গাঁথা।
গর্ভগৃহে শ্বেত পাথরের প্রায় দুই ফুট উঁচু বেদীর উপর বড় আকৃতির কালো পাথরের শিব লিঙ্গটি দেবীপট্ট-সহ বসানো। দেবীপট্টের মুখ উত্তর দিকে। কয়েকটি রৌপ্য ও লৌহ নির্মিত ত্রিশূল রয়েছে। কালো পাথরের তিন চারটি নন্দী (ষাঁড়) বেদীর নীচে বসানো। এখানেও দুটি লিপি ফলক রয়েছে। জানা যাচ্ছে মন্দিরটি প্রাচীন বাইন নদীর চড়ার ধারে অবস্থিত ছিল বলে বানচাবড়ার কেশবেশ্বর নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীকালে মন্দিরের কাছে বাজার বসত বলে জায়গাটির নাম হয় মন্দির বাজার। জমিদার কেশব রায় চৌধুরী পাল্কী চড়ে বিষ্ণুপুরে গঙ্গাস্নানে যেতেন। আসা যাওয়ার পথে তিনি হাউড়ি হাটের জোড়া শিব মন্দির দেখে অনুপ্রানিত হয়েছিলেন। তাঁর দুই স্ত্রী কিন্তু কোন সন্তান ছিল না। পরবর্তী কালে শিবের আরাধনা করে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে সন্তান লাভ করেছিলেন এবং এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। শিব লিঙ্গ আনা হয়েছিল কাশীধাম থেকে। মন্দিরের অভিষেক অনুষ্ঠানে অনেক শ্রাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে পৌরহিত্য করেন বোলসিদ্ধি গ্রামের বিখ্যাত পন্ডিত বানেশ্বর ন্যায়রত্ন মহাশয়। মন্দির নির্মানকে কেন্দ্র করে এক জনশ্রুতি আছে। নির্মান চলাকালীন কাজ কেমন হচ্ছে তা সরেজমিনে দেখার জন্য জমিদার কেশববাবু একদিন বাঁশের ভারা বেয়ে উপরে উঠেছিলেন কিন্তু নামার সময় নীচের দিকে তাকিয়ে তিনি এমন ভয় পেয়ে যান যে আর নামতে সাহস পাচ্ছিলেন না। কি ভাবে জমিদারবাবুকে নামানো যায় তা নিয়ে পারিষদেরা চিন্তায় পড়ে গেলেন।
তখন এক নাপিত এগিয়ে এসে তাদেরকে বলেন যে সে নামিয়ে আনতে পারে কিন্তু তারপর জমিদারের রোষানল থেকে তাকে বাঁচাতে হবে। পারিষদরা সম্মতি দিলে সেই নাপিত বাঁশের ভারা বেয়ে জমিদারের কাছে পৌঁছে গেলেন আর কটু কথা বলতে লাগলেন। তার কথা শুনে জমিদার রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তাকে মারার জন্য উদ্যত হয়ে নামতে লাগলেন। আর সেই নাপিত জমিদারের আগে আগে নেমে এলেন। নামার পর পারিষদরা জমিদারকে সব বুঝিয়ে বললেন। সব শুনে জমিদার খুশী হয়ে সেই নাপিতেকে অনেক পুরস্কৃত করেছিলেন। সারা বছর এখানে ভক্তদের সমাগম লেগেই থাকে । প্রত্যেক দিন নির্দিষ্ট সময় পূজার জন্য ব্রাহ্মণ উপস্থিত থাকেন। চৈত্র মাসের শেষে গাজন ও চড়ক উৎসব এবং ১লা বৈশাখ গোষ্ঠ উৎসব উল্লেখযোগ্য। সোম মঙ্গল ও শুক্রবার সপ্তাহের তিন দিন সকালে এখানে বিরাট বাজার বা হাট বসে। পুর্ব রেলের লক্ষীকান্তপুর স্টেশনে নেমেও এখানে আসা যায়। বর্তমানে জমিদারি প্রথা না থাকায়, সমস্তটাই দেখভাল করে মন্দিরের দায়িত্বে থাকা কমিটি।
চমৎকার লেখাটি ! তথ্যবহুল এবং কৌতূহলদ্দীপক ।
দক্ষিণ ২৪ পরগণার বড়াশী গ্রামের অম্বুলিঙ্গ চক্রতীর্থ নিয়ে লেখা পড়ার আগ্রহ রইল।
লিখবো
আপনার লেখা পড়ে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার শৈব তীর্থ মন্দিরবাজারে পৌঁছে গিয়েছিলাম। জমিদার সংক্রান্ত জনশ্রুতি ও ইতিহাস দুটো দিকই খুব সুন্দর করে লিখেছেন। ধন্যবাদ নিন।
ধন্যবাদ।