যখন সরকারিভাবে কোনো কর্তৃপক্ষ একটি বড় দুর্ঘটনাকে গুজব বলে দাবি করে তখন মানতেই হয় যে সেই কর্তৃপক্ষ দোষ ঢাকতে চাইছে, দায় নিজেদের ঘাড় থেকে নামিয়ে দিতে চাইছে, তা নাহলে তারা মিথ্যা কথা বলবে কেন। তার চেয়েও আশ্চর্যের বিষয় গুজব দাবি করেও তারা পরবর্তীতে দুর্ঘটনার কথা স্বীকার করে নিল কেন? কারণ, খাশ রাজধানীর রেল স্টেশনের অব্যবস্থা চরম আকার ধারণ করেছে। বিলম্বে ট্রেন চলাচল থেকে শুরু করে রেল স্টেশনের বিভ্রান্তিকর ঘোষণা তো সেকথাই বলে। আর সেই কারণেই পদপিষ্ট হওয়ার গোটা ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে রেল প্রশাসন। ঠিক এমনটাই করেছিল ২৯ জানুয়ারি মহাকুম্ভে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনার সময়। উল্লেখ্য, গত শনিবার রাত ৯টা ২০ থেকে রাত ১০টার মধ্যে, নিউ দিল্লি স্টেশনের ১৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মের ট্রেন আসার কথা ছিল ১২ নম্বরে, কিন্তু যে মুহুর্তে রেল ঘোষণা করে ওই ট্রেন ১৬ নম্বরে আসবে তারপরেই রেল যাত্রীদের মধ্যে চরম হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায় এবং তার থেকেই পদপিষ্টের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত অন্তত ১৮জনের প্রাণ চলে যাওয়ার পাশাপাশি বহু মানুষ গুরুতর আহত হন। ওই রাতেই ১১টা ৩৬ মিনিটে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব এক্স হ্যান্ডেলে দাবি করেন, নয়া দিল্লি স্টেশনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দিল্লি পুলিশ ও আরপিএফ ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে, আহতদের হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছে। কিন্তু রেলের তরফে তখনও পর্যন্ত পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর কথা বলা হয়নি। হয়নি তার কারণ, রেল মৃত্যু ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, এমনকি রেলমন্ত্রীও। নয়া দিল্লি স্টেশনে পদপিষ্টের ঘটনায় মৃত্যুর কথা প্রথম পোস্ট করেন দিল্লির উপরাজ্যপাল বিনয় কুমার সাক্সেনা। তাঁরকরা রাত ১১টা ৫৫ মিনিটের এক্সে তিনি বলেন, ‘নয়া দিল্লি রেল স্টেশনে মৃত্যু এবং গুরুতর আহত হওয়ার একটা মর্মান্তিক ও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে গিয়েছে।’ যদিও কিছুক্ষণ পরেই মধ্যেই উপরাজ্যপালের বিবৃতি বদলে যায়, নিজের পোস্ট থেকে তিনি মৃত্যুর কথা মুছে ফেলেন, রেখে দেন শুধু ‘দিল্লি স্টেশনে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে।’ — এই কথাটুকু।
শনিবার রাতে নয়াদিল্লি স্টেশনে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার কারণ হিসেবে একাধিক তথ্য উঠে এসেছে। তার চেয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে রেলের ভূমিকা নিয়ে। জানা গিয়েছে, রেল প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১৫০০ জেনারেল টিকিট বিক্রি করছিল। টিকিট নিশ্চিত না হলেও যাত্রীদের ট্রেনে উঠে পড়তে বলা হয়। যাঁদের কাছে নিশ্চিত টিকিট ছিল, সংরক্ষিত আসন যাঁরা বুক করেছিলেন দেখা গিয়েছে তাঁরাই ট্রেনে উঠতে পারেননি। অথচ টিকিট ছাড়াও বহু মানুষ ট্রেনে ওঠার জন্য ঠেলাঠেলি করেছেন। প্রশ্ন, যেখানে প্রয়াগরাজ যাওয়ার দেদার টিকিট বিক্রি হওয়ায় প্ল্যাটফর্মে ভিড় উপচে পড়ে কিন্তু রেল তার পরও কেন ট্রেন না বাড়িয়ে কেন প্ল্যাটফর্ম বদল করা হয়? ট্রেনে উপচে পড়া ভিড় দেখেও রেল ভিড় নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ করে না? কয়েকদিন আগে কুম্ভের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েও কেন সতর্ক ছিল না রেল প্রশাসন? এমন অনেক প্রশ্ন উঠে আসছে একের পর এক।
প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা থেকে জানা যাচ্ছে, প্রয়াগরাজের ট্রেন ধরতে সেই রাতে ১২, ১৩, ১৪ ও ১৬ নং প্ল্যাটফর্মে যাত্রীদের ভিড় ছিল উপচে পড়া। নয়াদিল্লি স্টেশনের ১৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছিল প্রয়াগরাজ এক্সপ্রেস। স্বতন্ত্র সেনানী ও ভুবনেশ্বর রাজধানী আসতে দেরি করায় স্টেশনে ভিড় ক্রমশ বাড়ছিল। ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে বারকয়েক প্ল্যাটফর্ম বদলের ঘোষণা হওয়াতে যাত্রীদের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। ১২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢোকার কথা ছিল ট্রেনের। কিন্তু হঠাৎই ঘোষণা হয়, ওই ট্রেন ১৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢুকবে। ফলে বিভ্রান্ত যাত্রীরা এদিক ওদিক ছুটতে শুরু করেন। আর তার থেকেই পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ে কিন্তু সেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো পুলিশ যেমন ছিল না, পাশাপাশি ছিল না রেলের নজরদারি। কিন্তু এই ঘটনার দায় রেল সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আশ্চর্য! মহাকুম্ভ নিয়ে যে এত প্রচার, লক্ষ লক্ষ মানুষকে মহাকুম্ভের জন্য উৎসাহ দেওয়া, তাতে তো কাতারে কাতারে মানুষ সারা দিচ্ছে, ভিড়ও হচ্ছে, তাহলে কেন বেশি ট্রেন চালালো না রেল? উলটে ঘটনার দায় ঘাড় থেকে নামিয়ে দিতে পদপিষ্টের ঘটনাকে গুজব বলে ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা? প্রশ্নের মুখে পড়লেই সরকার ঢোক গিলে দুর্ঘটনার কথা স্বীকার করে, রেল কর্তৃপক্ষও এক্ষেত্রে সেই পদক্ষেপ করেছে। কেন এই দুর্ঘটনা ঘটল, উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন রেলমন্ত্রী এবং রেলের তরফে ক্ষতিপূরণের ঘোষণাও করা হয়েছে। কিন্তু তাতেই কি ঘটনার দায় অস্বীকার করা যায়, না দায় এড়ানো যায়?
নয়াদিল্লিতে পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনার অন্যতম কারণ যদি অতিরিক্ত ভিড় হয় তাস্বত্তেও বলতে হবে রেলের গাফিলতি ছিল। ভিড়ের কারণ কুম্ভ যাওয়ার উদ্দেশে শনিবার রাতে শয়ে শয়ে মানুষ জড়ো হন নয়াদিল্লি স্টেশনে। আসলে নয়াদিল্লি স্টেশন থেকে একাধিক ট্রেন হয় সরাসরি কুম্ভে যাওয়ার কথা, নয়তো কুম্ভ হয়ে অন্য গন্তব্যে যাওয়ার কথা। সেই ট্রেনগুলির আশায় দাঁড়িয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ।স্বতন্ত্রতা সেনানী এক্সপ্রেস এবং ভুবনেশ্বর-রাজধানী এক্সপ্রেস এই দুটি ট্রেনে প্রয়াগরাজ যাবেন বলে বহু মানুষ ১২ এবং ১৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু দুটি ট্রেনের কোনওটিই সময়মতো পৌছয়নি। এর মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে ট্রেনদুটি বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে কুম্ভের জন্য স্পেশাল ট্রেন প্রয়াগরাজ এক্সপ্রেস ঢুকে পড়ে ১৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। প্রয়াগরাজ এক্সপ্রেস আসতে দেখে ওই ট্রেনের যাত্রীরা এবং বাকি দুটি ট্রেনের যাত্রীরাও ১৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে ছুটতে থাকেন। সকলে একসঙ্গে ওই ট্রেনটিতে ওঠার চেষ্টা করলে অনেকে পড়ে যান। বহু লোক তাঁদের মাড়িয়েই ট্রেনের দিকে ছুটে যান আর্তনাদ-চিৎকার তোয়াক্কা না করে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে রেল পুলিশ কার্যত ব্যর্থ হয়। প্রশ্ন ভিড় এবং তা থেকে হুড়োহুড়ির পরিস্থিতি তৈরি হল কেন? প্রথমত দুটি ট্রেন লেট। কেবল লেট নয়, এতটাই ‘লেট’ যে গুজব ছড়িয়ে পড়ে ট্রেনদুটি বাতিল হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া ট্রেনের প্ল্যাটফর্ম নিয়ে বিভ্রান্তিকর ঘোষণা শোনা গিয়েছে বলে দাবি। চমকপ্রদ বিষয় হল, প্রয়াগরাজ যাওয়ার জন্য দেড় হাজার যাত্রী অসংরক্ষিত টিকিট কেটেছিলেন। এত বিশাল সংখ্যক অসংরক্ষিত টিকিট বিক্রির পরও কোনওরকম সচেতনতামূলক পদক্ষেপ করা হয়নি।