সম্প্রতি এক বন্ধু আমাকে একটি ভিডিয়ো ফরোয়ার্ড করেছেন হোটাসঅ্যাপে। সেই ভিডিয়োতে মধুমালা চট্টোপাধ্যায় নামে এক বাঙালি নারীর অভিজ্ঞতার কথা আছে। মধুমিতা একজন নৃতত্ত্ববিদ। কৈশোর থেকে প্রথামাফিক পথে হাঁটেন নি তিনি। দেশের আদিবাসী জনজাতির জীবনের খোঁজ-খবর করার ইচ্ছে তাঁকে তাগিদ দিয়েছে বারবার। এ পথে ঝুঁকি আছে। তাই তাঁর অভিভাবকরা নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছেন। মধুমালা শোনেন নি। দেশের সরকারও তাঁকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছেন। শোনেন নি তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃতত্ব নিয়ে পড়াশোনা করার পরে তিনি বেছে নিয়েছেন গবেষণার পথ।
ফিজিক্যাল অ্যানথ্রপোলজির ছাত্রী হিসেবে তিনি বিভিন্ন উপজাতির মা ও শিশুর স্বাস্থ্য ওপুষ্টির ব্যাপার নিয়ে শুরু করেছেন গবেষণা। বেছে নিয়েছেন আন্দামান ও নিকোবরকে। যেখানে অন্তত ছয়টি জনজাতির বাস। সমাজের মূল ধারা থেকে যারা বিচ্ছিন্ন। দক্ষিণ ও মধ্য আন্দামানে থাকে জারোয়ারা। গ্রেট নিকোবরে থাকে শম্পেনরা। লিটল আন্দামানের পশ্চিমে থাকে ওঙ্গরা। উত্তর সেন্টিলেনি দ্বীপপুঞ্জে থাকে সেন্টিনেলিরা। জারোয়াদের দ্বীপে তিনি গিয়েছেন আটবার। নিকোবরের পনেরোটি গ্রামে কাটিয়েছেন টানা তিন মাস। গ্রেট নিকোবরে কাটিয়েছেন টানা সত্তর দিন।
কিন্তু সেন্টিনেলি দ্বীপে যেতে চাইলে সরকার ছাড়পত্র দেন নি। তার সঙ্গত কারণ ছিল। এই দ্বীপে ২৫০ জনের মতো সেন্টিনেলিজ আছে। তারা প্রস্তরযুগের মানুষ। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তারা যোগাযোগ রাখতে চায় না। দুজন জেলে এই দ্বীপের কাছাকাছি গেলে তাদের হত্যা করা হয়েছিল। সুনামির পরে যখন সরকার দ্বীপটির উপর আকাশ থেকে জরিপ করার চেষ্টা করে, তখন সেন্টিনেলিজরা তির ছুঁড়ে হেলিকোপ্টারকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল। টি এন পণ্ডিতের নেতৃত্বে একদল সেই দ্বীপে গিয়েছিলেন, কিন্তু খুব সুবিধে করতে পারেন নি। জন চাউ নামে একজন তরুণ খ্রিস্টান মিশনরি সে দ্বীপে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে নিহত হন। এ সব ঘটনার ফলে সরকার সেন্টিলেনি দ্বীপ সম্বন্ধে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। সিদ্ধান্ত নেন যে দ্বীপটির জনজাতির মানুষরা তাদের নিজের পথে চলুক।
মধুমালা যেতে চাইলেন সেই দ্বীপে। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রতিশ্রুতি দিলেন সেখানে গেলে যদি তাঁর কোন ক্ষতি হয়, তাহলে তার জন্য সরকার দায়ি থাকবেন না। বর্হিজগতবিচ্ছিন্ন সেন্টিনেলিদের জয় করলেন তিনি। এই জয়ের একটি উপাদান ছিল নারকেল। তাঁদের বোটটি দ্বীপের কাছাকাছি আসতে বোট থেকে তাঁরা নারকেল ছুঁড়তে লাগলেন। আস্তে আস্তে নারকেল কুড়োতে জলে নামল সেন্টিনেলিজরা। মধুমালাও নেমে পড়লেন জলে। তাদের হাতে তুলে দিতে লাগলেন নারকেল। ভাব হয়ে গেল। কিন্তু আমরা জানি, শুধু নারকেল নয়, অন্তরের ভালোবাসা না থাকলে আদিবাসীদের জয় করতে পারতেন না তিনি।
মধুমালার গবেষণা ও অভিযানের কথা ভাবতে ভাবতে আমার মনে পড়ে গেল সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’এর সেই বিখ্যাত উক্তির কথা : বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। আদিবাসীরা তো দিব্যি আছে বনে, তাদের নিয়ে সভ্য মানুষের এত মাথাব্যথা কেন! কি দরকার তাদের নিয়ে গবেষণা করার? তাদের জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করার? সভ্য ও শিক্ষিত মানুষের জ্ঞানের ক্ষুধা অপরিসীম। তাই তো সাগরে-পাহাড়ে-বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় একদল মানুষ। সেই নজরুলের মতো তাদের প্রতিজ্ঞা : দেখব এবার জগতটাকে। শুধু তো মধুমালা নয়, সারা পৃথিবীতে জনজাতির জীবন-অনুসন্ধানীর সংখ্যা কম নয়। জন উইলস, বার্ক, ড্যামপিয়ের, কুক, গ্রে, টিম মারি …. আরও অনেক।
সেই সঙ্গে আর একটা কথা আমাকে ভাবায়। এইসব জনজাতির মানুষজন কি চিরকাল বন্য থেকে যাবে? সভ্যতার আলোক কোনকালে দেখার অধিকার কি তাদের নেই? আমরা যাদের ‘দলিত’ বলি তারাও তো এককালে সমাজের মূল স্রোতের বাইরে ছিল; বাবা সাহেব আম্বেদকরের মতো মানুষজনের নিরন্তর চেষ্টায় আজ তারা সমাজের মূল স্রোতের অংশ হয়ে গেছে। সে অধিকার তো জনজাতিরও আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছেন যে রক্তসংমিশ্রণ না হলে সে জাতি উন্নত হতে পারে না। জনজাতির মানুষরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন রেখে উন্নতিকে ঠেকিয়ে রেখেছে।
লেখক সিনিয়র ফেলোশিপ প্রাপ্ত গবেষক