সোমবার | ১৬ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২রা আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | রাত ১:৪৫
Logo
এই মুহূর্তে ::
দুর্দৈবপীড়িত রবীন্দ্রনাথ : দিলীপ মজুমদার শান্তি সভ্যতার গুণ, যুদ্ধ তার অপরাধ … ভিক্টর হুগো : অশোক মজুমদার হরপ্পার ব্যুৎপত্তি নিয়ে নতুন আলোকপাত : অসিত দাস বল পয়েন্ট কলমের জার্নির জার্নাল : রিঙ্কি সামন্ত মহেঞ্জোদারো নামের নতুন ব্যুৎপত্তি : অসিত দাস পরিসংখ্যানে দারিদ্রতা কমলেও পুষ্টি বা খাদ্য সংকট কি কমেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী অথ স্নান কথা : নন্দিনী অধিকারী তন্ত্র বিদ্যার বিশ্ববিদ্যালয় চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মেসোপটেমিয়া ও সিন্ধুসভ্যতার ভাষায় ও স্থাননামে দ্রাবিড়চিহ্ন : অসিত দাস ধরনীর ধুলি হোক চন্দন : শৌনক দত্ত সিন্ধুসভ্যতার ভাষা মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলনের রাজা হামুরাবির নামে : অসিত দাস বিস্মৃতপ্রায় জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় ভাষায় সিন্ধুসভ্যতার মেলুহার ভাষার প্রভাব : অসিত দাস বঙ্গতনয়াদের সাইক্লিস্ট হওয়ার ইতিহাস : রিঙ্কি সামন্ত নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘ঝড়ের পরে’ ভালো থাকার পাসওয়ার্ড (শেষ পর্ব) : বিদিশা বসু গাছে গাছে সিঁদুর ফলে : দিলীপ মজুমদার ভালো থাকার পাসওয়ার্ড : বিদিশা বসু সলিমুল্লাহ খানের — ঠাকুরের মাৎস্যন্যায় : ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা : মিল্টন বিশ্বাস নেহরুর অনুপস্থিতিতে প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদও ৩৭০ অনুমোদন করেছিলেন : তপন মল্লিক চৌধুরী সিঁদুরের ইতিকথা আর কোন এক গাঁয়ের বধূর দারুণ মর্মব্যথা : দিলীপ মজুমদার সাহিত্যিকদের সংস্কার বা বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষে শ্রীপাণ্ডবা বা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত দশহরার ব্যুৎপত্তি ও মনসাপূজা : অসিত দাস মেনকার জামাই ও জামাইষষ্ঠী : শৌনক ঠাকুর বিদেশী সাহিত্যিকদের সংস্কার ও বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভক্তের ভগবান যখন জামাই (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য-এর ছোটগল্প ‘সময়ের প্ল্যাকটফর্ম’ গুহাচিত্র থেকে গ্রাফিটি : রঞ্জন সেন জামিষষ্ঠী বা জাময়ষষ্ঠী থেকেই জামাইষষ্ঠী : অসিত দাস
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই প্রভু জগন্নাথদেবের শুভ স্নানযাত্রার আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

মৃত্যুঃ বিমল করের গল্পে : উৎপল মণ্ডল

উৎপল মণ্ডল / ৩৫১৯ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

বাসু চ্যাটার্জীর ‘দিল্লাগী-ও যখন হিট হয়, তারপর মুম্বাইয়ের প্রযোজকেরা বিমল করের গল্প-উপন্যাস পেলেই ছবি করতে চাইতেন। একবার এক প্রযোজক প্লেনের টিকিট কেটে দিয়ে তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু তিনি যান নি! এমন কি বেশ কয়েকবার আমেরিকার আমন্ত্রণেও সাড়া দেন নি। খুবই নির্লোভ ছিলেন। কিন্তু ‘মানুষ বিমল কর’ রচনায় প্রদীপচন্দ্র বসু রসিকতার ছলে, এই না যাওয়ার দ্বিতীয় কারণ বলেছেন—

“দ্বিতীয় কারণটি গোপনে বলি। বিমল কর প্লেনে চড়তে ও ঘুমের ওষুধ খেতে খুব ভয় পান। প্লেনে চড়লে প্লেন যদি আকাশে ওড়ার পর ভেঙে পড়ে! ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোলে ঘুম যদি আর না ভাঙে!” [মানুষ বিমল কর, প্রদীপ বসু, কোরক বিমল কর সংখ্যা]

নিজের মৃত্যুভয় প্রত্যেকেরই আছে, সে মুখে যে যাই বলুক, তাই বলে এতো!

আবার অজয় দাসগুপ্ত লিখেছেন যে তিনি বিমল করের সঙ্গে একদিন মহাত্মা গান্ধী রোড অতিক্রম করার সময় একটি ট্রাম আসছিল। ট্রামটি চলে যেতেই অজয়বাবু পেরিয়ে যান। একটু পর বিমল কর এসে তাকে বকুনি শুরু করেন—

“এটা কিরকম হলো? তুমি ট্রামটা চলে যেতেই রাস্তা পার হলে কেন?

—অবাক হয়ে জানতে চাইলাম তাতে কি হয়েছে?

উত্তরে বললেন, ‘কি হয়েছে, ট্রামটা যাবার পর দোলানি লেগে তারগুলো কাঁপছিল—ওই অবস্থায় ছিঁড়ে যেতেও পারে।” [‘অনুষঙ্গঃ বিমল কর’, অজয় দাসগুপ্ত, কোরক বিমল কর সংখ্যা]

তাহলে শুধু নিজের নয় অন্যের জন্যও একই আশঙ্কা। তাঁর নাকি বিচিত্র ধরণের আশঙ্কা, সংশয়। ওই একই লেখাতে অজয়বাবু জানাচ্ছেন —

“বাস্তবজীবনে বিমল করের মনে সংশয় ভীষণ কাজ করে। … মৃত্যু চেতনার ব্যাপারটা এই সংশয় থেকেই উপজাত।” লক্ষ্য করা দরকার, তিনি ‘সংশয়জাত’ বলেন নি, কিন্তু ‘উপজাত’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তাহলে আরও গভীর কোন কারণ নিশ্চয়ই আছে, যার জন্যই হয়তো ‘মৃত্যু’ বিষয়টি তাকে সারাজীবন সদা শঙ্কিত রেখেছে যেমন, তেমনি ভাবিয়েছে।

‘উড়ো খই’ (প্রথম খণ্ড) গ্রন্থে জানতে পারি কৈশোর ও যৌবনে তিনি বহু প্রিয়জনের মৃত্যু দেখেন। এবং এ প্রসঙ্গেই তিনি জানিয়েছেন যে, আড়াই বছরের ছোট বোন যখন মার কোল খালি করে চলে যায় তখন তিনি মাকে দেখেছেন—আড়ালে এস্রাজের ছেঁড়া তারেছড় টানার মতো আদ্ভুত সুরে কাঁদতে। তারপর লেখেন—“মৃত্যুরএই যে নিষ্ঠুর চেহারা, অর্থহীন আবির্ভাব, স্বেচ্ছাচারিতা এবং নিবিড় আত্মস্যাৎবৃত্তি—এটি আমি কোনদিনই আর ভুলতে পারি নি পরে। আমার লেখায় তাই হয়তো ঘুরে ঘুরে দেখা দেয় মৃত্যুর কথা।”

অবচেতনের গভীর তলদেশ থেকে, তাই মৃত্যু বিষয়টি তাড়িত করেছে তাঁকে; ভাবিয়েছে নানান দৃষ্টিভঙ্গিতে। আর বার বার আসছে মৃত্যুর প্রসঙ্গে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে পৃথক পৃথক তাৎপর্য নিয়ে। এবং তা সবসময় যে গভীর ‘মৃত্যু দর্শন’ হয়ে আসছে তা নয়—কখনো মূল বার্তা প্রকাশের জন্য, কখনো চরিত্রের বিকাশে কখনো জীবন জিজ্ঞাসার অনুঘটক হয়ে—আরো নানান ভাবে। আর অধিকাংশ গল্পেই কোন না কোন ভাবে এই প্রসঙ্গ এসেই যায়।

‘জননী’ গল্প দিয়েই শুরু করি। কেননা ব্যক্তিগত জীবনেও তো তাঁর মা রয়ে গেছেন তাঁর চেতনার গভীরে। মৃত্যুটি ছিল ছোট্ট বোনের। কিন্তু ‘এস্রাজের সুরে’ মায়ের যে কান্না, কষ্ট, তাই তো দাগ কাটে লেখকের মনে। অন্তত আমার পাঠ তেমনি।

যেকোন বিষয়েরই একটি আদর্শ রূপ থাকে আমাদের চেতনায়, সবারই। সেই আদর্শ রূপের একেবারে একশো শতাংশকে বাস্তবের কঠিন সংঘাতে আমরা পাই না, হয়তো কেউই।  কিন্তু সেটা থাকে। আমাদের ঘনিষ্ট সম্পর্কতন্ত্রের ক্ষেত্রে চেতনে হোক অবচেতনে হোক— সেটা অনেক বেশি থাকে। হয়তো সকলে ভেবে দেখিনা।মায়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেক বেশি এবং তা প্রায় সক্কলের ক্ষেত্রে—এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। মাতৃত্বের এই আদর্শরূপ বিমল করের ধারণায় যেমন—তার চমৎকার ছবি অথবা ঘুরিয়ে বলতে গেলে মাতৃত্বের আদর্শ উত্তরণের চমৎকার প্রকাশ বিমল করের ‘জননী’ গল্পটি। এবং এই বক্তব্যকে ধারণ করেছে যে অনবদ্য টেকনিক, বাংলা গল্পের জগতে তা দুর্লভ।

গল্পের কথক শুরুতেই জানান— তারা পাঁচ ভাইবোন, মা-র হাতের পাঁচটি আঙুলের মতো। আর তাদের বাড়িতে প্রথম শোক এসেছে—তাদের মায়ের মৃত্যু। তারপর মাকে যেখানে দাহ করা হয়েছিল— বাড়ির ভিতরেই বাগানের দিকে, সেখানে তৈরি শ্বেতপাথরের বেদীটিতে, শ্রাদ্ধশান্তি মিটে গেলে, মাসান্তে চৈত্রপূর্ণিমার সন্ধ্যায় পাঁচ ভাইবোন বসেছে। মা-কে স্মরণ করছে তারা। তারপর সেজদার দেখা এক সাঁওতাল গ্রামে, একটি মৃত বাচ্চার বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো একটি ছবির সূত্রে আসে মৃত্যুর পরেও জীবনের কথা—

“ঘোড়ার পিঠে চড়ে বাচ্চাটা চলেছে, এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে লাগাম; কাঁধে খাবারের পুটুলি, মাথায় তেষ্টা মেটাবার জন্য জলের ঘটি রাখা।” [জননী, বিমল কর, বাছাই গল্প, পৃ-২৮০]

অর্থাৎ ছবিটির মধ্যে ছিল এক পরলোকের কল্পনা এবং তার যাত্রাপথ। যে পরলোকের উদ্দেশ্যে যে যাত্রা—সেই পথের জন্যই বাচ্চাটিকে লাঠি খাবার দাবার ও জল দেওয়া। অর্থাৎ সেই কল্পিত পরলোকে সার্থকভাবে উত্তরণের জন্য যা কিছু প্রয়োজন।

এই সূত্রেই আসে যে তারা পাঁচ ভাইবোন তাদের মা-কে কী দিতে পারে? এবং তা যে মায়ের, সেই পরলোকে সার্থকভাবে উত্তরণের কল্পনাতেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে বড়দার কথায়—

“ ‘অনু কিন্তু কথাটা মন্দ বলে নি’। বড়দা সুস্থ নরম গলায় থেমে থেমে বলতে লাগল, ‘আমরা কেউ মৃত্যুর পরটর বিশ্বাস করি না, কিন্তু ভাবতে ভাল লাগছে, আমাদের মা দীনুর গল্পের মতন দীর্ঘ পথ হেঁটে যাবে। আমরা মা-র জন্য কে কী দিতে পারি।”[ঐ, পৃ-২৮১]

লক্ষ্য করা দরকার, এখানে বলা হচ্ছে, ‘আমরা কেউ মৃত্যুর পরটর বিশ্বাস করি না’। প্রশ্নঃ তাহলে কেনই বা এই দিতে চাওয়া আর কেনই বা এই দেবার সূত্রেই এরপর শুরু হয় গল্পের অসামান্য টেকনিক—যা বাংলা ছোটগল্পে সত্যি দুর্লভ। সে প্রসঙ্গে যাব, একেবারে শেষে।

যাই হোক, তারপর পাঁচ ভাইবোন ভাবতে থাকে যে মা-কে তারা কী দিতে পারে এবং সে ভাবনার গতিপ্রকৃতি একই— ‘কী অভাব তার ছিল, কী পেলে মা-র সে অভাব থাকতো না।’ এবং তার চিন্তায় মা-র যে অভাবগুলি ধরা পড়ে— যা তারা মা-কে দিতে চায়, সেগুলি কোনোটিই পার্থিব কোনো বস্তু নয়। প্রত্যেকটিই একএকটি মানবিক গুণ। শুধু মেজদা— যিনি অন্ধ, তার ভাবনাটি একটু অন্যরকম। এখানেও সচেতন পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না যে, মেজদার এই অন্যরকম দিতে চাওয়াটা কিন্তু একেবারে শেষে , অর্থাৎ যে সিকোয়েন্সে—বড়দা থেকে শুরু করে কথক পর্যন্ত সকলে বলে যায়, তা ভেঙে মেজদার দেওয়াটা শেষে! সিকোয়েন্স অনুসারে মেজদার দেওয়াটা হবার কথা ছিল আরো আগে। কেন লেখকের এই সচেতন বিন্যাস?  কোন গভীর অর্থ? সে প্রসঙ্গ পরে।

তাদের এই দিতে চাওয়াগুলি পর্যায়ক্রমে এইরকম —

(ক) বড়-দা মা-র পছন্দের সুন্দরী মেয়েটিকে বিয়ে করতে রাজী হয়নি, কারণ সে বড়দার বন্ধুকে ভালোবাসতো। মা শুধু সৌন্দর্যই দেখেছিল, কিন্তু বড়দা সৌন্দর্যের থেকেও বেশি গুরুত্ব দেয় ভালোবাসাকে। যেটা মা কিছুতেই বুঝতে চায়নি। তাই বড়দার চিন্তা—‘আমি মা-কে আমার সেই ভালোবাসার মন দিতে পারি।’

(খ) বড়দি শ্বশুরবাড়ির কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বাড়িতে চলে আসে তা মা মেনে নেয়নি, এমনকি বড়দির আবার বিয়ে করার ইচ্ছে সত্ত্বেও মার সে সাহস হয় নি। তাই বড়দির চাওয়া— ‘মা যেন সেই সাহস পায়।’

(গ) ছোট অর্থাৎ গল্পকথক যাকে ছোট বলে ডাকে সে অসুস্থ ছিল। তখন তার বন্ধুরা আসতো। সুশান্ত আসতো বেশি তাকে ভরসা দিতে— যে এসব অসুখ-টসুখ কিছুই না, সব সেরে যাবে। কিন্তু মা সেটা পছন্দ করতো না। সুশান্তকে একদিন মা অপদস্থ করায় সে আর আসতো না। মা শুধু ছোটর অসুখটাই দেখেছিল; সুখটা দেখেনি। মা জানতো না যে সব অসুখ ডাক্তার দিয়ে সারানো যায় না—আশা ভরসা পাওয়ার শক্তি অনেক। তাই ছোটর ইচ্ছা—‘আমি মাকে আর কিছু দিতে পারি না, মন ছাড়া, আশা ছাড়া, ভরসা ছাড়া। মা যেন তার মনে ভরসা পায়।’

(ঘ) কথক তার মা-র সঙ্গে একবার কাশীতে যায়, বাবার মৃত্যুর পর। সেখানে মা-কে দেখে শচীন জ্যাঠার কাছ থেকে—তিনি অত্যন্ত দরিদ্র এবং তার বাবার ব্যবসার পার্টনার ছিলেন একসময়, মাত্র দু’শো টাকার বিনিময়ে সেই অংশীদার নাকচ করিয়ে নিতে। কথক শচীন জ্যাঠাকে ওটা ছেড়ে দেওয়ার জন্য মাকে বললে মা জানায় —‘আমি অত স্বার্থত্যাগ শিখিনি।’ তাই কথক চায় —‘মা দীন ছিল, আর মন কৃপণ ছিল। আমায় যদি কিছু দিতে হয় আমি মাকে স্বার্থত্যাগ দেব।’

(ঙ) অবশেষে, মেজদা—যিনি অন্ধ। মেজদার উপলব্ধি— তাকে যেমন ট্রেনে এক সুটকেসওয়ালা অন্ধ করে দিয়ে গেল, মাকেও তেমনি এই সংসারের শনি অন্ধ করে দিয়েছিল। তাই মেজদার ইচ্ছা— মা হৃদয়ের চক্ষু পাক।

তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো শেষপর্যন্ত?—পাঁচজনের মধ্যে চারজন সন্তান যা দিতে চায় মাকে তা আসলে এক একটি মানবিক গুণ— যার অভাব মা-র মনে ছিলো বলে তাদের উপলব্ধি— ভালোবাসার মন, সাহস, ভরসা এবং স্বার্থত্যাগ। আর আগেই বলেছি, তাদের দেওয়ার পর্যায়ক্রম ভেঙে অন্ধ মেজদার দান একেবারে শেষে এবং টেকনিকের এই সচেতন কৌশল লেখকের। আর চারভাইবোন মাকে যা দিতে চেয়েছে, সে তো হৃদয়ঘটিত ব্যাপার। মা-কে সেগুলি অনুভব করতে হত বুকের ভেতরের চোখ দিয়ে! আর হৃদয়ের চোখ প্রস্ফুটিত না হলে বাকি চারজনের দান বৃথা যাবে। তাই মেজদার দানেই সম্পূর্ণ হয় অন্যদের দানের তাৎপর্য। এজন্যই অনবদ্য এই গদ্যকৌশল।

হিন্দু সমাজে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের যে সামাজিক নিয়ম, তাতে দেখা যায় ছাতা-জুতো-খাট-বিছানা…ইত্যাদি ষোড়শ দান, যা আসলে পরলোকের জন্যই। এমনকি এই অনুষ্ঠানকে পারলৌকিক ক্রিয়াও বলা হয়। কিন্তু এ গল্পে ব্যাপারটি তেমন নয় একেবারেই। সবকিছু মিটে যাওয়ার পরে তারা ‘মাসান্তে’ বসেছে মায়ের বেদীতে। তাছাড়া বড়দার একটি সংলাপের উল্লেখ করেছি আগেই— ‘আমরা কেউ মৃত্যুর পরটর বিশ্বাস করি না।’ সবচেয়ে বড় কথা যে মানবিক গুণগুলির অভাব পৃথক পৃথক ভাবে তারা উপলব্ধি করেছে তাদের মায়ের মধ্যে, তা-ই তাদের নিবেদন মায়ের উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ প্রত্যেকের দৃষ্টিতে ‘শুধু এইটা’ থাকলেই যেন ‘মা’ সার্থক হয়ে উঠতো। আবার গল্প শেষ হয় এই কথায়— ‘ মা সেই অন্তহীন পথ অতিক্রম করুক।’ অথচ তারা তো মৃত্যুর পর বিশ্বাস করেনা! তাহলে? এরকম নয় কি— সময়ের সাপেক্ষে এদের এই দান ধীরে ধীরে মার মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে উঠলেই সার্থক মাতৃত্বে উত্তরণের যাত্রা শেষ? এবং তা ইহজন্মেই হোক আর পরজন্মেই হোক!

এ জন্যই বলছিলাম, এ গল্প আসলে লেখকের চেতনায় সার্থক মাতৃত্বের যে প্রতীতি, সেখানে উত্তরণের গল্প এবং মা-র মৃত্যু এর তাৎপর্য এখানেই।

‘আত্মজা’ গল্পটি ‘জননী’র একেবারে বিপরীত মেরুতে। বাস্তব জগতেও যেমন সত্য, গল্পটি গঠনগত দিক থেকেও। ‘জননী’তে মূল গল্প শুরু হয় মায়ের মৃত্যুর পর। ‘আত্মজা’ শেষ হয় বাবার মৃত্যুতে। মৃত্যু মানে আত্মহত্যা। এবং এই মৃত্যু বা আত্মহত্যা আমাদের বুঝিয়ে গেল তা যথেষ্ট জটিল এবং রহস্যময়ও বটে। হিমাংশুর আত্মহননের পূর্বে প্রায় দু’পাতা এবং মণিবন্ধের শিরায় খুব চেপে ধরার পরে দেড় পাতা, অত্যন্ত মনযোগের সঙ্গে প্রতিটি লাইন না পড়লে যে কোন মুহূর্তে অসচেতন পাঠকের মন স্লিপ করে পড়ে যেতে পারে কর্দমাক্ত আবর্জনার স্তুপে। কিন্তু কেন এই আত্মহনন?

পনের বছরের মেয়ে পুতুলকে নিয়ে বাবা হিমাংশুর আদর আহ্লাদকে আদিখ্যেতা মনে হয় স্ত্রী যূথিকার। বারবার সে হিমাংশুকে মনে করিয়ে দেয় মেয়ে বড় হয়েছে। কিন্তু তাতে কান দেয় না হিমাংশু। পুতুলের ড্রেসপোশাকে তাকে সুইমিং পুলে নিয়ে যাওয়া বা বাইরে যাওয়া কোন কিছুই ভালো লাগে না যূথিকার। আসলে হীনমন্যতাবোধ অনেকসময় মানুষকে খুব জটিল করে তোলে। হ্যাঁ, যূথিকার এই হীনমন্যতার কারণও ছিল একটু। পুতুলের জন্ম দিতে গিয়ে কোনক্রমে সে বেঁচে ফেরে ঠিকই, কিন্তু আগের যূথিকা আর নয়— ‘বিবর্ণ, শুষ্ক, অস্থিসার, দীপ্তিহীন। তার শরীরের একটা গোলমেলে অংশ চিরকালের জন্য বাদ দিল ডাক্তারেরা।’—এরকম অবস্থায় তার প্রতি মনযোগ কমে যাওয়ার আশঙ্কাজনিত কারণে যূথিকার আচরণ অন্তুত স্বাভাবিকতার মাত্রা ছাড়ায় না— এভাবেও ভাবা সম্ভব।

কিন্তু যূথিকার মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক আচরণের ঢিমে আঁচে একেবারে ঘৃতাহুতি দেয় শ্রিপ্রা চরিত্রটি—দিল্লীর মহিলা কলেজের, ফ্রয়েড পড়া শিক্ষক শিপ্রা। বেড়াতে এসে শিপ্রা যখন জানায়—

“ জিনিষটা মোটেই ভালো নয়, যূথি। এসব আসকারা তুই দিবিনে। এ একধরণের কমপ্লেক্স। …

শিপ্রা যূথিকার অজ্ঞতাকে উপেক্ষা জানিয়ে অনুকম্পার হাসি টেনে আনলো ঠোঁটে, ‘আসলে যূথি, এই— এই— ধরণের রুচি— কি বলবো যেন একে— হ্যাঁ, এই ধরণের রুচি খুব খারাপ, নোংরা।” [আত্মজা, বাছাই গল্প, মণ্ডল বুক হাউস, পৃ-১১৪]

চরিত্রের অবস্থানগত বিচারে একথা বলতেই হয় যে, এই যূথিকার সাধারণত এই শিপ্রা জাতীয় চরিত্রদের কথাকে প্রায় বেদ-উপনিষদেরও ওপরে স্থান দিয়ে থাকে। কলেজে পড়ায় বলে কথা, তার ওপর দিল্লী! ইংরেজি-টিংরেজিও জানে। লেখক সেকথা না জানালেও ‘দিল্লি’ আর ‘ফ্রয়েড’ শব্দের ব্যবহারেই তা প্রমাণিত। ফলত, এবার গল্পের গতি ও ফলাফল বর মারাত্মক।

এবার যূথিকার অস্বাভাবিক আচরণ নোংরা সন্দেহের দিকে ধাবিত হয় এবং তাকে অস্বাভাবিক করে তোলার জন্যই শিপ্রার অনুপ্রবেশ এই গল্পে। একদিন রাত্রে মায়ের দিকে কাত হয়ে ঘুমোচ্ছে পুতুল। লেপটা সরে যাওয়ায় অর্ধেক দেহটাই খোলা। কাশিটাও বেড়েছে পুতুলের। “যেভাবে শোয়, রোজই রাতে ঠান্ডা লাগে। গলার কাছটায় অতটা খোলা না রাখলেই কি নয়। হিমাংশু হাত বাড়িয়ে গলার কাছটায় জামার ক্লিপটা এঁটে দেয় পুতুলের, লেপটা গলা পর্যন্ত টেনে দেয়।’— কিন্তু দরজা ভেজিয়ে চলে যেতেই বিপত্তি। যূথিকা হাত টেনে ধরে বলে ‘তোমার কীর্তি’ দেখছিলাম। তারপর যেন কিছুটা সময় গল্প এগিয়ে চলে যূথিকার ‘তীক্ষ্ণ,অসম্ভব, তিক্ত’ বাক্য এবং হিমাংশুর ‘অবাক’ থেকে ‘বিস্মিত’ থেকে ‘বুকের হৃৎপিন্ডে এসে আঘাত’ পর্যন্ত। তারপর বেশ কিছুটা চলে সুধাংশুর আত্মসমীক্ষা,  যন্ত্রনা, হাতের শিরায় ‘খুর’টা চেপে ধরা এবং তারও পর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত লিছুটা। আর এই অংশটিতেই গভীর অভিনিবেশ দরকার পাঠকের। লেখক যেভাবে একটা টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন সিদ্ধান্তে এবং তার মূল বার্তায় পৌঁছে দেবার। হ্যাঁ, এমন বলছি এজন্যই যে, মনে আছে একবার উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে প্রায় তিনদিন ধরে দুটি দলে বিভক্ত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চলেছিল বিতর্ক—সুধাংশুর মৃত্যুর কারণ কি আত্মগ্লানি, যা অবশ্যই নেগেটিভ ইঙ্গিত; না কি নৈঞর্থক বিশ্বাসহীনতায় অস্তিত্বের সংকট, যা পাঠকের কাছে, সমাজের কাছে এক বিশেষ বার্তা— চাবকানো যাকে বলে!

যূথিকার কাছে অপমানিত হওয়ার পর হিমাংশুর চিন্তা কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে যায়। আত্মসমীক্ষার এই অংশে তার নিজের চিন্তাও কখনো কখনো পিছলে পড়ে অন্ধ গলি পথে। যেমন—

(১) “এত অন্ধকার! যেন একরাশ অশরীরী প্রেতস্পর্শ তাকে ঘিরে রয়েছে। একটু আলো আসুক।”

(২) “হয়তো অমনই হবে— স্নেহের আর পিতৃত্বের কুয়াশায় হিমাংশুর সত্য পরিচয় ঢাকা ছিল।”

(৩) “আয়নার বুকে একটা জল ধোওয়া শ্লেট রঙের ছবি ফুটেছে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে সেই ছবির মধ্যে হিমাংশু কাকে বুঝি খুঁজছে।…”

গালে হাত তুলতেই সেই ছবির মধ্যে থেকে সেই ছায়াকৃতি লোকটাও গড়ে ওঠে—হিমাংশু সে নয়, কারণ হিমাংশু পিতা, কিন্তু ও অন্য লোক, যে পিতা নয়, পশু। … হিমাংশুর অসম্ভব ঘৃণা হয় তার ওপর।”

এর কিছুক্ষণ পর হিমাংশু ক্ষুর চেপে ধরে হাতের শিরায়। তাহলে মিথ্যার আবরণে গোপন ছিল কোন পঙ্কিল সত্য রক্ষার জন্যই এই আত্মহত্যা। গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন—একেবারে বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে। লেখক ঠিক কোন বার্তা দিতে চান?

যূথিকা যখন হিমাংশুর হাত ধরে টান দেয়, পুতুলের ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় অর্থাৎ তীব্র অপমানের একেবারে শুরুতে যখন বলে —‘তোমার কীর্তি দেখছিলাম’, সেই পরিস্হিতিটা কেমন?—

“ ‘কীর্তি’! অবাক চ্চোখে চায় হিমাংশু।”

মানুষ কখন অবাক হয়? কেউ অভিযোগ করলে, আমরা অবাক হই কখন? অভিযোগের সামান্যতম সত্যতার সম্ভাবনা থাকলে নির্বিকার থাকলেও অবাক হই না। এরপরও লেখক লিখেছেন হিমাংশু কতদূর বিস্মিত হয়েছে অন্ধকারে ঠাহর করা যায় না।’

তাহলে প্রথমে ‘অবাক’ তারপর ‘বিস্মিত’। তারপর যূথিকা যখন দরজা বন্ধ করে চলে যায়, ‘সেই শব্দটা যেন হিমাংশুর বুকের হৃৎপিণ্ডে এসে আঘাত করে।’ এরপর যন্ত্রনার্ত হিমাংশু প্রায় অসুস্থতার পর্যায়ে চলে যায় এবং আত্মসমীক্ষা চালায়। কেন? হিমাংশুর দৃঢ়তা থাকলে নিজের মুখোমুখি হবে কেন? হবে। প্রায় অর্ধোন্মাদ হিমাংশুর প্রতিটি শিরা যখন জলের জন্য আকুলি বিকুলি করছে তখন এই নেগেটিভ চিন্তা আসতেই পারে তাও পরীক্ষামূলক ভাবে। মনে রাখতে হবে ‘লাই লাই লাই মেকস ট্রু’— এই গোয়েবলস থিয়োরির কথা। এবং দু’নম্বর দৃষ্টান্ত যেটা দিয়েছি, সেখানে শুরুতেই লেখক ‘হয়তো’ শব্দ ব্যবহার করেছেন —‘হয়তো অমনিই হবে।’ হিমাংশুর মানসিক অসহায়তা এখানে স্পষ্ট।

হিমাংশু আরো পরীক্ষা চায় নিজের ওপর। আর অসহ্য এক দোদুল্যমানতার মধ্য দিয়ে এগোতে থাকে পাঠক। এবার তিন নম্বর দৃষ্টান্ত— যেখানে আয়নার সামনে হিমাংশু তীক্ষ্ণ চোখে কাকে ‘বুঝি’ খুঁজছে। যাকে পায়- সে হিমাংশু নয়, পশু। মনে রাখতে হবে লেখক ‘আয়নার’ প্রতিবিম্বকে বলেছেন পশু। প্রতিবিম্ব তো আসল কখনোই নয়, এবং তা পরিবর্তিত হয়ে যায়! তাহলে প্রতিবিম্বটি হিমাংশুর দিকের নয়, সে উল্টো দিকের। সে পশুই তো হবে! কেননা হিমাংশু ‘মানুষ’। আর মানুষ বলেই বিশ্বাসের অভাবজনিত কারণে অস্তিত্বের সংকট। যেটি স্পষ্ট হয় আর একটু পরে—

“আরো একটু আলো এসেছে না ঘরে!… কোথাও তো কালো রক্ত নেই, সেই কুৎসিত কালো, যাতে পাপের বীজ লুকিয়ে থাকে। নেই, নেই—? হিমাংশু তবু খোঁজে, সতর্ক চোখে, যদিও কেমন আচ্ছন্নতা আসছে। এবং কান্নাও।” [ঐ, পৃ—১১৯]

লক্ষ্যণীয়—‘আলো’ আসা, ‘কালো’ রক্ত না থাকা, এবং ‘কান্না’ আসা। অর্থাৎ পরীক্ষানিরীক্ষা শেষ। সত্যে উপনীত হওয়া গেছে। কিন্তু আর তো বাঁচার রাস্তাও নেই, সময়ও। অতএব কান্না। বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয় হিমাংশুর প্রায় অন্তিম লগ্নে যখন শ্বাস প্রশ্বাস শিথিল হয়ে আসে, চেতনা ক্রমশ চলে যায় গভীর ঘুমে, চির ঘুমে—

“আচ্ছন্নতার মধ্যেই আকাশ যেন দেখতে পেল হিমাংশু… মেঘ-মেঘ। না, মেঘ নয়; মেয়ে। হিমাংশুর মেয়ে,যার নাম পুতুল, বয়স পনের নয়, পনের দিন… হিমাংশুর হৃৎপিণ্ডে এতক্ষণে একটু সাহস এলো, ভাসমান একটা আশ্রয়। না, তবে এই তো কারণ, যা পনের বছরের “পুতুলকে ছোট দেখছে, ছোটই ভেবেছে। প্রার্থনা করেছে নিঃশব্দে, নিত্য দিনঃ পুতুল, আমার পুতুল, আমার কাছে ছোটটি থাক চিরকাল— ঈশ্বর তুমি ওকে যৌবন দিওনা, প্রজাপতির রঙ ছুঁড়ো না ওর মনে।”

গল্পটা শেষ হওয়ার পর মনে হয়—ভোর তো হয়েই গেছে, একটু পরেই, সকালে যূথিকার কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?  তা জানতে পারার কথাও নয়। সেজন্যই তো ছোটগল্প। কিন্তু পাঠকের প্রতিক্রিয়া কী হবার কথা?

এতক্ষণের আলোচনায় তা অনেকটাই স্পষ্ট । তবু আরো একটু আছে। লক্ষ্য করার বিষয় মেয়ের নাম ‘পুতুল’। ঠিক আগের উদ্ধৃতিতে নিম্নরেখ অংশগুলিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চেয়েছি। আর গল্পের শেষ অংশটি মধ্যরাত্রি থেকে ভোর পর্যন্ত। যন্ত্রনার্ত হিমাংশুর আত্মসমীক্ষার সময় বারবার ‘অন্ধকার’ কথাটি এসেছে। বাথরুমে আয়নার সামনে —‘জানালা দিয়ে একটু ফরসা এসে ঢুকছে। তারওপর হিমাংশু যখন ‘কালো কুৎসিত’ কিছু খুঁজছে তখন—‘আরো একটু আলো এসেছে না ঘরে।’ অর্থাৎ আরো ফরসা— ভোর হয়ে আসছে। আর একেবারে শেষ লাইনে—‘সেই মুহূর্তটুকু জুড়ে শরীরের ফরসার মধ্যে একটি বিনুনী মৃত্যুতে ঝোলানো ম্রিয়মান রঙের মুখ…।’

বাইরে ফর্সা! গল্প শেষ মৃত্যুতে। বাবার নাম কি? হিমাংশু। চাঁদ ডুবে গেল। বাইরে ফর্সা সূর্য উঠবে। সূর্য তো উঠবেই পাঠকের মনে, এরপরও কি সূর্য না উঠে পারে!

গঠনগত দিক থেকে ‘জননী’র পর্যায়ভুক্ত হবে ‘আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন’। তবে এখানে গল্পের সূচনাবাক্যেই মৃত্যুর কথা— ‘নদীর চড়ায় শিবানীর চিতা জ্বলছিল।’ শিবানীর তিন প্রেমিক এবং স্বামী ভুবন এসেছে শ্মশানে, শিবানীর সৎকার করতে। তারপর এই তিন প্রেমিক পুরুষের (কথকও একজন) পৃথক পৃথক গল্প—তাদের গোপন অংশ এবং সে গল্প শুরুর আগে তাদের চিন্তাভাবনা, এই নিয়েই আখ্যান অংশ। শুধু ভুবনের কোনো কথা নেই।

একটি ঘটনাকে কে কীভাবে দেখছে বা ভাবছে, বা কোন চরিত্রই যদি হয়; তাহলে সেই চরিত্র সম্পর্কে কে কী ভাবছে অথবা সেই চরিত্রটির সম্পর্কে তার ধারণা আসলে সেই দ্রষ্টা বা সেই ভাবুকের মানসিক অবস্থাকেই চিহ্নিত করে। সরলভাবে বলতে গেলে আপনি ঠিক কী দেখছেন সেখান থেকে আপনারও একটা বৈশিষ্ট্য অন্যে বুঝে নেবে। কথাটা বলা হচ্ছে এই জন্যই যে, শোকাহত ভুবন-শিবানীর স্বামী উদাসভাবে বসে আছে ওই অধিক শোকে পাথর যাকে বলে সেইরকম; যা ভালো লাগছেনা কথকের এবং অন্যদেরও। কেননা তাদের প্রত্যেকেরই মনে হয় যে শিবানী তো তাকেই ভালোবেসেছিল, তাহলে ভুবন এত কী পেয়েছে যে ভুবনের এত শোক! ভুবনকে দেখে তাদের কোথাও একটা জ্বালা— ‘ভুবনের এত আতিশয্য আমার সহ্য হচ্ছিল না।’ তাই তারা দূরে সরে যায়। ঠিক তার আগেই লক্ষ্য করার মত বিষয়—

“ভুবন চিতার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে উদাসভাবে নদী, আকাশ, আর জঙ্গলের দিকে মুখ ফেরালো।”

এই নদী, আকাশ, জঙ্গল কথাগুলি গল্পে বারবার এসেছে ভীষণ প্রতীকী অর্থ নিয়ে। নদী—জীবনপ্রবাহ, এবং তা অবশ্যই কখনো কখনো শিবানীর। আকাশ অসীম আর জঙ্গল অনেক গভীর অর্থে—মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের শেষে এরোপ্লেনটি যেমন গেছিল সুন্দরবনের দিকে, সেই রকম। এখানে এই অর্থগুলি বলে রাখার কারণ— শিবানীর এই তিন প্রেমিক পুরুষ শিবানীর চিতা আর ভুবনের দৃষ্টি থেকে সরে যেদিকে গেল, সেখানে ‘ঘনঝোপঝাড় আর ছায়া’।

সেই ঝোপজঙ্গলের পাশে এসে প্রত্যেকের স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে তাদের আসল সত্তা, বোঝা যায় কেন তারা প্রত্যেকেই ভাবছে যে শিবানী তাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিল। প্রত্যেকের ভাবনা তো তার নিজের মত! তবে সেই স্বীকারোক্তির গল্প শুরু করার আগে আর একটি বিষয় গভীর অনুধাবনযোগ্য—

“আমরা তিন বিগত যৌবন বন্ধু পরস্পরের কথা জানতাম এবং ভুবন, আমাদের চতুর্থ বন্ধুও সব জানত।”

এখানে লক্ষ্য করার বিষয়— একটি সরল বাক্যে বলা হয়নি যে চার বন্ধুই সব জানতাম। যৌগিক বাক্য ! প্রথম অংশে তিন বন্ধুর সব কিছু জানার কথা, তারপর ‘এবং’ ব্যবহার করে চতুর্থ বন্ধু ভুবনও যে সব জানতো— তেমন ধারণা কথকের। কিন্তু একটু পরেই জানা যায় যে ওই তিন বন্ধু—শিবানীর প্রেমিক, সবার সবকিছু জানতো না—“আমরা কিছুই লুকোচুরি করিনি; তবু আমাদের তিনজনেরই কিছু গোপনীয়তা আছে’। তাহলে যারা যারা দাবী করেছে যে সকলেই সকলের সবকিছু জানে, যে তিনজন; কার্যত তা পুরোপুরি ঠিক না। তাহলে যাকে একটু দূরত্বে রেখে—‘এবং’ ব্যবহার করে চতুর্থ বন্ধু হিসেবে বলা হয়েছিল যে, সেও সব জানে; সে আসলে তেমন কিছুই জানে না— এমন ভাবাটা খুব কি অযৌক্তিক? না, অযৌক্তিক একেবারেই নয় বলেই লেখক এভাবে বলেন নি যে—আমরা চার বন্ধুই সবার সব কথা জানতাম। আরো একটা প্রমাণ আছে, যখন এই তিন বন্ধুর মধ্যেই একজন এই জানা না জানা এবং শিবানীর ভালোবাসা আসলে কে বেশি পেয়েছে সে প্রসঙ্গে বলেছে—“ ওসব তোমাদের মনের ধারণা, কল্পনা।” অর্থাৎ তাদের ভাবনা তাদেরই। তারা ভেবে নিয়েছিল যে তারা পরস্পরের সবকিছুই জানে, কিন্তু তা ঠিক নয়; আর ভুবন— শিবানীর স্বামী আসলে তেমন কিছুই জানতো না— এটা কাজে লাগবে এই আলোচনার শেষে গিয়ে।

যাই হোক, কমলেন্দুর গল্প থেকে জানা যায় যে, সে শিবানীর প্রথম প্রেমিক। অল্প বয়সে শিবানী যে ফুলের মতো নিষ্পাপ ছিল, কমলেন্দু তার সেই নিষ্পাপতা হরণ করেছিল। এই স্বীকারোক্তির পর কমলেন্দুকে ‘অন্যমনস্ক ও অপরাধীর মত দেখাচ্ছিল।’

তারপর কথকের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায় যে শিবানীর দ্বিতীয় প্রেমিক, যৌবনের প্রেমিক এবং তার দ্বারা ধ্বংস হয় শিবানীর কৌমার্য। এটি তার প্রতারণা, কারণ, ‘তারপর থেকে আমি পালিয়েছি।’

এরপর আসে অনাদির পালা। শিবানীদের যে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ছিল, অনাদি একটি কেসে ফেঁসে যাওয়ার পর শিবানীর তৃতীয় প্রেমিক তাদের অর্থ ব্যবহার করে সে যাত্রা বেঁচে যায়। শিবানীর মা এবং শিবানীও এই অনাদির ‘ওপর নির্ভর করতে চেয়েছিল।’ কিন্তু শেষপর্যন্ত সেও প্রতারণা করে।

অসাধারণ শিল্প কৌশলে এই তিনটি ভিন্ন আখ্যানকে জুড়ে একটি গল্পের পূর্ণ মালাটি সম্পূর্ণ করেছেন লেখক, যার কেন্দ্রে রয়েছে শিবানীর মৃত্যু। লক্ষ্য করার বিষয়, এই তিনজনের অতীতের গল্প শুরু করার আগে অনাদি বলেছে—

‘কিন্তু শিবানীর চিতা এখন জ্বলছে, আমরা শ্মশানে। এই সময় সে সব কথা বলা কি ভালো দেখাবে।

‘খারাপই বা কি!’ আমি বললাম, আমার বরং মনে হচ্ছে বলে ফেললেই স্বস্তি পাব।”

তাহলে স্বস্তি তারাও পাচ্ছিল না! জ্বলছিল ভিতরে ভিতরে। এবং একথা বলেছে কথক— যার চরিত্র ভীষণভাবেই আবেগহীন। বাকি দু’জন— কমলেন্দু আর অনাদি আবেগপ্রবণ— তারা কেঁদেও ফেলে! আসলে মানুষের মধ্যে পাশবিক এবং মানবিক দুটো সত্তাই তো থাকে, শুধু পার্সেন্টেজের কমবেশি। মানবিক সত্তা তো নিশ্চয়ই আছে, সে যত পার্সেন্টই হোক, কিন্তু পাশবিকটিকে বের করে আনার জন্য লেখক ‘জঙ্গল’এর প্রসঙ্গ এনেছেন বারবার। আর মানবিক সত্তাটি একটু হলেও জ্বলছিল, শিবানী তো জ্বলছিল বটেই।

খুব মনযোগী পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ্য করবেন— এই তিনজন যখন মেলে ধরেছে তাদের অতীত কথা, তখন অনেক কিছুই ঘটে চলে—সে ব্যাখ্যায় যাচ্ছি; কিন্তু তার আগে বলি— গল্পের শুরু শিবানীর চিতা জ্বলার কথা দিয়ে। আর এই তিন জনের অতীত কথা যখন শেষ হয় তখনই শিবানীর চিতাও শেষ— ‘আমাদের নাম ধরে চিতার কাছ থেকে ওরা তখন ডাকছে। দাহ শেষ।’ এই অসাধারণ ব্যঞ্জনা বেশি বুঝিয়ে বলতে গেলেই তার মাধুর্য নষ্ট হয়ে যাবে। পাঠকের মনে পড়তে পারে মনোজ মিত্রের বিখ্যাত একাঙ্ক নাটক ‘শিককাবাব’— এর অসাধারন ব্যঞ্জনার কথা।

আর কি কি ঘটে চলেছিল, ওই সময়? সে ব্যাখ্যাও খুবই দরকার। তাহলে আরো স্পষ্ট হবে মৃত্যুর তাৎপর্য এবং গল্পের পরিণতিতে পৌঁছানো—অর্থাৎ লেখক কোন বার্তা দিতে চাইলেন। তিন বন্ধু—যারা নিজেদের শিবানীর প্রেমিক বলে মনে করে, তাদের অতীত কথা (এবং গোপন কথা) এক এক করে শেষ হবার পর পরই লেখক একবার করে প্রকৃতির চিত্র এঁকেছেন, যা ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ।

(১) “ কমলেন্দু নীরব হল। তাকে খুব অন্যমনস্ক ও অপরাধীর মতো দেখাচ্ছিল। নদীর চরের ওপারে রোদ সরে যাচ্ছে, তাপ অনেকটা কমে এসেছে…”

(২) কথকের ক্ষেত্রে—

“ কী যে অনুশোচনা আজ কেমন করে বলব! নদীর ওপারে বনের মাথায় রোদ চলে গেছে। ছায়া পড়ে গেছে নদীর চর জুড়ে…”

(৩) অনাদির ক্ষেত্রে—

“ শিবানীর তিন প্রেমিক পুরুষ নীরবে বসে থাকলাম, কেউ কারো দিকে তাকালাম না। বসে বসে কখন যেন দেখলাম, আকাশ বন নদী জুড়ে আসন্ন সন্ধ্যার ছায়া…”

তাহলে কী দাঁড়ালো? শেষ প্রতারক অনাদি, যার ওপর নির্ভর করতে চেয়েছিল শিবানী; সেও যখন আশ্রয় দেয় নি তখনই অন্ধকার নেমে আসে শিবানীর জীবনে। তারপর আসে ভুবন। এখানে আর একটা প্রসঙ্গের বিচার প্রয়োজন— যার ইঙ্গিত আমি আগেই দিয়েছি। তিন প্রেমিকের প্রত্যেকেরই মনে হয়— শিবানী আসলে তাকেই সব দিয়েছে— ভালোবাসাটা সেই পেয়েছে। আবার তাদের এও মনে হয় যে, ভুবন কই আর পেয়েছে, যে তার এত শোক? আর আগেই আমি বলেছি যে, এই তিন বন্ধুর সবাই সবকিছু জানতো না এবং ভুবনের সবকিছু জানার প্রশ্নই আসে না। সে ইঙ্গিত লেখক দিয়ে রেখেছেন ‘এবং’ শব্দের ব্যবহারে— যে প্রসঙ্গ আগেই আলোচনা করেছি। তাহলে এই তিন বন্ধুর কাছে ভালোবাসার অর্থ—নিষ্পাপতা, কৌমার্য, নির্ভরতা। শিবানীর জীবন যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত— প্রায় সকলেই প্রতারণা করার পর, তখন আসে ভুবন এবং সে এসবের তেমন কিছুই জানতো না! আবার মনে করিয়ে দিই—কে কীভাবে ভাববে সেটা তার একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। আর জানতো না বলেই—তার অনুভবে সে সবগুলোই পেয়েছে। আর সে জন্যই অন্ধকারেও চাঁদের পরিপূর্ণ আলোয় সে পরিপূর্ণ।

তাহলে শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়ালো— নিষ্পাপতা, কৌমার্য, নির্ভরতা— যা ভুবন সবই পেয়েছে তার চেতনায়, এসবের যোগফলেই ভালোবাসার যথার্থতায় উত্তরণ! আর তা একান্তভাবেই অনুভূতির রাজ্য। সেই রাজ্যের রাজা তো ভুবন! তাই সে শোকে মুহ্যমান। তার কোন কথা নেই, কিন্তু তার যে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ— যা তার শোকার্ত হৃদয়ের প্রকাশকতার জন্যই শিবানীর মৃত্যু। এবং সেই শোকার্ত হৃদয়ের সমস্ত কিছু সহ্য করে মেনে নিয়ে বসে থেকেছে চিতার সামনে, আগুনের সামনে। সত্যের ধারক, সত্যকে অনুভব করেছে চেতনায়! আগুন এখানে অন্য ব্যঞ্জনাও আনে।

তাই বলছিলাম, এ গল্প যথার্থ ভালোবাসা কী, অনুভবের সেই সত্যে উত্তরণের গল্প। আর একটি কথা না বলেও পাঠককে সেই সত্যে পৌঁছতে সাহায্য করে ভুবন। সেই জন্যই তিন প্রেমিক পুরুষের মনে হয়, শেষ পর্যন্ত “কি পেয়েছে ভুবন, যার জন্য এত ব্যাথা? চাঁদের আলোয় ভুবনকে কেমন যেন দেখাচ্ছিল। তার চারপাশে নিবিড় ও নীলাভ, স্তব্ধ মগ্ন চরাচর তা ক্রমশই যেন ব্যপ্ত ও বিস্তৃত হয়ে এক অলৌকিক বিষন্ন ভুবন সৃষ্টি করেছিল।” [ঐ, ৪১ পৃ]

এই বোধে তিন বন্ধুর উত্তরণ ঘটেছিল কি না বলা মুশকিল, কিন্তু মননশীল পাঠকের উত্তরণ যে হয়-ই, সেই ব্যাপারে সন্দেহ নেই। আর তার জন্যই এই মৃত্যু।

তিন প্রেমিকের এই গল্পের শুরু মৃত্যুর কথা দিয়েই, কিন্তু তা অতীতে ঘটে যাওয়ার পর গল্পের শুরু। আর ‘নিষাদ’ গল্পটির শুরু একেবারে এর বিপরীতে— কথকের ভবিষ্যতবাণী—“ছেলেটা মরবে; লাইনে কাটা পড়েই মরবে একদিন। হয়তো আজ কিংবা কাল” আর লক্ষ্য করার মতো যে গল্পের মাঝখানে আরো তিনবার এসেছে কথকের এই ভবিষ্যৎ বাণী।

কেন এই ভবিষ্যতবাণী, কেনই বা মরবে জলকু? এরপর ধীরে ধীরে গল্পের মধ্যে প্রবেশ করে বোঝা যায়— জলকু একটি বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে রেল লাইনে রোজ পাথর ছুঁড়ে মারে। জলকুর বিশ্বাস তার প্রিয় ছাগল ছানাটির মৃত্যুর কারণ রেল লাইন ও রেলগাড়ি। তাই এত আক্রোশ তার। জলকু ওখানেই দেখেছিল তার প্রিয় ছাগলছানা— মানিকের মৃতদেহ। অথচ কথকই সেই ছাগল ছানার নিঃশব্দ ঘাতক, যা সে কোন দিন জানায় নি জলকুকে। জলকু তার বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রিয় মানিকের মৃত্যুর প্রতিবাদ জানিয়েছে— রেল লাইনে বিরামহীন পাথর ছুঁড়ে মেরে। কিন্তু একমাত্র সত্য— ভবিতব্য, যা ঘটবেই; সে যেভাবেই হোক— তা তো মৃত্যু! তার প্রতি আক্রোশ তো অর্থহীন। সে তো অনিবার্যই। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় —জলকুর মৃত্যু।

হয়তো মৃত্যুর এই অমোঘতাই উঠে আসে এই গল্পে। তবু মনে রাখতে হবে এই গল্পের নাম ‘নিষাদ’ —- যে গোপনে থেকে হত্যা করে। আর গল্পের শুরুতেই একটি ইংরেজি বাক্য ছিল—‘you begin by killing a cat and you end by killing a man.’ অর্থাৎ কথকই এই নিষাদ। কিন্তু সে জলকুকে বাধা দেয় নি, সেটাও একটা প্রবৃত্তি। তাই-ই ঐ ইংরেজি বাক্যটি শুরুতে! তাও যদি হয়, সেই প্রবৃত্তিও যদি গুরুত্ব পায় গল্পে তবু, মৃত্যুর অনিবার্যতাই বড় হয়ে ওঠে। কেননা জলকু তো তা জানত না, সে তো মৃত্যুর কাছেই কৈফিয়ৎ চেয়েছে—পাথর ছুঁড়েছে এবং মৃত্যুর সঙ্গে এই দ্বৈরথে পরাজিত শেষ পর্যন্ত।

জন্মের পর থেকে প্রতি মুহূর্তেই মৃত্যুর সঙ্গে নৈকট্য বেড়ে যাচ্ছে আমাদের; কিন্তু তা আমরা ভুলে থাকি। আমরা অধিকাংশ মানুষই ভুলে থাকি। কিন্তু যদি কোন চিন্তাশীল আত্মমগ্ন মানুষ অতিমাত্রায় সচেতন হয়ে ওঠে এ বিষয়ে, তাহলে কেমন হয় তার অবস্থা? কেমন হতে পারে? অনিবার্য—সে আসবেই; অথচ কখন,—অনিশ্চয়তায় ভরা। মগ্নচৈতন্য যদি আচ্ছন্ন হয় এই চিন্তায়? তাহলে তো অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে উঠবে। অস্তিত্বই বা তাহলে কী?—এই সব নানান জিজ্ঞাসার সামনে পাঠককে দাঁড় করায় ‘অপেক্ষা’ গল্পটি। গল্পে মৃত্যু ঘটে একটি। তার সঙ্গে ‘মূল’ আখ্যানের সম্পর্কও ক্ষীণ। কিন্তু গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। ঐ মৃত্যুই মূল চরিত্র শিবতোষকে, তার চিন্তনের মধ্য দিয়ে মূল আখ্যানকে এগিয়ে নিয়ে যায়, যার মধ্য দিয়েই শিবতোষ এবং পাঠকও পৌঁছে যায়—মৃত্যু বিষয়ক এক দর্শনে।

গল্পের শুরু অসম্ভব শক্তিশালী এক চিত্রকল্প দিয়ে। ‘অগোচরে সন্ধ্যা নামলো। ধূসর অন্ধকার অবশিষ্ট আলোর রেখাগুলি মুছে দিলে শূণ্যের কোথাও আর স্বচ্ছতা থাকলো না।’

তাহলে শূণ্যতাও অস্বচ্ছ। কখন? যখন অবশিষ্ট আলোর রেখ—আলো, যা সবকিছুকে স্পষ্ট করে; তাকে মুছে দেয়; অন্ধকার! আর শিবতোষ—সে চিন্তাশীল এবং আত্মমগ্ন মানুষ, উদাস চোখে দেখে ফাঁকা আকাশ কীভাবে আঁধারে তলিয়ে যায়। বস্তুত এ গল্প প্রথমবার পড়লে এসব জায়গা দৃষ্টি এড়িয়ে যেতেও পারে। কিন্তু দ্বিতীয়বার পড়লেই এসব চিত্রকল্পে থামতে হবে মননশীল পাঠককে। কেননা, এই প্রেক্ষাপটেই শিবতোষের মনে পড়ে—‘ গতকাল রাত্রে ভুবন মারা গেছে’। সাধারণ জ্বর, তবু মারা গেছে…অফিসের সহকর্মী। মাত্র বত্রিশ বছর বয়স। অনিশ্চিত। চূড়ান্ত অনিশ্চিত— সে কখন এসে পড়ে। এরপরই শুরু হয় মূল আখ্যান।

শিবতোষ সবসময়ই অন্যমনস্ক। এটা অবশ্য তার পুরানো অভ্যাস। তার এই অন্যমনস্কতার জন্য ওষুধ আনতে দেরী হওয়ায় বাবার মৃত্যু হয় এবং প্রথম প্রেম হারিয়ে যায়। এই অন্যমনস্কতার জন্যই —‘মৃত্যু এবং প্রেম দুটি জিনিসের কোনটিকেই সে আয়ত্তে আনতে পারে নি।’ কিন্তু ভুবনের মৃত্যু সেই অন্যমনস্কতা যেমন বাড়িয়ে দেয়, তেমনি বেড়ে যায় তার আত্মমগ্নতা। ভুবনের স্ত্রী গৌরীকে একটা চিঠি লেখার কথা ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়ে আর একতা চিঠির কথা— সে চিঠি এসেছিল তার কাছে বলে মনে হয় কিন্তু সে খুঁজে পাচ্ছে না। কার চিঠি, কিসের চিঠি খুব মনে পড়ে না, কিন্তু এসেছিল বলে তার মনে হয়। এইখানে লেখকের মন্তব্য—

“ কখনও কখনও এরকম হয়, খুব চেনা পরিচিত শব্দের প্রথম অক্ষরটি দেখেই পুরো শব্দটি মনে মনে ধরে নেওয়ার মতন আমরা অপরিচিত শব্দটিকে ভুল করে পরিচিত শব্দ বলেই ধরে নিই, পরে কেউ প্রশ্ন করলে হঠাৎ কেন যেন মনে পড়ে যায়, শব্দটি কি সত্যি তেমন ছিল? মনযোগ দিয়ে না দেখার ফলে যে সন্দেহ, সেই সন্দেহ পরে দেখা দিয়ে আমাদের কেবল বিব্রত করে।” [অপেক্ষা, ঐ, ২৯২ পৃ]।

 এখানেই লেখক মগ্নচৈতন্যের ইঙ্গিত দিয়ে দেন। তারপর শিবতোষের স্ত্রীর সঙ্গে কথপোকথনে জানা যায় যে, তার… ছাড়া অন্য কারো কোন চিঠি আসে নি। অথচ শিবতোষের বিশ্বাস চিঠি এসেছে। প্রেরক তার সঙ্গে দেখাও করতে চায় কোন একদিন। সেটাও তার মনে পড়ে, কিন্তু তারিখের সঙ্গে বারের গন্ডগোল। তারিখের সঙ্গে বার মেলে না। অর্থাৎ অনিশ্চয়তা। শিবতোষ তারিখ এবং বার ধরে দু’দিনই অপেক্ষা করে প্রেরক আসবে আসবে এই উৎকণ্ঠা নিয়ে। কিন্তু আসে না। পাঠকের মনে পড়ে যাবে রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ নাটকের কথা। তারপর চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা আর সংশয়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে গল্প।

ভুবনের শ্রাদ্ধকর্মে গিয়ে শিবতোষের বিষন্নতার শেষ নেই। সবকিছু অর্থহীন, অকারণ বলে মনে হয় তার। ফেরার সময় তার মনটা রিক্ত প্রান্তরের শূণ্যতা মনে হয় যেন। বাড়ি ফিরে এক বিষন্নতা গ্রাস করে। তারপর সন্ধ্যাবেলা ঝড়-কালবৈশাখী, বৃষ্টি— সবই ভীষণ প্রতীকী। অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে নানান চিন্তায় মগ্ন শিবতোষ। একটা গান মনে আসে তার—‘ আঁখি তৃষিত অতি আঁখিরঞ্জনে, আঁখি ভরিয়া মোরে দাও হে দেখা।’— এ যেন অবচেতনের এক তীব্র আকাঙ্খা—মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যুর রূপকে একবার দেখে নেওয়ার। হঠাৎ তার মনে হয় নীচে কড়া নাড়ার শব্দ— এসেছে সেই চিঠির প্রেরক! কিন্তু গিয়ে দেখে কেউ না। হতাশ। রাতে বিছানায় শুয়ে এক স্বপ্ন দেখে শিবতোষ— শিলাবৃষ্টিতে সে ভিজেছে, আহতও হয়েছে। কিন্তু সামনেই এক মনোরম মন্দির থাকা সত্তেও যেতে পারেনি সেখানে। এই স্বপ্নই তো দেখার কথা। মৃত্যুর চিন্তায় ক্লান্ত, অবসন্ন—এও তো আহত হওয়াই! কিন্তু মৃত্যুর ওপারে যদি এক সুন্দর জীবন থাকে আমাদের কল্পনায়, পবিত্র জীবন; সেখানে তো পৌঁছানো হল না! এইসব চিন্তায় শিবতোষ এক জলরাশির নিচে যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে, তার ওপর দিয়ে বইছে নিজস্বতার স্রোত। অস্তিবাদী দার্শনিকদের মতে, অস্তিত্বকে অনুভব করা যায় চূড়ান্ত শূণ্যতা, নিঃসঙ্গতার মধ্যে। অনুভব মানে টের পাওয়া যায়। তাঁরা আরো বলেন, জীবনের অর্থহীনতা, নিঃসঙ্গতা থেকেই সৃষ্টি হয় শূণ্যতার। শিবতোষের মনে আসে, ঠিক এই রকম মুহূর্তে, সে কে এবং কেনই বা এ সংসারে? তার উত্তরেরই শিবতোষের মনে হয় আপাতভাবে যে—আজন্ম সে আছে এই সংসারে— তার আত্মীয় স্বজন, ছেলে মেয়ে, অফিস—এসবের মধ্যে। অর্থাৎ আহার নিদ্রা মৈথুনের মধ্যে সীমাবদ্ধ যে জীবন তারমধ্যেই সে আছে। কিন্তু তাই কি অস্তিত্ব? পরক্ষণেই তার মনে হয়—

“না, সে এ সবের মধ্যে নেই। তার থাকাটা ছায়ার মতন; হ্যাঁ —এই থাকাটা ছায়ার অস্তিত্ব সদৃশ; মিথ্যা নয় অথচ মিথ্যাই, আমি, আমি, আমি। তুমি কে শিবতোষ? তুমি এই সংসারে একান্ত অন্যের ছায়া। তুমি অন্য বস্তুর গুণে একটি মিথ্যা আকার পেয়েছো, যেমন কিনা আলো এবং বস্তু বিনা ছায়া হয় না…।” [অপেক্ষা, ঐ, পৃ-৩০৭]

আসলে আমি কে?—এই প্রশ্নের উত্তর সরলভাবে ভাবলে যা দাঁড়ায়, তা সত্যিই কিছু সম্পর্ক নির্ভর স্থানাঙ্ক জ্যামিতির মত। অমুকের ছেলে/ মেয়ে, অমুকের ভাই/ বোন, অমুকের স্বামী/স্ত্রী, অমুকের বাবা/মা… এই তো! তাহলে ঐ ‘অমুক’ বস্তুতে সম্পর্কের আলো পড়লেই তৈরি হয় ‘আমি’ এর ছায়া। ‘আমি’ মানে আসলেই তাই। মনে রাখতে হবে ১৯৬৩ সালে ওই গল্প প্রকাশিত হয় ‘দেশ’ পত্রিকায়। আর তখন দুনিয়া জুড়ে চলছে অস্তিবাদ আর এবসার্ডিস্টদের আলোড়ন।

যাই হোক, ‘আমি’র অস্তিত্ব তাহলে অন্য-সাপেক্ষ। কিন্তু ঘুরিয়ে ভাবলে প্রত্যেক ‘অন্য’রাও তো তাই! তাহলে বস্তুর থেকে ‘আলো’-র গুরুত্বই বেশি, অর্থাৎ সম্পর্কের। কিন্তু সম্পর্ক বা সম্পর্কের সূত্রে যে বন্ধন, তাই বা আসলে কি? তাও তো একান্তই অনুভব! আর অনুভব তো আসলে চিন্তা নির্ভর। তাহলে আসল গুরুত্ব এই চিন্তনেরই! চিন্তার জগৎ অস্তিত্বের মূলকেন্দ্র। তাই যখন শিবতোষ তার ছেলে মেয়ে চারপাশের কথা ভাবে, তখনই মনে হয় তার—‘ওরাই যদি তোমার সর্বস্ব তবে তোমার এই, এই উদাসভাব, অন্যমনস্কতা কেন? কেন তুমি এমনিভাবে মাঝরাতে জেগে ওঠো?”

অস্তিত্বের মূল মনন-চিন্তনেই; প্রতিদৈনিক জীবনযাত্রায় নয়। একথা বলেন অস্তিবাদীরাও। এই ভাবে শিবতোষকে লেখক ……… চূড়ান্ত পর্যায়ে এনে—যেন এক পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিয়ে গিয়ে আবার এনে ফেলেন সেই চিঠিতে। আবার শিবতোষের চোখের সামনে যেন খুলে যায় সেই চিঠি। সে যেন স্পষ্ট দেখতে পায় সেই ছত্রটা —‘আমি আসবো, আমার অপেক্ষা করো।’ শিবতোষের অস্তিত্ব তাহলে, তার মগ্নচৈতন্য জুড়ে যে মৃত্যুকেন্দ্রিক চিন্তা, মৃত্যুর অনিবার্যতা; সেখানেই!

একটি মৃত্যু তাহলে কীভাবে মননশীল মানুষের সামনে তুলে ধরে অস্তিত্বের প্রশ্নচিহ্ন, এবং কীভাবে উপনীত হয় লেখকের মৃত্যুদর্শন; তারই গল্প হয়ে ওঠে ‘অপেক্ষা’।

রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের পাঠক যখন বিমল করের মৃত্যু বিষয়ক বহু আলোচিত গল্প ‘সুধাময়’ পড়েন, তখন তাকে স্বীকার করতেই হবে যে, ‘সুধাময়’ গল্পের মৃত্যুর প্রসঙ্গ অনেক গভীর। ‘চতুরঙ্গ’এর কথা দিয়েই শুরু করলাম, কারণ, এ গল্পের নির্মাণ কৌশল যে অনেকটা ‘চতুরঙ্গ’এর ধাঁচে—এটি সচেতন পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে না। ‘চতুরঙ্গ’এর মতোই চমৎকার চারটি স্তর কল্পনা করা যায় এ গল্পেও। আবার শচীশের মতো সুধাময়েরও আত্মান্বেষণ প্রসঙ্গই মূল কথা। তবে ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাস আর শচীশের আত্মান্বেষণ কিছুটা বিক্ষিপ্ত; আর এক একটি মৃত্যু শচীশকে নিয়ে যায় এক স্তর থেকে অন্য স্তরে। সুধাময়ের আত্মান্বেষণ একমুখী। ছোটগল্প তো! কিন্তু মৃত্যুচিন্তা এখানে অনেক গভীর। ভালোবাসা এবং আনন্দ—এর যে অন্বেষণ, তার সঙ্গে মৃত্যু এবং অস্তিত্বের সংকট চিন্তা মিলে মিশে এ গল্প অনেক গভীর। এ গল্প লেখা সম্পর্কে লেখক নিজেই বলেছেন, ‘জীবজগতে যেটা অবধারিত সত্য সেই মৃত্যু আমার কাছে নিয়ত এক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল এবং জীবনের অস্তিত্ব স্নেহ প্রীতিপ্রেম সৌন্দর্য দেহ ইত্যাদি নিয়ে সংশয় দেখা দিল— এই সব সংশয় ও জিজ্ঞাসাই এই গল্পকে দেয় জটিলতা এবং অবশ্যই গভীরতাও।

গল্পটির চারটি স্তর কল্পনার কথা বলেছি, যেটি আগে পরিস্কার হয়ে নেওয়া যাক। প্রথম স্তর—সুধাময়ের জন্ম পড়াশোনা—কলকাতা, বেনারস থেকে মাকে লেখা চিঠি পর্যন্ত। দ্বিতীয় স্তর—বাবার মৃত্যু থেকে মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত। তৃতীয় স্তরে রয়েছে কলকাতা এবং রাজেশ্বরী পর্ব। আর চতুর্থ স্তরে         বিরাম-হৈমন্তী…। আর সুধাময়ের আত্মান্বেষণকে যে একমুখী বললাম তার সূচনাবিন্দুতে রয়েছে বাবার শিক্ষা— ‘যা ভালো তাকে ভালোবাসতে পারলে আনন্দ।’ তারপর এই ভালোবাসতে পারা আর না পারা, আনন্দের পূর্ণতা আর অপূর্ণতা—এর মাঝামাঝি ঠিক সরলরেখা ধরে চলেছে গল্প, চলেছে জীবনজিজ্ঞসা।

চরিত্রপ্রধান গল্প। তাই, লেখক প্রথমেই, যাকে আমরা প্রথম স্তর বলেছি সেখানেই সুধাময় চরিত্রের ভিতটি খুব শক্ত করে গড়ে তুলেছেন। সুধাময়ের কথা নিসর্গ-রোমান্টিক মানুষ। সুধাময়ের জন্ম কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে। সুধাময়ের নামটিও তার বাবার দেওয়া। জন্মের পর শুধাময়ের খুব কান্নার কারণ হিসেবে তার বাবা জানান—জ্যোৎস্না, প্রকৃতি, নদী, আকাশ—এসবের মধ্য থেকেই এসেছে বলে তার খুব লেগেছে। তাই-ই কাঁদছে। আর সুধাময়ের এই বাবা তার মধ্যে একটু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চারিত করে দেন— ‘ভালোকে ভালবাসতে পারলেই আনন্দ। এটাই হয়ে ওঠে সুধাময়ের জীবনজিজ্ঞাসার কেন্দ্রবিন্দু। অল্প বয়সেই ভোগে এক অশান্তিতে। ভিতরে ভিতরে কিছুটা উদাস বোহেমিয়ান করে তোলে, এই প্রথম স্তরেই। তাই মা-কে সে চিঠি লিখে জানায়—

“আমি নিজেকে জানবার চেষ্টা করছি, মা। আমার মনে শান্তি নেই। কী ভীষণ অতৃপ্তি যে! আমার সুখ কীসে, কেমন করে তা পাবো, কে জানে। বাবার কাছে শিখেছি, যা ভালো তাকে ভালোবাসতে পারলে আনন্দ। আমার মনে আনন্দ কই? কত ভালো জিনিষ দেখেছি, ভালোও লাগছে, কিন্তু কই তেমন আনন্দ তো হয় না। আমি পারছি না… ভালোবাসতে পারছি না…।” [সুধাময়, ঐ, পৃ-২২১]

স্পষ্ট বোঝা যায়, সূচনাতেই সুধাময়ের আত্মান্বেষণের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে মাটি ভেদ করে ওঠে।

দ্বিতীয় স্তরে মৃত্যু আসে গভীর তাৎপর্য নিয়ে। ভালোবাসা, ভালোবাসতে পারলেই যে আনন্দ—এগুলি তো জীবনের পজিটিভ দিক। আর মৃত্যু, যা অনিবার্য, আর অনিবার্য বলেই উদ্বেগ-সংশয়-উৎকন্ঠাময় করে জীবনকে— তা ঠিক উল্টো দিক, অর্থাৎ নেগেটিভ দিক। দ্বিতীয় স্তরে বাবার মৃত্যু। বাড়িতে আসে সুধাময়। কিন্তু এই বাবার মৃত্যু তাকে অসহায়, নিঃসঙ্গ, কিরকম অদ্ভুত শূণ্যতার মধ্যে ফেলে দেয়। শরীর ভেঙে যায় তার।  জ্বর জ্বর ভাব, অসহ্য পরিস্থিতি। আসলে সুধাময় মৃত্যুভয় ভোগ করে।—‘যেন মৃত্যু তাকে চিঠি পাঠিয়েছে, আসছি বলে।’ আমি ঠিক এর আগেই ‘অপেক্ষা’ গল্পের আলোচনায় সেই চিঠি এবং চিঠিকেন্দ্রিক উৎকণ্ঠা নিয়ে আলোচনা করেছি। সেই একই— মৃত্যুর অনিবার্যতা অসহায় করে তোলে সুধাময়কে। ভীষণ ভয় পায় সুধাময়। আতঙ্ক। অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। আর এই চূড়ান্ত অস্তিত্বের সংকট থেকেই ঘুরে দাঁড়ায় একেবারে একশো আশি ডিগ্রিতে। এমন হবারই তো কথা এমনই তো হয়। দেখবেন আপনি, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে, আর তো পিছোনো যায় না! এগোতেই হয়! সবার ক্ষেত্রেই এ সত্য মহাসত্য। তাই —

“সুধাময় বুঝতে পারল, নিজেকে দুর্গের মধ্যে রক্ষা করায় আনন্দ নেই, তাতে আত্মা বাঁচে না— চিতায় ওঠা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। … সুধাময় ভয়কে জয় করল। মৃত্যুকে উপেক্ষা।” [ঐ,ঐ, পৃ- ২২৫]

কিন্তু, নিজেকে দুর্গের মধ্যে রক্ষা করার আনন্দ নেই, এই বোধে উত্তরণ যখনই, মূল অন্বেষণের ইশারা যখনই পায় সে, তখনই ঘটে মায়ের মৃত্যু! এবার কী? প্রবাদ আছে— অল্প দুঃখে কাতর, অধিক শোকে পাথর। হ্যাঁ, পাথরের মতই শক্ত সুধাময়। লেখক চমৎকার একটি উপমা দিয়েছেন, বাংলা সাহিত্যে যার তুলনা সত্যিই বিরল—

“কখনো কখনো এরকম কোন বাড়ি চোখে পড়ে—ফাঁকা ধু ধু মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, নির্জন নিস্তব্ধ, গায়ে শ্যাওলা, সুপুরি আর নারকেল গাছের ঝাঁকড়া মাথা অন্ধকারে আড়াল দিয়ে। এমন সুন্দর স্তব্ধ বাড়ির নিজস্ব একটা সৌন্দর্য আছে। পুণ্যময়ীর মৃত্যুর পর সুধাময়ের অবস্থাটা ওই রকম দেখাচ্ছিল। ও একা—নিঃসঙ্গ, শান্ত অথচ যেন সমাহিত।” [ঐ, ঐ, পৃ-২২৫]

এরপর তৃতীয় স্তর, যেখানে লেখক অত্যন্ত সচেতন শিল্পী বলেই—‘চোখ নিয়ে ভীষণ ভুগতে হল সুধাময়কে।’ আর এই চোখের চিকিৎসায় কোলকাতা বাস, সেখানেই রাজেশ্বরী পর্ব। ঐ রাজেশ্বরী পর্বে চোখই তো আসল!

প্রায় অপার্থিব এক সৌন্দর্যে ভরপুর এই রাজেশ্বরী যার সৌন্দর্যের বর্নণাকে প্রত্যক্ষ করে তুলতে লেখক প্রায় এক দেড় পাতা ব্যয় করেছেন। আর এই সৌন্দর্যকে উপভোগ করার জন্যই তো চোখের অসুখ এবং তা সারিয়ে নেওয়ার হয়! এখনেও সেই আত্মান্বেষণ পুনরুজ্জীবিত। ভালোবাসা— ভালোবাসতে পারলেই আনন্দ— সেই আত্মজিজ্ঞাসা আবার। তার মনে হয়, রাজেশ্বরীর প্রতি মুগ্ধতা বা ভালোবাসা বলে যে প্রেম তা আসলে রাজেশ্বরীর আকর্ষণ করার ক্ষমতা! সেটা সুধাময়ের স্বতোৎসারিত নয় তো! ভালোবাসা তাহলে কী?—সুধাময়ের বন্ধু পরিমলের এই প্রশ্নের উত্তরে সে জানায়—‘যা আমার আনন্দ, যাতে আমি আনন্দিত, অন্তত যার আবির্ভাবে আত্মায় আনন্দ জেগে ওঠে—আমি তাকেই ভালোবাসা বলি।’

এই রাজেশ্বরী পর্বকে গভীর করে দেখলে মনে হয় এখানে ভালোবাসা আনন্দ আর মোহগ্রস্ততা—এই দুইয়ের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে আত্মবীক্ষণ চলেছে সুধাময়ের। রাজেশ্বরীর সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ট এবং প্রাক-মিলন মুহূর্তে নিজের ভিতরে ডুব দেয় সুধাময়— তার মনে হয় রাজেশ্বরীর প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়, ওর গায়ের ঘ্রান এক বন্য প্রবৃত্তি জাগিয়ে তোলে। কিন্তু পৃথক পৃথক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আসলে পূর্ণতা নয়। দ্বিতীয়ত রাজেশ্বরীর শারিরীক অংশগুলির অসম্ভব সৌন্দর্যে মুগ্ধ সুধাময়, যাকে তার মনে হয় মোহ। তাই লেখকবন্ধু পরিমলকে সে জানায় —

“তার অমন দেহ আমি উপভোগ করতে পারতাম। … ওকে ভোগ করার জন্য আমি পাগল হয়েছিলাম— তখন রাজেশ্বরী কেন হারিয়ে গেল, তার বদলে ওর শরীরের কতকগুলি অংশই কেন আমার চোখ মন বোধ আবেগকে আচ্ছন্ন করল। যতই বলো, দেহের কোন কোন অংশ একটা পরিপূর্ণ মানুষ নয়। আমি কি পরিপূর্ণ মানুষকে ভালোবাসতে চাইছি না পরিমল! তবে? সুধাময়ের অন্তর হাহাকার করে উঠেছিল।” [ঐ,ঐ, পৃ- ২৩১]

লক্ষ্যণীয়, ভালোবাসায় উত্তরণ সে চাইছে, যাতে তার আনন্দের উৎসার, তা হয় না বরং হাহাকার করে ওঠে তার হৃদয়। ‘রাজেশ্বরী পর্ব শেষ হল’। এখানেই। চতুর্থ এবং শেষ পর্ব বা স্তর শুরুর আগে দু’বছর কাটে ঘুরে বেড়িয়ে।

চতুর্থ বা শেষ স্তরে মিহিরপুর টি.বি. স্যানেটরিয়ামে মানুষকে ভালোবাসতে পারায়, তাদের সেবায় যেন বৃহত্তর ভালোবাসায় উত্তরণ এবং তাতেই আনন্দ বলে তার মনে হয়। পরিমলকে লেখা চিঠিতে তা স্পষ্ট—

“আমি এখানে আতুরজনের শারিরীক সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করছি না; আমি তাদের হতাশ ক্লান্ত অসুস্থ মনের সেবায় নিজেকে সমর্পন করেছি।মৃত্যুভয় ওদের মনের রক্ত শুষে নিয়েছে। … আমি ওদের বিশ্বাস যোগাব। আমি এতদিন নীড় ছেড়ে আকাশে ঝাঁপ দিতে পারলাম। আমি কি আজ সুখী নয়!” [ ঐ, ঐ, ২৩১]

সুধাময় তার দেশের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রীর টাকা দিয়ে দেয় এই স্যানেটরিয়ামে। তার মনে হয় যেন অঙ্ক মিলে গেছে এতদিনে।

কিন্তু আবার তার জীবনে আসে ফিমেল ওয়ার্ডের এক রোগী—হৈমন্তী যে মোটেই রাজেশ্বরীর মত সুন্দরী নয়, খুবই সাধারণ—‘ছোট দুটি চোখ যেন—ক্লান্ত বিষন্ন গভীর অথচ কীসের এক ছায়ায় স্নিগ্ধ।’ সুধাময় অনুভব করে যে এই ভালোবাসায় সে আনন্দিত, এটা শারিরীক মোহ নয়, হৈমন্তী অদৃশ্য অথচ অখণ্ড অস্তিত্ব নিয়ে অরণ্যের মতো তাকে অধিকার করে রয়েছে; — সে আনন্দ অনুভব করে। হৈমন্তীর প্রতি তার প্রেম চাঁদের আলোর মতো স্নিগ্ধ এবং বিশ্বময়। বন্ধু পরিমলকে জানায়—

“সত্তার পূর্ণতার পথে এগিয়ে যাচ্ছি আমি—আমার এই প্রেম সেই পূর্ণতাকে অনুভব করা—আনন্দ তাকে পথ চিনিয়ে দিচ্ছে। আমার সব দ্বন্দ্ব মিটেছে। আর কোন সংশয় নেই।” [ঐ,ঐ, পৃ২৩৫]

সংশয় নেই বলে তার মনে হচ্ছে, কিন্তু লক্ষ্যণীয় সে এখনও পূর্ণতার ‘পথে’। ভালোবাসা-আনন্দের পরিপূর্ণতায় পৌঁছতে পারে নি কিন্তু! তাই চার মাস পর হৈমন্তী জীবন মৃত্যুর সীমানায় গিয়ে পড়লে, হৈমন্তীর মৃত্যু চিন্তায় আবার সংশয়-আত্মজিজ্ঞাসা। রাজেশ্বরীর ক্ষেত্রে তার মনে হয়েছিল, সে ভালোবাসা, দেহ সৌন্দর্যে আবদ্ধ, কিন্তু সে খুঁজছিল দেহের বাইরে। হৈমন্তীর মধ্যে দেহের বাইরেই তাকে পেয়েছে! তাহলে হৈমন্তীর সেই দেহ শূণ্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় কেন উদ্‌বিগ্ন?  এত সব আনন্দ কেন আবার বিষন্নতার কৃষ্ণগহ্বরে? পরিমলকে শেষ চিঠিতে জানায়—

“আমার ভালোবাসা অন্ধকারের মতন, প্রদীপের কাছে যতক্ষণ আছে ততক্ষণ আলোকিত। একে ভালোবাসা বলি না। যে আনন্দ এত চঞ্চল, ভঙ্গুর—সে আনন্দ মিথ্যে।”

তারপর চলে যায় মিহিরপুর টি.বি. স্যানেটরিয়াম ছেড়ে। আর খোঁজ পাওয়া যায় নি।

ভালোবাসা এক আনন্দময় অনুভব। মৃত্যু তার বিপরীত। মৃত্যুর অনুভব কখনোই আনন্দ দিতে পারে না। আবার মৃত্যুর পর মৃত্যু চিন্তায় শঙ্কিত সুধাময় নানান দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুভয়কে জয় করে জীবনকে ভালোবেসেই। রাজেশ্বরী পর্বে মূলত প্রেম-ভালোবাসার-আনন্দের পরীক্ষা নিরীক্ষা চললেও অন্তরালে সুপ্ত ছিল যে আশঙ্কা—অন্য এক মৃত্যুর। কেননা, রাজেশ্বরীর প্রতি মুগ্ধতা—যাকে তার মোহ মনে হয় সে সম্পর্কে বন্ধু পরিমলকে জানিয়েছিল, ‘ভোগদখলের পর একদিন আমি ক্লান্ত হবনা, আমার আনন্দ উবে যাবে না!’ এও ত এক মৃত্যুচিন্তা—আনন্দের মৃত্যুচিন্তা! হৈমন্তী পর্বেও একই ভাবনায় শঙ্কিত। আসলে জীবন তো সবকিছু নিয়েই— ভালোবাসা—আনন্দ—মৃত্যু, সব। এই জীবনের মধ্য থেকে জীবনের অংশীদার হয়ে, শুধু আনন্দকে বিচ্ছিন্ন করে পাওয়া কি সম্ভব? তাই গল্পের শেষটি বড় চমৎকার। কাঠামোটি ‘চতুরঙ্গ’র মতো বলেছি, কিন্তু যে কথা বলা হয় নি—গল্পের কথন ভঙ্গিটি ‘তেলেনাপোতা আবিস্কার’-এর মতো কিছুটা। অবশ্য প্রথম কথক পরিমলই পাঠককে দাঁড় করায় দ্বিতীয় কথকের মতো। তাই শেষে পাঠকের প্রতি পরিমলের আবেদন— ‘যদি কোন দিন সুধাময়ের সঙ্গে দেখা হ, তাকে বলবেন, তার লেখকবন্ধু পরিমলের বড় ইচ্ছে সুধাময় যেন জানায় সে কি তার সমস্ত জীবনে সেই সুধাকে পেয়েছে যার জন্য ওর এত আকুলতা…?”

বিমল করের অধিকাংশ গল্পেই মৃত্যু, অসুখ কিংবা এই দুই একই সঙ্গে এসেছে বারবার। একবারে প্রথম দিকের গল্প— ‘অম্বিকানাথের মৃত্যু’(১৯৪৩) থেকেই। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে এই প্রসঙ্গ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এমন আরো আছে। ‘আঙুরলতা’, ‘যক্ষ’, ‘ইঁদুর’, ‘অশথ’, ‘নদীর জলে ধরাছোঁয়ার খেলা’… অনেক অনেক। সে আলোচনা পৃথকভাবে একটি গ্রন্থ হয়ে উঠতে পারে। আপাতত সে চিন্তা নেই। অতএব এ লেখার মৃত্যু এখানেই।

লেখক উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ


আপনার মতামত লিখুন :

4 responses to “মৃত্যুঃ বিমল করের গল্পে : উৎপল মণ্ডল”

  1. Deep Chanda says:

    অসাধারণএকটা লেখা, বিমল করের লেখায় মৃত্যু কত বৈচিত্র্যময় এবং কত ডাইমেনশনাল, এ লেখা না পড়লে জানা যেত না।

  2. Sumana Ghosh says:

    Khub e valo laglo sir lekhata,samrriddha holam….

  3. Nunam Mukhopadhyay says:

    মৃত্যু নিয়ে অসাধারণ একটি বিশ্লেষণ পাঠ করলাম। যে উত্তরণ চেতনার অভ্যন্তরে তিলে তিলে খোদাই করে চলে জীবনেরই অপর নাম মৃত্যুকে। সূর্যের অন্যপিঠের অন্ধকার ক্রমাগত এই মৃত্যুরই জড়তাকে গ্রাস করে মানুষকে পৌঁছে দেয় ভিন্ন কোনো লোকে। যে লোকে যাওয়ার জন্যই মানুষের জীবনের যাত্রা। সেই যাত্রাই বিমল করের রচনায় মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে উত্তীর্ণ ও পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এখানেই উপরিউক্ত বিশ্লেষণের সার্থকতা।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন